দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬১ (২)
তাসফিয়া হাসান তুরফা
রাতের বেলা নিশীথ রুম অন্ধকার করে জানালার ধারে বসে আছে। আনমনে বহুক্ষণ ধরে একবার মায়ের কথা ভাবছে তো একবার বাবার কথা! আয়মান সাহেব যে এখন এসে এমন একরোখা হয়েছেন আসলে তা না। উনি আরও বহু আগে থেকেই এমন। নিজে যা বুঝবে তাই ঠিক। একবার ক্লাস টেনে থাকতে স্কুলের এক প্রোগ্রামে আয়মান সাহেব যেতে রাজি হলেন ঠিকি কিন্তু আসমা বেগমকে নিয়ে যাওয়া হলোনা। সাথে দুজন গেস্ট এলাউড থাকায় ইউনুস সাহেব ও আয়মান সাহেব গিয়েছিলেন ওর সাথে। ইউনুস সাহেব অবশ্য যেতে চাননি, আসমা বেগমকে যেতে দেওয়ার জন্য কিন্তু নিশীথের পীড়াপীড়িতে পরে তিনি চলে গেলেন বাধ্য হয়ে। নিশীথ আয়মান সাহেবকে মানা করতে চাইলেও আসমা বেগমের কড়া নির্দেশে চুপ থাকে। সেদিন স্কুলের এনুয়াল স্পোর্টস এ নিশীথ ফার্স্ট হওয়ায় কড়তালির ভীড়ে সবাই ওকে নিয়ে গর্ব করছিলো তখনো আয়মান সাহেব চলতি অনুষ্ঠানে ওকে খোটা মেরে বলেছিলেন,
—খেলাধুলায় ফার্স্ট হয়ে কি করবে? এগুলোতে হারজিত ম্যাটার করেনা। পারলে লেখাপড়ায় ফার্স্ট হয়ে দেখাও নিশানের মতো!
সেদিন নিশীথ খুব চটে গিয়েছিলো। বড় ভাই ওর ভীষণ প্রিয় হলেও তার সাথে তুলনার বিষয়টা নিশীথের বরাবর জঘন্য লাগতো। বিশেষ করে যদি সেই তুলনাটা আয়মান সাহেব করতেন তবে! নিশীথ রেগে বলেছিলো,
—এজন্যই আমি চাইনি আপনি আসুন আমার এ প্রোগ্রামে। আপনার জায়গায় মা থাকলে এতক্ষণে ঠিকই আমায় নিয়ে গর্ব করতো, আমার প্রশংসা করতো!
ইউনুস সাহেব আয়মান সাহেবকে ধমকে উঠলে তিনি বিরক্ত মুখে বলেছিলেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—এজন্যই তোমাদের সাথে আমার বনেনা, বাবা! আমি ওর মায়ের মতো সেন্টিমেন্টাল না যে এসব সিলি বিষয় নিয়ে গর্ব করবো! কিসে ভালো করলে ওর ফিউচার ভালো হবে আমি সেটা নিয়েই বলছি!
ইউনুস সাহেব তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন,
—সবাই যে সবকিছুতে ভালো হবে ব্যাপারটা তো তেমন না। নিশানের পড়াশোনা ভাল্লাগে ও ওখানে ভালো করছে। ঠিক তেমনি নিশীথের এক্সট্রা কারিকুলারে আগ্রহ ও ওখানে চ্যাম্পিয়ন।
কিন্তু এ সহজ বিষয়টাও আয়মান সাহেব বুঝতে পারলেন না, সহজ ভাষায় বলা যায় বুঝেও যেন বুঝতে চাইলেন না! তাই সেদিন বাবার কথায় নিশীথের খুশির দিনটাও উদাসী দিনে রুপান্তরিত হয়! আবার আয়মান সাহেব যে শুধু নিশীথের বেলায় এমন তাও না। আসমা বেগমের বেলায় উনি যেন আরও অনেকটা নিষ্পৃহ!
নিশীথ ছোটবেলা থেকেই একটা বিষয় লক্ষ্য করে এসেছে। আয়মান সাহেব কখনোই আর দশটা স্বাভাবিক স্বামীর মতো ওর মায়ের সাথে কখনো মধুর ব্যবহার করেনি। বরং মাঝেমধ্যেই ও বাবাকে মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে দেখতো। কতবার যে আড়ালে মাকে এভাবে চোখ মুছতে দেখেছে তার হিসাব নিশীথের কাছে নেই!
এমনকি কাজের লোকদের সামনেও তা বাদ যেতোনা! ছোট্ট নিশীথ খেয়াল করতো বাবা অফিসে চলে যাওয়ার সময় ও দাদাকে বলে গেলেও কখনো ওর মাকে বলে যেতোনা। অথচ তিনি বাড়ি থেকে বেরোনোর আগ অব্দি ওর মা দরজার কাছে থেকে নড়তেন না! ছোটবেলা থেকেই নিশীথ প্রচন্ড মা-নেওটা হওয়ায় মায়ের প্রতি বাবার এমন অনাদর ওকে পীড়া দিতো। বাবার প্রতি চাপা মনে রোজ একটু করে ক্ষো’ভ পুষতো। কিন্তু আয়মান সাহেব সব বুঝেও যেন বুঝতেন না। কিন্তু তার এমন আচারণের পেছনের কারণ যেন এক রহস্য। বিশেষ করে দাদু যখন বাবাকে রুমে ডাকতো তখন প্রায়ই নিশীথ লুকিয়ে লাগানো দরজার পেছন থেকে তাদের কথা শুনার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বাপ-দাদার তুমুল ঝগড়া ও কথা-কাটাকাটি বাদে আর কিছুই বুঝতে পারেনি সে! তবে এর পেছনে আসলে কি কারণ কে জানে?
নিশীথের ভাবনার মাঝেই ওর নাকে এসে ঠেকলো এক পরিচিত মিষ্টি সুবাস। নিশীথের ব্যক্তিগত দোলনচাঁপার সুবাস! হাসিমুখে পেছন ফিরতেই নিশীথের চোখে পড়লো মাথায় তোয়ালে পেচিয়ে রাখা সতেজ দোলনচাঁপাকে। ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সদ্য গোসল সেড়ে বেরিয়েছে। নিশীথ খেয়াল করেছে যখনি দোলনচাঁপা গোসল করে বেরোয় ওর শরীর থেকে এই মিষ্টি সুবাস বেরোয়। এ ঘ্রাণ নিশীথের ভীষণ পছন্দের! ওর পা নিজ হতেই এগিয়ে যায়। দোলার ভেজা পাতলা শরীরে কাপড় এটেসেটে লেগে আছে। পিঠের দিকে কামিজ কিছুটা ভিজেও গেছে। নিশীথ তা লক্ষ্য করে এক টানে ওর চুল থেকে তোয়ালে টেনে নেয়। মুহুর্তেই দোলার ভেজা চুল কোমড় অব্দি ছড়িয়ে পড়ে! নিশীথ খেয়াল করে চুলের নিচ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। তাতে দোলার কোমড়ের কাছেও অনেকটা অংশ কামিজের ভিজে যাচ্ছে। মেয়েটা তোয়ালে নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে বলে,
—কি করলেন এটা? পুরো গা ভিজে যাচ্ছে তো। দেন চুল মুছে নেই!
দোলা হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেও নিশীথ তোয়ালে দেয়না। বরং হাতটা উপরে তুলে মুচকি হেসে চেয়ে রয় ওর দিকে! দোলা তা লক্ষ্য করে মুখ ফুলিয়ে বলে,
—আমি এদিকে ভিজে যাচ্ছি আর আপনার মজা লাগছে? হঠাৎ এমন দুষ্টুমি করছেন কেন হুম?
—বউয়ের সাথে দুষ্টুমি না করলে আর কার সাথে করবো বলো? অফিসে তো সুন্দর কলিগও নেই যে ওর সাথে কর…
নিশীথ কথা শেষ করতে পারেনা তার আগেই দোলা তীক্ষ্ণ চোখে তর্জনী উঁচিয়ে বলে,
—খবরদার! ওসব করার চিন্তাও মনে আনবেন না বলে দিচ্ছি।
দোলাকে রাগতে দেখে নিশীথ ঠোঁট এলিয়ে হাসে। হাসির দমকে ওর বুক কেপে উঠে! দোলা বিরক্ত হয়ে সরে যেতে ধরলে নিশীথ ওর কোমড় জড়িয়ে থামিয়ে দেয়। ভ্রু উচিয়ে বলে,
—নিশীথের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া এতই সোজা বুঝি?
দোলা মনে মনে হাসলেও ওর সামনে মুখটা গম্ভীর করে রেখে বলে,
—ভীষণ সোজা! চাইলেও সরে যাওয়া যাবে!
দোলার কথা শেষ হতেই ওর ঠোঁটে কামড় দেয় নিশীথ। লজ্জায় বিস্ময়ে দোলা ঠোঁট চেপে ধরে দু’হাতে! নিশীথ তখনো রাগী চোখে দোলার দিকে তাকিয়ে আছে। অথচ একটু আগের করা কান্ডে ব্যাথায় দোলার চোখে প্রায় পানি এসে গেছে! ও ছলছল চোখে নিশীথের থেকে সরে যায়। নিশীথের হাত থেকে তোয়ালে কেড়ে নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বিড়বিড় করে বলে,
—নিজে যত ইচ্ছা মজা করবে তাতে কিছু নয় আর আমি সামান্য মজা করলেও এমন করবে। এভাবে কি থাকা যায়?
এতক্ষণ গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকলেও এবার দোলার চাপাকণ্ঠের গুঞ্জন কানে আসতে নিশীথের মন নরম হয়। ও ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে দোলার পেছন দাঁড়ায়। দোলা তা লক্ষ্য করেও যেন করেনা এমনভাবে মাথা মুছতে থাকে। নিশীথ পেছন থেকে হাত দিয়ে ওর হাত থামিয়ে দেয়। নিজের হাতে তোয়ালে নিয়ে এবার নিজ থেকেই দোলার চুল মুছে দিতে দিতে বলে,
—হ্যাঁ, এভাবেও থাকা যায়। আর কেউ না থাকলেও তোমায় থাকতেই হবে।
দোলা চুপচাপ মাথা নত করে নিশীথের কথা শুনে। ওর চুল মুছে দেওয়া শেষ হলে নিশীথ তোয়ালে ছুড়ে মারে এক কোণে। দোলা রুষ্ট চোখে বলে,
—তোয়ালে ছুড়লেন কেন ওভাবে? এগুলো কেমন স্বভাব, নিশীথ?
—শুসস!!
নিশীথ দোলাকে থামিয়ে দেয়। দোলা মুখ খুলতে চাইলেও পরবর্তীতে নিশীথের করা কাণ্ডে মুখ খোলার মতো পরিস্থিতিতে থাকেনা। ওর ভেজা ঘাড়ে নিশীথের উষ্ণ ঠোঁট বিচরিত হয়। দোলা ভারি কণ্ঠে বলে,
—ক,কি করছেন?
—বুঝতে পারছোনা? নাকি আরও ভালোভাবে বুঝিয়ে দেবো?
নিশীথ চুমুর মাঝে শুধায়! দোলা লজ্জায় চুপসে যায়। নিশীথ অধৈর্য কণ্ঠে বলে,
—বাবা কেন আমাদের মেনে নিতে পারছেনা, দোলনচাঁপা? ভালোবাসা কি এতোই খারাপ?
—কিছু মানুষের ভালোবাসা বুঝতে সময় লাগে, নিশীথ। হয়তো বাবারও এজন্য লাগছে! আপনি চিন্তা করবেন না, উনি জলদিই আমাদের মেনে নিবে। সব ঠিক হয়ে যাবে!
—সেদিন কবে আসবে, দোলনচাঁপা? আমার যে আর তর সইছেনা! আমার কি ইচ্ছে করছে জানো?
—কি?
দোলা শুধায়। নিশীথ কিছুক্ষণ চুপ থেকে দোলাকে নিজের দিক ফেরায়। ওর গালে হাত রেখে হঠাৎ দুষ্টু হেসে বলে,
—আমার মন চাচ্ছে আমরা সিনেমার নায়ক-নায়িকার মতো বাচ্চা নিয়ে তোমার শশুড়বাসায় যাই। নাতিপুতি দেখলে গলে যেয়ে নির্ঘাত মেনে নেবে!
নিশীথের কথায় দোলার বিষম খাওয়ার যোগাড়! এ কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলছে সে? কিছু খেয়েটেয়ে এসেছে নাকি বাইরে থেকে?
দোলার নিরবতার মাঝেই নিশীথ ওকে ঝাকিয়ে বলে,
দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬১
—কি হলো? বল্লেনা যে আমার আইডিয়াটা কেমন?
নিশীথের প্রশ্নে দোলা অতীষ্ঠ ভংগিতে মাথা নেড়ে চলে যেতে নেয়। কিন্তু পেছন থেকে নিশীথ আচমকা ওকে কোলে তুলে বলে,
—ইচ্ছে যখন হয়েছে কিছু তো করতেই হবে। দেখা যাক প্ল্যান কতদূর এগোয়!
দোলা হাত পা ছাড়ানোর উদ্দেশ্যে বলে,
—এই আপনি চুপ করবে…
কিন্তু বেচারির কথা ওর কণ্ঠনালিতেই সীমাবদ্ধ থাকে। দু দেয়ালের মাঝে শোনা যায় ওদের দুজনের চাপাকণ্ঠের হাসির ঝংকার!