দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬০ (২)

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬০ (২)
তাসফিয়া হাসান তুরফা

বাসার দরজা খুলে নিশীথকে কিছু বলতে ধরতেই ওর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আয়মান সাহেবের দিকে চোখ গেলো দোলার। বিস্ময়ভাব কাটিয়ে দ্রুত মাথার কাপড় ঠিক করে সালাম দিলো শশুড়কে। আয়মান সাহেব মাথা নেড়ে সালামের জবাব দিতেই দরজার সামনে থেকে সরে গিয়ে জায়গা করে দিয়ে বললো,
—বাবা, প্লিজ আসুন না ভেতরে!
আয়মান সাহেব নিরবে ভেতরে ঢুকে ফল ও মিষ্টির প্যাকেট দোলার হাতে ধরিয়ে দিলেন। দোলা প্যাকেট হাতে নিয়ে লজ্জিত মুখে বললো,

—ছেলের বাড়িতে এসেছেন। এসবের কি দরকার ছিলো?
তবে আয়মান সাহেব জবাব দিলেন না এবারো। তাতে দোলা খানিকটা দমে গেলো। আয়মান সাহেব ভেতরে যেতেই আসমা বেগম ও ইউনুস সাহেব চমকে গেলেন। ইউনুস সাহেব বললেন,
—তুই কখন এলি? বাসায় যখন এত করে বললাম আমাদের সাথে আসতে তখন তো কিছু বললিনা। এখন হঠাৎ একা একা চলে এলি যে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—এখন আসতে ইচ্ছে করলো তাই চলে এলাম। কেন আসতে পারিনা, আব্বা?
ইউনুস সাহেব জবাব দিবেন তার আগেই শরবতের গ্লাস হাতে পারভীন বেগম এলেন সেখানে। তিনি এসেই বললেন,
—কেন পারবেন না, বেয়াইসাহেব? আপনার ছেলের বাসা মানেই তো আপনার বাসা। ফ্যানের নিচে বসুন, শরবত খান! ঠিক বলেছিনা, আংকেল?
ফ্যানের নিচে বসে আয়মান সাহেব খানিকটা স্বস্তি পেলেন। এতক্ষণ গরমে নাজেহাল অবস্থা হচ্ছিলো তার। তাই শরবত পাওয়া মাত্রই আর নাকচ করলেন না। ঢকঢক করে গিলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেন।
এদিকে দোলা টেবিলে খাবারদাবাড় রাখছিলো। পেছন থেকে নিশীথ এসে বললো,

—কেমন লাগলো সারপ্রাইজ? খুশি হয়েছোনা?
—ভীষণ খুশি হয়েছি! আপনি বাবাকে কোথায় পেলেন বলুন তো? এ চমৎকার কিভাবে হলো?
—সবাই গেলে বলছি। এখন আপাতত সবাইকে খাবার সার্ভ করো। তিনটে বাজছে প্রায়!
—হ্যাঁ, আপনি গিয়ে বসুন। মা ও কামিনিকে এদিকে পাঠিয়ে দিন। টেবিল রেডি হলেই ডাকছি।
নিশীথ মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। যেতে নিয়ে কি মনে করে যেন থামে। আবার পেছন ঘুরে দোলার কাছে এসে বলে,
—তখন বাবা কথার জবাব দেননি বলে মন খারাপ করোনি তো?

নিশীথের কণ্ঠে দোলা চমকে পেছন ফিরে। নিশীথকে দেখে পুনরায় কাজে মনোযোগ দিয়ে বলে,
—একদম না। বরং বাবা এসেছেন দেখেই আমি খুশি হয়েছি! এসব ছোটখাটো কারণে মন খারাপ করবো কেন? উনি যে আপনার কথার মান রেখে এখানে এসেছেন, এটাই তো বড় কথা!
দোলার জবাবে নিশীথ স্বস্তি পেলো। দ্রুত এসে চোখের পলকে ওর গালে চুমু খেয়ে আবার নিজের জায়গায় সরে গিয়ে বললো,

—এটাই এক্সপেক্ট করেছিলাম তোমার থেকে। আমি তাহলে যাই, মা ও কামিনিকে পাঠাচ্ছি।
নিশীথ যেভাবে ঝড়ের বেগে এসেছিলো ঠিক তেমনি ঝড়ের বেগে চলেও গেলো। দোলা ওর যাওয়া দেখে মাথা নাড়িয়ে হাসলো। কিছুক্ষণের মাঝেই রুম থেকে পারভীন বেগম ও কামিনি বেরিয়ে এলো। তিনজন মিলে ঝটপট টেবিল গুছিয়ে সব রেডি করে তালুকদার পরিবারকে টেবিলে ডাকা হলো!

খাবার টেবিলের পাশেই একটি বড় স্ট্যান্ড ফ্যান সেট করেছে নিশীথ। এখানে মূলত কোনো ফ্যান ছিলোনা। দুজন মানুষ ওরা রুমে বসেই খায় তাই প্রয়োজন পড়েনা। তবে ওর পরিবার আসবে বলেই কাল নিজে গিয়ে এটা কিনে এনেছে নিশীথ। আপাতত এই বড় ফ্যান ঘুরে ঘুরে সবাইকে বাতাস সরবরাহ করছে। দোলা ও পারভীন বেগম সবাইকে খাবার সার্ভ করছিলেন। আসমা বেগম বেয়াইনকে মানা করছিলেন বারবার, তাদের সাথে বসার জন্য অনুরোধ করছিলেন কিন্তু তিনি শুনছিলেন না। তা দেখে নিশীথ নিজ দায়িত্বে শাশুড়িকে বসিয়ে দিলো চেয়ারে। দোলার সাথে ও নিজে খাবার সার্ভ করতে করতে বললো,

—কারও সার্ভ করার প্রয়োজন নেই। সবাই আমাদের বাসায় এসেছেন। আমি আর দোলাই সার্ভ করবো। সবাই প্লিজ খাওয়া শুরু করুন!
আয়মান সাহেব এতক্ষণ চেয়ারে বসে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিশীথের এ বাসা দেখছিলেন। তার ছেলে কেমন জীবনযাপন করতো আর এখন কেমন জীবনযাপন করছে, মনে মনে তার তুলনার ছক কষছিলেন। এমন সময় দোলার কথায় তার ধ্যান ভাঙলো। দোলা জিজ্ঞেস করল,
—গরু দেবো না মুরগি, বাবা?
—গরু।
আয়মান সাহেব ছোট্ট করে উত্তর দিলেন। দোলা খুশি হয়ে তার পাতে বেশ কয়েকটা মাংসের টুকরো তুলে দেবে তখন নিশীথ বললো,

—অতি আবেগে শশুড়ের ক্ষতি করোনা, দোলনচাঁপা।
—মানে?
দোলা চমকে উঠে শুধালো। নিশীথ চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
—তোমার শশুড়ের হাই প্রেসার। তার পাতে বুঝেশুনে মাংস দিও।
দোলা চারটা টুকরো দিয়ে আরেকটা দিতে ধরছিলো এমন সময় নিশীথের কথা শুনে ওর হাত থেমে গেলো। আয়মান সাহেবের দিকে তাকাতেই উনি লক্ষ্য করলেন দোলার চাহনি, ওকে বললেন,
—হয়েছে, আর লাগবেনা। তুমি বসে পড়ো।

আয়মান সাহেবের কথায় দোলা তো খুশি হলোই, একিসাথে আসমা বেগম ও ইউনুস সাহেবও যেমন অবাক হলেন তেমনি খুশি হলেন। কেননা, তাদের বাসায় এর আগেও বহুবার আয়মান সাহেবকে প্রেসারের কারণে মাংস নিয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন ডাক্তার। পরিমানমতো খেতে বলেছেন। কিন্তু অতি পছন্দ হওয়ায় ডাক্তারের সেই নির্দেশ বরাবর অমান্য করেছেন আয়মান সাহেব। সেই তিনি কিনা আজ ছেলের কথায় থেমে গেলেন?
এ যেন ভারি আশ্চর্যের বিষয়!

খাওয়াদাওয়ার পর্ব চুকে গেলো বেশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে। দোলা ও পারভীন বেগমের রন্ধনকৌশলের প্রশংসা করলো সকলে। খাওয়া শেষে সকলে সফটড্রিংক হাতে রুমে বসে গল্প করছিলো। এতক্ষণে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। দুপুরের কড়া রোদও এখন সিংহভাগ নিভে গেছে। আকাশ ও প্রকৃতি দুটোই স্বাভাবিক। ঘড়ির কাটায় বাজে তখন বেলা সাড়ে চারটা। আয়মান সাহেব সফটড্রিংকস খুব একটা পছন্দ করেন না। বরং দুপুরের খাবারের পর এক কাপ ব্ল্যাক কফিই তার বিশেষ পছন্দের পানাহার। কিন্তু ছেলের অপরিপক্ক সংসারে বেড়াতে এসে সে কথা তিনি বলবেন কি করে? তাই চুপচাপ সফটড্রিংকস এড়িয়ে এখানে বসেছিলেন এতক্ষণ।

মিনিট পাঁচেক হবে তিনি বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। এরই মাঝে বারান্দার দরজা খুলে গেলো। উনি তাকাতেই দেখলেন, দোলা এসেছে। ওকে দেখে আয়মান সাহেব যেমন অবাক হলেন, তার চেয়েও বেশি অবাক হলেন ওর হাতে ধরে রাখা কফির মগ দেখে। তাকে বিস্মিত করে দোলা কফির মগ এগিয়ে দিয়ে বললো,
—মা বললেন আপনি লাঞ্চের পর ব্ল্যাক কফি খান। তাই বানিয়ে এনেছি।
আয়মান সাহেব চোখেমুখে বিস্ময়ভাব ধরে রেখেই চুপচাপ ওর হাত থেকে কফির মগ নিজের হাতে নিলেন। দোলা চলে যেতে নিয়ে থেমে গেলো, পাশ ফিরে বললো,

—আসলে নিশীথেরও এই অভ্যাস। যেদিন ছুটির দিনে বাসায় থাকবেন, লাঞ্চের পর তাকে ব্ল্যাক কফি করে দিতে হয়। এবার বুঝলাম উনি আপনার থেকেই এ স্বভাবটা পেয়েছেন!
দোলা চলে গেলে আয়মান সাহেব কফিতে চুমুক দিলেন। মনে মনে ভাবলেন, নিশীথ তার থেকে শুধু এটাই নয় বরং আরও অনেক স্বভাব পেয়েছে। তার মতো রাগ, ইগো, জমিদারি চালচলন, দেখতেও হয়েছে তার মতো। কিন্তু এত এত মিল থাকা স্বত্ত্বেও যেটা তাকে ও নিশীথকে আলাদা করে তা হলো তাদের মানসিকতা! নিশীথ বাকি সবকিছু বাপের মতো পেলেও, শুধু মনটা পেয়েছে ওর মায়ের! আর এটাই যেন ওর মানসিকতা ও ব্যক্তিত্বকে আয়মান সাহেবের থেকে বহুগুণে আলাদা করে দিয়েছে! ওকে একটা ভালো মানুষ বানিয়েছে। নয়তো নিজের ভালোবাসার মানুষের জন্য জীবনের সব সুখ-ঐশ্বর্য ছেড়ে নিশীথ যেভাবে চলে এসেছে, হয়তো আয়মান সাহেব তা কোনোদিন পারতেন না! আচ্ছা, নিশীথ কিভাবে এখানে আছে? ওর কি অসুবিধা হয়না?

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬০

আয়মান সাহেবের মনে প্রশ্ন আসে।
ঠিক সে সময় বারান্দায় দরজা আবার খুলে যাওয়ার শব্দ হয়। আয়মান সাহেব চেয়ে দেখলেন, এবার নিশীথ নিজেই এসেছে বারান্দায়। ওর হাতেও কফির মগ। হয়তো বাবাকে সে এখানে আশা করেনি সেভাবে হুট করে চমকে উঠে আয়মান সাহেবের দিকে তাকালো নিশীথ। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে চুপচাপ এসে তার পাশে দাঁড়ালো। যেন কিছু হয়নি সেভাবেই আকাশের দিক তাকিয়ে কফির মগে চুমুক দিলো। আয়মান সাহেব কিছুক্ষণ আড়চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর মনের প্রশ্ন মনে না রেখে নিরবতা ভেঙে ছেলেকে প্রশ্ন করলেন,
—কিভাবে আছো এখানে? তোমার এখানে কষ্ট হয়না?

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬১