দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ২

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ২
অবন্তিকা তৃপ্তি

অনিরূপ ভ্রু বাঁকিয়ে বললো-‘বিয়ে করবে। না করে যাবেটা কোথায়? তুমি করবে, তোমার ঘাড়ও করবে।নামটা কী যেন? আশা? নাহ, আশাবরি।’
আশার পেছনে পেছনে বারান্দা থেকে ফিরে এসে অনিরূপ পাঞ্জাবি ঠিক করে সোফায় বসলো। সামনেই আশা বসা। সুন্দর মুখ রক্তিম, অপমানে লাল। অনিরূপ আশার দিকে তাকালে, আশা মুখ ঝাঁমটা দিয়ে সরিয়ে ফেললো। এ লোকগুলোকে আশার বি ষাক্ত মনে হচ্ছে। যাবেটা কখন এরা? অনিরূপ তির্যক হেসে আশার দিকে তাকিয়ে আছে। আশা অনিরূপের এমন তাকানোতে চূড়ান্ত বিরক্ত হচ্ছে, বারবার-বারবার ভ্রু কুচকে নিচ্ছে। অনিরূপ যেন এতে ভীষণ মজা পাচ্ছে। আশা বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুঁচকানো-অনিরূপকে ভেতরে ভেতরে আত্মতৃপ্তি দিচ্ছে ভীষণ।

বিয়ের কিছু কথা বাড়িতেই সাড়া হলো। বাকি কথা যে যার ঘরে বড়দের সঙ্গে আলাপ করে জানাবেন-সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। ওয়াহিদা আরা সোফা থেকে পার্স হাতে উঠে দাঁড়ালেন। শাড়ির আঁচল মাটিতে ছুয়ে আছে তার, কথা বলার ধরন রাজকীয়। হালকা হেসে বললেন-‘আজ আসি, বেয়াই। বিয়ের কেনাকাটা-আত্মীয় স্বজনের লিস্টটা আজ থেকেই শুরু করতে হবে। আমি অনির বিয়েতে আর দেরি করতে চাইছি না।’
রহমান সাহেব মৃদু হেসে সায় দিলেন-‘ঠিক আছে। আমিও আমার দিকটা আজ থেকেই দেখে নিচ্ছি। ‘

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ওয়াহিদা রহমানের সঙ্গে কথা বলে সামনে এগুতে লাগলেন। আশা এখনও সোফায় এভাবেই বসে, মূর্তির মতো। মাঝেমধ্যে রাগান্বিত চোখে অনিরূপকে দেখছে, আবার চোখ সরিয়ে নিচ্ছে চোখাচোখি হওয়ার ভয়ে। এই মুহূর্তে শাড়িটা গা থেকে আশার ছিঁড়ে ফেলতে মন চাইছে। অনিরূপ অরূপের সাথে হাঁটতে হাঁটতে পেছনে আশার দিকে একবার তাকালো। অনিচ্ছায় দুজনের চোখে চোখ পড়লো। অনিরূপ ঠোঁট জিহ্বা দিয়ে লিক করে ভ্রু নাড়িয়ে হাসলো। আবারও দুষ্টু ইঙ্গিত-অভদ্রতা। আশা তেলেবেগুণে জ্বলে শাড়ির আঁচল মাথা থেকে ফেলে সোফা থেকে উঠে রেগে হনহনিয়েনিজের ঘরে চলে গেলো। অনিরূপ আশার যাওয়ার দিকে চেয়ে ভ্রু নাড়লো। একবার আশার ঘরের দরজার দিকে চেয়ে দেখে, অরুপের দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো-‘আশার ছবি লাগবে একটা, যা নিয়ে আয়।’
অরুপ আচমকা এমন কথা শুনে অবাক হয়ে অনিরুপের দিকে তাকালো। হা হয়ে বললো-‘ছবি তো আছে আমাদের কাছে, কনে দেখারটা।’

অনিরূপ বললো-‘ভালো ছবি চাই আমার, একা একটা ছবি, শাড়ি পরে।’
অরূপ অনিরুপের দিকে হা হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে হো হো করে হেসে উঠে বললো-‘মেয়ে দেখতে এসেই ফিদা ভাই? এখানে আসার পর থেকে অদ্ভুত আচরণ করছো।’
অনিরূপ গাড়ি অব্দি চলে এসেছে। গাড়ির দরজায় হেলান দিয়ে এক পা বটে দরজায় ঠেসে অরূপের দিকে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল।আদেশ লেগে আছে চোখেমুখে। অরুপ ভাইয়ের ইশারা বুঝল নিমিষেই। সঙ্গেসঙ্গে দৌড়ে ছুটল নিধির কাছে।

নিধি তখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। রহমান-ওয়াহিদা আরও কিছুটা উঠোনের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। অরূপ তাদের দিকে একবার তাকিয়ে নিধির দিকে ফিরল। নিধি ভদ্রতা নিয়ে বললো-‘কিছু বলবেন?’
অরূপ নিধির দিকে ঝুঁকে আশপাশ দেখে তারপর ফিসফিস করে বললো-‘ভাবির ছবি চাইছে ভাই। শাড়ি পড়া-একা একটা ছবি। দেওয়া যাবে?’

নিধি মাথা তুলে অনিরুপের দিকে তাকাল। অনিরূপ চোখে সানগ্লাস পরে গাড়িতে ড্রাইভিং সিটে ঢুকছে। নিধি হালকা হাসলো। আশাকে পাত্রের ভীষণ পছন্দ হয়েছে, কথাটা ভেবে ভেতর থেকে স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। হালকা হেসে নিধি বললো-‘আমি ভেতর থেকে নিয়ে আসছি।’
নিধি আশার ঘরে গিয়ে ড্রয়ার খুঁজে ভালো শাড়ি পরা ছবি বের করলো। আশা বিছানায় বসে নিধির এত খোঁজাখুঁজি দেখে জিজ্ঞেস করলো-‘কী করছো আপা? কী খুঁজো?’

নিধি ছবি হাতে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো-‘পাত্রকে তোর ছবি দিচ্ছি’
আশা থমকে গেলো এ কথা শুন। দৌঁড়ে নিধির পেছনে পেছন আসতে আসতে বললো-‘আপা, দাড়াও দিয়ো না ছবি; আপা।’

নিধি কানে শোনেনি আশার কথা,ততক্ষণে উঠোনের সামনে চলে এসেছে। আশা থমকে যাওয়া মুখে নিধির অরুপকে ছবি দেওয়া দেখলো। আশা হতাশ ভঙ্গিতে দরজায় মাথাটা ঠেসে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো নিধি-অরুপের দিকে।
ছবি পেয়ে অরূপ নিধির প্রতি কৃতজ্ঞতার চোখে তাকিয়ে বললো—‘থ্যাংক ইউ, আসি এবার-বাই।’
অরূপ গাড়ির দিকে ছুটছে। নিধি-রহমান পাত্রপক্ষকে গাড়িতে তুলে দিয়ে ঘরে আসলো। ঘরে ঢুকে দুজনেই দেখে-আশার মুখটা অন্ধকার, থমথমে। নিধি-রহমান দুজনেই একে অপরের দিকে তাকায়।

অনিরূপের সামনে কয়েকটা মেয়ের ছবি এনে তুলে ধরলো অরূপ। অনিরূপ মেয়েদের ছবিগুলো দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। ল্যাপটপের শ্যাটার নামিয়ে অরূপের দিকে চেয়ে বললো-‘মানে?’
অরূপ হতাশ শ্বাস ফেলে ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো-‘মানেটা হচ্ছে-তুমি, দ্য গ্রেট অনিরূপ শেখ জয় রিজেক্ট হয়েছে মেয়েপক্ষের থেকে। আজ মায়ের কাছে কল এসেছে, কনেকে নাকি তুমি কী বলেছো, সেজন্যে কনে বিয়ে করবে না বলে মানা করে দিয়েছে।’

অনিরূপ অরূপের দিকে চেয়ে থাকলো। মনেমনে আশার বাচ্চামো কান্ডের জন্যে একচোট হাসলো। মেয়েটা কী ভেবেছে? অনিরূপ থেকে পাড় পেয়ে যাবে? এত সহজে? সবকিছু এত আছান লাগে আশার কাছে? পোউর আশা!
অনিরূপ হালকা আওয়াজে বললো-‘সঙ্গে কী আর কিছু বলেছে?’
অরূপ ভ্রু কুচকে তাকাল। বললো-‘বলেছে তুমি হচ্ছো চূড়ান্ত অভদ্র। সে কোন অভদ্র ছেলেকে কখনোই বিয়ে করবে না।’

অনিরূপ ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালো। তারপর শব্দ করে হেসে ফেললো। এটাও বলেছে? আহা, কী বেচারা। অনিরূপ মাথা দুদিকে ঝাকিয়ে হতাশ গলায় বললো-‘আহারে, বড্ড বেচারি সাজলো তোর ভাবি।’
অনিরূপের কণ্ঠে উপহাশ। যেন সে এই সবকিছুতেই ভীষণ মজা পাচ্ছে। অরূপ ভাইয়ের দিকে চেয়ে আছে, সে অবশ্য এতটা অবাক হচ্ছে না। ভাই এমনি তার, সেটা সে জানে। সে কেন, পুরো শেখ বাড়ি জানে এটা। অনিরূপ অভদ্র, একরোখা, দুধে ধোয়া তুলসী পাতা নয়।

অরূপের হাতে এখনও কনেদের ছবিগুলো। অনিরূপ কিছুক্ষণ মেয়েদের ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে ল্যাপটপের স্যাটার আবারও তুলে নিলো। অরূপকে বললো-‘ছবিগুলোর দরকার নেই আর। তোর ভাই ওই অতি ভদ্র রমনিকেই বিয়ে করছে, এবং করবে।’
অরূপ বিস্মিত হলো। অনিরূপের ঠোঁটের হাসি কেমন যেন অন্যরকম দেখাচ্ছে। একদম আলাদা-ভিন্ন। অরূপ ভ্রূ বাকালো-‘কী পাকাচ্ছো তুমি তোমার মাথায় বলোতো ভাইয়া? উল্টাসিধা করতে চাইছ কিছু?’
অনিরূপ ল্যাপটপের দিকে চেয়ে ধিমে আওয়াজে বলে-‘আজ থেকে যা হবে, সব উলটাই তো হবে। সিধা থাকার দিন শেষ।’

শেখ বাড়িতে রীতিমত হইচই শুরু হয়ে গেছে। অনিরূপকে, শেখ বাড়ির ছেলেকে পাত্রী বিয়ে করবে না বলেছে, অভদ্র বলে গালি দিয়েছে কথাগুলো ওয়াহিদা রীতিমত মানতেই পারছেন না। ডাইনিং টেবিলে ওয়াহিদা এটা নিয়েই আলাপ করছেন অনিরূপের বাবা উমায়েদের সঙ্গে। উমায়েদ সব শুনে শান্ত স্বরে বললেন-‘খামোকা মেয়ের উপর রাগ করো না ওয়াহিদা। তোমার ছেলেকে তুমি চেনো, কখনোই ধোয়া তুলসী পাতা ছিলো না সে। হয়তো মেয়ের সঙ্গে কোন অভদ্রতা করেছে, মেয়ে রিজেক্ট করে দিয়েছে। বিয়ের আগে আসল রূপ দেখালে, মেয়ে তো রিজেক্ট করবেই। এটাই ন্যাচারাল।’

ওয়াহিদা উমায়েদের কথায় আরও ক্ষেপে গেলেন। কাঁটা গায়ে যেন তার নুনের ছিটা পরলো। ওয়াহিদা বললেন-‘তুমি শুধু আমার ছেলেদের দোষই দেখো সবসময় উমায়েদ।’
উমায়েদ বললেন-‘আমি ফ্যাক্ট দেখছি, কার সত্যি দোষ আছে সেটা দেখছি। তুমি এটা নিয়ে ভেজাল করো না। মেয়ে হাতে আরও আছে। আমি কবির সাবকে বলে আরও মেয়ের ছবি আনবো?’
ওয়াহিদা এতক্ষণ রাগারাগী করে হাপিয়ে গেছেন। লম্বা শ্বাস ফেলে বললেন-‘আনো এখন, কী আর করার।’
অনিরূপ তখন মাত্র খেতে বসেছে। অরূপ এদের কথা এতক্ষণ শুনে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে ছিল তাদের দিকে। সে এসবের মধ্যে নীরব শ্রোতা স্রেফ। অনিরূপ চেয়ারে বসতেই অরূপ জোরেজোরে বললো-‘ভাই মা মেয়ে দেখবে আরো। তোমার জন্যে মেয়ের বন্যা বইয়ে দিবে মা বলেছে।’

অনিরূপ ভ্রু কুঁচকে ওয়াহিদার দিকে তাকাল। অনিরূপের মন খারাপ ভীষণ-মনেমনে কথাটা ভেবে ওয়াহিদা অনিরূপকে সামলাতে বললেন-‘মন খারাপ করবি না অনি। আমার কাছে এর থেকেও সুন্দর মেয়ের ছবি আছে। আমি তোকে দেখাচ্ছি।’
অনিরূপ ভ্রু বাকালো,, বললো-‘কার জন্য?’
‘তোর জন্যে-‘ ওয়াহিদার উত্তর।

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১

অনিরুপ খেতে খেতে বেশ স্বাভাবিক গলায়ই বললো-‘আমি বিয়ে করলে ওই মেয়েকেই বিয়ে করছি মা। মেয়ে দেখো না আর।’
ওয়াহিদা বললেন-‘কিন্তু মেয়ে তো বিয়েতে মানা করলো।’
অনিরুপ হালকা হেসে মায়ের দিকে তাকাল। মৃদু হেসে বললো-‘কিন্তু আমি কী ওকে ছাড়ছি?’

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ৩