দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭৭

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭৭
তাসফিয়া হাসান তুরফা

নিশানের মতিগতি এতক্ষণে নিশীথের কাছে পুরোপুরি স্পষ্ট হওয়ায় ওর মাথায় এক বুদ্ধি এলো। বাবার সামনে ভাইকে এক্সপোজ করার জন্য ও ইচ্ছে করে আয়মান সাহেবের উদ্দেশ্যে বললো,
—কোন জমি ভাইয়াকে লিখে দিতে চেয়েছেন আপনি?
—অফিসের দক্ষিণ পাশের যে প্লট আমাদের, ওটা। তোমার তো চেনার কথা।
নিশীথ মাথা নেড়ে বললো,

—আলবত চিনি। কিন্তু আপনি সেটা ভাইয়ার নামে লিখে দিবেন এ কথা তো কোনোদিন বলেননি। সবাই জানতো ওটা তালুকদার ব্রাদার্স গ্রুপের সম্পত্তি। অর্থাৎ আপনার পরে জমিটার মালিকানা ভাইয়া এবং আমি দুইজনেই পাবো। শুধু ভাইয়া একাই নয়!
নিশীথের কথায় নিশান চোখ বড় বড় করে তাকায়। নিশীথ যে কখনো এমন কথা বলবে তাও জমি নিয়ে এটা ও কখনো ভাবেনি। বরং ও ভেবেছিলো যে নিশীথ যেহেতু দোলার জন্য বাসা ছাড়তে পেরেছে তাই এই একটা পৈতৃক সম্পত্তিও ছাড়তে দ্বিধাবোধ করবেনা। এজন্যই ও সুযোগ বুঝে দেশে এসেই বাবার কাছে এ প্রসঙ্গে কথা বলেছিল কিন্তু এখন নিশীথের কথায় ও চিন্তায় পড়ে গেলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অপরদিকে, একি অবস্থা হলো আয়মান সাহেবেরও! উনি ভেবেছিলেন যে এভাবে এ সময় জমির কথা তুললে নিশান হয়তো জমির লোভে পড়ে সত্যি কথা স্বীকার করবে সবার সামনে। কিন্তু তার ছোটছেলে যে এটা নিয়ে তাকে এমন প্রশ্নের সম্মুখীন করবে এটা তার মাথায় আসেনি! আয়মান সাহেব স্মিত গলায় বললেন,
—আমি তোমার কথা বুঝেছি। কিন্তু ওই জমিটা নিশান অনেকদিন আগেই আমার কাছে চেয়েছিলো। তখন তো তুমি এখানে ছিলেনা তাই তোমার সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করা হয়ে উঠেনি!
নিশীথ পাল্টা জবাবে বললো,

—আমি এ বাসায় থাকি কিংবা না থাকি সেটা তো আর আমাকে নিজের হক পাওয়া থেকে বঞ্চিত করতে পারবেনা তাইনা? আপনি মুখে যতই কিছু বলুন না কেন, ওই জমিতে ভাইয়ার যতটুকু অধিকার আছে তার সমান অধিকার আমারও আছে। এবং আমি আমার অধিকার ছাড়বোনা!
এবার নিশান আর নিতে পারলোনা। রাগে ক্রোধে ওর মাথা নষ্ট হয়ে গেলো। চেচিয়ে বললো,
—অধিকারের প্রসঙ্গে যখন আসছিস তখন তো আজ একটা কথা না বলে আমি থাকতে পারছিনা!
—বলো! আমাকে আর কি কি বলা বাকি আছে তোমার, আজ সব শুনি!
নিশীথ শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে। নিশান বলে,
—অধিকার চাইতে হলে সম্পর্ক রক্ষা করতে হয়। কিন্তু তুই কি তা করেছিস?
—কি বলতে চাইছো তুমি?
নিশীথ ভ্রু কুচকায়। নিশান তাচ্ছিল্য ভরে বলে,

—সারাজীবন বাবার সাথে সাপ-নেউলের সম্পর্ক রেখে এখন তুই কোন অধিকারে বাবার থেকে ওই জমি চাইছিস? যেখানে তুই নিজেই বাবার সাথে কোনো ভালো সম্পর্ক রাখিসনা।
আজ নিশানের কথায় নিশীথ সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেলো। ওর আপন ভাই, ওর বড় ভাই ওকে এ ধরনের কথা বলছে? তাও কিনা এভাবে সবার সামনে ওকে অপমান করে? এবার নিশীথের ধৈর্যের বাধ ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো। ও তেজি অথচ ঠান্ডা গলায় বললো,
—তবে তো এখন আমিও তোমায় একটা সুন্দর প্রশ্ন করতে পারি!
—কি?

—তবে কি তুমি এত বছর বাবার সাথে এত ভালো সম্পর্ক এই সম্পত্তির লোভে রেখেছো?
নিশীথের প্রশ্নে নিশান থমকে যায়। ও ঘড়ি দেখে, বেশিক্ষণ ঝগড়া করে লাভ নেই। নিশীথ কেও বেশি রাগানো যাবেনা। ও যেই রগচটা, নিশান ওকে বেশ ভালোভাবেই চিনে। যদি একবার রেগে বাবার সামনে ওর বিয়ের কথা উচ্চারণ করে তবে ভুল হয়ে যাবে।
তাই বহু চিন্তাভাবনা করে ও নিজেকে ঠান্ডা রেখে বলে,
—দেখ নিশীথ, আমি জানি তোর হয়তো কষ্ট লাগছে আমার কথা শুনে, তবে আজ তুই যা বললি তাতে ও কথা আমি না বলে পারিনি। আমি অনেক আগেই বাবার কাছে ওই জমিটা চেয়ে রেখেছিলাম। ও জায়গাটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছিলো বলে। আর বাবাও আমাকে জমিটা দিতে রাজি হয়েছিলো। বাকি সবকিছুতে তুই তো ভাগ পাবি। কিন্তু ওটায় না। তাই তোকে বুঝানোর জন্য বলছিলাম ওসব কথা।

—ভাইয়া, তোমার এসব আজগুবি কথাবার্তা রাখো তো। ফ্লাইটের আগে এসব ফালতু কথা বলে নিজের ও সবার মুড নষ্ট করোনা প্লিজ।
—সত্যি কথা বললে তো গায়ে লাগবেই।
নিশান বিড়বিড়িয়ে বলে। নিশীথ তা শুনতে পায়। আবার রেগে বলে,
—সত্যি কথাটা তুমি না আমি বলছি। তুমি যেমন বাবার ছেলে, আমিও তেমনি বাবার ছেলে। একই রক্ত আমাদের দুজনের শরীরে বইছে। তুমি চাইলেও যা ইচ্ছা বলে আমাকে আমার অধিকার পাওয়া থেকে বঞ্চিত করতে পারবেনা!
—তোর যে সম্পর্ক, এমন নামে মাত্র সম্পর্কে এসব অধিকারবোধ খাটানো যায়না। আমি হাজার কিলোমিটার দূরে থেকেও বাবার যতটা কাছের তুই এত কাছে থেকেও ততটাই দূরে!
নিশান হিসহিসিয়ে বলতেই নিশীথ কিছু বলার আগে আয়মান সাহেবের আওয়াজ ভেসে আসে।
—নিশান! বড্ড বেশি কথা বলছিস তুই!

আয়মান সাহেবের হঠাৎ ধমকে নিশান থেমে যায়। নিশীথ মনে মনে কষ্ট পেলেও বাবা নিশানকে ধমক দেওয়ায় যেমন অবাক হয় তেমনই খুশিও হয়! নিশান এ জীবনে বাবার ধমক খুব কমই খেয়েছে। তাও প্রসঙ্গ যখন নিশীথের সাথে তর্কের তখন তো আয়মান সাহেব সবসময় নির্দ্বিধায় ওরই পক্ষ নিয়েছেন। তাই এ প্রথম নিশীথের বিরুদ্ধে কিছু বলায় বাবার ধমক খেয়ে ও বিস্ময়ে গর্জে উঠে বলে,
—তুমি আমায় মানা করছো, বাবা? ও কি বলেছে তা দেখোনি? আমি কি ভুল বলেছি কিছু?
আয়মান সাহেব শক্ত কণ্ঠে বললেন,
—অবশ্যই বলেছিস।
—কি ভুল বলেছি?

নিশান চেচিয়ে বলে। এখন ও নিজের মধ্যে নেই। এদিকে নিশীথ অভিমানি চোখে বাবার দিকে চায়। সবসময় ও নিজেকে একাই ডিফেন্ড করে এসেছে। বাবা কোনোদিন ওর হয়ে একটা কথা বলবে এ আশা সে করেনি, তাও সেটা নিশানের বিপক্ষে যেয়ে? এ আশা তো সে স্বপ্নেও করেনি! তাই আয়মান সাহেবের এ সামান্য সাপোর্ট ওকে আশা দেয়। ওদের বাবা-ছেলের যে সম্পর্ক ডুবতে বসেছিলো সে সম্পর্ক যেন নতুন করে তরি ফিরে পাওয়ার আশা জাগে ওর মনে! এরই মাঝে আয়মান সাহেব বললেন,

—তুই যেমন আমার রক্ত, নিশীথও আমার রক্ত। আমি আবেগের বশে তোকে কিছু দিতে চাইলে সেখানে নিশীথ এসে যদি নিজের অধিকার চায় তবে ওকে মানা করার সাধ্য আমার নাই। ও তো ঠিকি বলেছে কথাটা। সেখানে তুই কেন বারবার আমার ওর মধ্যেকার সম্পর্ক টানছিস?
এবার নিশান নিজের হিতাহিত সব হারিয়ে চিৎকার করে বলে,
—তবে তুমি নিশীথকে ওই জমি দিয়ে দিবে? তুমি কি ভুলে গেছো নিশীথ তোমার সাথে কি করেছে? তোমার পছন্দ, তোমার ইচ্ছা দুটোর বিরুদ্ধে যেয়ে আমাদের ক্লাসের বাইরে যেয়ে দোলনচাঁপাকে বিয়ে করেছে। তাও তুমি ওকে ওই জমি দেবে?

এবার আয়মান সাহেব হাসলেন। তা দেখে নিশান ও নিশীথ দুজনেই অবাক হলো। আসমা বেগম বাবা-ছেলেদের মাঝের ঝগড়া এতদূর গড়ানো দেখে অজ্ঞান হবার উপক্রম প্রায়। ইউনুস সাহেব অসহায় মুখে নাতি ও ছেলেকে দেখছেন। তিনি জানতেন এমন দিন আসবে তাই আজ তিনিও নির্বাক। আর দোলনচাঁপা, সে তো শুধু আয়মান সাহেবকে দেখছে। কাল সবকিছু বলার পরেও এখনো লোকটা কত্তা ঠান্ডা আছে, কতই না শক্ত তার মনোবল। এটা দোলাকে অবাক করছে! রুমজুড়ে পিনপতন নীরবতা। এরই মাঝে হঠাৎ আয়মান সাহেব নিশানকে প্রশ্ন করলেন,

—নিশীথ না হয় আমার পছন্দের বিরুদ্ধে যেয়ে বিয়ে করেছে। ওর সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ তাই আমার কথা শুনেনি সেটাও মানলাম। কিন্তু তোর সাথে তো আমার সম্পর্ক খুবই ভালো, অত্যন্ত স্বাভাবিক। তবে তুই কেন আমায় না জানিয়ে বিদেশে একা একা বিয়ে করলি? একটাবারও কেন আমায় জানানোর প্রয়োজন মনে করলিনা সেটা বলতে পারবি?

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭৬ (২)

আয়মান সাহেবের প্রশ্নে শুধু নিশান নয়, অবাক হলো রুমের প্রত্যেকটা মানুষ। সবার মনে একটাই প্রশ্ন- উনি কিভাবে জানলেন? কিন্তু একটা মানুষই খুশি হলো আয়মান সাহেবের প্রশ্ন শুনে, সেটা দোলনচাঁপা। তাকে দেখে মনে হলো যেন এতক্ষণ ধৈর্য ধরে ও এই মুহুর্তটারই অপেক্ষা করছিলো!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭৮