দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬০
তাসফিয়া হাসান তুরফা
সব আয়োজন শেষ করে দম নিচ্ছিলো দোলারা। এমন সময় বাড়ির কলিংবেল বেজে উঠলো। নিশীথ উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললো,
—মা ও দাদু এসেছে। দোলা চলো?
নিশীথের সাথে তাল মিলিয়ে দোলা অগ্রসর হলো। পিছে পিছে গেলো ওর মা ও ভাইবোন। নিশীথ হাসিমুখে দরজা খুলতেই আসমা বেগম ও ইউনুস সাহেব ওকে দেখে হাসলেন। দোলা ওদের সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকতে বললো। আসমা বেগম সালামের জবাব দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলেন। এতদিন পর শাশুড়ির দেখা পেয়ে দোলার মনটাও ভালো হয়ে গেলো। ও হাসিমুখে বললো,
—কেমন আছেন, মা?
—তোদের ছাড়া ভালো কিভাবে থাকি?
আসমা বেগম জবাব দিলেন। দোলা বললো,
—আপনাকে দেখে কতটা খুশি হয়েছি বলে বুঝাতে পারবোনা, মা!
—আর এ বুড়োকে দেখে বোধহয় খুশি হওনি, নাতবউ?
পাশ থেকে মজা করে বললেন ইউনুস সাহেব। দাদুর কথা শুনে নিশীথ দোলার দিকে তাকাতেই ও জিব কেটে দাদুর দিক চেয়ে লজ্জিত মুখে বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—সরি, দাদু। আপনাকেও ভীষণ মিস করেছি। আপনাদের ছাড়া অনেক খালি খালি লাগে!
—তাহলে চলে আয় না আমাদের কাছে আবার?
ইউনুস সাহেব নম্রভাবে বললেন। তার কথায় দোলার মাথা নিচু হয়ে এলো। আড়চোখে নিশীথের দিক তাকাতেই নিশীথ প্রসঙ্গ বদলে বললো,
—এসব কি, দোলনচাঁপা? মা ও দাদু প্রথমবার তোমার বাসায় বেরাতে এসেছে আর তুমি ওদের দরজার সামনে দাঁড়িয়েই কথা শুরু করেছো? ভেতরে আসতে দিবেনা নাকি?
নিশীথের কথায় সায় দিয়ে পেছন দিয়ে পারভীন বেগম বলে উঠলেন,
—একদম ঠিক বলেছো, বাবা। এ মেয়েটার কোনো হুশ-ই নেই! ভেতরে বসেও তো এসব কথা বলা যায়, তাই না?
নিশীথ ও পারভীন বেগমের কথায় দোলা চটজলদি আসমা বেগম ও ইউনুস সাহেবকে ভেতরে এনে বসিয়ে দিলো। দুই বেয়াইন এ সুযোগে কুশল বিনিময় করলেন। তাদের কথাবার্তা নিশীথ ও দোলা একপাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলো। নিশীথ একহাত দোলার কাধে রেখে বললো,
—সবাইকে একসাথে এতদিন পর কথা বলতে দেখে অনেক ভাল্লাগছে, না?
—একদম! শুধু একজন মিসিং।
দোলা মন খারাপ করে বললো। নিশীথ হতাশ স্বরে বললো,
—মন খারাপ করোনা। আমি আমার তরফ থেকে চেষ্টা করেছিলাম। উনি আসেননি এটায় তো আমার কিছু করার নেই তাইনা?
—হুম। আপনাকে কিছু করতে বলিনি। শুধু বলছিলাম যে বাবা থাকলে আরও ভালো লাগতো!
দোলার কথায় নিশীথ একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে সময় পেছন থেকে কামিনি চলে আসে। ও গলা খ্যাকারি দিতেই নিশীথ দোলা পেছন ফিরে তাকায়। কামিনিকে দেখে নিশীথ দোলার কাধ থেকে হাত সরায়। কামিনি দুষ্টু হেসে বলে,
—তোমাদের গল্প করা শেষ করে একটা কাজের কথা বলতে এসেছিলাম!
—কি হয়েছে, মিনি? কোনো কিছু করা বাদ গেছে নাকি?
—না, আপু। তবে লেবু নাই বাসায়। নামাজে যাওয়ার সময় শিমুলকে বলেছিলাম নিশীথ ভাইকে বলতে। ও মাত্র এসে বললো ও নাকি বলতে ভুলে গেছে , আবার খাওয়া শেষে যে সবাইকে সফট ড্রিংকস খেতে দিবো সেটাও আনতে বলা হয় নাই।
—তো সেটা তুই মেহমান আসার পরে বলছিস? এতক্ষণ কেন বলতে পারলিনা? এগুলো কেমন কথা, মিনি?
দোলা বোনকে ঝাড়ি মারে। কামিনি বলে,
—আমি বলবো তখনই তো আন্টিরা এলো। সুযোগ পেলাম কোথায়। সরি, আপু।
—দোলা রিল্যাক্স। এটা এমন কিছু না যে এখন আনা যাবেনা। এলাকার মোড়েই তো দোকান আছে, ওখানে খুচড়া সবজি, সফট ড্রিংকস সবই পাওয়া যায়। আমি নিয়ে আসছি, চিল!
—কিন্তু নিশীথ, মা ও দাদুকে রেখে আপনি বাইরে যাবেন এটা কেমন দেখায়? তার চেয়ে আমি শিমুলকে পাঠিয়ে দিই। ও নিয়ে আসুক।
—শিমুল বাথরুমে গেছে, আপু। এখনো বের হয়নি। ওকে যে বকেছি, লুকিয়ে কাদছে নির্ঘাত!
কামিনি মৃদু হেসে বলে। দোলা বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ করে। নিশীথ দুই বোনকে দেখে বলে,
—ছোট মানুষ ভুলে গেছে ওকে বকা দেওয়া ঠিক হয়নি, কামিনি। আচ্ছা যাই হোক, আমি বের হচ্ছি। দশ মিনিটের ব্যাপার। যাবো আর আসবো। দোলা, তুমি যাও মা-দের সাথে থাকো।
নিশীথের কথায় দোলা চলে গেলো শাশুড়ী ও দাদুর নিকট। নিশীথ তাদের বলেই দ্রুতপায়ে রওনা হলো বাড়ির বাইরে। শুক্রবারের তপ্ত দুপুরে রোদের ছাটা উঠেছে বেশ। জুম্মার পর এ রোদের মধ্যে রাস্তায় তেমন কেউ নেই, লোকজন সব বাসায়। তাই নিশীথও পরনের নীল পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে তাড়াতাড়ি হেটে গেলো মুদির দোকানে। প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে শিমুলের জন্য চকলেট কিনতে ভুললোনা। অতঃপর বাসার দিকে হাটা দিতেই রাস্তার ওপাড়ে চোখে পড়লো এক অদ্ভুত দৃশ্য।
কালো সানগ্লাস ও সাদা পাঞ্জাবি পড়া আয়মান সাহেব একহাতে রুমালে কপাল মুচছেন আর কিছুক্ষণ পরপর আশেপাশে তাকাচ্ছেন। উনাকে আশেপাশে তাকাতে দেখে নিশীথের মাথায় হঠাৎ কি হলো, ও দ্রুত দোকানের পিছে গিয়ে লুকোলো। এরপর উকি দিয়ে আয়মান সাহেব কি করছেন তা দেখতে লাগলো। একটুপর নিজের কান্ডে নিজেই থতমত খেলো সে! তবে মাথা ঘুরিয়ে আয়মান সাহেবের দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করলো উনি একটা লোকের সাথে কথা বলছেন। লোকটা তাকে হাতের ইশারায় কোথায় যেনো দেখিয়ে দিচ্ছে।
এসব দেখে নিশীথ ভ্রু কুচকে তাকালো, এই রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে এখানে কি করছেন উনি? কার সাথে কথা বলছেন? পরক্ষনেই আয়মান সাহেব পাশ ফিরতেই তার অপরহাতে ধরে রাখা মিষ্টি ও ফলমূলের ব্যাগ দেখে নিশীথের বুঝতে আর বাকি রইলোনা এখানে কি হচ্ছে! ওর বাবা নিশ্চিত ওর বাসা খুজছেন।
কিন্তু বাসায় তো এড্রেস বলে দেওয়া হয়েছিলো, তবে ড্রাইভারকে না এনে একা একা কেন এসেছেন তিনি নিশীথ বুঝলোনা। যদি আসতেই হতো তবে সরাসরি মা ও দাদুর সাথেই আসতেন। এসব করার মানে কি? সোজাসুজি কিছু করতে পারেনা কেন লোকটা!
নিশীথের ভাবনার মাঝেই আয়মান সাহেব হাটতে শুরু করলেন এবং নিশীথ খেয়াল করলো তিনি ওর বাড়ির রাস্তা দিয়েই যাচ্ছেন। এবার নিশীথের মাথায় একটি দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো। সে দোকানের পেছন থেকে বেরিয়ে রাস্তায় চলে এলো। আয়মান সাহেবকে ফলো করে যেতেই একপর্যায়ে ইচ্ছা করে উনার পাশ দিয়ে হাটা শুরু করলো। আয়মান সাহেব যেই না নিশীথকে দেখে চমকেছেন, ওমনেই নিশীথ পাশ ফিরে নিজেও আয়মান সাহেবকে দেখে চমকে যাওয়ার অভিনয় করলো! ভেতরের হাসি চেপে রেখে বাইরে বিস্মিত ভাব এনে বললো,
—আপনি? এখানে?
এ মুহুর্তে রাস্তায় ছেলেকে দেখে আয়মান সাহেব খানিকটা দিশেহারা হয়ে গেলেন। কি বলবেন না বলবেন আমতা আমতা করতে লাগলেন! নিশীথ শুধালো,
—তা কোথায় যাচ্ছিলেন এ রোদের মধ্যে? আপনার গাড়ি নিয়ে আসেননি কেন?
—ড্রাইভার ছুটি চেয়েছিলো। আমায় রাস্তার মোড়ে ড্রপ করে গাড়ি বাসায় পার্ক করে চলে যাবে।
—ওহ!
নিশীথ আস্তে করে বললো। এতকিছু বললো তবু তিনি ওর বাসায় যাচ্ছেন এটা বলছেন না মুখে। ও খানিকটা রসিকতা করে শুধালো,
—তা এখানে কি করতে এ সময়?
—হাটতে বেরিয়েছি। তুমি জয়েন করবে?
আয়মান সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে বললেন। তার বিরক্ত মুখ দেখে নিশীথ এবার নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলোনা। হো হো করে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো হঠাৎ! আয়মান সাহেব সেদিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। বাইরে থেকে না দেখালেও মনে মনে খানিকটা আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন বটে! ঠিক কতদিন পর অথবা ঠিক কত বছর পর নিশীথ তার সামনে এভাবে প্রাণখুলে হাসছে তিনি মনে করতে পারলেন না! এ দৃশ্য যেন তার সামনে ঘটা বিরল।
আয়মান সাহেবের বিস্ময়মাখা চাহনি উপলব্ধি করে নিজেকে সামলে নেয়। মুখ ঘুরিয়ে বিদ্রুপের সহিত বলে,
—হাটতে বেরোলে কেউ মিষ্টি আর ফল নিয়ে বের হয় বুঝি? সোজাসাপটা বললেই পারেন কই যাচ্ছিলেন!
আয়মান সাহেব এবার বিরক্তির চরম শিখায় পৌছে গেলেন। তার ছেলে ঠিক তার মতোই নাছোড়বান্দা! তার মুখ থেকেই স্বীকার করিয়ে ছাড়বে ওর বাসায় যাচ্ছিলেন। এ রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আর তর্কে এগোতে আয়মান সাহেবের দেহ সায় দিলোনা। তিনি হার মেনে বললেন,
—তোমার বাসায়ই যাচ্ছিলাম! খুশি এখন? রোদের মধ্যে আর কথা না বাড়িয়ে এখন চলো তাড়াতাড়ি!
নিশীথ এবার সরাসরি তাকিয়ে দেখলো বাপের চেহারা। ওর মায়া হলো। ও আর কথা না বাড়িয়ে বললো,
—নিয়ে যাচ্ছি। আসুন আমার সাথে!
নিশীথের বাসার সিড়িতে উঠার মাঝেই দোলার কল এলো ওর ফোনে। নিশীথ ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে দোলা বলছে,
—কই আপনি? সেই কখন বেরিয়েছেন, এতক্ষণ লাগছে কেন? মা বারবার আপনার কথা জিজ্ঞেস করছেন। প্লিজ তাড়াতাড়ি আসুন। আমার ভালো লাগছেনা!
—আমি বাসার সিড়িতে। মাকে বলো চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি শিওর দরজা খুলতেই তোমার মন অটোমেটিক ভালো হয়ে যাবে!
দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৫৯
নিশীথ ফোন কেটে আয়মান সাহেবের দিকে তাকালো আড়চোখে। আয়মান সাহেব ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলেন, নিশীথ তাকাতেই চোখ ফিরিয়ে নিলেন। এদিকে ফোন হাতে ধরে দোলা ভাবতে লাগলো, নিশীথ হঠাৎ কিসের কথা বলছে? এর মাঝে আসমা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,
—কিরে? কি বললো নিশীথ?
দোলা শাশুড়িকে জবাব দেবে, ঠিক সে মুহুর্তে বাসার কলিংবেল বেজে উঠে!