দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭১
তাসফিয়া হাসান তুরফা
খাবার টেবিলে বসে দুই ভাই অনেকটাই নিরব বসে আছে। বিশেষ করে নিশান চুপচাপ খাবার খেয়ে উঠতে নেয় দেখে আসমা বেগম বললেন,
—কি হয়েছে, বাবা? তোর ভালো লাগেনি খাবার?
নিশান মায়ের দিকে তাকায়। সরল মুখে কত আশা নিয়ে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। ও মাকে খুশি রাখতে মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে বলে,
—তুমি বানাবে আর সে খাবার ভালো হবেনা এমন কোনোদিন হয়েছে নাকি, মা?
—তাহলে এমন মনমরা হয়ে বসে আছিস কেন? প্রথমবার ভাইয়ের বাসায় এসেছিস। সবার সাথে কথা তো বলবি নাকি!
নিশান ইতস্তত মুখে ওর সামনের চেয়ারে বসা নিশীথের দিকে তাকায় যে খাবার চিবোনোর মাঝেই ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল। নিশীথ ভাইয়ের অবস্থা বুঝে। মাকে বলে,
—ভাইয়ার নাকি শরীর খারাপ লাগছে, মা। একটু আগে যখন রুমে ডাকতে গেলাম তখন দেখলাম মাথা ধরে বসে আছে। ক’দিন ধরেই শরীর খারাপ নাকি ওর
আসমা বেগমের মুখে চিন্তার ভাজ পড়লো। ভ্রু কুচকে বললেন,
—সেকি! দেশে আসার পর থেকে তোর শরীর খারাপ আর তুই কাউকে না বলে চুপচাপ বসে আছিস? এসব কেমন কথা, নিশান?
—তেমন খারাপ না, মা। তুমি চিন্তা করোনা। নেক্সট উইক তো আমি এমনিতেও কানাডায় ফিরে যাবো তাই এতো প্যারা নিতে চাচ্ছিনা এখন। যে কয়দিন দেশে আছি ভালো থাকতে চাই। কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাইনা।
মাকে কথাগুলো বল্লেও শেষের কথাটা যে নিশান কাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে তা নিশীথ ঠিকি বুঝতে পারে! নিশান উঠে বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—মা, আমার একটা কাজে বেরোতে হবে। নিশীথ একটু আসিস তো আমার সাথে!
নিশীথ মাথা নেড়ে হাত ধুয়ে চললো ভাইয়ের পিছু পিছু। নিশান রেডি হয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার আগে বললো,
—তুই কিন্তু আমাকে এখনো বললিনা কাল রাতে আমি কি করেছি সে ব্যাপারে।
নিশীথ হালকা হাসলো। তা দেখে নিশান সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললো,
—কি? হাসছিস কেন?
নিশীথ আবারো হেসে মাথা নাড়লো। নিশান ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ চেয়ে হঠাৎ চোখ বড় করে শুধালো,
—তুই যা যা বলেছিস তেমন আহামরি কিছুই আমি করিনি, তাইনা?
নিশীথ এবার আরও হেসে উপর-নিচে মাথা নাড়লো। নিশান চোখ মুখ পাকিয়ে রে’গে বললো,
—লজ্জা লাগেনাই ভাইয়ের সাথে এতবড় মিথ্যা কথা বলতে?
—তোমার লজ্জা লাগেনাই ভাইয়ের থেকে এত বড় সত্যি লুকিয়ে রাখতে?
নিশীথ পালটা জবাব দেয়। নিশান কিছু বলতে যেয়েও বলেনা, খানিকক্ষণ ফোসফাস করে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। মাথা চাপড়িয়ে আফসোস এর সুরে বলে,
—আমারই ভুল হয়েছে তোকে সরল মনে বিশ্বাস করতে গেছি। আসলে তুই এমন করবি আমি একেবারেই ভাবিনি।
—ঠিকি বলেছো, ভাইয়া। আমিও কখনো এমন করতাম না কিন্তু তুমি করতে বাধ্য করেছো। বাবা-মার সরল বিশ্বাস ভেঙে জীবনের এত বড় সিদ্ধান্ত যে একাই নিলে এটার প্রভাব কেমন হবে একটাবারও কি মাথায় আসেনি?
—আমার লাইফ নিয়ে আমিই ভালো বুঝবো। তুই তেমন কিছুই জানিস না যে এটা নিয়ে কথা বলতে পারবি। তাই চুপ থাকবি এ ব্যাপারে!
নিশীথ কিছু বলতে যাবে এর মাঝেই নিশানের ফোন বেজে উঠলো। ও ফোনের দিক তাকিয়ে আর কিছু না বলে গটগট করে হেটে চলে গেলো বাসার বাইরে। নিশীথ সেদিকে চেয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
নিশীথ পেছন ফিরতেই যেতেই কেউ ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। ফলে ও আর পেছন ঘুরতে পারলোনা। আগেকার স্থানেই স্থির দাঁড়িয়ে রইলো। বুকে রাখা দোলনচাঁপার হাতের উপর হাত রাখতেই দোলা চিন্তিত সুরে বললো,
—আপনার কি মন খারাপ?
বউয়ের আহ্লাদী প্রশ্নে নিশীথের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। ও এবার পেছন ফিরে দোলাকে সামনে থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—তুমি পাশে থাকতে আমার মন খারাপ হতে পারে?
দোলা বুক থেকে মাথা তুলে নিশীথের চোখের দিক চেয়ে বললো,
—এখন এসব ডায়লোগ রাখুন তো! সত্যি করে বলুন। আপনার মন খারাপ তাইনা?
—কিভাবে বুঝলে?
নিশীথ শুধালো। দোলা লজ্জিত কণ্ঠে বললো,
—আসলে আমি একটু আগে এখানে আসছিলাম তখন আপনার ভাইয়ার কথা-কাটাকাটি হচ্ছিলো। তবে আমি কিন্তু সাথে সাথেই সরে এসেছি। আপনাদের কথা কিছু শুনিনি, এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত হতে পারেন!
দোলার কথায় নিশীথ হেসে বললো,
—এটা তুমি না বল্লেও আমি জানতাম। তোমায় আমি চিনি, দোলনচাঁপা। তুমি কেমন মেয়ে আমি ভালো করেই জানি। তোমার কোন এক্সপ্লেনেশন দিতে হবেনা
এবার দোলা হাসলো নিশীথের কথায়। ওর হাসি দেখে নিশীথ বললো,
—আর তাছাড়াও যদি তুমি শুনেও ফেলতে, আমার কোনো অসুবিধে ছিলোনা। আমি দিনশেষে আর কাউকে কিছু বলি না বলি তোমাকে তো ঠিকি বলবো।
নিশীথের শেষের কথায় দোলার মন ভরে গেলো। দুনিয়ায় প্রতিটা মেয়েই চায় এমন এক জীবনসঙ্গী যে দিনশেষে খুটিনাটি তার সাথেই সবকিছু শেয়ার করবে। তাই নিশীথকে পেয়ে দোলা প্রতিদিন আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে! ওরা রুম থেকে বের হওয়ার আগে নিশীথের হঠাৎ ড্রেসিং টেবিলের সামনে চোখ যায়। ওখানে নিশানের ঘড়ি দেখে ও এগিয়ে যায়। হাতে নিয়ে ঘড়িটা উল্টেপাল্টে দেখে হ্যাঁ এটা নিশানেরই ঘড়ি। কাল রাতে এটাই পড়া ছিলো। আজ ফ্রেশ হওয়ার আগে খুলে রেখেছে বোধহয় এখানে। বের হওয়ার আগে তাড়াহুড়োয় ও নিশীথের সাথে কথা কাটাকাটির মাঝে এটার কথা নির্ঘাত ভুলে ফেলে রেখে গেছে সে! নিশীথ ঘড়িটা নিয়ে পকেটে ঢুকায়। ভাবলো বাসা থেকে বের হলে ও বাসায় যেয়ে এটা রেখে আসবে। এ ফাকে দাদুর সাথে দেখাও করা হবে। নিশানের সাথে আবার কবে দেখা হয় কে জানে! এমনেও ওর উপর যে রেগে আছে!
নিশীথ দুপাশে মাথা নেড়ে ভাবে।
সেদিন সন্ধ্যায় নিশীথ বাবার বাসায় গেলো। ওখানে যেয়ে দেখলো বাবা ও দাদু আছে শুধু। নিশান এখনো বাসায় আসেনি। বাবা তার রুমে ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে আর দাদু এতদিন পর প্রিয়নাতিকে পেয়ে খুশিতে ওকে জড়িয়ে ধরলেন। নিশীথ শুধালো,
—কেমন আছো, দাদু?
—কেমন আর? যেমন রেখে গেছিস তোরা তেমনি আছি।
দাদু উদাস কণ্ঠে জবাব দিলেন। নিশীথ বললো,
— এভাবে বলোনা তো, দাদু। নয়তো আমি…
নিশীথ হঠাৎ থেমে গেলো। ওকে থামতে দেখে দুই চোখে আশার আলো নিয়ে ইউনুস সাহেব শুধালেন,
—নয়তো তুই কি বল? থামলি কেন? বল তুই এ বাসায় চলে আসবি থাকার জন্য!
আয়মান সাহেব মাত্রই বাবার রুমে আসছিলেন কথা বলার জন্য কিন্তু রুমে ঢুকতেই বাপের মুখে নিশীথের ফেরার কথা শুনে চমকে দাঁড়িয়ে যান দরজার কাছে। নিশীথ কিছু বলতে যেতে খেয়াল করে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ওর বাবাকে। তা দেখে দাদুকে বলে,
—তোমাকে রেখে এ বাসা ছাড়ার ইচ্ছে তো আমারও ছিলোনা, দাদু। কেন ছেড়েছি তুমি তো ভালো করেই জানো। সে কথা না হয় থাক! এখন কেন এসেছি বলি, ভাইয়া তো কাল আমার বাসায় ছিলো জানোই। ওর ঘড়ি ফেলে এসেছে আমার ওখানে। ওটাই ফেরত দেওয়ার বাহানায় তোমার সাথে দেখা করতে এলাম!
—দাদার সাথে দেখা করতে আবার বাহানা লাগে রে, বোকা? যখন মন চায় চলে আসবি। নিশান তো এখনো আসেনি বাসায়। সারাদিন কি যে করে বাইরে! যা ঘড়িটা রেখে আয় ওর রুমে।
নিশীথ ঘড়ি রাখতে রুম থেকে বেরোলে আয়মান সাহেব বাবার রুমের ভেতরে ঢুকলেন। বাবাকে জানালেন, তার এক পরিচিত লোক ফোন দিয়েছিলো। নিশানের জন্য এক দারুণ মেয়ের খোঁজ পেয়েছেন নাকি তিনি। বেশ উচ্চ বংশের এবং সুন্দরী মেয়ে। আয়মান সাহেব মেয়ের ছবি দেখতে চেয়েছেন। একবার মেয়েকে পছন্দ হলেই নিশানের সাথে এ বিষয়ে কথা বলবেন। ছেলে দেশে ফিরেছে এর মাঝেই বিয়ে দিয়ে দিতে পারলে হয়ে যায়। ছোটছেলে যেহেতু এমননিতেই মাতব্বরি করে আগে বিয়ে করে ফেলেছে। কিন্তু তার নিশানের বিয়ে অন্তত নিজের পছন্দেই ভালো বংশে দিবেন তিনি।
দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭০
নিশীথ ঘড়ি রেখে দাদুর রুমে ফিরতেই ওর কান আটকালো বাবার শেষের কথায়। সাথে সাথেই ওর মনে পড়ে গেলো নিশানের বিয়ের কথা! ও মনে মনে ভাবলো, যেই ছেলের বিয়ে দেওয়ার জন্য বাপের মনে এত প্রস্তুতি এত আয়োজন, সেই ছেলে যে তাকে না জানিয়েই শুভকাজ সেড়ে ফেলেছে তা জানতে পারলে ওই বাবার কেমন লাগবে?