দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ২২

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ২২
অবন্তিকা তৃপ্তি

নিধির রিপোর্ট এসেছে! হাসপাতাল থেকে এসে, অনিরূপ আশাকে রুমে আসতে বলে- রিপোর্টটা নিয়ে সোজা উপরে চলে গেলো।অনিরূপকে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছিল। আশা অনিরূপের পিছু পিছু উপরে এলো। অনিরূপ রিপোর্টটা বিছানায় রাখল! আশা রুমে ঢুকে একবার রিপোর্টটার দিকে তাকাল, তারপর অনিরূপের দিকে চোখ ফেরাল। অনিরূপ এপ্রোন খুলে বিছানায় রেখেছে। আশা অনিরূপের বাসার টিশার্ট-ট্রাউজার এগিয়ে দিল। অনিরূপ ফ্রেশ হতে গেলো। আশা মুখিয়ে আছে, অনিরূপ ফ্রেশ হয়ে এলেই, শুনবে রিপোর্টে কী এসেছে। অনিরূপের আচার-আচরণ দেখে মোটেও মনে হচ্ছে না- রিপোর্ট ভালো! আশার বুকটা কাঁপছে, অশান্ত বোধ করছে ভীষণ!

অনিরূপ ফ্রেশ হয়ে এলো। আশার অস্থির জিজ্ঞাসু দৃষ্টির দিকে একবার চেয়েই সোজা গিয়ে দরজা লক করে ফিরে এলো। আশাকে জোর করে বিছানায় বসে নিজে আশার সামনে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে আশার কোলের উপর রাখা দুহাত আলতো করে ধরলো। আশা অবাক হয়ে দুজনের হাতের দিকে একবার তাকালো, তারপর আগ্রহী দৃষ্টিতে অনিরূপের দিকে তাকাল। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। অনিরূপ এত অস্থির কেন?
তাই আশা নিজেই জিজ্ঞেস করল-‘আপনি এমন করছেন কেন, বলুন তো?রিপোর্ট ভালো না?’’
অনিরূপ থামল, অসহায় চোখে আশার দিকে চেয়ে, হাতটা শক্ত কর ধরলো-‘আশা?’
‘বলুন।’ -আশা ভ্রু উঁচু করে আছে, অপেক্ষা করছে অনিরূপের বলার।
‘তুমি একজন স্ট্রং মেয়ে, রাইট?’- অনিরূপ ভারী গলায় বলল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আশা কিছু বললো না। শুধু চুপ করে তাকিয়ে থাকল! অনিরূপ আশার হাত ছেড়ে, ডান গালে একহাত রেখে ভরসাপূর্ণ গলায় বললো-‘নিধির রিপোর্ট এসেছে। আমি যা বলবো, এতে প্লিজ নিজেকে শক্ত রাখবে। আমরা সবাই শক্ত থাকলে নিধি এই অবস্থা থেকে ফিরে আশা সম্ভব, হু? এটাকে লেভেলিং না করে আমরা একসঙ্গে ফাইট করব? ওকে?’
আশা এবার এগুলো কথা শুনে আরও বেশি অস্থির হয়ে গেল। অনিরূপকে তাড়া দেখিয়ে বললো-‘আরে বলুন তো, আপার হয়েছে কী?’
অনিরূপ মাথা নিচু করে একটা ঢোক গিলে আবার আশার দিকে তাকাল। একপর্যায়ে গলা ছেড়ে হতাশ গলায় বলে ফেলল-‘শি হ্যাজ ক্যান্সার, ব্লাড ক্যান্সার!’
‘কী?’ – আশার চমকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল।

অনিরূপ সঙ্গেসঙ্গে আশাকে আগলে ধরে বললো-‘ওকে, ওকে! রিলাক্স! এটা কিউর করা পসিবল। এখনও টাইম আছে আশা। আমাদের চিকিৎসা শুরু করা উচিত, যত দ্রুত সম্ভব!’
আশার দু চোখে অবিশ্বাস! ও থমকে থেকে বললো-‘এটা কিভাবে সম্ভব? আপা এত বড় রোগ বাধাল কিভাবে? রিপোর্ট কী ভুল আসতে পারে না?’
অনিরূপ আশার দিকে চেয়ে বললো-‘আমি কয়েকবার চেক করেছি রিপোর্ট! রিপোর্টে ভুল নেই।’
আশা দু কদম পিছিয়ে থমকে অনিরূপের দিকে চেয়ে থাকল! আপনা আপনি আশার ডান চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়াল! সঙ্গেসঙ্গে দুহাতে নিজের চোখ মুছে বললো-‘বা-বাঁচার চান্স কত প-পারসেন্ট?’
অনিরূপ ধিমে গলায়, মিনমিন করে বললো-‘ফিফটি-ফিফটি।’

কথাটা বলে অনিরূপের নিজেরই কেমন বিস্বাদ লাগছে! আশার মনের অবস্থা অনিরূপ বুঝে, মেয়েটার পুরো দুনিয়া ওর বোন! কিভাবে নিবে ব্যাপারটা, আল্লাহ ভালো জানেন!
আশা নিজেকে শান্ত রাখার অনেক চেষ্টা চালাচ্ছে, শেষ পর্যন্ত আর আটকাতে পারল না। চোখের জল ছেড়েই দিল। থমকে গিয়ে বিছানায় ধপ করে বসে, অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকল আয়নার দিকে। অনিরূপ আশার পাশে বসে আশাকে দেখে! শক্ত-এই কঠোর মেয়ে মুহূর্তেই ভেঙে পড়েছে। আশা ভাঙা ভাঙা গলায় বিড়বিড় করে-‘আ-আপা! আপ-আপা! আপা চলে গেলে আমদের ক-কী হবে?কই যাব, কার কাছে যাব আমরা?
আশা নিজের মনেই নিজে বিড়বিড় করছে শুধু! অনিরুপ আশাকে পাগলের মতো করতে দেখে জোর করে নিজের দিকে ফেরাল। আশা তখনো একা একা বিড়বিড় করছে। অনিরূপ ওর মুখটা দুহাতে আগলে ধরলো, ‘আশা, আশা শাট অ্যাপ!’

আশা অনিরূপের ধমকে চুপ হয়ে গেল! টলমলে চোখে তাকাল অনিরূপের মুখের দিকে।
অনিরূপ আশার এলোমেলো চুল গোছাতে গোছাতে বলতে লাগলো- -‘দেখো আশা, ভেঙে পড়ো না প্লিজ! নিধির কিছু হবে না। আমরা বেস্ট ডক্টর দিয়ে ওর চিকিৎসা করাব। আমি আজকেই অ্যাপোইনমেন্ট নিচ্ছি ডক্টরের। তুমি প্লিজ নিজেকে নিধির সামনে শক্ত রেখো। ওকে এক্ষুনি অসুখের কথা জানানোর দরকার নেই।সময়মত জানানো যাবে। তুমি প্লিজ শক্ত রাখো নিজেকে।’
আশাকে অনেক কষ্টে অনিরূপ বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাখলো। আশা শুধু শুনে গেল অনিরূপের একেকটা ইন্সট্রাকশন! ও যেন আজ রীতিমত রবোট হয়ে গেছে একদম। নিজের মধ্যেই নেই আর। অনিরূপ যা বলছে, যন্ত্র মানবীর মতো শুধু শুনছেই। অনিরূপ নিজেও আশাকে যেভাবে পারে সামলানোর চেষ্টা করছে।

সন্ধ্যার দিকে অনিরূপ অরূপের ঘরে গিয়ে বিছানায় বসল। অরূপ তখন কম্পিউটারে কিছু একটা করছে। অনিরূপকে দেখে কিবোর্ডে টাইপিং করতে করতে জিজ্ঞেস করল-‘‘কিছু বলবে, ভাইয়া?’
অনিরূপ কোনো ভনিতা ছাড়াই বলে দিলো-‘নিধির রিপোর্ট দিয়েছে আজ।’
অরূপ এবার কিছুটা নরম হয়ে এলো। তার হাতের টাইপিং বন্ধ হয়ে গেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে অনিরূপের দিকে চেয়ে ছোট্ট করে বললো-‘কী এসেছে রিপোর্টে?’
‘ক্যান্সার, ব্লাড ক্যান্সার!’ -অনিরূপের ভারী গলার উত্তর!
অরূপ সঙ্গেসঙ্গে ভ্রু কুঁচকে ফেলল! বিশ্বাস হলো না যেমন! বললো-‘রিপোর্ট কোথায়?’
অনিরূপ হাত থেকে রিপোর্ট এগিয়ে দিল অরূপের দিকে, বললো-‘আমি কয়েকবার চেক করেছি। রিপোর্টে ভুল হবার চান্স নেই।’

অরূপ তবুও অনিরূপের কথা না শুনে নিজে পুরো রিপোর্ট চেক করল। রিপোর্টের শেষ অংশটা পড়ে ওর আচমকাই বুক কেঁপে উঠল। গলার স্বর এলোমেলো হয়ে গেলো একদম। এমনটা কেন হলো ও জানে না। জীবনে অনেক ক্যানসার রোগী দেখেছে ও। সবার বেলায়,সর্বোচ্চ খারাপ লাগা অনুভব করেছে শুধু। কিন্তু আজকেও মনে হচ্ছে বুকটা একদম খালি হয়ে গেছে। অদ্ভুত এক জ্বালা হচ্ছে বুকের ভেতর। অরূপ নিজেকে সামলালো! ডাক্তরদের এত আবেগ খাটে না। অরূপ ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো-‘ভাবী জানে?’
অনিরূপ উত্তর দিল-‘বলেছি। ভীষণ ভেঙে পড়েছে শুনে।’

অরূপ রিপোর্টে আরেকবার চোখ বুলিয়ে বললো-‘ট্রিটমেন্ট শুরু করা উচিত। কাল থেকে হলে ভালো হবে।’
অরূপের বড্ড তাড়া দেখছে অনিরূপ। অরূপ কিছুটা উদ্ভিগ্ন হয়ে বললো-‘আমি আমাদের মেডিকেল উত্তর কুমারকে কল দিচ্ছি। অ্যাই থিঙ্ক হি উইল বি দ্য বেস্ট! ! কী বলো?’’
‘ভালো হবে।’- অনিরূপের ছোট্ট উত্তর!
‘অ্যামি অ্যাপোইনমেন্ট নিয়ে রাখছি।ভাবিকে জানিয়ে রেখো।’
‘ঠিকাছে।’-অনিরূপ তখনো অরূপের দিকে চেয়ে আছে। অরুপের মধ্যে নিধি কে নিয়ে চিন্তার মাত্রাটা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দেখতে পারছে ও। এটা কী শুধুই ভাবির বোন বলে? নাকি অরূপও…

অনিরূপ রাতের খাবার খেয়ে রুমে এসেছে!আশা নয়টার সময় একটু খেয়ে যে রুমে এসেছে, আর খবর নেই। রুমে এসেও, আশাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। অনিরূপ ডাকে-‘আশা? আশা?’
ডাকতে ডাকতে অনিরূপ বারান্দায় যায়! ঠিক ধরেছে ও, আশা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে! সুতির মেরুন রঙের আঁচল দুলছে শীতল বাতাসে, চুল খোপা করা। পরিচ্ছন্ন আশার খোপাটাও আজ বড্ড এলোমেলো! অনিরূপ মলিন হেসে এগিয়ে যায়। আশার পাশে দাড়িয়ে আশার মতো করেই অনেকক্ষণ চাঁদটা দেখে। একপর্যায়ে চাঁদের দিকে চেয়ে বলে-‘মন খারাপ করো না আশা! তুমি যে ভয় পাচ্ছো, ওটা সত্যি হবে না কোনোদিন।’

আশা কথা বলে না। শুধু চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়ে চোখের জল! অনিরুপ চাঁদের থেকে চোখ সরিয়ে পাশে ক্রন্দনরত আশার দিকে চায়। শাড়ি পড়া বউ, আকাশের চাঁদ দেখতে দেখতে কাঁদছে! অবশ্যই মারাত্মক একটা দৃশ্য! অনিরূপ বুকে হাত ভাজ করে হালকা হেসে অনেকক্ষণ এভাবেই চেয়ে থাকল আশার দিকে
একটু পর আশার ফোপানোর শব্দ কানে জেনে, ধ্যান আসে ওর! আরেকবার পূর্ণ দৃষ্টিতে ওকে দেখে এগিয়ে গেলো দু কদম! তারপর, আশার কাঁধ ধরে নিজের দিকে ওকে টেনে এনে চোখের জল মুছিয়ে দিলো যত্নবান স্বামীর মতো। আলতো গলায় বললো-‘তোমার চোখটা খুব সুন্দর, আশা প্লিজ ওতে পানি এনো না। আই জাস্ট হেইট ইট!’

অনিরূপ কথাটা বলে চোখ-মূখ বিকৃত করার চেষ্টা করল। আশা টলমলে চোখে অনিরূপের দিকে চায়! কান্নায়, অনিরূপের আদুরে কথায় রীতিমত ঠোঁট ভেঙে আসতে চাইছে ওর!অনিরূপ আশার বাচ্চামো দেখে হালকা হেসে আশার কপালে বহুদিন পর চুমু বসায়। অবাক করা ব্যাপার, আশা এবার আটকায় না ওকে। বরং অনিরূপের পিঠের দিকের শার্ট খামছে ধরে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুঁজে দিয়ে…আচমকাই শব্দ করে কেঁদে ফেলে! অনিরূপ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় একদম। আশা শক্ত করে ধরে রেখেছে ওকে, মেয়েলি কণ্ঠে কাঁদছে! অনিরুপ নিজেকে সামলায়! ভেঙে পড়া আশার পিঠে আলতো করে হাত রেখে চাপড় দিয়ে নরম গলায় বোঝায়-‘এত কাঁদছ কেন, পাগল! ঠিক হয়ে যাবে নিধি।ডোন্ট ক্রাই,স্টপ স্টপ!’

আশা শোনে না! কাঁদতে কাঁদতে অনিরূপের কাঁধে মুখ গুঁজে বলে উঠে-‘আপা ছোটবেলা থেকে এত কষ্ট পেল কেন ডাক্তার? কেন আল্লাহ আপার কপালে সুখ রাখলেন না। অল্প বয়সে বিধবা, লোকের ধিক্কার এখন আবার যখন আপা নিজেকে সামলে নিচ্ছিল তখন মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে এই ক্যান্সার! আপা এসব সহ্য করবে কিভাবে?আপাকে আমি কোন মুখে জানাব এই বিশ্রী রোগের কথা!

ডাক্তার, আমার আপা বাইরে নিজেকে শক্ত দেখালেও অত শক্ত না। আর কেউ সেটা না জানুক, আমি জানি! আমার আপা বড্ড ভীতু ডাক্তার। খুব ভীতু! ও এসব ডিজার্ভ করে না,মোটেও করে না। আপা একটা ভালো লাইফ, একটা সুন্দর লাইফ ডিজার্ভ করে। বলুন, ডিজার্ভ করে না?’
অনিরূপ আশাকে কী বলবে বুঝতে পারছে না। একবার ভাবে, মেয়েটা কাদুক! কাঁদলে শান্তি পাবে। পরপর মনে হয়, ওর অন্তর তো বৌয়ের কান্নার আওয়াজ জ্বলে যাচ্ছে। অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে! রাবিশ অন্তর অনিরূপের! অনিরুপ থামলো না আশাকে। বরং আলগোছে পাঁজকোলে তুলে নিলো। আশা অনিরূপের কাঁধে এখনও মুখটা গুঁজে রেখে ফোপাচ্ছে! কান্না একটু থেমেছে!

অনিরূপ আশাকে বারান্দা থেকে এনে বিছানায় শুইয়ে দিল।নিজে আশার উপর আধশোয়া হয়ে ওর হাতটা নিজের গলা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো-‘স্টপ নাও! অনেক হয়েছে, আর না। লেটস স্লিপ নাও!’
আশা শুনে না। তার এখন বুক ফেটে কান্না আসছে, কী করবে ও? অনিরূপ বুঝে, আশা মানার পাত্রী নয়! ও তাই আশার পাশে শুয়ে আশাকে আলগোছে বুকে টেনে নিলো। আশা অনিরূপের দিকে চেয়ে আবারও ফোপাতে ফোপাতে বললো-‘আপা সত্যি ঠিক হয়ে যাবে না, ডাক্তার?’

অনিরূপ আশার ঠোঁটে আঙুল চাপে, শাসানোর স্বরে বললো-‘হ্যাঁ হয়ে যাবে কিন্তু এখন তুমি না ঘুমালে তুমি নিজে বিছানায় পরে যাবে, ফর শিউর। শুসস…নো মোর ক্রাইং! চোখ বন্ধ!’
অনিরূপ কথাটা বলে সুইচ টিপে বাতিটা বন্ধ করে দিল। তারপর আশার মাথায় আলতো করে বিলি কেটে দিতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে আশার মাথাটা প্রচণ্ড ধরেছিল। অনিরূপের এমন আরামদায়ক বিলি কাটাতে, একটাসময় আশার চোখ লেগে আসে!

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ২১

আজ- বহু মাস পর, দুজন স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের সান্নিধ্যে আসলো, জড়িয়ে ঘুমাল! অন্যথায়, এক বিছানায় থাকা সত্ত্বেও, দুজনের মধ্যে থাকত যোজন-যোজন দুরত্ব! দুরুত্বটা একাধারে, শারীরিক ও মানসিক!

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ২৩