ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ২২
জেনিফা চৌধুরী
প্রাক্তন স্বামী আহিলের কোলে ছোট্ট মেয়ে আনায়াকে দেখে মেহরিশ কেঁপে উঠল। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। দৌড়ে গেলো সামনের দিকে। এক প্রকার কেড়ে নিল আনায়াকে। আনায়াকে এনে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখল। মেহরিশের কান্ডে সায়র, আহিলসহ উপস্থিত সবাই অবাকের শেষ সীমানায়। আহিল হালকা হেসে বলে উঠল,
“তোমার মেয়ে, তোমারই থাকবে। আমি কখনো তোমার মেয়েকে ছিনিয়ে নিব না।”
মেহরিশ এবার চিৎকার করে বলল,
“আমার বাড়িতে ঢোকার পারমিশন আপনাকে কে দিয়েছে?”
সায়র শান্ত বাক্যে বলল,
“আমি।”
মেহরিশ থমকাল। মনে হলো কেউ বুকের ভেতরে আঘাত করল। অস্পষ্ট স্বরে বলল,
“আপনি?”
কয়েক সেকেন্ড থেমে পুনরায় বাজখাঁই স্বরে বলে উঠল,
“আনায়া আমার মেয়ে__কথাটা ভুলে গেছেন? এই বাড়িটাও আমাদের৷ তাহলে আপনি কোন সাহসে আমাদের পারমিশন ছাড়া আহিলকে এই বাড়িতে এনেছেন?”
সায়র তখন শান্ত, শীতল বাক্যেই বলল,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“আনায়া আপনার মেয়ে__কথাটা অনিবার্য সত্য। তবে আনায়া যে আহিলেরও মেয়ে__কথাটা তো মিথ্যা নয়? আহিল স্বামী হিসেবে না হয় খারাপ, বাবা হিসেবে খারাপ নয়। পৃথিবীর কোনো বাবা খারাপ হতে পারে না, আর যারা হয় তারা হলো জঙ্গলের জা°নোয়ার। হ্যাঁ, আমি মানছি আহিল নিজের সন্তানের দায়িত্ব না নিয়ে ফেলে এসে জঘন্যতম কাজ করেছে। কিন্তু একটা মানুষ যখন নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয় তাহলে কি তাকে একটা সুযোগ দেওয়া যায় না? আহিল অপরাধী, তাই বলে কি আহিল নিজের মেয়েকে এক নজর দেখতে পারবে না? ছুঁতে পারবে না?”
মেহরিশ তখনও শান্ত। উত্তর দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেল না। মেহনূর তখন মুখ খুলল। বলল,
“আপু, আহিল ভাইয়া যদি খারাপও হয় তবুও তার সম্পূর্ণ অধিকার আছে মেয়েকে দেখতে পারার।”
নীলিমা বেগম এগিয়ে গেলেন মেহরিশের দিকে। মেহরিশের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“মা, এত ভয় নিয়ে বেঁচে থাকিস না। ভয় নিয়ে বেঁচে থাকা মানে মৃ°ত্যুকে সেচ্ছায় গ্রহণ করা। আর সেচ্ছায় মৃত্যু মানে পাপ।”
মেহনূর এর মধ্যেই ফিচলে হেসে মিনমিনিয়ে বলল,
“যে নিজে পাপকে ঘিরে বেঁচে আছে, সে আবার অন্যকে পূন্যের বানী শুনায়। হাস্যকর!”
কথাটার মানে সায়র আর নীলিমা বেগম বুঝলেও মেহরিশ বা আহিল কেউ বুঝল না। মেহরিশ কিছু প্রশ্ন করার মতো খেয়ালেই ছিল না। আহিল এবার নিরবতা কাটিয়ে বলল,
“মেহরিশ, আমার মেয়েকে শুধু দেখতে দিও। কথা বলতে দিও। ছুঁতে দিও। ভালোবাসতে দিও। অল্পস্বল্প দায়িত্ব পালন করতে দিও। ব্যস! আর কিছু চাই না। ভাগ চাইনা আমি। আমি চাই শুধু আমার রক্ত জানুক আমি ওর বাবা৷ ঘৃণা করুক তবুও তাকে দেখার ভাগ্য আমার হোক।”
মেহরিশ কাঠকাঠ গলায় বলল,
“আপনি নিজেকে সংযত করে রাখতে পারলে আপনার মেয়ের ভালোবাসা থেকে আমি আপনাকে বঞ্চিত করব না। কিন্তু ভুলেও মেয়েকে নিয়ে যেতে আসবেন না”
আহিল আর কথা বাড়াল না। আনায়ার কপালে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে আদুরে স্বরে বলল,
“আমার মা, অনেক বড় হও। মায়ের মতো ভালো মানুষ হবে। বাপের মতো জঘন্য হবে না কিন্তু।”
মেহরিশ এক নজর তাকাল আহিলের দিকে। আহিলের চোখের কোনে অশ্রু৷ ঠোঁটে হালকা হাসি। আহিলের চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।
আহিল সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। সেদিন আনায়ার কিডন্যাপ হওয়ার খবর শোনার পর থেকে আহিল শান্তি পাচ্ছিল না। এক নজর দেখার জন্য মন ছটফট করছিল। তাই টিকেট ম্যানেজ করে ছুটে এসেছে আনায়াকে দেখতে। আহিল চলে যেতেই সায়র থমথমে গলায় বলে উঠল,
“আমাকে বিশ্বাস না করুন, ভালো না বাসুন প্রবলেম নেই। কিন্তু সবার সামনে অপমান করার রাইটও আপনার নেই, মেহরিশ। হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন আনায়া আপনার মেয়ে। আনায়ার প্রতি যত, দায়িত্ব, কতব্য, অধিকার সব আপনার একার আছে, মানছি। তবে কাগজে কলমে আপনি আমার স্ত্রী তাই আনায়ার প্রতি সামান্য হলেও আমার অধিকার জন্মেছে__এটা তো অস্বীকার করতে পারবেন না? এই বাড়িটাও আপনাদের। তাহলে আমি কেন পড়ে আছি এখানে? আপনার জীবনে কি জোর করে জায়গা করে নিয়েছি, মেহরিশ? অবশ্য জোর করেই তো বিয়ে করেছি৷ আমার প্রতি আপনার এত তীক্ততা যে, নিজের প্রাক্তন স্বামীর সামনেও আমাকে অপমান করতে পিছপা হলেন না? বাহ! ওকে, ফাইন। আপনি যেদিন আমাকে ভালোবাসতে পারবেন, সম্মান করতে পারবেন, সেদিন আমি আবার আপনার সামনে আসব৷ তার আগে আমার মুখও আপনাকে দেখব না৷”
বলেই আনায়ার গালে চুমু খেয়ে বড় বড় পা ফেলে চলে গেল। মেহরিশ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীলিমা বেগমও কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গেলেন। মেহনূর শুধু শান্ত বাক্যে বলল,
“আপু, সায়র ভাইয়ার মতো রত্নকে পায়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিস না। নিজেকে শক্ত খোলস থেকে বের করে নিয়ে এসে, সুন্দর ভাবে বাঁচতে শিখ।”
বলে সামনে দুই পা এগিয়ে আবার থেমে গেল। পেছন ফিরে পুনরায় বলে উঠল,
“আপু, জীবনের কিছু সত্য খুব তিক্ত হয়। তাই সময় থাকতে জীবনটাকে গুছিয়ে নে। নয়তো খারাপ সময়ে কারোর কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে অব্ধি পারবি না।”
সবাই চলে যেতেই মেহরিশ সায়রের বলা কথা গুলো ভাবতে লাগল। আনায়াকে বুকে জড়িয়ে ডুঁকরে কেঁদে উঠল। নিজে নিজে বলতে লাগল,
“আমি আপনাকে এভাবে আঘাত করতে চাইনি, সায়র। আহিলকে হঠাৎ দেখে নিজেকে সামলাতেও পারিনি।”
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। চারদিকে অন্ধকার নামছে। হঠাৎ কলিং বেলের শব্দ ভেসে আসল। এই সময় কে এলো? বাসায় আর কেউ না থাকায় অনিচ্ছা স্বত্তেও গিয়েও সায়র দরজা খুলল। সানায়াকে দেখে আকাশ থেকে পড়ল। চমকিত বাক্যে বলে উঠল,
“সানায়া! সানায়া!
সায়র অবাক স্বরে বলে উঠল,
“তুই? এখানে? মাকে একা রেখে তুই চলে আসলি? আমাকে একটাবার জানানোর প্রয়োজন বোধ করিসনি?”
সানায়া চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। অতঃপর সায়রকে সাইড করে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে উত্তরে বলল,
“আমি কোথায় যাব না যাব তা কি তোমার থেকে পারমিশন নিয়ে যেতে হবে?”
সায়র অবাক হয়ে তাকাল। কড়া বাক্যে জিজ্ঞেস করল,
“আমি তোর ভাই ভুলে গেছিস?”
সানায়া হাসল। হাসতে হাসতে বলল,
“ যে ভাই বোনের মন বুঝেনা, বোনকে সপোর্ট করতে পারে না তাকে অন্তত আমি নিজের বিষয় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দিতে পারিনা।”
সায়রের কেন যেন বুকের ভেতরট দুমড়েমুচড়ে উঠল। এক মাত্র বোনের থেকে এমন বাক্য কোনো ভাইয়ের কাম্য নয়। সায়র আর কথা বাড়াল না। দরজা আটকে শান্ত বাক্যে বলল,
“বাসায় রান্না করা নেই, রান্নার কোনো উপকরণও নেই৷ আমি খাবার অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি। তুই ফ্রেশ হয়ে নে। আমি রাহেলা খালাকে ফোন করে আসতে বলছি। খালা আসলে তোর রুমটা ভালোভাবে পরিষ্কার করে দিতে বলিস।”
বলেই নিজের রুমে চলে গেল। সানায়াও আর কথা বাড়াল না। সায়র চলে যেতেই সানায়া নিজে নিজে বলে উঠল,
“যে মেয়েটা আমার চোখে তোমাকে ভিলেন বানিয়েছে, তার জীবনটা ছারখার না করা অব্দি আমার শান্তি নেই।”
অতঃপর ওয়াইফাই কানেক্ট করে কাউকে কল দিল। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করতেই সানায়া বলে উঠল,
ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে পর্ব ২১
“আলিশা আপু, তুমি কখন এন্ট্রি নিচ্ছো?”
ওপাশ থেকে উত্তর আসল,
“আমি এন্ট্রি নিলে ধামাকা হবে, বেবস। একটু মশলাদার ধামাকার জন্য অপেক্ষা তো করতেই হবে।”
বলেই ফোন রেখে দিল। ফোন কাটতেই সানায়া বলে উঠল,
“সরি ভাইয়া, আমার থেকে আমার ভালোবাসাকে কেড়ে নেওয়ার শাস্তিস্বরূপ তোমাকেও ভালোবাসা হারাতে হবে।”