দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১২
অবন্তিকা তৃপ্তি
শেখ বাড়ির মানুষরা খাবার টেবিলে একজোট হয়ে বসেছেন। বিশাল বড় ডাইনিং টেবিলে মেহমানসহ মোট ১২ জন বসা। অনিরূপ গোসল করে নিচে নেমে সোজা হেঁটে গিয়ে আশার পাশের চেয়ারে বসে প্লেট টানল! আশা ভ্রূ কুঁচকে অনিরূপের দিকে চায়, অনিরূপ প্লেট উল্টিয়ে আশার রাগান্বিত চেহারার দিকে চেয়ে মৃদু হাসল! ব্যস, আশার কা/টা গায়ে নুনের ছিটা পড়ল ওই হাসির শব্দে! আশা মুখ ঝামটি দিয়ে মাথা নিচু করে প্লেটের দিকে চেয়ে রইলো! সার্ভেন্ট এগিয়ে এসে সবার প্লেট খাবার তুলে দিল। আশা খাবার প্লেটে নিয়ে খুঁটছে শুধু খাবার। অনিরূপ নিজের মতো করেই খেয়ে উঠে গেলো, তার একটা জরুরি কাজ আছে, বেরুতে হবে এখন!
আশা খাচ্ছে না দেখে ওয়াহিদা লক্ষ্য করলেন সেটা!
-‘আশা? আশা?’
বারবার ডাকাডাকি শুনে আশা চমকে ওয়াহিদার দিকে তাকাল। ওয়াহিদা প্লেটের দিকে ইশারা করে বললেব-‘খাচ্ছো না কেন? খাবার ঠান্ডা হচ্ছে।’
আশা হালকা হাসার চেষ্টা করে বললো-‘খাচ্ছি।’
ওয়াহিদা মৃদু হেসে বললেন-‘লজ্জা পেও না, যা লাগবে নিয়ে খাও।আজ সার্ভেন্ট খাবার বেড়ে দিচ্ছে, নেক্সট টাইম থেকে আমরাই খাবার বাড়বো, হু?’
আশা শোনে, তারপর হালকা করে মাথা দুলায়!
নাস্তাটা কোনরকমে শেষ করে আশা চেয়ার থেকে উঠে নিজের রুমে আসে। আশা মূলত আজ সকাল থেকেই ভীষণ চিন্তিত! চিন্তায় খাবারটাও ঠিকমত গিলতে পারেনি।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কাকে দিয়ে আনবে মেডিসিনগুলো? বাড়ির কারও সঙ্গেই তেমন সখ্যতা হয়ে উঠে নি। নতুন এলো, এসব মেডিসিনের কথা তো খোলাখোলি ভাবে কাউকে বলাও যায়না, নতুন বউ যে! বললে কে কী না মনে করে বসবে! কিন্তু আশার এক্ষুনি মেডিসিনগুলো চাই! আর যাই হোক, আশা কোনোভাবেই চাইবে না, একটা অসুস্থ সম্পর্কে কোনো বাচ্চা আসুক, এসে জানুক তার মা-বাবা ঠিক কতটা অসুখী আছে! আশা হাঁপ ছাড়ে, তারপর নিচে নেমে আসে। মেহমানরা সবাই সোফায় গল্প করছেন!
আশা এগিয়ে এসে ওয়াহিদার কাছে এলো,
‘আন্ট- মা?’
ওয়াহিদা তাকালেন, আশা অনেকটা দোনামনা করে বললো-
‘একটু বাইরে যাবো, দরকার ছিল।’
ওয়াহিদা ভ্রূ কুঁচকে ফেলেন, অবাক হয়ে বলেন-‘নতুন বউ তুমি, আজই বাইরে গেলে লোকে কী বলবে! কী লাগবে দারোয়ানকে বলে দাও, উনি নিয়ে আসবে।’
আশা আশাহত চোখে চেয়ে রইলো! ওয়াহিদা কেউ ডাকছে, তাই তিনি আশার মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি হেসে চলে গেলেন ওদিকে।
আশা হাঁপ ছেড়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
‘আশা?’ -অনিরূপের চাচাতো ভাইয়ের বউ এগিয়ে এসে ডাকল।
আশা তাকাল ওর দিকে, রিতু আশাকে চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলো-‘কী ব্যাপার? টেনশনে আছো মনে হচ্ছে খুব।’
আশা হালকা হাসার চেষ্টা করে বললো-‘না, তেমন কিছু না।’
রিতু হালকা হেসে আশার দিকে চায়! কথা বলার ফাঁকেই তার বিবাহিত সূক্ষ্ম নজর আশার ঘাড়ে যায়! রিতু আশার শাড়ির আঁচল ঘাড় থেকে সরিয়ে দিয়ে সূক্ষ নজরে আশাকে দেখে কৌতুক স্বরে বললো-‘লাল হয়ে গেছে একদম, মলম পাওনি?’
আশা লজ্জায় শেষ হয়ে গেলো একদম! কান দুটো গরম হয়ে গেলো! সঙ্গেসঙ্গে শাড়ির আঁচল ঠিক করে ঘাড় ঢেকে নিলো! এ বাড়ির লোকেরা কী লজ্জা শরমের বালাই খেয়ে মুছে সাফ করে দিয়েছে?আশাকে অপ্রস্তুত হতে দেখে রিতু হাসতে লাগল, আশা লজ্জায় চুপ করে আছে! তাই হাসি থামিয়ে রিতু বললো-‘আমাকে তোমার শাশুড়ি পাঠালেন, কী লাগবে বলো আমি আনিয়ে দিচ্ছি।’
আশা বলতে চাইলো না প্রথমে, পরে রিতুর জোড়াজোড়িতে বলে ফেলল। রিতু শুনে বললো-‘এটুকুতেই এত লজ্জা? আমার সময় অবশ্য তোমার ভাই এনে দিয়েছিল। অনিরূপও না, একদম ইউজলেস। ডাক্তার হয়েছে, আগে থেকে এগুলো আনিয়ে রাখবে না?’
আশা কী বলবে? লজ্জায় ইতি-অতি চেয়ে দেখে। রিতু হেসে বললো-
‘আমি আনিয়ে দিচ্ছি, তুমি রুমে যাও।’
অনিরূপ ঘরে ফিরেছে দুপুরে খাবারের সময়। রুমের দরজা লক নয়, এমনিই লাগিয়ে রাখা ছিল! আগে বউ ছিল না, যেভাবেইচ্ছে রুমে ঢুকেছে! সেই পুরনো অভ্যাস থেকে আজকেও তাই সাতপাঁচ না ভেবেই অনিরূপ রূমের দরজা খুকে ঢুকে পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে আশা চিৎকার করে উঠে শাড়ি বিছানা থেকে নিয়ে গা ঢাকল। অনিরূপ ভ্যাব্যাচ্যাকা খেয়ে আশার দিকে চেয়ে আছে। আশা কেঁদেই দিবে প্রায়, ও চেঁচিয়ে উঠল-‘রুম থেকে এক্ষুনি বেড়োন।’
অনিরুপ চোখ বড়বড় করে আশাকে দেখছে, রাগে আশার ঠোঁট কাঁপছে! অনিরূপ সেদিকে দেখে ঢোক গিলে। ভেবেছিল ভদ্র লোকের মতো বেরিয়ে যাবে রুম থেকে, কিন্তু নিজের বিয়ে করা বৌয়ের সামনে হুট করে আর ভদ্রতার মুখোশ পরতে ইচ্ছে করলো না।অনিরূপ বাঁকা হেসে দরজার সিটকিনি তুলে দিতেই আশার মুখটা ছোট হয়ে গেলো একদম!
আশা ভ্রূ কুঁচকে ফেলে, শাড়িটা নিজের সঙ্গে আরও ভালো করে প্যাঁচিয়ে বলে উঠল-‘এই মুহূতে আমাকে ছুঁলে আমি আপনাকে জাস্ট খু/ন করে ফেলব!’
অনিরূপ কাঁধ ঝাঁকাল, ভাব নিয়ে বললো-‘ছুঁবে? কে ছুঁবে তোমাকে? আমি? সরি, আমার মুড নেই। আ’ম ফিলিং ড্যাম স্লিপি!’
কথাটা বলে অনিরূপ বিছানায় জুতো নিয়েই শুয়ে পড়ল! আশা চূড়ান্ত রেগে অনিরূপের দিকে চেয়ে থাকল! রাগে আশার দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে একপ্রকার!ওই লোকটা ঘুমের ড্রামা করছে, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে! সবসময় আশাকে জ্বালানোর ধান্দা! অনিরূপ চোখ বুজে ঘুমানোর অভিনয় করছে! আশা কী করবে আর? অগ্যতা শাড়ি নিয়ে বাথরুমেই ছুটল।
শাড়ি গায়ে বেরিয়ে এসে দেখে অনিরূপ বিছানায় হেলান দিয়ে ফোনে কথা বলছে। আশা অবাক! এইমাত্র না ঘুমে ম/রে যাচ্ছিল, এক্ষুনি ঘুম নেই? ড্রামাবাজ কোথাকার! আশা বেরিয়ে আসতেই অনিরুপ হাত দিয়ে ইশারা করল ওর পাশে বসতে। আশা মুখ বাঁকালো, অবাধ্য হয়ে বারান্দায় চলে গেলো! অনিরূপ ফোনে কথা বলার মধ্যেই ভ্রু কুঁচকালো, মেয়েটা এতটা নাছোড়বান্দা কেন?
অনিরূপ ফোন কেটে আশাকে এবার জোরেজোরে ডাকতে লাগল-
‘আশা? আশা? রুমে আসো।’
আশা শোনে; তারপর রুমে এসে অনিরূপের দিকে চেয়ে বলে-
‘বয়রা নাই আমি, শুনতে পাই।এভাবে ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছেন কেন?’
ভীষণ অপমানিত হয়ে অনিরূপ চুপ হয়ে যায়! কিছুক্ষণ আশাকে ভ্রু কুঁচকে দেখে তারপরই চোখ সরিয়ে ফেলে! আশার দিকে আর একবারও তাকায় না, সোজা রুম থেকেই ওয়াহিদার ফোনে কল করে বসে-
‘মা?’
—
‘রুম থেকেই বলছি। আমি আশাদের বাড়ি যাচ্ছি না আজ।’
__
‘নিয়ম সব চুলোয় যাক, আমি যাব না বলেছি মানে যাবোই না। যা মন চায় করো।’
—-
‘তো? আমার কিসের দায়? ও গেলে যাক!’
——
‘নো ওয়ে!’
ওয়াহিদা ওপাশ থেকে কথা বলছিলেন, অনিরূপ তার মাঝেই কল কেটে দিল! আশা হা করে ওদের কথা শুনছিল! অনিরূপ কল কেটে বিছানা থেকে নামল! তারপর কোনোপ্রকার কথা-বার্তা না বলে জুতো পায়েই রুম থেকে বেরিয়ে নিচে চলে গেলো!
আশা ওর যাওয়ার দিকে চেয়ে মুখ ভেঙায়! যেন আশার খুব ঠেকা তাকে সাথে নিয়ে যাওয়ার! সে না গেলে আশা আরও বাঁচে!
আশাও নিচে নামে! নিচে মা-ছেলের মধ্যে কী কথা হচ্ছে শুনতে হবে!
অনিরুপ ওয়াহিদার সঙ্গে কথা বলছে, ওয়াহিদা অনিরুপের কাঁধে হাত রেখে মানানোর চেষ্টা করছেন। এটুকু দেখে আশা ওয়াহিদার কাছে এসে দাঁড়ায়! আশাকে দেখেই অনিরুপ আশার দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে অন্যদিকে চলে যায়। ওয়াহিদা আশার দিকে চেয়ে আশাহত গলায় বললেন-‘ বিয়ের পরেরদিনই ঝগড়া করলে কেমনে হবে আশা? ছেলেটা বাহির থেকে এসেই এসব ঝামেলা দেখলে বাড়িমুখী হবে আর? শোনো, এভাবে করলে স্বামী হাতে রাখা যায়না, আশা! অনি রুমে গেছে, আমি খাবার প্লেটে দিচ্ছি; দুজন মিলে এক প্লেটে খাবে আজ। মান-অভিমান মিটিয়ে সুখে থাকো, আমার চাওয়া এটুকুই।’
আশা চুপ করে শোনে কথাগুলো! ওয়াহিদাকে কী করে বলবে ও, উনার ছেলে হাতে রাখার কোন ইচ্ছা আশার নেই। হাত ফঁসকে বেরিয়ে গেলেও আশার বিশেষ কিছু যায়-আসবে না।
আশার হাতে ওয়াহিদা খাবারের প্লেট ধরিয়ে দিয়ে উপরে জোর করে পাঠিয়ে দিলেন! আশা রুমে খাবার নিয়ে ঢুকে দেখে অনিরূপের হাতে কতগুলো মেডিসিন! যেগুলো আজ আশা আনিয়েছিল! আশা স্বাভাবিক চোখেই অনিরূপের দিকে চেয়ে আছে!
দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১১
অনিরূপ তার শক্ত হাতে মেডিসিনগুলো নাড়তে নাড়তে আশার দিকে চায়! অনিরূপের চোখের ভাষা বদলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে! ও চোখে আগে আশা প্রশ্রয় দেখতে পেলেও, এখন কেমন যেন অন্যরকম লাগছে অনিরূপকে! একটাসময় অনিরুপ ভয়ানক শান্ত স্বরে প্রশ্ন করে বসে-
‘বার্থ কন্ট্রোল ট্যাবলেট?তুমি আনিয়েছো?’