দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ৯
অবন্তিকা তৃপ্তি
আজ আশা-অনিরূপের বিয়ে। আশাদের বাড়ি সাজানো হয়েছে সম্পূর্ণ গ্রাম্য রূপে! আশাকে পড়ানো হয়েছে লাল জামদানি বেনারসি, গলা-কানে স্বর্ণের অলংকার, আলতা রাঙা পা, মেহেদী রাঙা দুহাত! আশা আয়নার সামনে বসে আছে। ওকে সাজিয়ে দিয়েছে ইমা। ইমা আয়নায় আশাকে দেখে হইহই করে উঠে খুশিতে-
‘আশাপা, তোমাকে তো ভীষণ ভালো লাগছে দেখতে।লিপস্টিকের কালার ম্যাচ করেছে স্কিনের সাথে।’
আশা হালকা হাসার চেষ্টা করলো। নিধি কাজের ফাঁকে কয়েকবার এসে দেখে যাচ্ছে। আশার সাজানো শেষ হলে নিধি একপ্লেট ভাত নিয়ে ঢুকে ঘরে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘আশা, চল কিছু খেয়ে নে।’ -নিধি ভাতের প্লেট নিয়ে বিছানায় বসতে বসতে বললো!
আশা শাড়ি সামলে চেয়ার থেকে উঠে নিধির পাশে এসে বসলো। নিধি শুটকি ভর্তা দিয়ে ভাত মাখিয়ে লোকমা তুলে দিল আশার মুখে। আশা খাচ্ছে, আর অপলক নিধির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ টলটলে আশার, যেন এক্ষুনি আহ্লাদ দিলে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়বে। নিধি নিজের মতো করেই বললো- ‘রোস্ট আনব?পোলাও দিয়ে?’
আশা মাথা নাড়লো, মুখের খাবার চিবুতে চিবুতে বললো-‘না,এটাই ভালো লাগছে। ঝাল ঝাল!’
নিধি হালকা হেসে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে আশার মুখের আশেপাশে লেগে থাকা ভাত ফেলে দিয়ে বললো-‘এখনও খাওয়া শিখলি না আশা!’
আশা হালকা হাসার চেষ্টা করে বললো-‘শিখবও না কোনোদিন।’
‘হ্যাঁ, বর তখন আমার মতো খাইয়ে দিবে।’ -নিধি হেসে হেসেই মজা করে বলে বসলো!
আশা চমকে উঠে, নিধিও পরপরই বুঝে- যেখানে আশার মত ছিলো না এই বিয়েতে, সেই বিয়েতে আবার কীসের সুখ? নিধি চুপ হয়ে যায়। আশাকে খাওয়ানো শেষ হলে, নিধি খাবারের প্লেট রেখে নিজেই গোসলে চলে যায়। বরপক্ষ আসলো বলে!
‘বরপক্ষ আসছে রে….!’
মুহূর্তেই আশাদের উঠোনের সামনে হইচই লেগে গেল! আব্দুর রহমান সাহেব দৌঁড়ে বেরিয়ে এলেন মেয়ে জামাইকে এগিয়ে আনার জন্য। অনিরূপ গাড়ি থেকে নামলো, ড্রাইভিং সিট থেকে নামল অরূপ। একে একে মোট ২৫ জন মানুষ দাওয়াত খেতে এসেছে। আব্দুর রহমান অনিরূপের সঙ্গে হাসিহাসি মুখে কথা বলছেন-
‘আসতে কোন কষ্ট হয়নি তো বাবা?’
অনিরূপ হালকা হাসার চেষ্টা করে বললো-‘না আঙ্কেল! এদিকের রাস্তাটা একটু ভাঙা, বাট উই ম্যানেজড!’
আব্দুর রহমান অরূপসহ একে একে সবাইকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে ঘরে আনলেন। বসার ঘরে বসানো হয়েছে বরপক্ষকে। অনিরূপের আশেপাশে গ্রামের কতগুলো বাচ্চা ছেলে-মেয়ে ঘুরঘুর করছে। আবার অনিরূপকে একবার দেখে দেখে নিজেদের মধ্যে কী যেন ফুসুরফুসুর করছে। আব্দুর রহমান তাদের ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা আটকালেন। নিধি রান্নাঘর থেকে মিষ্টি, মিঠাই, সেমাই সব পাঠাচ্ছে বসার ঘরে।
আশা নিজের ঘরে বসে আছে, চুপচাপ! তার দু চোখ পায়ের লাল রঙের আলতার দিকে। ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে মলিন পা দুটো! তবে আশা সৌন্দর্য্য দেখছে না। তার মন ভীষণ ভার, মরামরা! বাইরে ভীষণ হৈ-হল্লোর শোনা যাচ্ছে। ও এসে গেছে!
অনিরুপ সুগার খায়না, তবুও একটা মিষ্টি সে কোনরকমে শেষ করলো। সুগার খায়না দেখে আব্দুর রহমান এসব খেতে জোর করলেন না। পিঠার প্লেট এগিয়ে দিলেন অনিরূপের দিকে। অরূপের একটা কল আসছে। অরূপ আব্দুর রহমানকে বললো-‘আপনারা গল্প করুন, একটু আসছি আমি।’
অরূপ বারান্দায় চলে আসে ফোন নিয়ে। হাসপাতাল থেকে কল এসেছে। আজ দায়িত্বে অনিরূপ নেই, তাই অরূপ আজ যতটুকু পারে কলের মাধ্যমে কাজ শেষ করেছে। নিধি বারান্দা পেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটছে তখন। হঠাৎ নিধিকে কেউ পেছন থেকে ডাকল, নিধি পেছনে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করছে কে ডাকছে, আর হাঁটছে। তারপর যা ঘটার ঘটে গেলো। অরূপের গায়ের সঙ্গে আকস্মিক ধাক্কা খেয়ে বসল নিধি। অরূপ চমকে উঠে তাকাল, নিধির হাত থেকে ফুলের থালা ঝনঝনিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। ফুলগুলো সব ছড়িয়ে- ছিটিয়ে মেঝেতে পরে গেলো। নিধি হা করে ফুলগুলোর দিকে চেয়ে মাথা তুলে অরূপের দিকে তাকাল। অরূপ ফোন কানে নিয়ে হা করে নিধির দিকে চেয়ে আছে। নিধি আর কথা বাড়াল না, নিচে ঝুঁকে ফুলগুলো তুলতে লাগল! অরূপও নিজের ভুল বুঝতে পেরে কল কেটে ফুল তোলায় সাহায্য করতে লাগল! নিধি ছোট স্বরে বললো-
‘দুঃখিত আমি।’
অরূপও ফুল তুলতে তুলতে হালকা হেসে বললো-‘আ’ম অলসো সরি!’
নিধি হাসার চেষ্টা করল। ফুলগুলো আবার থালায় নিয়ে নিধি উঠে দাঁড়াল। অরূপ বললো-‘কেমন আছেন?ফাইনালি আমরা পারিবারিক ভাবে বেয়াই হতে যাচ্ছি।’
নিধি হালকা হেসে বললো-‘জী! দুঃখিত আপনাকে অযথা কষ্ট দিয়ে ফেললাম।’
‘না, না! সমস্যা নেই।’ -অরূপের বিচলিত উত্তর!
ফুল তোলা শেষ হলে দুজন উঠে দাঁড়ায়। নিধি এবার মিহি স্বরে বললো-‘রান্নাঘরে কাজ আছে’
‘জী,জি যান।’ -অরূপ নিধির সামনে থেকে সরে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে হালকা হেসে বললো।
নিধিও আর কিছু না বলে আবারও ছুটল রান্নাঘরে।কত কাজ পরে আছে! এখানে তার খোশগল্পের সময় কই? অরুপ নিধির যাওয়ার দিকে চেয়ে হালকা হেসে ফোন পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে মেঝেতে তাকাল। একটা কানের ঝুমকো পরে আছে মেঝেতে! এটা নিধির কানে ছিল, অরূপ দেখেছে! অরুপ ঝুমকোটা তুলে নিলো, ভাবল নিধিকে সামনে পেলে দিয়ে দিবে! ভাবা অনুযায়ী ঝুমকোও ওপর পাশের পকেটে ঢুকিয়ে রাখল! তারপর আবার চলে গেলো অনিরূপের কাছে।
একটাসময় কাজী এলেন। অনিরূপ এবার নড়েচরে বসল। আশাকে এবার নিয়ে আসা হোক,আব্দুর রহমান কাউকে বলে পাঠালেন ভেতরে। খানিকটা সময় পর; ! নিধি একহাতে আশাকে ধরে ধীরে ধীরে নিয়ে এলো বসার ঘরে। বধূ রূপে আশা; চোখ দুটো নামানো, মুখে হাসি নেই!
মারাত্মক সুন্দররূপে নিজই বধূকে দেখে, অনিরূপ তির্যক হেসে চেয়ে রইলো আশার দিকে। আশাকে অনিরুপের পাশাপাশি বসানো হয়েছ। অনিরূপ নিজে থেকেই আশার সঙ্গে চেপে বসেছে একদম। আশা সরতে চাইলে অনিরূপ আশার হাত আটকে থামিয়ে দিলো। আশা নির্জীব চোখে তাকালো, অনিরূপ কানের কাছে ফিসফিস করে বললো -‘ধারকান শুনতে পারছ আমার, আশা? উফ!’
আশা অনিরূপের দিকে চায়, পরপর বিদ্রুপের মতো হেসে চোখ সরিয়ে ফেলে! অনিরূপও হালকা হাসে! বাকিত সময় আশাকে অনিরুপের সঙ্গে চিপকে বসে থাকতেই হলো!
কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করেন! প্রথমে আশাকে কবুল বলতে বলা হল। আশা থামে, একে একে চোখে ভেসে উঠে একের পর এক দূর্ঘটনা!
এই বিয়ের জন্যে আশা কত কী স্যাক্রেফাইজ করেছে।অনিরূপদের দেখতে আসা, আব্দুর রহমানের জেলে যাওয়া, টাকা ছিনতাই, অনিরূপের ব্ল্যাকমেইল, লুকিয়ে বিয়ে- তারপর এখন সবার সামনে কবুল বলার মুহূর্ত। আশা দু চোখ বুজে থাকে, চোখের কোণা বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে আশার। আশা নিশ্চুপ! মুখ থেকে তার আওয়াজ বের হচ্ছে না কোনো! গলার মধ্যে অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে, কান্নাগুলো গলায় দলা পাকিয়ে আছে। আশা কথা বলতে চায়, পারে না।
অনিরূপ ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে! কী মনে করে কে জানে, হয়তো মানবিকতাবোধ থেকে অনিরূপ আশার হাতে হাত রাখে! আশা অনিরূপের দিকে চায়, অনিরূপ চোখের ইশারায় ভরসা দিল। আশা ওই ভরসা যে চায়নি কখনো, ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে আশা হাত সরিয়ে নিলো সঙ্গেসঙ্গে! অনিরুপ নিজের হাতের দিকে চেয়ে আবার আশার দিকে চায়! আশা এবার নিজেই নিজেকে শান্ত করে! অতঃপর নিজের মনের সঙ্গে একপ্রকার যুদ্ধ করে বলে উঠো-
‘কবুল, কবুল, কবুল!’
শব্দগুলো অনিরূপের কানে কী যে শান্তি দিলো, বলে বোঝানো যাবে না। অনিরূপ মৃদ্যু হাসল! আশাবরি তার হবে, শুধু এবং শুধুই অনিরূপের।অনিরূপ আশার দিকে চেয়ে মজা করে চোখ টিপলো! আশা সেটা দেখে দাঁতে দাঁত পিষে ধরে।
আশা নিজেই নিজের হাত অপরহাতে খামছে ধরে বসে আছে। বোঝা যাচ্ছে; ভীষণ চেষ্টা করছে নিজের রাগ সংবরণ করতে।
আগুনে ঘি ঢালার মতো: এমন একটা মুহূর্তে অনিরূপ আশার কানের কাছে বিড়বিড় করলো-‘তোমার কবুল বলার মধ্যেও একটা আর্টের ব্যাপার আছে! আই লাইক ইট, বৌ!’
আশা এবার আর চুপ থাকে না, বিরক্তিতে দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠে-‘গো টু হেল।’
‘উইদ ইউ ওভেসলি।’ -অনিরূপের কৌতুক স্বর!
আশা কী বলবে আর এই পাগলকে! তাই চুপ করে বসে থাকে।
এবার অনিরূপের কবুল বলার সময়! অনিরূপের ভাই-ব্রাদাররা এবার হৈ-হল্লোর লাগিয়ে দিয়েছে। চেয়ার্স অ্যাপ করছে অনিরূপকে! অনিরূপ এক মুহূর্ত দেরি না করে আশার দিকে একবার চেয়েই স্পষ্ট গলায় বলে উঠল-
‘কবুল, কবুল, কবুল!’
দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ৮
আশা চোখ খিঁচে রাখলো সেসময়টায়। বসার ঘরে সবাই ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে উঠেন উচ্চস্বরে! আব্দুর রহমান মিষ্টি খাওয়ালেন কাজীকে। আবারও শুরু হয়ে গেলো হৈ হল্লোর! কাবিন শেষ, এবার খাওয়া-দাওয়ার পালা! তারপর কনে বিদায় হয়ে যাবে! আশা চিরদিনের জন্যে তার স্বামীর ঘরে চলে যাবে। যেখানটায় থাকবে আশার আস্ত এক সংসার, একটা ছোট ঘর, দুজন মানুষ, আর? আর কী?
আর থাকবে অনিরূপ! অনিরুপ শেখ জয়! যার কাছে ভালোবাসা মানেই ছিনিয়ে নেওয়া, জিতে যাওয়া, হাসিল করে ফেলা!