দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৯ (৩)

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৯ (৩)
তাসফিয়া হাসান তুরফা

নিশীথ-দোলার রুমে ফোন রেখে চলে গিয়েছিলেন আসমা বেগম। হঠাৎ কারেন্ট চলে যাওয়ায় আলো জ্বালাতে অন্ধকারে হাতড়ে ওদের রুমে এসেছিলেন ফোন ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু রুমের কাছে আসা মাত্রই উনার কানে যায় নিশীথকে করা দোলার প্রশ্ন, “নিশান মাতাল ছিলো কিনা”। এরপর থেকেই কৌতুহল এর বশে উনি দরজার কাছেই থেমে যান। নিশীথ যখন হ্যাঁ বললো তখন মূলত আসমা অতটা অবাক হয়নি। কেননা নিশানকে দেখার পর থেকেই এই সন্দেহ তার শুরু থেকেই হচ্ছিলো। দোলা ঠিকি বলেছে, শুধু তিনি কেন যেকেউ ওকে দেখলেই বুঝবে ও কেমন অবস্থায় ছিলো। কিন্তু নিশীথের ব্যাপারটা চেপে যাওয়ায় তিনিও ইচ্ছা করেই ওকে জিজ্ঞেস করেননি। এখন দেখলেন নিশীথ নিজেও ব্যাপারটা জানেনা তাই উনার মনের ভার একটু কমলো। যাক ছেলে তবে জানেনা দেখেই তার থেকে লুকিয়েছে, জানলে নিজেই তাকে জানাবে বলছে। সুতরাং এ ব্যাপারে এখন প্রশ্ন করে নিশীথকে বিব্রত না করাই ভালো। এজন্য ওদের স্বামী-স্ত্রীর কথোপকথন শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি নিরবে অপেক্ষা করলেন এবং যখন ওরা থামলো তখন আস্তে করে দরজায় টোকা দিলেন। নিশীথ দোলা দুজনেজ দরজার দিকে তাকাতে আসমা বেগম রুমে প্রবেশ করলেন। মাকে দেখে নিশীথ এর মনে একটু ভয় ঢুকলো। ও ভাবলো মা আবার ওদের কথা কিছু শুনেনি তো?
নিশীথ ইতস্তত মুখে শুধালো,

—কখন এলে, মা?
—মাত্র এলাম। বিছানায় শুয়ে দেখি ফোন তোদের রুমেই রেখে চলে এসেছি তাই নিতে আসলাম।
নিশীথ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো,
—ওহ। শুয়েই যখন পড়েছিলো আবার উঠে এলে কেন? একটা আওয়াজ দিলেই হতো। আমি বা দোলা কেউ দিয়ে আসতাম তোমার রুমে।
—তোরা কি সারাদিন কষ্ট কম করিস যে এই সামান্য কাজের জন্য আওয়াজ দিবো? পাগল ছেলে আমার! ঘুমা তোরা এখন। অনেক রাত হয়েছে।
আসমা চলে যেতেই নিশীথ-দোলা স্বস্তি পায়। যাক তবে মা কোনো সন্দেহ করেনি ভুলেও গেছে নিশানের ব্যাপারে। এখন সকাল হলে নিশানের সাথে কথা বলা যাবে!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পরদিন সকালে নিশানের ঘুম ভাংলো প্রচণ্ড মাথাব্যথা নিয়ে। ব্যাথার দরুন দু হাতে মাথা চেপে বিছানা থেকে উঠে বসলো সে। চোখ খুলতেই মুখের সামনে একটা গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে থাকা দোলনচাঁপাকে দেখে হকচকিয়ে গেলো সে! ওকে ভড়কে যেতে দেখে দোলা বললো,
—ভাইয়া আপনি ঠিক আছেন?
নিশান আশেপাশে চেয়ে দেখলো। এটা কার রুম? ওদের বাসায় তো এমন কোনো রুম নেই। নাকি এতবছর বিদেশ থেকে নিজেদের বাসার রুম চিনতে পারছেনা সে? নিশানের ভাবনার মাঝে দোলা আবারও কথা বললে ও তাকায় মেয়েটার দিকে। বোকার মতো প্রশ্ন করে,
—আমি কোথায়?
—আপনার ভাইয়ের বাসায়!

দোলা হেসে বলে। নিশান এবার আরও চমকে যায়। ও নিশীথের বাসায় কি করে এলো? ওর যতদূর মনে পড়ে ও ক্লাবে গিয়েছিল। ওখানে ড্রিংক করছিলো। এরপর কি হয়েছে ওর মনে আর পড়ছেনা। সবকিছু মনে করার চেষ্টা করতেই নিশানের মাথায় চাপ পড়ে। দুহাতে মাথা চেপে ধরতেই দোলা বলে,
—ভাইয়া, এটা লেবুপানি খেয়ে নিন। মাথাব্যথা সাড়বে দেখবেন ভাল্লাগছে।
নিশান লেবুপানি খেয়ে গ্লাস ফেরত দিতেই দোলা চলে যায়। নিশান ওকে ডাকে। দোলা পেছন ফিরতেই শুধায়,
—নিশীত কই?
—বাসায়ই আছে। পাঠাচ্ছি আপনার কাছে!
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে নিশান রুম থেকে বের হতে নেয় আর তখনি নিশীথ রুমে ঢুকে। ওকে দেখতেই নিশান বলে,

—আমি এখানে কিভাবে আসলাম, নিশীথ?
—সব প্রশ্নের উত্তর পাবে এবং কিছু প্রশ্নের উত্তর তুমি নিজেও দিবে। ঘুম থেকে উঠেছো, আগে ফ্রেশ হয়ে এসো যাও! বাথরুমে গেলেই সব পাবে।
নিশান বুঝলো নিশীথ কি জিজ্ঞেস করতে চায় ওর কাছে তাই আর কথা বাড়ালোনা। ফ্রেশ হয়ে এসে নিশান দরজা লাগাতে লাগাতে বললো,
—এ বাসা তো বেশ ছোট রে, নিশীথ। আর বাথরুমের কথা কি বলবো ঢুকতেই মনে হলো বের হওয়ার জায়গা নাই। এরকম বাসায় কিভাবে আছিস? বড় বাসা নে! আমাদের তো এমনভাবে থাকার অভ্যাস নাই। তুই কি করে আছিস! এভাবে থাকা যায়?
নিশীথ ইষত হাসলো ভাইয়ের কথায়। বললো,
—যেই প্রবাদটা লিখেছে “মানুষ অভ্যাসের দাস” সে কিন্তু কথাটা ভুল লিখেছে জনো ভাইয়া?
—মানে?

—মানে এই যে তুমি বললে আমাদের এভাবে থাকার অভ্যেস নেই কিন্তু দেখো আমি ঠিকি থাকতে পারছি। প্রথম প্রথম আমারও তোমার মতোই লাগতো তবে এখন থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে গেছে!
—কি দরকার এওন অভ্যাস করার? একটা ভালো বাসা নিলে কি এমন হবে তোর?
—তেমন কিছুই হবেনা। তবে আমি দোলার সাথে থাকতে থাকতে অকারণে স্পেন্ড করা বন্ধ করে দিয়েছি। তুমিই ভেবে দেখো, আমরা দুজন মানুষ এর সংসার। বড় বাসা নিয়ে আমরা কিইবা করবো? শুধু আমার বেতনের টাকায় সংসার চলছে। এমন না যে আমি খারাপ বেতন পাই তবু আলাদা যখন হয়েছি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য টাকা সঞ্চয় করা শুরু করেছি। এতে এখন একটু কষ্ট হলেও ভবিষ্যতে যাতে সুখে থাকতে পারি সেই ব্যবস্থা অন্তত হবে! তুমি নিজের কথাই ভাবো, কানাডায় যখন প্রথম গিয়েছিলে তখন কি তুমিও এভাবে সঞ্চয় করে চলোনি যাতে ভবিষ্যতে ভালো দিন কাটাতে পারো?
নিশান এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে নিশীথের কথা শুনলেও এখন নিশীথের প্রশ্নে তার ভ্র‍ু কুচকে গেলো। প্রশ্ন করলো,
—আমার কানাডায় থাকার সাথে তুই ঢাকায় থাকার তুলনা দিচ্ছিস? এটলিস্ট ওখানকার লাইফস্টাইল আর এখানকার লাইফস্টাইলের তফাৎ তো বুঝিস!
—তুমি আমার কথার সারমর্ম বুঝলেনা। আমি লাইফস্টাইলের কথা বলিনি। স্ট্রাটেজির কথা বলেছি।
—তা বুঝলাম। তবে কানাডায় কষ্ট করে আমি সাকসেসফুল লাইফ পেয়েছি। কিন্তু তুই যে এত কাহিনি করে দোলাকে বিয়ে করে আবারও এত কষ্ট করছিস। এসবের বিনিময়ে তুই কি পাবি? এই সম্পর্কে থেকে তোর লাভ তো জিরো!

নিশীথ এবার আবারো হাসলো। এখন নিশানের কথা শুনে ওর মনে হচ্ছে যেন ও ভাইয়ের সাথে নয় বরং বাবার সাথে কথা বলছে! ওর ভাই যে পুরোপুরি ওর বাবার উপর গেছে নিশীথের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিলোনা আজকে সেটা আবারও নিশান প্রমান করলো। ওকে হাসতে দেখে নিশান বিরক্ত হয়ে বললো,
—হাসছিস কেন? প্রেমে পড়ে তোর মাথা আসলেই গেছে দেখছি। লজিকাল কথা শুনেও হাসি পাচ্ছে তোর
—হাসছি কারণ আছে। তুমি হাসার মতো কথা বললে কি করবো? সম্পর্ক কি কেউ লাভ-লস দেখে করে, ভাইয়া? প্রেম ভালোবাসা কি মানুষ ভেবেচিন্তে করে?
—করতেই পারে। আমি কানাডায় প্রেম করেছি যে মেয়ের সাথে তুই জানিস ওর কাছে কানাডার সিটিজেনশিপ আছে। অর্থাৎ ওকে বিয়ে করলে আমি সরাসরি কানাডায় থাকার গ্রিনকার্ড পাবো। আমার লাইফ সেট হয়ে যাবে!
নিশীথের প্রশ্নে গটগট করে নিশান ওর প্রেমের কথা বলে দিলো। নিশীথ একটু অবাক হলো। ও জানতো নিশান প্রেম করে, তবে ও যে এতকিছু ভেবেচিন্তে প্রেম করছে সেটা জানতোনা। নিশীথ ধাতস্থ হয়ে প্রশ্ন করে,

—তুমি সত্যিই এতকিছু ভেবে প্রেম করেছো?
—তা নয়তো কি। আমি তোর মতো বোকা নাকি!
নিশান ভাব নিয়ে বলে। নিশীথ মাথা নেড়ে বলে,
—তা আর কি কি চালাকি করেছো শুনি?
—তোকে কেন বলবো?
নিশান বাকা হেসে বলে। বিনিময়ে নিশীথ নিজেও হেসে বলে,
—তুমি না বললে তোমার রাত-বিরেতে ক্লাবে যেয়ে ড্রাংক হয়ে বাসায় আসা বন্ধ হয়ে যাবে এজন্য!
ভাইয়ের কথায় নিশান থতমত খেয়ে যায়। ভোতা মুখে বলে,
—কাল রাতে তুই-ই আমায় ক্লাব থেকে এখানে এনেছিস তাইনা?
—হুম
—বাসায় তো মা আছে। মা দেখেছে আমাকে ওই অবস্থায়?
—দেখলেও বা কি? তোমার কি কিছু যায় আসে নাকি?
নিশীথ গম্ভীর মুখে বলে। নিশান বিরক্তিসূচক শব্দ করে বলে,
—এমন করিস না তো, নিশীথ। তাড়াতাড়ি বল কাল রাতে কি হয়েছে!
—এমন কিছু করেছো তুমি তোমার উপর কেস হয়ে গেছে। পুলিশ ধরেছিলো তোমায়। আমি পুলিশ স্টেশন থেকে তোমায় উদ্ধার করে এনেছি।
ভাইয়ের মুখ থেকে সত্যি কথা বের করতে নিশীথ ইচ্ছে করে মিথ্যা বলে। ওর কথা শুনে নিশান আঁতকে উঠে! বসা থেকে উঠে বসে বলে,

—হোয়াট ডু ইউ মিন? কি এমন করেছি নেশার বশে আমি যে পুলিশ ধরেছিলো? নেশা আমি আগে থেকেই করি। এমন তো হওয়ার কথা না। জলদি বল তো!
—কাম ডাউন, ভাই। আগে আমায় বলো তুমি আমাদের না বলে নেশা করা বাদে আরও কি কি অওয়াজ করেছো? তাহলেই সব বলছি!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৯ (২)

—এটা তো কিছুই না! আমি আরও এমন কিছু করেছি যা জানলে তোরা সবাই আকাশ থেকে পড়বি!
নিশান বিড়বিড়িয়ে বলে। ও ভীষণ আস্তে করদ বল্লেও কথাটা ঠিকি নিশীথের কানে আসে। এতক্ষণ স্বাভাবিক থাকলেও এবার নিশীথের মনে চিন্তা আসে। কি এমন অকাজ করেছে ওর ভাই যা সবার থেকে লুকিয়ে রেখেছে?

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭০