দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৮২ (২)
তাসফিয়া হাসান তুরফা
“সময় থাকতে মানুষকে মূল্য দেওয়া উচিত, আয়মান সাহেব। কথাটা জানেন তো?”
আসমার বলা কথায় রুমজুড়ে নিরবতা। আয়মান সাহেব লজ্জায় চুপ করে রইলেন। আসমা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন,
—আপনি আমার জীবনের ৩০ বছর আমাকে অবহেলা করেই কাটিয়েছেন। পারবেন সেই বছরগুলোকে জীবন থেকে ফেরাতে?
—মানুষ মাত্রই ভুল, আসমা। আমি জীবনের এ বয়সে এসে নিজের ভুল অনুভব করছি এটা কি আমার দোষ বলো?
আয়মান সাহেব ব্যথিত ভাবেই বললেন। আসমা জবাবে বললো,
—আমি কি একবারো বলেছি আপনি এ বয়সে এসে ভুল স্বীকার করছেন এটা আপনার দোষ? আমি তো আপনাকে কোনোদিন দোষী করিনি। যদি করতাম তবে আপনার সাথে আর সংসার করতেই পারতাম না।
—মানে?
আয়মান দ্বিধা নিয়ে শুধায়। আসমা গম্ভীর মুখে বলে,
—আমি ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি, আয়মান সাহেব। অনেক বছর আগেই মেনে নিয়েছি। হ্যাঁ, আমার এটা করতে অনেক কষ্ট হয়েছে ঠিকি তবে যতটা না কষ্ট আপনার অবহেলায় হতো, ভাগ্যকে একবার মেনে নেওয়ার পর তার চেয়ে কমই কষ্ট হয়েছে।
আসমা থামলো। একটি নিশ্বাস নিয়ে আবারো বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—আপনি যখন নিশান হবার ওকে পুরোপুরি ওকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে গেলেন, আমিও ঠিক করলাম পরের সন্তান হবার পর আমিও নিজের ধ্যান-জ্ঞান দিয়ে পুরোপুরি ওকে সময় দেবো। এবং নিশীথ হওয়ার পরে হলোও ঠিক তাই। আপনি নিশানকে নিয়ে ব্যস্ত আমি নিশীথ কে নিয়ে। এর মাঝে আমাদের দুজনের একান্তই সংসার নামক যে বিষয়টা আছে তা তো পুরোপুরি হারিয়েই গেছে! ওইযে আমি আপনার প্রতি মান-অভিমান করা থেকে বেরিয়ে এলাম, আর সেপথে ফিরে যাইনি কখনো! এখন আপনিই বলুন, হুট করে এতগুলো বছর পর এসে যদি আপনি এসব কথা বলেন তবে কি ও পথে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব?
আয়মান সাহেব স্তব্ধ হয়ে নির্বাক রইলেন। বলাবাহুল্য, আসমার কথাগুলো এতক্ষণ অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শোনায় ওর একটা কথা বুঝতে উনার দেরি হলোনা। আসমা যা যা বলছে সব শতভাগ ঠিক। এমতাবস্থায় উনি কিভাবে নিজের পক্ষে সাফাই গাইবেন যেখানে তিনি জানেন আসমার যুক্তির বিপরীতে তার বলার কিছুই নেই। উনার বিবেকই উনাকে কথা বলতে দিলনা। বেশ অনেকক্ষণ যাবত আয়মান যখন চুপ আছেন তখন আসমা তাকে সহজ করতে বললো,
—আপনি আবার এটা ভেবেন না যে আমিও এখন সুযোগ পেয়ে আপনাকে অবহেলা করবো। যদি আমিও সেটা করি তবে আপনার আমার মধ্যে তফাৎ কোথায় থাকলো। আমি বহু আগেই এমন জীবন মেনে নিয়েছি তাই আমার আপনাকে নিয়ে এখন কোনো অভিযোগ আক্ষেপ নাই। সংসার করা আমার দায়িত্ব তাই করছি, যেমনভাবে আপনার খেয়াল রাখা আমার দায়িত্ব এবং আমি সেটা পালন করবো। আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।
আসমার কথায় আয়মান উদাসীন অনুভব করলো। ও বললো,
—তুমি যদি আগের মতোই কষ্টে থাকো তবে আমি নিশ্চিন্তে কিভাবে থাকবো! অনুতাপ কমানোর জন্য তোমার সাথে কথা বললাম, উল্টো এখন অনুতাপ বেড়ে গেলো। তোমার দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে না আমি আগে কখনো সন্দেহ করেছি না এখন করবো। আমি জানি তোমার জন্য ভীষণ কঠিন হবে তবে শুধু এটুকুই বলবো, সম্ভব হলে আমাকে মাফ করার চেষ্টা করো। আমি এতেই খুশি থাকবো!
আয়মান সাহেব কথাগুলো বলে চোখ থেকে চশমা খুলে রেখে বাথরুমে গেলেন। আসমা তার যাওয়ার দিকে চেয়ে বড়সড় এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি চাইলেই মনকে নরম হতে দিতে পারতেন, এতবছরের না পাওয়া অনেককিছুই হয়তো তাহলে পেয়ে যেতেন। কিন্তু তিনি সময়মত মনে লাগাম টেনে নিয়েছেন যাতে আত্মসম্মানে আঘাত না আসে। কারণ ভালোবাসা হারালে বাঁচা যায়, আত্মসম্মান হারালে যায়না!
নিশীথের মনে রং লেগেছে। বরাবরই ও দোলনচাঁপাকে নিয়ে ভীষণ সেন্সিটিভ হলেও এবার মাত্রাটা অন্যরকম। শুধু নিশীথই না, বাসার প্রত্যেকটা সদস্যই দোলনচাঁপার এক্সট্রা যত্ন নিচ্ছে এ সময়। আয়মান সাহেব কড়া গলায় নিশীথ কে বলে দিয়েছেন এবার ওদের এ বাসাতেই থাকতে হবে। ওই বাসায় তিনতালা হেটে উঠা সহ সারাদিন একা বাসার সব কাজ করা, এ সময় দোলার জন্য বিপদজনক হতে পারে। উনার বংশধরের যত্নে কোনো ত্রুটি তিনি মেনে নিতে নারাজ। সাধারণত অন্যসময় হলে নিশীথ রাজি হতোনা, কিন্তু এখন সময় ভিন্ন। এটা বাবার সাথে তর্ক করার সময় না বরং সব ইগো, অভিমান পাশে চেপে রেখে দোলনচাঁপার জন্য যেটা সবচেয়ে ভালো হবে নিশীথ ওই ডিসিশনটাই নিবে। তাই শেষমেশ চুড়ান্ত হলো ওরা এখন থেকে এ বাসাতেই থাকবে। ফলে নিশীথ ওই বাসা থেকে প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে এসে ও বাসা ছেড়ে দিলো।
তিন মাস পরের কথা। শারিরীক দিক থেকে চিকন হবার কারণে দোলনচাঁপার পেট এখনো তেমন বুঝা যাচ্ছেনা। তবু ও প্রতিদিন বারবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের পেট দেখার চেষ্টা করে রোজ রাতে। তেমনি আজকেও দেখছিলো। নিশীথ অফিস থেকে মাত্র ফিরলো। রুমে ঢুকে আয়নার সামনে পেট বের করা দোলাকে দেখে মুচকি হাসলো। আজ প্রথমবার এমন দেখছেনা ও। অফিস থেকে আসার পর নিশীথ প্রায়ই খেয়াল করেছে দোলাকে এভাবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পেট দেখতে। কিন্তু ওর সামনে কখনো এমনটা করেনা মেয়েটা। যেন নিশীথ দেখে ফেল্লেই ভীষণ লজ্জায় পড়ে! নিশীথ ভেবে পায়না বিয়ের এত দিন পরেও কেন একটা মেয়ে এভাবে লজ্জা পাবে! তাই অন্যসময় ওকে লজ্জায় না ফেলতে নিশীথ দেখেও না দেখার ভান করে। দোলাও মনে করে নিশীথ দেখেনি তাই লজ্জা পায়না, চুপিসারে পেট লুকিয়ে এমন ভাব করে যেন এতক্ষণ আয়নার সামনে কিছুই দেখছিলোনা সে। কিন্তু আজকে ওর মনে দুষ্টুমির ইচ্ছা জাগে। হুট করে রুমে ঢুকে পেছন থেকেই ও দোলাকে জড়িয়ে ধরে। আয়নায় নিশীথকে দেখামাত্র দোলা বেশ চমকে যায়। ফর্সা মুখটায় সাথে সাথে লালচে আভা ছেয়ে যায়। ও থতমত খেয়ে বলে,
—আপনি কখন এলেন?
—যখন তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের ছোট্ট এই পেট টা দেখছিলে!
—ছি! এভাবে কেউ বলে? আপনি আসার আগে একটু আওয়াজ দিবেন না?
—ওরে বাবা! এমনভাবে বলছো যেন জীবনে প্রথম দেখছি তোমার পেট।
নিশীথ ভ্রু নাচিয়ে বলে। দোলা লজ্জায় আরও মিইয়ে যায়। নিজেকে নিশীথের বাহুডোর থেকে ছাড়ানোর জন্য নড়াচড়া করে। তা দেখে নিশীথ হেসে ওর গালে টুপ করে চুমু দেয়। দোলার কানের কাছে মুখ এনে বলে,
—এত তাড়াতাড়ি কি পেট ফুলে উঠবে বোকা মেয়ে? আরেকটু সময় হতে দাও।
—অনেকের তিন মাস পরই কিছুটা বুঝা যায় মা বলছিলো। তাই দেখার চেষ্টা করছিলাম। আমার যে কেন যায়না বুঝছিনা! টেনশন হয় আমার।
নিশীথ চোখ গরম করে বলে,
—ওরা আর তুমি কি এক হলে? একেকজনের প্রেগন্যান্সি একেকরকম, দোলা। তাছাড়াও তুমি কত শুকনো। ওজন দেখেছো তোমার? কত বলি বেশি বেশি খেতে তাও গায়ে কিছু লাগুক!
দোলা মুখ ছোট করে বললো,
—আমি তো খাই-ই। গায়ে না লাগলে কি করবো বলুন! ডাক্তার বলেছিলো আমায় বেশি করে খেতে নয়তো ডেলিভারির সময় সমস্যা হবে। এমনিই আমার ওজন অনেক কম। আমার ভীষণ ভয় করে নিশীথ! সব ঠিকভাবে হবে তো? আমাদের বেবি ভালোমতো দুনিয়ায় আসবে তো?
দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৮২
—সব ভালোভাবেই হবে ইন শা আল্লাহ। তুমি দেখো। আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখো, যা হবে আমাদের ভালোর জন্যই হবে। আমি আছিনা? আমি থাকতে কিসের ভয় তোমার? আসো বুকে মাথা রাখো!
দোলা পরম শান্তিতে নিশীথের বুকে মাথা রাখে। ও জানে নিশীথ থাকতে ওর সাথে খারাপ কিছু হতে দিবেনা। কিন্তু তবু মনে মনে একটা অজানা ভয় তো থেকেই যায়। দোলা ভাবে, এমন অনুভূতি কি এ সময় সবারই হয়?