ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ১০

ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ১০
জেনিফা চৌধুরী

প্রায় দেড় বছর পর মেহরিশ বাংলাদেশে পা রেখেছে। কিন্তু বাংলাদেশে পা রাখার সাথে সাথে নিজের একমাত্র মেয়েকে হারাতে হবে এটা ভাবতে পারছে না। মেহরিশ ছুটছে প্রাণপণ। মেহরিশের পিছু পিছু মেহনূর, সাথে ওর বাবা-মাও ছুটছে। মেহরিশ ছুটতে ছুটতে হঠাৎ একটা গাড়ি এসে ধাক্কা দিয়ে চলে যায় মেহরিশকে। মেহরিশ মুখ থুবড়ে পড়ে যায় রাস্তায়। মেহনূর চিৎকার করে উঠে। দৌড়ে এসে মেহরিশকে টেনে উঠানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ততক্ষণে মেহরিশ জ্ঞান হারিয়েছে। মাথা ফেটে রক্ত বন্যা বইছে।

মেহরিশের বাবা-মাও এবার পাগলের মতো কাঁদতে শুরু করলেন। একটা গাড়ি ডেকে মেহরিশকে হাসপাতালের নেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। মেহনূর আর নিলুফা বেগম মেহরিশকে নিয়ে হাসপাতালে গেলেন। আর আবির সাহেব পুলিশ স্টেশনে গেলেন। মেহরিশকে হাসপাতলে এনে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হলো। মেহনূর আর নিলুফা বেগম বাইরে বসে কাঁদছে। মেহনূরের দম বন্ধ হয়ে আসছে। সবকিছু কেমন স্বপ্ন মনে হচ্ছে। এইতো কিছুক্ষণ আগেও ওরা সবাই হাসিখুশি ছিল। ঘন্টা খানেকের ব্যবধানে সবকিছু এভাবে এলোমেলো হয়ে গেলো কিভাবে? ওরা বাংলাদেশ ল্যান্ড করেছে বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬টা বেজে ১০ মিনিটে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এয়ারপোর্টের সব ঝামেলা মিটমাট করে বাইরে বের হতে হতে প্রায় সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। মেহরিশ, আনায়া, মেহনূর দাঁড়িয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল। আবির সাহেব আর নিলুফা বেগম গাড়ি আনতে গিয়েছেন। মেহনূর কিছু খাবার কেনার জন্য আনায়াকে কোলে নিয়ে একটা দোকানের দিকে গেল। দোকান থেকে কিছু কেনাকাটা করে রাস্তা পার হওয়ার টাইমে একটা গাড়ি এসে মেহরিশের কোল থেকে আনায়াকে ছুঁ মে°রে নিয়ে যায়। চোখের পলকে সবটা ঘটে যাওয়ায় মেহরিশ কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। যখন কানের আনায়ার তীব্র কান্নার শব্দ গেল তখন মেহরিশ শুধু নিস্তব্ধ চোখে দেখল আনায়াকে নিয়ে গাড়িতে চলে যাচ্ছে।

মেহরিশের ধ্যান ভাঙতেই মেহরিশ গাড়িটার পিছু পিছু ছুটতে লাগল। আর চিৎকার করতে লাগল। মেহনূর দূর থেকে দৃশ্যটা দেখে মেহরিশের পেছন পেছন ছুটতে লাগলো। চোখের পলকে সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেলো। মেহনূর গাড়ির নাম্বারটা দেখেছিল। সাথে সাথে নোটও করেছিল। আবির সাহেব আপাতত পুলিশের সাহায্যে গাড়িটা ট্রাক করার চেষ্টা চালাচ্ছে। মেহনূরের ফোনে সিম কার্ডও নেই যে কারোর সাথে যোগাযোগ করবে। হসপিটালের ওয়াইফাই চালুর জন্য চেষ্টা করতে লাগল। মেহনূর কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুবাধে যেকোনো কিছুর পাসওয়ার্ড হ্যাক করার বিষয়টা খুব ভালো করেই জানে। তাই ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড নিজের ফোনে কানেক্ট করে সবার আগে সায়রকে ভয়েস রেকর্ড করে সবটা জানাল। সায়র এই মুহূর্তে অনলাইনে নেই। তাই নিজের বাংলাদেশের কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের সাথে যোগাযোগ করল। এর মধ্যে ডাক্তার এসে জানাল,

“মেহরিশের, ব্লাড লাগবে।” মেহনূর আর মেহরিশের ব্লাড গ্রুপ এক হওয়ায় মেহনূর ব্লাড দেওয়ার জন্য গেল।
আমেরিকা টাইম সকাল ৮টা। সায়র ঘুম থেকে উঠে নাস্তার টেবিলে বসে মায়ের সাথে টুকটাক কথা বলছিল। তখনি কথার মাঝে সায়র হঠাৎ প্রশ্ন করে,
“মেহরিশ, শুধু ডিভোর্সি বলে তোমাদের সমস্যা? নাকি অন্য কোনো সমস্যা আছে?”
সায়রের অসহায় বাক্যে প্রশ্ন শুনে শাহিনা বেগম ছেলের দিকে অপরাধীর ন্যায় তাকালেন। বলে উঠলেন,
“বাবা, তুই অবিবাহিত একটা ছেলে হয়ে কেন বিবাহিত একটা মেয়েকে বিয়ে করবি? তাও যেই মেয়েটার সন্তান আছে।”
সায়র প্রতিউত্তরে প্রশ্ন করল,

“একটা ডিভোর্স হলে ডিভোর্সের কারণ হিসেবে শুধু মেয়েদের কেন দায়ী করা হয়, মা? না মানে ছেলেদের কেন দোষ দেখা হয় না? ছেলেরা কি সাধু? নাকি ছেলেরা ফেরেশতা যে তাদের কোনো দোষ নেই, থাকতে পারে না?”
শাহিনা বেগম চুপ করে গেলেন। সায়র পুনরায় প্রশ্ন করে বসল,
“যেই ছেলেকে তুমি নিজের মেয়ের পাশে প্রেমিক হিসেবে মানতে পারছো না, সেই ছেলেকে নিয়ে একটা মেয়ে ঘর করবে এমন ভাবছো কিভাবে? ছেলেটা যদি ভালো হতো তাহলে তো তুমি নিজের মেয়ের জামাই হিসেবে তাকে গ্রহণ করতে। ছেলেটা ভালো না বলেই মেয়েকে দূরে সরাতে চাচ্ছো। তা মা, নিজের মেয়ের বেলায় ১৬ আনা, অন্যের মেয়ের বেলায় ২আনা কেন?”

শাহিনা বেগম আর উত্তর দিতে পারলেন না। চুপ করে গেলেন। আলগোছে উঠে চলে গেলেন। সায়র চুলগুলো দুই হাতে খামচে ধরল। মাথাটা বড্ড ধরেছে। আজ মেহরিশ পরিবার সহ বাংলাদেশ চলে গেছে। কিন্তু একবারও সায়রকে জানায়নি অব্দি। সায়রকে মেহনূর বলেছে বলেই জানতে পারলো। মেহরিশের হঠাৎ দূরত্ব বুঝতে পারছেনা সায়র। এই দূরত্বের কারণ কি? মেহনূর সব বলেছে সায়রকে। সানায়ার আচরণে সায়রের ইচ্ছা করছে সানায়াকে থাপ্পড়ে গাল লাল করে দিতে। সব কিছু শুরু হওয়ার আগে এভাবে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কেন? সায়রের নিজেকে অসহায় লাগছে। সবটা বুঝে উঠতে পারছেনা।

মেহরিশের মন জয় করবে কিভাবে? সানায়াকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করবে কিভাবে? আদৌও কি সায়র মেহরিশকে পাবে? সায়রের গলা দিয়ে খাবার নামছে না আর। তাই খাবার রেখেই উঠে চলে আসল। গাড়িতে এসে মনে পড়ল এতক্ষণে মেহরিশদের পৌঁছে যাওয়ার কথা। পৌঁছে তো মেহনূরের জানানোর কথা তাহলে জানানো হলো না কেন? ফোনের কথা মনে উঠতেই খেয়াল হলো ফোনটা রুমে রেখে এসেছে। তাই তড়িঘড়ি করে আবার রুমে গেল। ডাটা অন করতেই মেহনূরের ভয়েস ম্যাসেজটা আসল।

সায়র বুঝতে পারল ওরা পৌঁছে গেছে। তাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ভয়েস রেকর্ডটা চালু করে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পা জোড়া থেমে গেল। মেহনূরের কান্নারত বাক্যে আনায়ার কিডন্যাপ হওয়ার কথা কানে আসতেই সায়রের মনে হলো ওর চারদিক ঘুরছে৷ চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল। বুকের ভেতরটায় ধক করে উঠল। চিনচিন ব্যাথা শুরু হয়েছে। ভুল শুনল? আনায়ার মতো নিষ্পাপ একটা বাচ্চাকে কেউ কিডন্যাপ করেছে? নাহ! ভাবতে পারছেনা সায়র। হাটু ভেঙে পড়ে যেতে নিলেই হঠাৎ কেউ এসে ধড়ে ফেলল। সায়র পাশ ফিরে সানায়াকে দেখে আরো রেগে গেল। সানায়া চিন্তিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল,

“কি হয়েছে, ভাইয়া? আর ইউ ওকে?”
সায়র শুধু অস্পষ্ট বাক্যে উচ্চারণ করল,
“আনায়া, কিডন্যাপ হয়েছে।”
সানায় কথাটা শুনতেই মনে হলো আকাশ থেকে পড়ল। আনায়া তো এসব চায়নি৷ কে করল এসব? আহিল? কিন্তু আহিল তো এখানে। তাহলে কে করল?

“স্যার, বাচ্চাটা কাঁদছে বার বার। প্লিজ আমরা বাচ্চাটাকে ফিরিয়ে দেই?”
২৭/২৮বয়সী একটা ছেলে কথাটা বলতে দেরি কিন্তু তার গালে থাপ্পড় পড়তে দেরি হলো না। সামনে বসে থাকা বয়স্ক লোকটা গর্জন করে বলে উঠল,
“ওর জন্য এত মায়া লাগলে তোর নিজের মেয়েকে এনে দে।”
ছেলেটার কলিজা ধক করে উঠল। চুপ করে গেল সেকেন্ডের মাথায়। লোকটা এবার শান্ত বাক্যে বলল,
“মায়াকে খবর দাও, বাচ্চাটাকে সামলাতে বলো। যাও।”
ছেলেটা প্রতিউত্তরে মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। ছেলেটা চলে যেতেই লোকটা বিশ্রি ভাবে হেসে উঠল,
“মেহরিশ মা আমার, খুব শিঘ্রই তুমি তোমার জীবনের সবথেকে ভয়ংকর সত্য জানতে পারবে। জানতে পারবে তুমি কে, কি তোমার পরিচয়? তোমার জন্য আমি আমার মেয়েকে হারিয়েছি, তাই তোমাকেও তোমার মেয়েকে হারাতে হবে।”

ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ৯

সায়র পাগলের মতো ছুটছে এদিক সেদিক। কাগজ পত্র সব ঠিক করে টিকেট কয়াটা, একদিনের ভেতর সব কিছু ম্যানেজ করা সম্ভব না। সায়রের ইচ্ছে করছে এক্ষুনি মেহরিশের কাছে উড়ে চলে যেতে। মন, মস্তিষ্ক প্রশ্ন করছে বার বার, কে এই শত্রু? আহিল? কিন্তু আহিল নিজের মেয়েকে কিডন্যাপ করে নেওয়ার হলে এতদিনেই পারতো। তাহলে কে এই অদৃশ্য? কি শত্রুতা মেহরিশের সাথে? আনায়া ঠিক আছে তো?

ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ১১