দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ২৫

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ২৫
অবন্তিকা তৃপ্তি

নিধি চলে গেছে, আজ প্রায় দুদিন! অরূপ অবশ্য বেশ স্বাভাবিক! সে আনন্দে খাচ্ছে-দাচ্ছে; ঘুমাচ্ছে, হাসপাতাল যাচ্ছে! ওর লাইফ চলছে বিন্দাস! অনিরূপের অরূপের এই অদ্ভুত আচরণ ভালো ঠেকছে না। ও বারবার তীক্ষ চোখে যখনই সামনে পড়ে, অরূপকে দেখে। আজ অনিরূপের বাবা উমায়েদ বিজনেস ট্রিপ থেকে ফিরবেন। অরূপ মূলত আজকের জন্যই এতটা শান্ত, উদগ্রীব! বাবা এলে, সবার সামনে আজ নিধির কথাটা তুলবে! কেউ যদি ওদের সম্পর্ক না মানে, তবে ও অন্য উপায় নিবে!

আজকে অরূপ হাসাপতাল যায়নি। বাসার সবাইকে আজ রাতে বলে দিয়েছে, ও আজকে ওদের সঙ্গে মিটিং করবে। সেই অনুযায়ী অনিরূপও আজ দ্রুত বাড়ি ফিরেছে! আপাতত উমায়েদের রুমে ওরা দু ভাই, আর ওয়াহিদা আছেন। আশাকে আনা হয়নি এখানে। অনিরূপ সোফায় বেশ আরাম করে বসে আছে।! ও তো জানেই আজ কী আলোচনা হবে! তাই ওর আপাতত কোনো মাথা ব্যথা নেই!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অরূপ বসে আছে মাথা নিচু করে অনেকক্ষণ হলো। বাবা-মায়ের সামনে নিজের বিয়ের কথা নিজে তোলা ভদ্র-সভ্য অরূপের জন্যে অনেকটাই কষ্টদায়ক! উমায়েদ অরূপকে নীরব থাকতে দেখে বিরক্ত হয়ে এবার বললেন-
‘বাবা, তোমার কী বলার আছে বলো। আমি ঘুমাব, অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছি।’
ওয়াহিদা বাথরুমের কাজ শেষ করে বিছানায় এসে বসলেন। অরূপ এবার মাথা তুলল! কিছুক্ষণ বাবা-মাকে দেখলো! তারপর গলা পরিষ্কার করে সোজা হয়ে বসলো! সরাসরি স্পষ্ট গলায় বললো-
‘আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করি।বিয়ে করতে চাইছি তাকে!’

শান্ত, নিঃশব্দ রুমে যেন বাজ পড়ল! ওয়াহিদা চমকে তাকালেন ছেলের দিকে! উমায়েদ অবশ্য তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। তিনি ছেলেদের গোড়া চিনেন। তার ছেলেরা একেকটা হয়েছে, একরোখা-জেদি! যা বলে তাই করে। উমায়েদ এতে মানা করেন না। ছেলেরা যতদিন উশৃঙ্খল না হচ্ছে ততদিন এসব চলুক! তিনি এবার অরূপকে লক্ষ্য করে বললেন- ‘ওহ! সমস্যা কী? তোমার বড় ভাই যে পথে হেঁটেছে তুমিও সেই পথেই হাঁটবে, জানা কথা এটা।’

ওয়াহিদা বরের দিকে একবার চেয়ে, আবার অরূপের দিকে তাকালেন। শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন-
‘মেয়েটা কে? আমরা কী তাকে চিনি?’
অরূপ একবার অনিরূপের দিকে তাকাল! অনিরূপ বাঁকা হাসি হাসল, অরূপের দিকে চেয়ে মুখ বাকালো! অরূপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো ওয়াহিদের দিকে তাকাল, উত্তর দিল-
‘নিধি, ভাবির বড় বোন।’
ওয়াহিদ চমকে উঠলেন! উমায়েদও ভ্রূ কুঁচকে ফেললেন। নিধি? ওই ক্যান্সারে আক্রান্ত, ডিভোর্সি মেয়েটা?
অনিরূপ এবার হেসেই ফেলল নিঃশব্দে, ও তো এগুলো জানেই! অরূপ না বললেও জানে। উমায়েদ বললেন-‘এটা কিভাবে হয়? মেয়েটা তোমার আত্মীয়তার দিকে বড়, বয়সে বড় না হোক! সামাজিকতাও দেখতে হবে আমাদের। বিয়ে করলেই হয়না শুধু।’

অরূপ কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো-‘বাবা, আমি অনেকে ভেবেছি আমার মনে হয়না এটা কোনো বড় সমস্যা। সংসার আমি করবো। তুমি ভাবো, আমি এমন কারো সঙ্গে কীভাবে সংসার করবো যাকে আমি ভালোই না বাসতে পারি। তখন ডিভোর্স হলে, সেই একই সমাজ আমাদের দিকে আঙুল তুলবে। আমি সমাজের লোককে আগেও ধার ধারিনি বাবা, তবে এখন কেন?’
ওয়াহিদা এবার কথা কেড়ে নিলেন- বললেন;

‘অসম্ভব! ওই পরিবারের মেয়েগুলো দায়িত্বহীন হয়! তোমার ভাবীকেই দেখো। আছে তার অনিরূপের প্রতি কোনো দায়িত্বশীলতা? দিনের পর দিন তোমার বড় ভাই বাইরে থাকতো, সে কী এসব গুরুত্ব দিয়েছে? সংসারে মন থাকে না ওই পরিবারের মেয়েদের। তুমি কী চাও, তোমার পরিণতি তোমার ভাইয়ের মতো হোক?’
অরূপ কিছু বলার আগে, অনিরূপ কথা ভাঙ্গে! সোজা হয়ে বসে বললো-
‘মা,একটা মিসআন্ডার্সট্যান্ডিং হচ্ছে তোমার। আশা এখন আমার প্রতি যথেষ্ট কেয়ারফুল! আগে যাই হোক না কেন, মোস্ট ইম্পর্টান্ট, আমরা এখন সুখে আছি! নিধিও আশার মতো হতে পারে, যদি ওকে প্রপারভাবে কেয়ার করা হয়,পিউর ভালোবাসা পায়!’

অনিরূপের কথা শুনে অরূপ কৃতজ্ঞতা চোখে চায় ভাইয়ের দিকে। ওয়াহিদা কী বলবেন? তিনি বলে বসলেন-‘মেয়েটা ডিভোর্স হয়েছে! এর মাঝে আবার ক্যান্সার আছে, কদিন বাঁচবে কে জানে? তুমি চাইলে একজন কুমারী মেয়ে দেখে বিয়ে করতেই পারো অরূপ! খামোকা নিজের প্রতি অবিচার করো না।’
অরূপ মায়ের এই পুরনো বিশ্বাসে যারপরনাই বিরক্ত হলো। কিন্তু মুখে সেই বিরক্তি ফুটালো না, মা তো! চিন্তা হতেই পারে! ও যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো-‘মা, কুমারী মেয়ের আমার দরকার নেই! আর ডিভোর্স কেন হয়েছে এটা তুমিও জানো! উনি অসম্ভব ভালো মেয়ে মা! হয়তো হাজারো কুমারী মেয়ের থেকেও ভালো! আমার স্ত্রী হিসেবে আমি উনাকে ছাড়া কাউকে মানতে পারব না।’
অরূপ থামে! বড়বড় নিঃশ্বাস ফেলে একপর্যায়ে বলে বসল-

‘এই বিয়ে না হলে, তোমাদের ছোট ছেলের বিয়ের কথা ভুলে যেতে হবে তোমাদের। সিদ্ধান্ত নাও এখন।’
ওয়াহিদা ছেলেকে বোঝাতে যাবেন, তার আগেই উমায়েদ আটকে দিলেন-‘আহ থামো! অরূপের দিকটা ভাবো। এভাবে জোর করে আমাদের সিদ্ধান্ত আমরা ওর উপর চাপিয়ে দিতে পারিনা।’
তারপর অরূপের দিকে চেয়ে বললেব-‘আমরা রাজি! কবে যেতে হবে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে জানিয়ে দিয়ো।’
এতটা দ্রুত সবাই মেনে যাবে, এটা একদমই আশা করেনি অরূপ! ও হেসে উঠলো নিঃশব্দে! অরূপকে অসম্ভব খুশি হতে দেখা গেলো। ওর চোখ-মুখ খুশি ঝলমল করেছে.!

‘ভাবি, আসব?’
আশা তখন বিছানা ঝাড়ু দিচ্ছে! রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি চলছে। অরুপের দরজায় টোকা শুনে, দ্রুত মাথায় আঁচল তুলে হালকা হেসে বললো-
‘আসো, আসো।’

অরূপ ভেতরে ঢুকলো! তার পিছু পিছু অনিরূপও ঢুকলো! ওদের দুই ভাইর মুখ ভীষণ শান্ত, গম্ভীর! আশা কিছুটা ভয় পেলো।কিছু কী হয়েছে আজকের পারিবারিক মিটিংয়ে? আশা জানে না। ও শুকনো মুখে বললো-‘কী হয়েছে তোমাদের দুই ভাইয়ের? এভাবে শুকনো মুখ করে কেন আছো?’
অনিরূপ এবার আশার দিকে এগিয়ে গিয়ে, ফিসফিস করে বললো-‘অরূপ কিছু বলতে চায় তোমাকে। শুনো ও কী বলে, তারপর ঠান্ডা মাথায় এটা নিয়ে ভাববে। তোমাকে সময় দেওয়া হবে ভাবার জন্যে।’
আশা কিছুই বুঝল না। ও অবুঝের ন্যায় শুধু মাথা নাড়লো। অনিরূপ গিয়ে বিছানায় বসলো। অরূপ এগিয়ে আসলো! আশার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বললো-‘ভাবী, আমি তোমার কাছে কখনো কিছু চাইনি। কিন্তু আজ বড্ড আশা নিয়ে একটা কিছু চাইবো তোমার কাছে।’

আশা অবাক চোখে অরুপকে দেখল।একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ আশার সামনে ঘামছে, আঙ্গুলের নখ খুঁটছে। আশার এসব কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। ও এবার এসব দেখে হালকা করার জন্যে অরূপকে বললো-‘এত নার্ভাস কেনো হচ্ছো ভাইয়া। বলো, কী চাই? আমি এতটাও রাগি নই।’
বলে হালকা হাসলো আশা। অরূপ এবার মাথা তুললো, স্পষ্ট গলায়, গম্ভীর স্বরে বললো-‘আপনার বোনকে চাই, নিজের বিবাহিতা স্ত্রী রূপে।’

আশা চমকে উঠলো। অরূপকে একবার দেখে আরেকবার অনিরূপের দিকে তাকালো। অনিরূপ চোখের ইশারায় আশাকে শান্ত থাকতে বললো। আশা অরূপের দিকে আবারও তাকাল। অরূপ এবার বড্ড অধৈর্য্য ভঙ্গিতে বললো-‘আপনি আমাকে ভরসা করুন ভাবী। শুধু একবার! নিধিকে আমি পুরনো কষ্ট আবার পেতে দিবনা। আমি ওমন ছেলে নাই,আপনি জানেন। আমি উনাকে ভালোবাসি, আমার এএই ভালোবাসার মধ্যে কোনো কুৎসিত উদ্দেশ্য নেই, মোটেও নেই ভাবি। প্লিজ মানা করবেন না আমাকে। আপনি রাজি না হলে, আমার হাতে আর কিছুই করার থাকবে না ভাবি। আমাকে প্লিজ নিরুপায় করে দিবেন না! অনুরোধ আপনার প্রতি আমার।’

আশা এখনো বিষয়টা হজম করতে পারছে না। ওর শুধু মনে পড়ছে- যাওয়ার আগে নিধি বারবার বলেছিল, নিধির জন্যে আশার সংসারে অশান্তি হোক ও চায়না। নিধিকে অরূপের সঙ্গে যেতে বলায়, নিধি ভীষণ অপ্রস্তত হয়ে যায়, দুহাতে মানা করে বারবার।নিধি তাহলে ভয়ে পালিয়েছে? আশা কিছুটা থমকেই গেলো। ও আশা করেনি অরূপের এমন ফিলিংস!

আশা অরুপের দিকে চায়! অরূপের মুখটা বড্ড কাচুমাচু! আশা না বললে, হয়তো এই ছেলেটা এখানেই মুর্ছা যাবে! আশা ভাবে; অরূপ ভালো ছেলে। এক কথায়, আদর্শ ছেলে! আশা জানে সেটা। এ বাড়িতে আসার পর, যখন কেউ আশার পাশে ছিল না; তখন অরূপ আশার পাশে ছিল, দেবর নয় শুধু, একজন বন্ধু হিসেবেও আশাকে ভালো অনুভব করানোর চেষ্টা করেছে। অনিরূপের সঙ্গে মনোমালিন্য হলে, অরূপ আশাকে হাসানোরচেষ্টা করেছে, বারবার আশার মনটা হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করেছে। নতুন অবস্থায় এটুকু স্বস্তি পাওয়াটাই আশার কাছে অনেককিছু ছিল! অনিরূপের মধ্যে একটা রাগী-রাগি ভাব থাকলেও, অরূপ একদম শান্ত পানির ন্যায়!
ওরা তো নিধির জন্যে এমন কাউকেই খুঁজছিল! যে শান্ত হবে, রাগ থাকবে কম! অরূপকে কদিন ধরেই লক্ষ্য করেছিল আশা! ওরও খটকা লেগেছিল, কিন্তু এসব মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দেওয়া আশা এখন বুঝতে পারছে-আদতে কোনো কিছুই ওর মনের ভুল ছিল না।

আশা এখনো কোনো জবাব দেয়নি। অরূপ অসহায় চোখে অনিরূপের দিকে তাকাল। অনিরূপ চোখের ইশারায় ভাইকে শান্ত হতে বলে আশার দিকে এগিয়ে গেল।
‘আশা? ঠিক আছো? -আশার কাঁধে হাত রাখে অনিরূপ। ওর স্পর্শে আশার ধ্যান ভাঙলো।
অরূপ এবার বড্ড নিরুপায় ভঙ্গিতে বললো-‘প্লিজ ভাবি, প্লিজ।’
আশা নিজের মনের সমস্ত জড়তা ঠেলে দিলো। ছেলেটার কাজ-মিনতি আশাকে আপ্লুত করলো! ও হালকা হেসে বলল-
‘মা, বাবা রাজি থাকলে আমার সমস্যা নেই।’
আচমকা এমন কথা শুনে প্রথমে অরূপ অবাক হলেও, পরপর শব্দ করে হেসে ফেলল! কপালে আঙুল ঠেসে হেসে উঠে নত মুখে ভাইয়ের দিকে তাকাল। অনিরূপও ভাইয়ের খুশিতে হাসলো। অরূপ হাসি থামিয়ে খুশিতে কাঁপতে কাঁপতে বললো-‘মা, বাবা রাজি সবাই। আমি ওদের সঙ্গে কথা বলেছি।আমি চাইছি কালকেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাব, ভাবী। কোন সমস্যা হবে?’

আশা অনিরুপের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে। অনিরূপ আশার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে অনেকক্ষণ! একপর্যায়ে আশাকে বুকের মধ্যে বারবার উশখুস করতে দেখে অনিরূপ বিরক্ত হলো ভীষণ!
ও শাসালো-‘ঘুমাচ্ছে না কেন? গতকালও ঘুম হয় নি, আজকেও না ঘুমালে বিছানায় পরলে খবর আছে তোমার। আমিডাক্তার হয়ে, কারো নার্স-সেবা করতে পারবো না আগেই বলে রাখলাম।’
আশা ঠোঁট উল্টে তাকালো। পরপর অনিরুপের গায়ের সঙ্গে ঘেঁষে আরো একটু উঁচু হয়ে অনিরূপকে জড়িয়ে ধরে ওর মুখের দিকে তাকাল।

অনিরুপ ভ্রু কুঁচকে আশার দুরন্তপনা দেখছে। আশা বড্ড উচ্ছসিত গলায় বলতে লাগলো-‘আমার বড্ড খুশি খুশি লাগছে, ডাক্তার। আপার জীবনটা আবারও রঙিন হবে। আগের মতো আমার আপা আবার হাসবে, আমার চোখের সামনে আমি আপার একটা সুখের সংসার দেখবো। আমি না এসব চিন্তা করলেই খুশিতে কাঁপছি। ঘুম আসছে না তাই।’
অনিরূপ শুনল! মেয়েটা বড্ড পরিবারকেন্দ্রিক! আশার গন্ডিটা বড্ড ছোট! এইতো, স্বামী, সংসার আর পরিবার; এটুকুই! এতটুকু আশা করা মেয়েটাকেই অনিরূপ বিয়ের পর কতভাবে অশান্তিতে রেখেছিল।

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ২৪

অপরাধবোধে অনিরূপের মুখটা ছোট হয়ে যায়। ও মলিন হাসল! মুখটা এগিয়ে এনে আশার কপালে দীর্ঘ চুমু খেলো, আশা চোখ বুজে উপভোগ করে স্বামীর আদুরে স্পর্শ। অনিরূপ সরে আসলো, আশাকে বুকে শক্ত করে আগলে ধরে বললো-
‘ঘুমাও।তোমার এতো খুশি আজকে রাতের জন্যে আর হ্যান্ডেল করা যাচ্ছে না। বাকি খুশি কালকে শুনবো। নাও, চোখ বন্ধ।’

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ২৬