দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭৯
তাসফিয়া হাসান তুরফা
আয়মান সাহেব দোলনচাঁপার কথা বলায় রুমজুড়ে কিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা দেখা দিলো। সকলের মাঝে দুই ধরনের বিস্ময় দেখা দিলো। একদল বিস্মিত হলো দোলনচাঁপা আয়মান সাহেবকে সবকিছু বলে দিয়েছে দেখে, আরেকদল বিস্মিত হলো উনি দোলনচাঁপাকে মেয়ে বলে সম্বোধন করায়। প্রথম দলের মাঝে রয়েছে নিশান, আসমা বেগম ও ইউনুস সাহেব। যারা পারতপক্ষে কখনো ভাবেনি দোলনচাঁপাই আয়মান সাহেবকে এ কথা বলতে পারে।
তাদের ধারণা ছিলো দোলা কখনো আয়মান সাহেবের সাথে এ বিষয়ে কথা বলার সাহসই করতে পারবেনা! আর দ্বিতীয় পক্ষের মাঝে রয়েছে নিশীথ ও দোলনচাঁপা। ওদের দুজনের কানে এখনো ভাসছে আয়মান সাহেবের উক্তি। দোলনচাঁপাকে “আমার মেয়ে” সম্বোধন করা ছিলো ওদের জন্য সবচেয়ে বড় চমক। এমন এক মুহুর্তের জন্য ওরা কতদিন প্রার্থনা করেছে ওরা নিজেরাও সঠিক জানেনা। বিশেষ করে দোলার কানে বারংবার বাজছে শব্দ দুটো! বিস্ময়ে, খুশিতে হৃদপিণ্ড ধুকপুক করছে ওর। এদিকে ওরা খুশি হলেও নিশান হঠাৎ রেগে গেলো। রাগে ওর চোখমুখ হিংস্র দেখালো। ও নিশীথের দিকে তাকিয়ে বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—বাহ! আমি বলতে না বলতেই বউকে বলা ঠিকি হয়ে গেছে তাইনা? বিশ্বাসঘাতকতা নাকি তুই করিসনি? তোর বউ-ই তোর হয়ে অন্যায় করলো আমার সাথে।
—আমাকে যা বলছো বলো দোলাকে নিয়ে কিছু বলোনা, ভাইয়া। ওকে কিছু বললে আমার সহ্য হবেনা
নিশীথ যথেষ্ট শান্ত গলায় জবাব দিলো। নিশান যেন তাতে আরও ক্ষেপে গেলো। তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
—ওরে ভালোবাসা! একদম উপচে পড়ছে দেখি। বলছি কি দেখেছিস তুই এই মেয়ের ভেতর হ্যাঁ? শুধু দেখতেই সুন্দর এছাড়া আর কি আছে ওর মধ্যে? তোরা তো খুব বলিস দোলার মনে কোনো লোভ নাই। তবে কেন ও আমার বিয়ের কথা বাবাকে বলে দিলো? নিশ্চয়ই বাবার চোখে ভালো হওয়ার লোভে? এইযে আজকে বাবা ওকে নিজের মেয়ে বলে সম্বোধন করলো এটাতো তারই প্রমাণ। এতকিছু করলো শুধুমাত্র সম্পত্তির লোভে! আর ওকেই তোরা মাথায় তুলে রাখিস!
—ভাইয়া! চুপ করো এখন। আর একটা কথা বলবেনা তুমি দোলার নামে। আমি একবার বলেছিনা আমায় নিয়ে যা ইচ্ছা বলো আমি শুনতে রাজি কিন্তু আমার দোলনচাঁপাকে নিয়ে একটা বাজে কথা বললে আমি একেবারেই মেনে নেবোনা। শেষে এমন কিছু বলে ফেলবো যেটা শুনতে তোমার মোটেও ভাল্লাগবেনা। তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে আমি এতক্ষণে ওকে কি কি বলতাম তোমার আইডিয়াও নেই। শুধুমাত্র তুমি আমার বড়ভাই দেখে এতক্ষণ ধৈর্য ধরে আছি। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়োনা!
নিশীথ এবার চড়া গলায় কথা বললো। তা শুনে নিশান থেমে গেলো। হয়তো ও বুঝলো, আসলেই নিশীথের সামনে দোলনচাঁপাকে নিয়ে কিছু বলা যাবেনা। নিশীথের চড়া মেজাজ ও রাগ দুটো সম্পর্কেই সে খুব ভালোভাবে পরিচিত। তাই ও চুপচাপ চলে যাচ্ছিলো। এমন সময় নিশীথ পেছন থেকে বলে উঠলো,
—দোলা কেমন মেয়ে এটার প্রমাণ না আমি কখনো কাউকে দিয়েছি, না এখনো দেবার প্রয়োজন মনে করি। ও যেমনি হোক না কেন যাই করুক না কেন পুরো দুনিয়া ওর বিরুদ্ধে গেলেও নিশীথ একাই দোলনচাঁপার জন্য যথেষ্ট। ও কেন বাবাকে বলেছে আমি জানিনা, হয়তো আমার চিন্তা দেখেই বলেছে। কারণ তোমার বিয়ের কথা বাবা জানলে কি হবে এটা নিয়ে এ কয়দিন ভেবে ভেবে আমার যে অবস্থা হয়েছে তা তুমি না দেখলেও দোলা ঠিকি দেখেছে। আমি কতবার বলবো বলবো করে বাবাকে বলতে পারিনি শুধুমাত্র তোমার ওয়াদার কারণে এটাও দোলা দেখেছে। তুমি বাবার কথা চিন্তা না করলেও ও করেছে। এবং বাবার কাছে থেকে আজ যে সম্বোধন সে পেলো এটা দোলা নিজে থেকে অর্জন করে নিয়েছে। তোমার মতো সম্পত্তির লোভ না আমাদের কখনো ছিলো না কখনো হবে। আমাদের কাছে এক টুকরো জমির চেয়ে বাবা বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। এটা হয়তো তুমি বুঝবেনা। কানাডায় যেয়ে তুমি নিজের শিকড় ভুলে গেলেও আমরা এখনো যাইনি।
নিশীথ সুন্দরমতোন ঠান্ডা মাথায় কথা শুনিয়ে দিলো নিশানকে। নিশান সব শুনেও হজম করে নিলো এবার। শুধু দেখলো ঘরে থাকা একটা মানুষও নিশীথের কথায় বিরোধিতা করলোনা। এ প্রথম ওর মনে হলো ও আসলেই পরিবার থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। আগেকার মতো সম্পর্ক, আগেকার মতো বন্ধন কোনোটাই আর অবশিষ্ট নেই ওদের সাথে। ওর দেশে থাকারও কোনো কারণ রইলোনা। নিশান একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে রওনা হলো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে!
নিশীথের রুমের বিছানায় দোলা মুখ ভার করে বসে আছে। কিছুক্ষণ আগে কেদেছেও! কারণ নিশীথ সবার সামনে ওকে ডিফেন্ড করলেও একলা পেয়ে রুমে এসে ওকে ঝেড়েছে। কেন ওকে না বলে সব বাবাকে বলতে গেলো, বাবাকে ও কখন বললো এসব জিজ্ঞেস করলো। দোলা সত্যবাদীর ন্যায় সবকিছু খুলে বললো। নিশীথ ওর দিক থেকে ব্যাপারটা ভাবলেও দোলাকে নিয়ে নিশানের বলা কথাগুলো ভেবে ওর রাগ কমলোনা অতটা। দোলা বেচারি কেদে ফেলায় আরেকদফা বকা খেয়েছে। এজন্য এখনো চুপ করে আছে। নিশীথ বেশ অনেকক্ষণ চুপ থেকে মুখ খুলে বললো,
—হয়েছে এত মুখ ফুলিয়ে থাকার মতো কিছু বলিনি আমি। নরমাল হও!
—যতগুলো বকা দিয়েছেন মানুষ সাথে সাথে কি নরমাল হতে পারে?
দোলা মুখ ফুলিয়ে বললো। নিশীথ এবার তাকালো দোলার চেহারার দিকে। মায়াবী মুখটা হাটুতে রেখে একদিকে মাথা কাত করে বসে আছে। ওকে এভাবে দেখতে যে কতটা আদুরে লাগছে নিশীথ বলে বুঝাতে পারবেনা কাউকে! ও এগিয়ে যেয়ে দোলার পাশে বসলো। দোলা একটু সরে গেলো। নিশীথ গালে হাত রাখতেই ও মুখ অন্যদিকে ফিরালো। ওর ছেলেমানুষী দেখে নিশীথ হেসে ফেললো। মাথা নত করা দোলনচাঁপার মাথায় চুমু দিয়ে বললো,
—তুমি বাবাকে বলেছো এটা নিয়ে আমার অত রাগ নেই, দোলনচাঁপা।
—তাহলে অযথা বকলেন কেন?
দোলা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করে। নিশীথ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
—তুমি শুনলেনা ভাইয়া তোমাকে কিসব বাজে কথা বললো? আমি নিজেকে নিয়ে সব শুনতে রাজি, তোমাকে নিয়ে কেউ টু শব্দ করলেও আমার তা কোনোভাবেই সহ্য হয়না। আই স্যয়ার ওখানে ভাইয়ার জায়গায় অন্য কেউ হলে এতক্ষণে ওকে…
নিশীথ কথার মাঝখানে থেমে যায়। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। দোলা এবার মাথা তুলে তাকায় নিশীথের দিকে। মনে মনে ভাবে, কে বলেছে বিয়ের পর ভালোবাসা বদলায়? নিশীথকে দেখলে কেউ এ কথা বলার সাহসই পাবেনা! ও বিয়ের আগে যেমন পাগল ছিলো দোলার জন্য, বিয়ের পর নিশীথের ভালোবাসা ওর যত্ন নেওয়া যেন আগের চেয়ে হাজারগুণে বেড়ে গেছে! দোলা নিশীথের হাতে হাত রাখলো। নরম গলায় বললো,
—কে আমাকে নিয়ে কি বললো এটা দিয়ে আমার কোনো যায় আসেনা, নিশীথ। আপনি আমাকে নিয়ে কি ভাবেন আমার কাছে শুধু এটাই ম্যাটার করে।
নিশীথ এর মন ভরে যায় দোলার কথায়। পরম ভালোবাসায় বুকে আগলে নেয় প্রিয়তমাকে। কপালে উষ্ণ চুমু বসিয়ে দেয়। ঠিক সে মুহুর্তে ওদের রুমের দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হয়। নিশীথ আলিংগন ভেঙে উঠে দাঁড়ায়। গেট খুলে দিতেই আসমা বেগমের দেখা। শাশুড়ি কে দেখে দোলা উঠে দারায়। উনি ভেতরে এসে প্রথমেই দোলাকে জড়িয়ে ধরেন। অশ্রুভেজা কণ্ঠে বলেন,
—তোকে ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা আমার নেই দোলা। আজ তুই সত্যিটা আগে বলে দিয়ে শুধু তোত শশুড়ের নয় বরং আমাদের সবার উপকার করেছিস, মা। আমি জানতাম একদিন তুই এ বাসায় এসে সব ঠিক করে দিবি। হয়তো আজকে সেদিন এসে গেছে!
—আমি কিছুই করিনি, মা। আমি শুধু সেটাই করেছি যেটা আমার কাছে এ পরিবারের জন্য সঠিক মনে হয়েছে। অযথা আমায় ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবেন না
—নাহ আজকে তোকে ধন্যবাদ দেওয়ার একটা বিশেষ কারণ আছে।
—কি কারণ?
—আজ তোর কারণে নিশীথ ও তার বাবার মধ্যে সম্পর্ক ভালো হয়ে যাবে।
আসমা বেগমের কথায় দোলার পাশাপাশি নিশীথও চমকে উঠে। এটা আবার কি বলছে ওর মা? নিশীথ প্রশ্ন করলো,
—হঠাৎ এ কথা বলছো কেন মা? বাবার সম্পর্ক তো দোলার সাথে ভালো হলো। আমি মাঝখানে আসলাম কই থেকে?
আসমা বেগম হেসে বললেন,
দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭৮
—সে কথা বলতেই তো এসেছি রে, বাপজান। তোর বাবা তোকে রুমে ডেকেছে। আমাকে বললো, “আসমা যাও আমার ছেলেকে ডেকে নিয়ে আসো। বলো ওর বাবা ওর সাথে একাকী কিছু কথা বলতে চায়!” এজন্যই তো আমি এলাম এখানে! যা নিশীথ, দ্রুত যা। তোর বাবা তোর সাথে একাকী কথা বলতে চায়। আমাদের কাউকে যেতে মানা করেছে।
মায়ের কথায় নিশীথ থমকে গেলো। আড়চোখে দোলার দিকে তাকাতেই ও চোখের ইশারায় ওকে দ্রুত যাওয়ার ইংগিত দিলো। নিশীথ চোখ ফিরিয়ে নিয়ে রুম ছাড়লো। আচমকা নিশীথ অনুভব করলো, অজানা এক উত্তেজনায় ওর বুক কাপছে!