দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪৭(২)

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪৭(২)
তাসফিয়া হাসান তুরফা

“কি বললেন আপনি? আমার মনে আপনার জন্য কোনো অনুভূতি নেই, তাইতো?”
দোলার প্রশ্নে নিরব হয়ে গেলো কক্ষ। নিরব রইলো কক্ষে অবস্থানরত মানব। নিশীথের মুখ থেকে দোলা হাত সরিয়ে নেয়। তবু ওর তরফ থেকে কোনো জবাব না আসায় দোলা পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,

—কিছু বলেছি আপনাকে। শুনতে পাননি?
—শুনেছি।
নিশীথ গম্ভীর স্বরে জবাব দেয়। দোলা রে’গে বলে,
—তাহলে জবাব দিচ্ছেন না কেন?
—ইচ্ছে হয়নি তাই!
—উফ! আপনি এত্ত ত্যা’ড়া কেন?
দোলা বিরক্তিতে চিল্লায়। নিশীথ মুখের গাম্ভীর্য বজায় রেখেই ভ্রু কুচকে তাকায়। দোলা নিজেকে থামায়। থামিয়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—সেদিন পার্কেযখন আমি ডেকেছিলাম তখন আপনি আমায় কি কি বলেছিলেন, ইনসাল্ট করেছেন সেসব মনে আছে তো?
—আছে!
—তবে আপনি নিজেই ভাবুন, একজন মেয়ে যার মধ্যে নূন্যতম আত্মসম্মানবোধ আছে, তাকে যদি কেউ এভাবে সূক্ষ্মভাবে অপমান করে তবে কি সে ওই ব্যক্তিকে বিয়ে করতে রাজি হবে?
দোলার ঠান্ডা গলায় ছোড়া প্রশ্নে নিশীথ চটে গেলো। গমগমে গলায় বললো,

—কি এমন অপমান করেছি শুনি?
দোলা তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো। মুখে বিতৃষ্ণাভাব ফুটিয়ে বললো,
—আবার শুনতে চান? কত কিই তো বলেছিলেন। আমার মতো মেয়ে আপনার সাথে যায়না আর…
—ওহ রিয়েলি? এই কথাটা যেন কে আগে তুলেছিলো বলো তো! আমি না তুমি?
নিশীথ কথা কাটায় দোলার মুখ গম্ভীর হয়। ওকে চুপ থাকতে দেখে নিশীথ পুনরায় বলে,
—ভালোভাবে মনে করে দেখো, আমি বলার অনেক আগে তুমি নিজেই আমায় বলেছিলে এসব কথা। তখন আমি কি জবাব দিয়েছিলাম এসব কি ভুলে গেছো? নাকি ক’দিন আগে ইচ্ছা করে তোমার কথা তোমায় ফিরিয়ে দিলাম সেটাই শুধু মনে রেখেছো?
দোলা নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে,

—মনে আছে সবই। কিন্তু আপনি কোন কারানে বলেছিলেন তা তো আমি আর জানতাম না, তাইনা? আপনি নিজেই ভাবুন, এতদিন ভালোবাসার কথা বলে আসা মানুষ যদি বিয়ের কথা শুনে হুট করে এমন কিছু বলে তবে যেকেউ সাধারণভাবে কি মনে করবে? অবশ্যই ভুল বুঝবে। তাই আমি নিজেও ভুল বুঝেছিলাম!
—এটাই তো আমার অভিমান, দোলনচাঁপা!
নিশীথ বড় এক শ্বাস ছেড়ে বলে। দোলা বিভ্রান্ত চোখে তাকায়। ওর চাহনি লক্ষ্য করে নিশীথ এগিয়ে আসে। দোলার দুই বাহু চেপে ধরে নিজের দিক টেনে নেয়। হকচকিত দোলার হাতদুটোর অবস্থান হয় নিশীথের উদোম পিঠে। নিশীথ চোখে রাগ মিশিয়ে বললো,

—কেন তুমি আমায় ভুল বুঝলে? কেন তুমি একবারো ভেবে দেখলেনা আমি কোন কারণে তোমার সাথে ওভাবে আচরণ করছি? একটু কি ভাবা যেতোনা? তুমি না হয় রাগ করলে, কেন ইংগেজমেন্টের আগ পর্যন্ত একটা দিন আমায় ফোন দিয়ে বলতে পারলেনা, তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করবেনা। কেন বিয়ের আগে একটাবারও আমার সেদিনের ওমন ব্যবহারের সাফাইজবাব তুমি চাইলেনা, দোলনচাঁপা?
দোলা নিশীথের চোখে চোখ রাখতে পারেনা। মুখ অন্যদিকে করে নেয়। নিশীথের তা পছন্দ হয়না। এক হাতে বাহু ধরে রেখে, অপরহাতে দোলার মুখ নিজের দিক ঘুরিয়ে নেয়। পুনরায় বলে,

—আমার উপর অন্তত এতটুকু আস্থা তোমার থাকা উচিত। তোমার নিশীথ কখনো তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবেনা এটুকু বিশ্বাস রাখা প্রয়োজন ছিলো। তুমি না হয় আমাকে না-ই ভালোবাসলে, কিন্তু আমি যে তোমায় কতটা ভালোবাসি এটা জানা…
দোলা ওকে থামিয়ে বললো,
—আপনার প্রতি আমার কোনো অনুভূতি যদি না-ই থাকতো তবে কেন সেদিন নিজের বিয়ের কথা শুনে পাগলের মতো আপনার সাথে দেখা করতে পার্কে ছুটে গেলাম বলুন? যেই আমি কক্ষনো কোনো ছেলের সাথে প্রয়োজনের বাহিরে কথা অব্দি বলিনি, সেই আমি শুধুমাত্র আপনার আবদার রাখতে মাঝরাতে দেখা করতে বের হতাম, কেন? আর কেনই বা আমার বিয়ের কথা জানামাত্রই সবার আগে আপনাকে জানাতাম? কোনো জবাব আছে আপনার কাছে?
নিশীথ চুপচাপ চেয়ে রয়। ওর চাহনি দেখে মনে হয় যেন দোলার চোখেমুখে নিজের প্রতি অনুভুতি খুজার চেষ্টা করছে। এরই মাঝে দোলা আবারও বলে,

—এটা সত্যি যে, আমি বাসায় ফিরে রাগের বশে পাত্রের ব্যাপারে কোনোকিছু না জেনেই হ্যাঁ বলে দিয়েছিলাম। কিন্তু মাথা ঠান্ডা হওয়ার পরে আমার খটকা লাগে। আমার মনে হয় আপনার এমন ব্যবহারের পেছনে হয়তো কোনো কারণ আছে, হয়তো আংকেলের সাথে আপনার ঝগড়া হয়েছে অথবা অন্য কোনো কারণে আপনি আপসেট ছিলেন যার কারণে ওমন আচরণ করেছিলেন। এরপর আ..
—তবে কেন পরে আমার সাথে যোগাযোগ করোনি? কেন আন্টির থেকে ছেলের ব্যাপারে শুনতে চাওনি, বিয়ের জন্য মানা করোনি?

—আরে ভাই, সেটাই বলছিলাম। থামুন তো! এত অধৈর্য হলে হয়? আমি তো বলছিই!
নিশীথকে থামাতে দোলা হাপিয়ে যায়। একটা মানুষ এত অধৈর্য হয় কিভাবে ও বুঝেনা! দোলার কথা মেনে নিশীথ চুপ হয়ে যায়। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। দোলা হাফ ছেড়ে বলে,

—আমি মোটেও অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাইনি। বরং, আপনার ব্যাপারে মা-কে বলার জন্যই ওদিন রাতে বের হয়েছিলাম রুম থেকে। সে সময় মার রুমে ঢুকে তাকে ফোনে কথা বলতে শুনি। আমি চলে আসছিলাম এমন সময় ওনার মুখে আপনার নাম শুনে থেমে যাই। এরপর আপনাদের দুজনের বলা বিয়ের ব্যাপারে কিছু কথোপকথন শুনে ফেলি। তখন আমি চমকে যাই, একপ্রকার থমকে যাই। মা আমাকে দেখার আগেই দ্রুত রুমে ফিরে এসে সবকিছু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে থাকি। একদিকে আপনি আমার সাথে সব জেনে-বুঝে এমন করলেন, অন্যদিকে মা নিজেও সবকিছু জানে তবু আমায় বলছেনা বিষয়টা আমায় বেশ ভাবায়! ইংগেজমেন্টের আগ অব্দি এ নিয়ে চিন্তা করি কিন্তু কারণ খুজে পাইনা।
দোলা একটু থামে। থেমে নিশীথের হাত ধরে বলে,

—এক পর্যায়ে আমি ভেবেছিলাম হয়তো আপনি আমায় সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এসব করেছিলেন তাই ইংগেজমেন্টের দিন আসবেন। আমি ধৈর্যের সাথে আপনার অপেক্ষা করছিলাম কিন্তু ইংগেজমেন্টের দিন আপনি যা বললেন তাতে আমি কনফিউজড হয়ে যাই। আমি বুঝিনি আপনি কেন আমায় শা’স্তি দিতে চেয়েছিলেন। যেখানে আমার কোনো দোষই নেই! এজন্যই আজ সবার আগে আপনার থেকে জবাব চাই। এবার বলুন আমার ভুলটা কোথায়?

নিশীথ দোলাকে ছেড়ে দেয়। ও কি বলবে ঠিক ভেবে পায়না! যতদূর সে বুঝলো দোষটা ওদের কারোরই না, দোষটা পরিস্থিতির। দুজনই দুজনের জায়গা থেকে ঠিক কিন্তু একজনের দিক থেকে অপরজন দোষী। তবে কি করবে ওরা? নিশীথ ধীর গলায় বলে,
—সবই বুঝলাম। যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন আর কি করার? বাদ দাও!

নিশীথ বিছানায় চলে যায়। খাটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে। দোলা শান্ত নজরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে নিশীথের পানে। যেন ও বুঝে, নিশীথ কি ভাবছে। ও নিজেও ধীরপায়ে এগিয়ে যায়। নিশীথের শিওরে বসে চুপিসারে। পুরুষালি হাতের উপর আলতো করে রাখা কোমল হাতের স্পর্শ পেতেই নিশীথ চোখ মেলে তাকায়। পাশ ফিরে দোলাকে বসে থাকতে দেখে। দোলা মাথা নিচু করে বলে,

—হয়তো আমি আপনার মতো করে আপনাকে ভালোবাসতে পারবোনা, নিশীথ। এ কথাটা আজ নয়তো কাল আপনাকে মেনে নিতেই হবে। প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা, তাদের ভালোবাসার ধরন, প্রকাশভংগি আলাদা। আমরা যেভাবে চাইবো সবকিছু তো সেভাবে হবেনা। জীবন আমাদের সবসময় সেটা দেয়না যেটা আমরা চাই, বরং জীবন আমাদের ওটাই দেয় যেটা আমাদের প্রয়োজন! আমি আমার মতো করে আপনাকে ভালোবাসবো, আপনি আপনার মতো করে! জানেন, আমার বাবা বলতেন ভালোবাসা হলো রংধনুর সাত রঙের মতো। যার প্রত্যেকটা রঙ আলাদা। একটার সাথে আরেকটার কোনো তুলনা হয়না। কিন্তু কোনোটার সৌন্দর্য অপরটার চেয়ে কম নয়! মানুষের জীবনে ভালোবাসার সার্থকতাও ঠিক এখানেই। আমি কি বুঝাতে পেরেছি?

নিশীথ মুগ্ধ হয়ে শুনলো দোলার প্রত্যেকটা কথা। মেয়েটা অল্পবয়সেই এত্ত ম্যাচিউরড। এত গোছানো ওর প্রত্যেকটা কথা! নিশীথের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মুগ্ধতা ছেয়ে যায় নিজের ভালোবাসার প্রতি। দোলনচাঁপার মতো স্বচ্ছ মনের মেয়েকে ভালোবেসে নিজেকে ধন্য মনে হয় ওর! নিশীথ তৎক্ষণাত উঠে বসে। হুট করেই দোলাকে টেনে চেপে ধরে বক্ষপিঞ্জরে। মেয়েটাকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে নিশীথের! দোলাও নিশীথের ডাকে সাড়া দেয়। দু’হাতে নিশীথকে আগলে ধরে রাখে! মিনিট পাঁচেক পরে ওকে ছেড়ে দেয় নিশীথ। দোলাকে কি যেন দেখানোর জন্য ফোন খুজে আশেপাশে।
অতঃপর মাথা চাপড়ে বলে,

—ওহ নো! শাওয়ারে যাওয়ার টাইম ফোন নিয়ে বেরিয়েছি। ওটা মেইবি বাইরে রেখেই চলে এসেছি। পাঁচ মিনিট দিবে, দোলনচাঁপা? ফোনটা নিয়ে আসি!
দোলা মাথা নাড়তেই নিশীথ গায়ে টিশার্ট চাপিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ফোন খুজে রুমে আসতে আসতে দশ মিনিট পেরিয়ে যায়। রুমে ঢুকে দরজা লক করে বিছানার কাছে যেতেই নিশীথ লক্ষ্য করে দোলা বিছানায় হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে! নিশীথ মনে মনে খানিকটা হতাশ হলেও কাছে এগিয়ে দোলার কাছে যায়। ঘড়িতে রাত ১.৩০টা পার হয়ে গেছে ততক্ষণে! এ সময়টা ঘুম আসাই স্বাভাবিক! তারপর যত ধকল গেছে মেয়েটার উপর দিয়ে আজকে!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪৭

নিশীথ দোলাকে ঠিকভাবে শুয়ে দেয়। দোলা পাশ ফিরে ওর দিক হয়ে গুটিসুটি মেরে ঘুমায়। নিশীথ ওর গায়ে কাথা টেনে দিয়ে নিজেও পাশে শুয়ে পড়ে। রাত গভীর হতেই বাতাসের সাথে টবে ফোটা দোলনচাঁপার সুবাস নাকে এসে লাগে। শ্বাস টেনে ঘ্রাণ নিয়ে নিশীথ পাশ ফিরে ঘুমন্ত দোলনচাঁপার দিকে তাকায়। খানিকটা ঝুকে গাঢ় এক চুমু একে দেয় মেয়েটার কপালে। দোলা নড়ে ঘুমের ঘোরে আরেকটু কাছে চলে আসে। নিশীথ সাদরে ওকে দু’হাতে বুকের মাঝে আগলে নেয়।
আজকের রাতটা ওর কাছে স্বপ্নের মতো লাগে!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪৮