দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৯ (২)
তাসফিয়া হাসান তুরফা
নিশীথের বাসার সামনে গাড়ি এনে আজকের মতোন ওদের গ্যারেজে গাড়ি পার্ক করে নিশীথ মা ও দোলার উদ্দেশ্যে বললো,
—মা তুমি দোলার সাথে উপরে যাও। ওর কাছে চাবি আছে। আমি ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে আসছি।
রাত হয়ে যাওয়ায় আসমা বেগমও আর কিছু বললেন না। দোলার সাথে উপরে চলে গেলেন। নিশীথ বুঝলো এখন ভাইকে যতই ডাকা হোক না কেন ও পুরোপুরি উঠবে না, তাই নিশান অর্ধচেতনা ফিরে পেতেই ওকে ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে তিনতলা বেয়ে নিজের বাসায় উঠলো। মা বাথরুমে থাকতে থাকতেই নিশানকে গেস্টরুমের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওর জুতা খুলে নিশীথ দরজা লাগিয়ে রুম থেকে বের হলো। আসমা বেগম এসব না দেখলেও সবকিছু লক্ষ্য করলো দোলনচাঁপা। নিশীথ রুমে আসতেই দোলা বললো,
—আমার কিছু প্রশ্ন ছিলো
নিশীথ বেশ বুঝলো দোলা কি জিজ্ঞেস করতে চাইছে তাই ও মাথা নেড়ে বললো,
—সবই শুনবো, বলবো। ফ্রেশ হয়ে আসি আগে?
দোলা মাথা নাড়লো। নিশীথ বাথরুমে ঢুকতেই আসমা বেগম ওদের রুমে এলেন। দোলাকে বললেন,
—নিশান দেখি বাসায় ঢুকতেই আবারো ঘুমিয়ে গেছে। এটা কোনো কথা? ভাইয়ের বাসায় প্রথমবার এলো অথচ একটু জেগে গল্প করা তো দূরের কথা ঘোড়ার মতো ঘুমোচ্ছে পড়ে পড়ে। বিদেশ থেকে আসার পর থেকে কি যে হয়েছে আমার বড় ছেলেটার!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দোলা কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেলো। ভাবলো, নিশীথ যেহেতু মাকে কিছু না বলে চুপচাপ নিশানকে নিয়ে এলো তাহলে নিশ্চয়ই ও চায়না আপাতত মা এ ব্যাপারে জানুক। এটুকু বুদ্ধি দোলার আছে। আর বউ হিসেবে ও নিজের স্বামীর সিদ্ধান্তকে সম্মান করে। তাই দোলা ঠিক করলো নিশীথের সাথে কথা না হওয়া অব্দি ও মাকে কিছুই বলবেনা। এখন তো ও নিজেও সবকিছু জানেনা তাই চুপ থাকাটাই শ্রেয়! দোলা বললো,
—ভাইয়া জেগে থাকতে চাইছিলো, মা। কিন্তু আপনার ছোটছেলেই মানা করলো। উনি বললেন ভাইয়া তোমার জেটল্যাগ হচ্ছে এখন জোর করে জেগে থাকলে শরীর খারাপ করবে। তাই এখন তুমি ঘুমিয়ে পড়। কাল সকালে তো আছোই আমরা গল্প করবো!
দোলার কথায় আসমা বেগম আর কিছু ভাবলেন না। নিশীথের আচরণে একটু সন্দেহ হলেও দোলাকে তিনি ষোলো আনা ভরসা করেন। দোলা যখন বলেছে তার মানে ও সত্যিই বলেছে তাই তিনি আর বেশি না ভেবে বললেন,
—আচ্ছা, মা। তুই যখন বলছিস তাহলে তাই হবে। আমিও যাই তবে শুয়ে পড়ি। খেয়ে উঠে শরীর ছেড়ে দিয়েছে।
—হ্যাঁ, মা আপনি শুয়ে পড়েন। কাল সকালে কথা হবে
দোলা মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বললো। নিশীথের জন্য ওকে মায়ের সাথে মিথ্যে বলতে হলো, তিনি কত বিশ্বাস করেন ওকে! দোলার মন খারাপ হলো। এরই মাঝে ভেজা চুল মুছতে মুছতে নিশীথ বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। দোলা ওর দিকে কড়া একটা লুক দিয়ে কোমড়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়তমার চাহনি দেখে নিশীথ সুন্দর হাসি দিলো। ওর কাছে এসে মাথা নেড়ে এলোমেলো চুলের পানি ঝাড়লো দোলার মুখের উপর। ঠিক সেই সময় আচমকা কারেন্ট গেলো। অন্ধকার রুমে পর্দার ফাঁকে দিয়ে চাঁদের আলো প্রবেশ করলো, আলোর কণাগুলো সবার প্রথম ছুয়ে দিলো নিশীথের দোলনচাঁপাকে। ওই মিহি আলোতে দোলার চেহারায় পড়ে থাকা কয়েকটা পানির ফোটা মুক্তার ন্যায় চকচক করলো। এ মুহুর্তে দোলাকে দেখে নিশীথের মনে হলো ওর সামনে সদ্য প্রস্ফুটিত দোলনচাঁপা ফুল ফুটে আছে! নিশীথ হাত বাড়িয়ে দোলাকে কাছে টানে। ওর হাত দোলার কোমড়ে আর দোলার হাত ওর বুকে আছড়ে পড়ে! নিশীথ ঠোঁট এগিয়ে দোলার মুখ থেকে পানির ফোটা শুষে নেয়। দোলা চোখ বুজে মুহুর্ত অনুভব করে।
কিছুক্ষণের জন্য এ আবছা অন্ধকারে দুজন সব ভুলে একটা ঘোরের মাঝে চলে যায়। আর সেই সময় মুহুর্তের অনুভূতি নষ্ট করে দিতে নিষ্ঠুর কারেন্টের আবির্ভাব হয়! হঠাৎ আলো জ্বলে উঠায় দুজনেরই চোখে লাগে। ওরা চোখ বুজে কিছুক্ষণ আলোতে সয়ে যেতে সময় নেয়। দোলা সরে যেতে নিলে নিশীথ বাধা দেয়। ওকে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। দোলাও ওকে জড়িয়ে ধরে থাকে অনেকক্ষণ। হঠাৎ দোলার মনে পড়ে ও নিশীথকে কি জিজ্ঞেস করতে চাইছিলো। তাই ওর বুক থেকে মাথা তুলে বলে,
—ভাইয়া নেশা করেছিলো তাইনা?
নিশীথ চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে ছিলো। নিশানের কথা কানে আসতেই চোখ আপনা হতেই খুলে যায়। ওর মনে পড়ে সবকিছু। এতক্ষণ দোলাকে বুকে পেয়ে যেন জগতসংসার ভুলতে বসেছিলো ও! এখন আস্তে-ধীরে সব মনে পড়ে যায়। নিশীথ বলে,
—তুমি বুঝেছো?
দোলা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
—শুধু আমি?
—মাও বুঝে ফেলেছে নাকি? শি’ট!
নিশীথ আহত কন্ঠে শুধায়। দোলার সন্দেহ এবার পরিষ্কার হয়ে যায়। ও বুঝে নিশানের এ অবস্থা লুকোনোর জন্যই নিশীথ ওমন করছিলো। ও বলে,
—মা এখনো বুঝেনি। তবে সন্দেহ করছিলো ঠিকি আপনার উপর। বুঝেছিলো কিছু লুকোচ্ছিলেন
আমার কাছে এসেছিলেন জানতে, আমি বুঝিয়ে সুঝিয়ে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছি।
নিশীথ চমৎকৃত হয় বউয়ের কথায়। মুগ্ধ হয়ে বলে,
—মা তোমায় অনেক ভালোবাসে, দোলনচাঁপা। অনেক বিশ্বাস করে তোমাকে।
—জানি। এজন্যই মায়ের সাথে মিথ্যা বলতে কষ্ট হয় আমার। নেহাৎ আপনার জন্য না হলে আমি বলতাম না
—আমি জানি, দোলনচাঁপা। আমিও মা-র থেকে কিছু লুকানো পছন্দ করিনা। তবে আগে আমার ভাইয়ার সাথে কথা বলতে হবে। কারণ আমি এখনো জানিনা ভাইয়ার এসব বদ অভ্যাস কবে থেকে হলো, কেনই বা হলো! সেসব বিস্তা না জেনে মাকে বলা ঠিক হবেনা। মা ছোটবেলা থেকেই আমাদের সব স্বাধীনতা দিলেও কিছু ব্যাপারে ভীষণ স্ট্রিক্ট। মদ্যপান তার মধ্যে অন্যতম। এজন্য আমি এত ল্যাভিশ লাইফস্টাইলে থাকলেও আমার মাঝে কখনো এ বদ অভ্যাস ছিলোনা। ইভেন বাবা ও দাদুও এসবের বিপক্ষে। আমি শিওর ভাইয়ার ক্লাবে যাওয়া আসার ব্যাপারে জানলেও ও যে নেশা শুরু করেছে এটা বাবা জানেনা।
—তাহলে কাল সকালে ভাইয়া উঠলে জিজ্ঞেস করে শুনে নিয়েন কাহিনি কি
—তা তো শুনবোই। যদিও আমি জানি পুরোটা প্রথমেই বলতে চাবেনা। ভাইয়া অনেক চাপা, ওকে অনেক গুতিয়ে পেটের কথা বের করতে হয়! ও কি করে না করে ও নিজে না বলা অব্দি কারও সাধ্যি নেই সেটা জানার।
—আপনারই ভাই। কিভাবে তার থেকে কথা বের করে নিতে হয় আপনাকে নিশ্চয়ই বলে দিতে হবেনা! বুদ্ধি তো আর কম নেই আপনার!
নিশীথ হো হো করে হাসে দোলার কথায়। মাঝেমাঝে মেয়েটা এমন করে কথা বলে শুনে না হেসে থাকা যায়না! ও এগিয়ে এসে দোলাকে ধরতে গেলেই মেয়েটা পেছনে সরে যায়। মুখ ভেংচি দিয়ে বলে,
দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৯
—একদম কাছে আসবেন না। আপনার জন্য আমাকে মিথ্যা বলতে হলো। আমার গিলটি ফিল হচ্ছে!
—গিলটি তো আমারও লাগছে, সোনা। কিন্তু এখন কি করবো বলো পরিস্থিতি কেমন তুমি তো জানোই। শুধু একবার ভাইয়ের থেকে জেনে নেই এরপর আমি নিজেই মাকে জানাবো! ততদিন না হয় মা-র থেকে ব্যাপারটা গোপনই থাকুক।
নিশীথের কথায় দোলা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। এদিকে ওরা জানলোনা, যার থেকে ব্যাপারটা লুকোনোর এত আয়োজন হচ্ছিলো উনি সবটাই জেনে গেছেন!