ধূসর রংধনু পর্ব ২৭

ধূসর রংধনু পর্ব ২৭
মাহিরা ইসলাম

নিস্তব্ধ বিকেল।আকাশে গুমোট ভাব স্পষ্ট বিদ্যমান।
সূর্য্যিমামার দেখা নেই আকাশে।তাই তার অস্ত যাওয়ার ক্ষণ ও বলা ভারী মুশকিল।
আর আজ নিস্তব্ধ আসবে কিনা তা বলাও তৃপ্তির জন্য ভারী মুশকিল।
তৃপ্তি আঁধা ঘন্টা যাবত বসে আছে সুনামধন্য এক পার্কের বেঞ্চিতে।কতশত মানুষের আনাগোনা এই পার্কে অথচ তার প্রণয়পুরুষেরই আসার নাম নেই। আঁধা ঘন্টা কেন সারাদিন রাত বসে থাকতেও তার কোনো আপত্তি নেই।
হ্যাঁ তার প্রণয় পুরুষ তো নিস্তব্ধ ব্যতীত আর কেউ নয়।
আজ তৃপ্তি তাকে দেখা করতে বলেছে এই পার্কে।আজ সে নিস্তব্ধ কে নিজের হাতের মুঠোয় পুরতে আর একটু চেষ্টা করবে।

নিস্তব্ধ হাজির হলো আরো দশ মিনিট তৃপ্তি কে অপেক্ষা করিয়ে।
এসেই সে তৃপ্তির সামনের বেঞ্চে বসে গম্ভীর স্বরে বলল,
-” কি দরকারে ডেকেছিস দ্রুত বল?আমার হাতে এত সময় নেই।”
নিস্তব্ধ’র আগমনে তৃপ্তি যেমন খুশি হলো সঙ্গে আর একটু আবেদনময়ী ভঙ্গিতে বসার চেষ্টা করলো নিস্তব্ধ কে নিজের দিকে আকর্ষণের তাগিদে।
নিস্তব্ধ’র সে দিকে ধ্যান নেই।সে ব্যস্ত তার ফোন স্ক্রল করতে।
তৃপ্তি গলা খাঁকারী দিয়ে বলল,
-” শুনলাম তোর বউ নাকি তোকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা বলেছে?”
নিস্তব্ধ ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“তো?”
তৃপ্তি নিজের স্বর আর একটু মধুর করার চেষ্টা করে বলল,
-“ডিভোর্সটা বরং দিয়েই দে বুঝলি?”
নিস্তব্ধ এবারে তৃপ্তির দিকে একভ্রু উঁচিয়ে চাইলো। বোঝার চেষ্টা করলো এরপর সে কি বলবে।
তৃপ্তি আবারো বলতে লাগলো।
-” দেখ লো ক্লাস একটা মেয়ে, তার উপর এতিম, তোকে ডিভোর্স দিতে চায় তুই ভাবতে পারছিস।যেখানে ওই মেয়ের মুখের উপর তুই ডিভোর্স পেপার ছুঁড়ে ফেলবি।সেখানে ওই মেয়ে তোকে ডিভোর্স দিতে চাচ্ছে। ওর কোনো ক্লাস আছে।তাছাড়া তুই তো ওকে মানিস না।দেখ তোর জন্য তো মেয়ের অভাব পড়বে না।এই আমাকেই দেখ। ”

-” ওয়েট ওয়েট ওয়েট।তুইএসব বলার জন্য আমায় এখানে ডেকেছিস, রাইট? ”
-” এসব বলার জন্য মানে।নিস্তব্ধ তোকে আমি এতগুলো দিন যাবত ভালোবাসি অথচ তুই আমাকে বার বার অপমান করেছিস।ওই সামান্য পুঁচকে মেয়ের মাঝে কি পাবি তুই বল কি পাবি।আমি তোকে যতটা সুখ দিতে পারবো,ওও কি তোকে ততটা সুখ দিতে পারবে। তোকে বহন করার ক্ষমতা আছে ওর।গেঁয়ো ক্ষ্যাত।সমান্য সরকারি মেডিকেলেই চান্স পেতে পারলো না।আবার তোদের টাকায় ফুটানি মেরে বেসরকারিতে পড়ছে।”
তৃপ্তি নিস্তব্ধ হাত ধরতে গেল।তবে সেটা আর হয়ে উঠলো না।তার আগেই বাড়ানো হাতটা তার গালে গিয়ে ঠেকলো।
তৃপ্তি হাত বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নিস্তব্ধ ঠাস করে ওর গালে চর মেরে দিলো কষিয়ে।
রাগের নিস্তব্ধ’র শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।
নিস্তব্ধ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

-” কথাগুলো কান খুলে শুনে রাখ। তোকে আগেও বলেছি আবারো বলছি।তাসফি আমার ওয়াইফ।ডিভোর্স দেওয়ার জন্য তো আমি ওকে বিয়ে করিনি।তাছাড়া আমার ওয়াইফ কে আমি ডিবোর্স দেব কি না দেব তুই বলার কে।আমার ওয়াইফ লো ক্লাস নয় বরং তোর স্ট্যাটাস লো ক্লাস।আর তুই আমায় কি সুখ দিবি বে।তোর মতো পতিতার পাশ দিয়েও এই নিস্তব্ধ ইয়াসার হাঁটে না।শুধুমাত্র কোনো একসময় বন্ধু বলে পরিচয় দিয়েছিলাম আর একজন মেয়ে বলে আজ তুই বেঁচে গেলি।নাহলে জ্যান্ত পুঁতে রাখতাম তোকে আজ এখানেই।
আর এসব ভালোবাসা ভালোবাসা না ছাড়।কেন হাজারটা পুরুষের নিচে যখন শুয়ে পড়তিস তখন এসব ফাউল ভালোবাসা ছিল কোথায় তোর।
আমার পিছনে না পড়ে থেকে বেচারা সুজন তোকে এতগুলো বছর ধরে ভালোবাসে কই সেগুলো তোর চোখে বাঁধে না। আমার পিছু ছেড়ে না এবার একটু ছেলেটার দিকে চোখ দে।”

-“নিস্তব্ধ আমার কথাটা শোন…”
নিস্তব্ধ আবার তার গালে চর বসিয়ে দিলো।
আশেপাশের মানুষ আড় চোখে চাইছে।সার্কাস দেখতে কারই না ভালো লাগে।
-” যা বললাম মাথায় গেঁথে নিস”
এই লাস্ট বার ওয়ার্নিং দিলাম।সূধরে যা।
বলেই নিস্তব্ধ আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না।
ভর সন্ধ্যা বেলায় তৃপ্তি গাঁলে হাত দিয়ে নিস্তব্ধ’র যাওয়ার পানে শূন্য মস্তিষ্কে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।
আশেপাশের মানুষ তার পাশ দিয়ে যাচ্ছে আর কটুক্তি করছে।একেই বলে নিজের পায়ে কুড়াল নিজে মারা।
নিস্তব্ধ তার বহু বছরের ভালোবাসা।

প্লে থেকে পঞ্চম শ্রেনি পর্যন্ত তৃপ্তি নিস্তব্ধ সাথেই একই স্কুলে পড়াশোনা করেছে।ছেলেটা ছিল একটু আলাদা। সবার সঙ্গে কম কথা বলতো।ক্লাসে ছিল ফাস্টবয়।তৃপ্তি তাকে সবসময় লুকিয়ে লুকিয়ে অবলোকন করতো।প্রেমের অর্থ না বুঝতে পারলেও নিস্তব্ধ’র করা সকল কার্যক্রম তার ভীষণ ভালো লাগতো।ক্লাস ফাইভে থাকাকালিন তৃপ্তি বুঝতে পারলো সে নিস্তব্ধকে অনেকটা পছন্দ করে।যেটা অন্য সব পছন্দের চেয়ে একটু আলাদা। কোনো মেয়েকে নিস্তব্ধ’র আশে পাশে দেখলে তার হিংসে হতো।
এমনকি ছেলেদের সঙ্গে নিস্তব্ধ যখন কথা বলতো তখন ও তার রাগ হতো।তার সঙ্গে কখনো কথা বলে না অথচ দেখ কি সুন্দর ওদের সঙ্গে কথা বলছে।

একদিন নিস্তব্ধ’র স্কুল ব্যাগের চেইন খোলা দেখতে পেল।
তৃপ্তি কি করবে বুঝে পেল না। ডাকবে কি ডাকবে না।
হাজারটা চিন্তা করতে করতে সে বলে উঠলো,
-” এই নিস্তব্ধ শুনছো তোমার চেইন খোলা।”
নিস্তব্ধ থেমে গেল। তার হাঁটা থামিয়ে দিল।ভ্রু কুঁচকে পিছু ঘুরে চাইলো।
তৃপ্তি আমতা আমতা করে বলল,
-” তোমার ব্যাগের চেইন খোলা।”

নিস্তব্ধ ওহ বলে কাঁধ হতে ব্যাগ নামিয়ে দেখে সত্যি চেইন খোলা।
অতঃপর তা লাগিয়ে তৃপ্তির উদ্দেশ্যে বলল,
-” থ্যাংকস।”তৃপ্তি কে আর পায় কে।এত ভালো লেগেছিলো সেদিন তার।নিস্তব্ধ সেই তার সঙ্গে প্রথম এবং শেষ কথা বলেছিল স্কুল লাইফে।
এরপর? এরপর ওদের দুজনের পথটা আবার আলাদা হয়ে গেল। নিস্তব্ধ অন্য স্কুলে আর তৃপ্তি আরেক স্কুলে। দীর্ঘ পাঁচটি বছর সে নিস্তব্ধ’র দেখা পায়নি।

আগের বোকা সোঁকা ভদ্রবাচ্চা তৃপ্তি হয়ে উঠলো ধুরন্ধর, বদমেজাজি, অহংকারী আর হিংসুটে।
ক্লাস টেন এ থাকতে তার বাবা মা নিজেদের স্বার্থে সেপারেট হয়ে গেল।কেউ ভাবলো না তৃপ্তির ভবিষ্যতের কথা।
তৃপ্তি থাকতে শুধু করলো বাবার কাছে।
বাবা নিত্যনতুন মেয়ে এনে ঘরে ফূর্তি করতো।
বাবা তাকে ভীষণ আদর করতেন কিন্তু বাবার ওই একটাই ছিল খারাপ অভ্যাস।মেয়েবাজি।
আর কখনো বিয়েও করলেন না। এখন অবশ্য তার শিক্ষা হয়েছে এখন আর মেয়েবাজি করেন না তার বাবা।হজ্ব করে এসেছেন।
কিন্তু যা ক্ষতি করার তার বাবা তো তার করেই ফেলেছে।এই একটা কারণেই তে নিস্তব্ধকে আজও সে নিজের কাছে টানতে পারে না।

বাবার এসব কার্যকলাপ দেখে তৃপ্তি রাগে দুঃখে একাধিক ছেলের সঙ্গে মিশতে শুরু করলো।
কলেজের প্রথম বছরটা তৃপ্তির কাটলো একটা ঘোরের মাঝে। বাজে নেশার সঙ্গে খারাপ বন্ধু, যার তার সাথে ইন্ট্রমেট হওয়া যেন তারও বাবার মতো নেশায় পরিনত হতে লাগল।আর তারপরেই এলো তার জীবনের ভয়াবহ দিন গুলো।
একদিন নেশা করে ছেলেদের সঙ্গে ইন্টিমেট হয়ে উলঙ্গ অবস্থায় এক হোটেলে ধরা খেল পুলিশের হাতে।
ব্যস টানা পনোরো দিন সে কাটিয়েছে জেলে।

তার বাবা মেয়ের দিকে সেদিন অসহায় চোখে তাকিয়ে ছিলেন।আর তৃপ্তি তাকিয়ে ছিল ঘৃণার চোখে।
তার বাবা সেদিন খুব ভালো করে নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছিলেন। বুঝতে তো হবেই।
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর মাদকের নেশা ছাড়াতে একমাস যাবত সে ছিল অ্যাসাইলামে।
বাড়ি ফেরার পর আর বাবার অসব কর্মকান্ড দেখেনি তৃপ্তি।
এরপর বাবা তাকে অন্য কলেজে ভর্তি করালো যেন পূনরায় তার পরিচিত বাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশতে না পারি আর সেখানেই সে দেখা পেল আবারো নিস্তব্ধ’র। পুরনো অনুভুতি তার আবারো জাগ্রত হলো।সে নিজেকে ছেলেদের সঙ্গে মেশার বাজে অভ্যাস থেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করলো।এবং সফল ওও হলো।
কিন্তু নিজের অহংকার, আর বদমেজাজ কোনোটাই সে পাল্টাতে পরলো না।ধীরে নিস্তব্ধ’র সাথে সে বন্ধু গড়ে তুললো।

মেডিকেল লাইফে তৃপ্তি তাকে দুবার প্রোপোজ ও করেছিল কিন্তু নিস্তব্ধ দুবারই তাকে রিজেক্ট করেছে।
বলেছে সে এসব প্রেম ভালোবাসায় জরাতে চায় না। তৃপ্তির অতীত নিস্তব্ধ কিভাবে যেন জনে গিয়েছিল।আর তারপর থেকেই নিস্তব্ধ চোখে সে আর তাদের বন্ধুত্বটা দেখতে পায় না। পায় শুধু অধিকাংশ ঘৃণার আস্তরণ।
তৃপ্তি বেঞ্চে বসে হাওমাও করে কান্না করতে লাগলো।
সে একটা অপদার্থ। কারো ভালোবাসা পাবার যোগ্য নয় সে।
একটা মানুষ তো এমনি এমনি খারাপ হয় না। তার চারপাশের পরিবেশে প্রভাবিত হয়ে তবেই সে কোনো খারাপ পন্থা বেঁছে নেয়।

এই যে আজকাল যেসমস্ত মেয়েগুলো খারাপ বের হয় তারা কেন খারাপ হয়? এই অসুস্থ সমাজের কারণেরই।
সারাক্ষণ ফোনে নোংরামি দেখে দেখে তাদের মস্তিষ্কের মাঝেও নোংরামির নেশা চেঁপে ধরে ঠিক তৃপ্তির মতো।
রবের প্রতি তারা বিশ্বাস হারাতে শুরু করে।
নিজেকে নিজের সর্বেশর্বা ভাবতে শুরু করে। বাবা মার সঙ্গে তারা খারাপ ব্যবহার করে। একসময় তারা এতটাই টক্সিক হয়ে ওঠে যে মানুষের ভালো কথাও তাদের গায়ে বিষের মতো ফোটে। অথচ যদি দেখে কোথাও নোংরামি আলোচনা হচ্ছে সেখানে তারা ঝাপিয়ে পড়ে৷ হাসি ঠাট্টায় মেতে ওঠে নিরন্তর।
অথচ তাদের মাঝে থাকেনা কোনো অনুশোচনা না মৃত্যুর প্রতি ভয়।

তারা ভুলে যায় একদিন তাদের ওও মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে। কি করবে সেদিন তারা কি জবাব দেবে সেদিন তারা নিজের সৃষ্টিকর্তার সামনে দাঁড়িয়ে।তাদের দুহাতের সঙ্গে সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গই যে শুধু নোংরামিতে ভরা।
এই দুনিয়া যে সামান্য জেলখানা। তা কি তারা বুঝেনা।
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। সন্ধ্যা শেষে রাত নামলো। মানুষের আনাগোনা কমতে লাগলো।একসময় একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গেল চারিধারের মানুষের আনাগোনা দ।গভীর আধারে ছেয়ে গেল চারিপাশ। মেঘে গুরুম গুরুম শব্দ হলো।
ধরণীর বুক চিরে হালকা ঝিরিঝিরি বর্ষনের ক্ষুদ্র কণার দেখা মেললো। তবুও তৃপ্তি সেই এক জায়গাতেই হাটু গেঁড়ে বসে রইলো।

বর্ষনের মাত্রা অত্যাধিক নয় হালকা। তবুও তা পরতে রইলো ঘন্টা ধরে।
তৃপ্তি হঠাৎ বুঝতে পারলো আধ ঘন্টা যাবত তার গায়ে কোনো বৃষ্টির ফোটা লাগছে না।আর নাতো এতক্ষণে দূরের সেই ল্যাম্পোস্টের সুক্ষ্ম রশ্মিটা আর সে তার হাটুর নিচ দিয়ে দেখছে।
কারো আবছা ছায়া। কে আসবে তার খোঁজ নিতে
তাকে নিয়ে যে কারো টেনশন নেই। তৃপ্তি মাথা তুলে চাইলো।মাথাটা ভার হয়ে আছে।
তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক সুদর্শন যুবকের অবয়ব। যে তার মাথায় দীর্ঘক্ষণ যাবত নিঃশব্দে ছাতা ধরে আছে।
অথচ যুবকের চোয়াল বেয়ে পড়ছে বৃষ্টির প্রতিটি ফোটা।
সে এক অদ্ভুত ছন্দ।

যুবকটি কে এই তো তৃপ্তি এই অন্ধকারের মাঝেও হালকা আবছা আলোয় সুজনের মুখখানা হালকা করে দেখতে পাচ্ছে।
সুজন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার প্রিয়তমার দিকে।তৃপ্তি এই মুহুর্তে যেন একটি আদুরে বিড়ালছানা।তার মাঝে নেই কোনো অহংকারের লেশ মাত্র। নেই কোনো অভদ্র অশালীন আচরণ।
দুঃখের সাগরে ভেসে কেই বা নিজের নোংরামি সত্তা কে চিরন্তন জাগ্রত রাখতে পারে।
দুঃখের জোয়ারে ভাসার পরেই তো মানুষের জাগতিক জ্ঞান জাগ্রত হয়।
দুঃখ শেষে পুনরায় সে জ্ঞান লোপ পায়।আবারো হয়ে ওঠে দুর্বল থেকে হিংস্র। একই অঙ্গে তাদের কত রুপ। হায়রে মনষ্য জাতি!
তৃপ্তি হাতে ছাতাটা ধরিয়ে দিয়ে গম্ভীর সুজন একটি ছোট্ট বাক্য উচ্চারণ করলো,

-” বাড়ি ফিরে যা।”
অতঃপর সুজন যেমনি নিঃশব্দে আগমন করেছিল।তেমনি নিঃশব্দে প্রস্থান করলো।
যেমন করে মানুষের মনে প্রেম ফাগুনের বাতাস নিঃশব্দে আগমন করে।আবার সময় শেষ হলে নিঃশব্দে তা প্রস্থান করে।ফাগুন তো চিরকাল রয় না।
“বাড়ি ফিরে যা।”
বাক্যটি কোন ধরনের পর্যায় পরে? আদেশ নাকি অনুরোধ জানে না তৃপ্তি। তবে সে তাই মেনে নিলো।
হোকনা কখনো নিজের নিয়মের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে অদ্ভুত আচরণ করা।
জীবনটাকে তো একটু সীমার মাঝে থেকে উপভোগ করা দরকার।

পরদিন কলেজে গিয়ে তাসফি তার চারপাশের পরিবেশ অবলোকন করে বুঝতে পারলো আজ কলেজে কিছুটা উৎসব মুখোর পরিবেশ। চারপাশ ফুলদিয়ে সাজানো।
একটু এগিয়ে দেখলো আশা,আরাধ্য, সর্নিধি ওরা সবাই দাঁড়িয়ে আছে ক্লাসের বাইরে।
তাসফি সেদিকে এগিয়ে গেল।
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলে কি ব্যাপার বলতো?
আরাধ্য হেঁসে বলল,
-” আরে জানিস না আজ ইশতিয়াক স্যারের শিক্ষকতার শেষ দিন কলেজে।এরপর থেকে তিনি আর আমাদের পড়াবেন না। তাই ওনার বিদয় উপলক্ষে এত আয়োজন।
তাসফি অবাক কন্ঠে বলল,

-” ওয়েট ওয়েট।কেন। স্যার খুব ভালো এক্সপার্ট একজন ডাক্তার। সমস্ত বিষয় খুব ভালোভাবে বোঝাতেন তিনি আমাদের তবে?
আশা বলল,
-” আরে উনি নাকি বিদেশ যাবেন ছেলে মেয়ের কাছে। বার্ধ্যকের সময়টা নাকি উনি ছেলে মেয়ের সঙ্গেই কাটাতে চান। তাই বাংলাদেশের সঙ্গে সঙ্গে এই হসপিটাল ও কলেজ ছাড়বেন।”
তাসফি তাল মিলিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
-” বার্ধ্যকের একটা সময় এসে সকলের কাজ থেকে ছুটি নেওয়া উচিত যদি তার বাড়িতে কর্মজীবী সন্তানেরা থেকে থাকে।
একটা ছেলে সারাটা জীবন পরিবার, সংসারের জন্য খেটে যায়।সারাদিন অফিস, নয় নিজ নিজ পেশায় নিয়োজিত কর্মস্থলেই তাদের কেটে যায়।
স্ত্রী সন্তানের নিকট ওই রাতটুকুই বরাদ্দ।
তাই এই সময়টা অন্তত সব কিছু কে বিরত রেখে, পরিবার কে সময় দেওয়ার সঙ্গে রবের বন্দেগী করা উচিত।মৃত্যুর ডাক কখন চলে আসে বলা তো যায় না।

চারপাশের মানুষের এত কিচিরমিচির তাসফির ভালো লাগছে না। আগে জানলে সে কখনো আসতো না। তাছাড়া আজ ক্লাস হবে বলে মনে হয় না।
তাসফি শান্ত একটি পরিবেশ খুঁজে সেখানে একটি বেঞ্চে মাথা এলিয়ে বসে রইলো।
ক্লাসে আর কারো টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না। তাতে সে নিশ্চিত হলো।
হঠাৎ সামনে কারো উপস্থিত বুঝতে পেরে তাসফি মাথা তুলে চাইলো।
নিস্তব্ধ’র গম্ভীর মুখখানা অবলোকন করতেই তাসফি চট করে উঠে দাঁড়ালো।
এই লোকের জন্য কোথাও বসেও সে শান্তি পাচ্ছে না। ভারী মুশকিল হলো তো।
তাসফি ক্লাস থেকে বের হতে গেলে নিস্তব্ধ বাঁধা দিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালো।
তাসফি তার ডান পাশ দিয়ে বের হতে গেলে নিস্তব্ধ তার বাম হাত দিয়ে সে স্থান বদ্ধ করে দিলো।
বাম পাশ দিয়ে বের হতে গেলে নিস্তব্ধ তার ডান হাত উঁচিয়ে একি কাজ করলো।
তাসফি নিস্তব্ধ’র দিকে বিরক্তি নিয়ে চাইলো।
নিস্তব্ধ এক ভ্রু উঁচিয়ে চাইলো।
মুখে বলল,

-” কথা বলবেন না ম্যাডাম?”
তাসফির নিস্তব্ধ’চোখের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো।
নিস্তব্ধ হাত ঢিল হয়ে পড়তেই তাসফি চট করে পাশ দিয়ে বেরিয়ে এলো।
নিস্তব্ধ তার পিছু ডাকলো।
-” এই যে ম্যাডাম শুনুন তো।”
তাসফি তাকে ভেঙচি কেটে চলে গেল।
মনে মনে বাঁকা হেঁসে বলল,
-” ডাক্তার সাহেব আপনি যতই এই তাসফিকে ধরতে চেষ্টা করেন না কেন।সে তো এত দ্রুত ধরা দেবে না।উহু! প্রশ্নই উঠে না।”
নিস্তব্ধ শক্ত চোখে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে বলল,

-” সবসময় আপনার এই ট্রিক্স কাজে লাগবে না মিসেস নিস্তব্ধ ইয়াসার। আমার সব দুর্বলতা তো আপনি জানেন না। তবে কি করে তা ক্ষণে ক্ষণে কাজে লাগাবেন শুনি।তবে ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং। আই লাইক ইট। ”
তাসফি আজ বাড়ি ফিরতেই তার দাদি কমলা বেগম আহাজারি শুরু করলেন।
-” ওমন সুন্দার পোলাডারে ছাড়িস না রে মাইয়্যা।পরে পস্তাইবি রে। কত সুন্দার পোলাডা। ”
তাসফি বিরক্ত হয়ে নিজের ঘরের দ্বার দিলো।
দাদির এক প্যাঁচাল৷ শুনতে শুনতে সে অসহ্য।
তাসফি ফ্রেস হয়ে ওয়্যারড্রবের কাছে গেল।

মনটা একটু খারাপ হলেই তার বাবার বাবার চিঠি গুলো পড়তে ভীষণ ভালো লাগে।
আজ তাসফি ভুলবশত হয়তো বেলকনির দরজাটা না লাগিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে।
সেদিনের আবছা অবয়বের সুদর্শন যুবকটি পুনরায় এসে অর্ধরাত কাটিয়ে দিল শিমুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে তার প্রেয়সীর সুন্দর মুখখানা অবলোকন করতে করতে।কখন রাত দুটো পেরিয়ে তিনটে বাজতে চলল তার হদিশ নেই।
ভয়ের দরুণ মেয়েটা রুমের লাইট জ্বালিয়েই ঘুমায়।
অবশ্য এতে তার সুবিধাই হয়।
বেলকনি তে কোনো রেলিং নেই, কোমর সমান রেলিং গাঁথা। সে চাইলেই নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকতে পারে।
তবে সে তা করবে না।কি দরকার লুকিয়ে সব করার।
যা করার সামনাসামনি করবে সে।
সে তো ভীতু নয়।
তার ভেতরকার সত্তা বিদ্রুপ করে বলে,

ধূসর রংধনু পর্ব ২৬

-” হুহ ভীতু নয়।ভীতু নয় দেখেই তো তুমি এভাবে
চোরের মতো তাকে লুকিয়ে দেখতে আসো।সাহস থাকলে সামনে গিয়ে দেখা দাও।হাহ ভীতু যুবক।
সুদর্শন যুবকটি তাকে ভীষণ করে শাঁশায়,
-” চুপপ।”

ধূসর রংধনু পর্ব ২৮