দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১৭
অবন্তিকা তৃপ্তি
সেদিন রাতটা আশা ঘুমায় না। কেন যেন-সবমিলিয়ে অপরাধবোধ, লজ্জা, অপমান সব আশার মাথায় ঘূর্ণিপাক খেতে থাকে। অনিরূপ যাই করুক-সে আশার স্বামী। ওর উপর আশার হাত তোলা অন্যায়। সেটা হোক নিজেকে বাঁচানোর জন্যে, কিন্তু অন্যায় তো অন্যায়ই। আশা চায়-অনিরূপ আসুক, ফিরিয়ে নিয়ে যাক আশাকে। আশার সঙ্গে একবার বসুক, জানতে চাক আশার মনোভাব। আশা তো চায় সংসারটা করতে।
বিয়ে তো হয়েছেই-আশা নিজের ইচ্ছেতে বিয়েটা করেছে। সত্যি বলতে এখন আশার মনে হচ্ছে- হয়তো কোথাও না কোথাও আশা অনিরূপের ফায়দা তুলেছে, নিজের বাবাকে বাঁচাতে অনিরূপের টাকার ফায়দা তুলতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু আবার মনে পড়ে-ফায়দা তোলা কেন হবে?এর বদলে অনিরূপ শর্ত দিয়েকে-সে যা চেয়েছে তাই তো পেল। বিয়ে করল আশা ওকে। তাহলে?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আশা ভাবতে পারছে না। একটা সাধারণ ঘরের মেয়ে আশা, ওকে সবার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো শেখানো হয়েছে। তাহলে কেন এখন অব্দি আশা অনিরূপের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না। পরপর আশা ভাবে- বিয়ের সম্পর্ক খাপ খাওয়ানোর নয়। বিয়ের সম্পর্ক ভালবাসার, বোঝাপড়ার!মন থেকে, আশা চায়-অনিরূপ শুধরে যাক। আশাকে বুঝুক, ওকে নিয়ে ভাবুক। ব্যাস-এটুকুই চায় আশা শুধুমাত্র! ভাবতে ভাবতে কখন যে আশার চোখ লেগে আসে, বলতে পারেনা।
সকালে আবছা আলোতে কারো গরম নিশ্বাস মুখের উপর পড়ে, আশা চোখ পিটপিট করে চায়। কেউ যেন আশাকে আস্টেপিষ্টে জড়িয়ে রেখেছে, নড়াচড়া করতে পারছে না ও। আশা চোখ খুলে ধীরেধীরে- ও মা! অনিরূপ? আশার পাশে? এত সকালে? আশা চমকে উঠে বসে শাড়ির আঁচল ঠিক করে। আশার নড়াচড়ায় ততক্ষণে অনিরূপেরও ঘুম ভেঙে যায়। সে চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে আরমোড়া ভেঙে বলে-
‘সস-কাল হ-হ গেছে?’
অনিরূপ অস্পষ্ট ভাষায় কথা বলছে, আশা ভ্রু কুঁচকে তাকায়! বুঝতে পারছে না অনিরূপ কী বলছে? ও ভ্রূ কুঁচকে আবারও জিজ্ঞেস করে-
‘কী বলছেন?’
অনিরূপ চোখ থেকে হাত সরায়, গলা খাকারি দিয়ে পরিষ্কার করে স্পষ্ট করে বলে-
‘সকাল কয়টা বাজে?’
আশা ঘড়ি দেখে বললো-‘দশটা বিশ।’
আশা এখনও অনিরূপকে অবাক চোখে দেখছে, অনিরূপ এত দ্রুতই আশাকে নিতে এসেছে? শুধরে যাবে অনিরুপ শেষ অব্দি? অনিরূপ বিছানায় বসে এখনও ঝিমুচ্ছে। আশা কিছুক্ষণ অনিরূপকে ঝিমুতে দেখে একসময় প্রশ্ন করল-
‘আপনি কখন এসেছেন?’
‘ফজর পর।’-ঝিমুতে ঝিমুতে উত্তর দিলো অনিরূপ।
‘এত সকালে?’ —আশা হতভম্ব!
অনিরূপ এবার ঘুমঘুম চোখে আশার দিকে চেয়ে হালকা স্বরে বললো-
‘বউরা রাগ করে বাপের বাড়ি এলে, বরদের এত সকালেই শ্বশুরবাড়ী আসা লাগে।’
আশা অনিরূপের দিকে চেয়ে আছে, অবস্থা বেহাল বেচারার। যে মানুষ ঘুম থেকে উঠেই ১০টায়, সে নাকি ফজরের আগে ড্রাইভ করে পৌঁছেছে আশাদের বাড়ি, ভাবা যায়?
আশা আহাম্মক হয়ে চেয়ে আছে, এলোমেলো চুলে অনিরূপ এখনও ঝিমুচ্ছে বসে বসে। আশা কিছু বলবে, তার আগেই দরজায় টোকা পরলো।
‘আশা, নাস্তা রেডি। অনিরূপকে নিয়ে আয়।’
নিধির গলা। আশা শুনে আবার দরজার দিকে চেয়ে দেখে। নিধির গলা পেয়ে অনিরূপ ঝিমুনো ছেড়ে বিছানা থেকে উঠে, স্যান্ডেল পরতে পরতে বললো-
‘বাথরুমটা কোথায় একটু দেখিয়ে দিবে?’
আশা উঠে দাঁড়ায়, অনিরূপকে দেখিয়ে দিল বাথরুম। অনিরূপ ফ্রেশ হয়ে আসলো। নিধি গামছা দিয়ে গেছে একটা, অনিরুপ মুখ মুছে আশার দিকে চায়। আশা এখনও অবাক চোখে অনিরুপের দিকে চেয়ে রয়েছে। ওর কার্যকলাপ সূক্ষ্ম চোখে দেখছে যেন।মূলত বিশ্বাস করতে পারছে না, অনিরূপ ওকে নিতে এসেছে। অনিরুপ গামছা রাখল। আশার পাশে বিছানায় বসে আশার দিকে চাইল।
অনিরূপ পাশে বসতেই আশার বুকটা কাপছে, অনিরুপ আশার দুহাত চেপে ধরল নিজের দুহাতে। আশা ছাড়িয়ে নিতে চাইলেও, করল না। নিজে থেকেই শুনতে চাইল, অনিরূপ কী বলতে চায়।
অনিরূপ আশার দিকে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর ঢোক গিলে মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ উশখুস করে চুপ থাকল, তারপর আবার আশার দিকে মুখ তুলে তাকাল। আশা এক বুক আশা নিয়ে চেয়ে রয়েছে অনিরূপের দিকে। অনিরূপ একসময় বলে বসল-
‘আশা, আমি শুধরে যাবো। তুমি যেভাবে চাও সেভাবে নিজেকে গড়ে তুলব। তুমি ফিরে চলো, প্লিজ!’
আশা চোখ বড়বড় করে তাকাল, অনিরূপ আবারও আশার হাতে হালকা চাপ দিয়ে বললো-
‘আমার জোর করে স্পর্শ তুমি পছন্দ করো না, ওকে ফাইন। আই ওন্ট টাচ ইয়ূ! যতক্ষণ না তুমি চাইছো, আমি তোমাকে স্পর্শও অব্দি করবো না।’
আশা শুনতে থাকে, অনিরূপ আবারো বলে-
‘চলো না আমরা আবারও আমাদের সুন্দর সংসারটা সাজাই, এবার একসঙ্গে, একতরফা না।’
আশা এখনও চুপ, বলতে দিলো অনিরুপকে সব কথা! ভারী, গম্ভীর স্বভাবের অনিরূপ আজ এত সাফাই গাইছে, মাথা নত করছে আশার সামনে, আর কেউ না জানুক আশা জানে পুরো বিষয়টা অনিরূপের স্বভাববিরুদ্ধ। তবুও অনিরূপ করছে, কেন করছে? শুধুমাত্র আশাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্যে। আশা মনটা কেমন করছে!
অনিরূপ আবারো বললো-
‘আমি তোমার সঙ্গে কিছু খারাপ করে থাকলে মাফ চাইছি। এমনটা আর হবে না, প্রমিজ!’
ক্ষমা চাইল সে? আশা চূড়ান্ত হতভম্ব হলো এবার।রাতারাতি আশা অনিরূপকে বদলে ফেলেছে? এতটাই বদলে গেলো সে?
আশা কথা বললো না, অনিরূপ আশাকে চুপ দেখে হাতে হালকা চাপ দিয়ে ব্যস্ত গলায় বললো-
‘চুপ থেকো না, কিছু তো বলো আশা।’
আশার চোখ ছলছল করছে, পুরো ব্যাপারটা ওর কাছে অদ্ভুত লাগলেও, ভীষণ মন কেড়েছে। অনিরূপ যাই হোক, নিজের ইগো ছেড়ে আশার কাছে ক্ষমা চাচ্ছে, সুযোগ চাইছে একটা।এর বেশি আর কিবা দরকার আশার?
আশা নিজেকে আর আটকে রাখতে পারেনি এবার। ম্লান গলায় অনিরূপের গালের দিকে চেয়ে বললো-
‘আমিও মাফ চাইছি-আমার এভাবে আপনার গায়ে হাত তোলা উচিত হয়নি।’
আবারও সেই থাপ্পড়ের কথা। অনিরূপের মনে পড়ে রাগ হলেও, সে চেপে যায়। আশা নিজে এবার সাফাই গাইল,সারারাত যে অপরাধবোধটা তাকে ঘুমাতে দেয়নি, সেটুকু উজাড় করল অনিরূপের সামনে। ব্যস্ত গলায় বললো-
‘আমি এমনটা করতে চায়নি বিশ্বাস করুন। আমি কিভাবে এটা-আমি জানিনা! আমি সত্যি মন থেকে দুঃখিত।’
অনিরূপ হালকা হাসলো। আশার হাতটা আলতো করে ছুঁয়ে বললো-
‘আগের কথা আমরা এখন ভুলে যাই? নতুন করে আবার সব শুরু করি!Lets build a new life together, আশা।’
অনিরূপ কথাটা বলে হালকা হাসল! আশাও তার বদলে মৃদু হাসল! দুজনের মন থেকেই একটা বড় পাথর সরে গেলো!এরমধ্যে নিধি আরও একবার এসে ডেকে গেলো তাদের। অনিরূপ আশার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে হাত ছাড়ল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল-
‘চলো, ক্ষুধা লেগেছে প্রচুর।’
আশা অনিরূপের পিছু পিছু এলো। আশার বাবা নাস্তার টেবিলে অনিরূপকে দেখে গদগদ হয়ে বললেন-
‘বসো জামাই। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।’
অনিরূপ বসলো, তারপর তার পাশের চেয়ার টেনে দিল আশার জন্যে। আশা কিছুটা অবাক হলেও, চুপচাপ বসলো। অনিরূপ আশার বাবার সঙ্গে আজ হঠাৎ করেই মন খুলে কথা বলছে। অনিরূপ মাঝখানে প্রস্তাব তুলল-
‘বাবা, আপনাদের গ্রামে হাসপাতাল তো নেই। কেউ এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়নি?’
আব্দুর রহম্যান প্রতথমবারের মতো মেয়ে জামাইর মুখে বাবা ডাক শুনে অবাক হলেন ভীষণ, আশার দিকে চাইলে দেখা গেলো আশাও বেশ অবাক হয়েছে। আব্দুর রহমান নিজের খুশিটুকু আড়াল করে বললেন-
‘চেয়ারম্যানকে বলেছিলাম আমরা। ওরা কোন কিছু করলও না।’
অনিরূপ বললো-‘আচ্ছা আমি ব্যাপারটা দেখছি। আশা, আরেকটা রুটি দাও।’
আশা যন্ত্রমানবীর ন্যায় রুটি তুলে দিল অনিরূপের প্লেটে। নাস্তা শেষ করে অনিরূপ রুমে যাওয়ার সময় সবার অলক্ষ্যে আশার শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে বলে গেলো-
‘এক কাপ চা পেতে পারি?’
কী আদুরে কণ্ঠে আবদার। সমস্ত সন্দেহ একপাশে ঠেলে, আশা ভেজা আঁচলখানা চেপে বললো-‘বানিয়ে আনছি।’
অনিরূপ চলে গেলো। আশা চা বানাচ্ছে। বড্ড অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে ওকে। অনিরূপ সত্যি এতটা বদলে গেল? রাতারাতি এতটাই? অনিরূপের এত কোমল ব্যবহার আশাকে ভাবাচ্ছে। পরপরই আশা ভাবছে-মানুষ তো, ভুল করতেই পারে। হয়তো এখন ভুল বুঝতে পারছে নিজের।তবুও আশা হালকা ভাবুক থেকেই গেলো। চা বানিয়ে অনিরূপের রুমে নিয়ে গেল।
আশা রুমে ঢুকে দেখে, অনিরূপ আশার বই-খাতা নড়াচড়া করছে। আশা চায়ের কাপ নিয়ে এগিয়ে গেল-
‘আপনার চা।’
অনিরূপ পেছন ফিরে চা হাতে নিয়ে হালকা হেসে বললো-‘থ্যাঙ্ক ইউ।’
অনিরূপ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বিছানায় বসলো।আশা কিছুক্ষণ অনিরূপকে চোরাচোখে দেখল, অনিরূপ চাইলেই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে টেবিল গুছাতে শুরু করল।
অনিরুপ বুঝে সব! ও বক্র হাসলো। পরপর নিজেকে আবারো স্বাভাবিক করে বলল-
‘আশা, আমার কল আছে। আমাকে ফিরতে হবে আজ।’
আশা কাজ রেখে অনিরূপের দিকে তাকাল, অনিরূপ আবারো জিজ্ঞেস করল-
‘তোমার যদি মনে হয়, আমাকে একটা সুযোগ দেওয়া যায়, তাহলে আমার সঙ্গে তুমি ফিরতে পারো। যদি না হয়, চিল! আমি তোমাকে টাইম দিচ্ছি।’
আশা অন্যমনস্ক হয়ে আছে, একটু পর অনিরূপ আশার দিকে চায়। আশা ভাবছে কঠিন কিছু। অনিরুপ ভ্রু কুঁচকে আশাকে দেখে, আশা কী এখনও মনে সন্দেহ পুষছে? হবে হয়তো।অনিরূপ যেমন, তাকে এখনকার চরিত্রে একদমই মানাচ্ছে না। সেটা স্বয়ং অনিরূপও জানে।
অনিরূপ চায়ের কাপ টেবিলে রেখে আশার মুখোমুখি দাঁড়াল। আশার দিকে চেয়ে বললো-
‘আশা?’
আশা মাথা উঁচু করে অনিরূপের দিকে তাকাল,লম্বা যে খুব সে। অনিরূপ আশার দু গালে হাত রেখে আদুরে গলায় বললো-
‘ফিরে চলো আমার সঙ্গে- প্লিজ! কথা দিচ্ছি-আমি একজন বেটার হাসবেন্ড হয়ে দেখাব।প্রমিজ!’
আশা চায়, ভাসা ভাসা চোখগুলো টলমলে দীঘির ন্যায় শান্ত, স্বচ্ছ! আশা আর ভাববার অবকাশ পায়না, নিয়ে নিলো নিয়ের সিদ্ধান্ত। উৎসাহ নিয়ে বললো-
‘যাব আমি,আমার সংসারটাকে আবার আমি গোড়া থেকে গুছিয়ে তুলব।’
অনিরূপ এবার নম্র গলায় প্রশ্ন করে বসে-
‘আর আমাকে? আমাকে গুছাবে না?’
আশা চুপ হয়ে যায়, একটুপর হালকা স্বরে হেসে বললো-
‘শুরুটা আপনাকে দিয়েই করবো।’
আশার কথাতে অনিরূপও হেসে ফেলল। অনিরূপ আশাকে ছেড়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে বললো-
‘তাহলে চলো?’
আশা বললো-
‘আমি ব্যাগ গুছাচ্ছি।’
আশা লাগেজ গোছাতে শুরু করল। অনিরূপ বিছানায় বসে আশার ব্যাগ গুছানো দেখতে লাগল।নিজে যেচে একটা শাড়ি এলোমেলোভাবে ভাঁজও করে দিল। অবশ্য আশাকে সেটা আবার ভাঁজ করতে হয়েছে। অনিরূপ আরেকটা শাড়িতে হাত দিতে চাইলে আশা আগেই শাড়িটা কেড়ে নিয়ে বললো-
‘ভাঁজ করার কোন দরকার নেই, আমি করছি।’
অনিরূপ হতাশ চোখে আশার দিকে চেয়ে পরপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। লম্বা কয়েকটা শ্বাস টেনে কিছুক্ষণ ব্যস্ত আশাকে দেখলো। তারপরই ফুটে উঠল তার ঠোঁটে ক্রূর হাসি!
অনিরূপ একটা মিশনে নেমেছে,বউ জয় করার মিশন। মিশনের প্রথম ধাপ ‘সাক্সেসফুল’
এরপরের ধাপ ধীরে ধীরে পা রাখবে অনিরুপ। যে জিনিসটা জোর করে হাসিল হয়নি, সেটা বুদ্ধি দিয়ে হাসিল করবে ও।
দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১৬
নিজেই নিজের মনে হাসে অনিরূপ। মনেমনে একটা কথা আপনাআপনি বের হয়ে আসে-
‘বড্ড হ্যাপা গেলো, বাপরে! বউ, উফ! এক চিজ মাইরি!’
আশা শুনে না সে কথা। শুনলে হয়তো আশা ভাবত, তার স্বামী আদৌ কি শুধরে যাওয়ার মানুষ কখনো ছিল? নাকি সবটাই অভিনয়, মিথ্যা আশ্বাস! হায়, পোউর আশার জীবনেও বুদ্ধি হলো না।