ধূসর রংধনু পর্ব ৫৪

ধূসর রংধনু পর্ব ৫৪
মাহিরা ইসলাম

নিস্তব্ধ ভ্রু কুঁচকে মাহীনের চিঠিখানার দিকে তাকিয়ে আছে।
প্রিয় নিস্তব্ধতা,
প্রথম সম্মোধন টুকু পড়েই নিস্তব্ধ’র মেজাজ বিগড়ে গেল। আশ্চর্য তার জেন্ডার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে অসভ্য ছেলে। নামের সঙ্গে “তা” কেন যুক্ত করতে হবে।
তা টুকু নিস্তব্ধ পাশে থাকা কলম দিয়ে কুটকুট করে কেটে দিলো।হ্যাঁ এবারে ঠিক আছে।
এরপর পড়তে শুরু করলো,
” প্রিয় নিস্তব্ধতা,

রাগ করিস না ভাই।এরপর যা বলবো তাতেও রাগ করিস না। তোর রাগ টা বাড়াতেই নামের বিকৃতি টা করেছি।প্রথমবার রাগ প্রকাশ্যের হয় ধ্বংসলীলা কিন্তু মানুষের রাগ একবার হলে পরমুহূর্তেই আবার হলে তা প্রকাশ্যের জন্য মনোযোগ ধরে রাখা দায়।
রাগের পরিমাণ ওও কিছুটা কমে যায়।
তাই তোকে প্রথমেই রাগান্বিত করলাম।সরি ভাই।
শোন এই মুহুর্তে তো আমি তোর সামনে নেই তাই এবারে আসল কথাটা বলেই দেই।
একজনকে ভীষণ ভালোবাসি।
একটাসময় গিয়ে সেও আমায় ভালোবাসলো।
কিন্তু যখন আমার মুখে প্রকাশ করার সময় এলো।
মেয়েটা তখন পিছিয়ে গেল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সমাজ নিজের পরিবার আমার পরিবারের কথা ভেবে যে আমারা কি ভাববো,কি বলবো।
কিন্তু আমি চাই সব কিছু উপেক্ষা করে মেয়েটাকে আপন করে নিতে।
ভালোবাসার মানুষটিকে হাজারো দুঃখের মাঝে একটুকরো সুখ দিতে।
মেয়েটির নাম বাসন্তী।
আমার প্রিয় বন্ধু নিস্তব্ধ’র বোন সে।
আমি তোর উত্তর চাই নিস্তব্ধ ।
প্লিজ নেগেটিভ উত্তর দিস না।
আমি তাহলে বাঁচতে পারবো না।
পজিটিভ উত্তর লিখিস কেমন।
ইতি
আমি হতভাগা মাহীন।
চিঠিখানার দিকে নিস্তব্ধ হতবাক হয়ে চাইলো।
নিস্তব্ধ সঙ্গে সঙ্গে মাহীনকে কল দিলো।

“চেম্বারে আয়।”
” চেম্বারে কেমন করে যাবো আমি তো চলে এসেছি দোস্ত। ”
” পশ্চাৎ বরাবর এক লাত্তি মারবো।সব মিথ্যা কথা বেরিয়ে যাবে।আমি জানি তুই হসপিটালেই আছিস দ্রুত আয়।”
” এভাবে আমায় মিথ্যা ব্লেইম দিতে পারিস না তুই দোস্ত।দিস, ইজ নট ফেয়ার।”
” আসবি কি না তুই?”
” আসছি তো এমন করছিস কেন। আশ্চর্য মনে হচ্ছে আমি চুরি করেছি।”
” হ্যাঁ করেছিস।আয়।”
মাহীন আসলেই হসপিটালে ছিলো।মনের মাঝে তার আকুপাকু করছিলো। তাই তো রয়ে গিয়েছিল।
মাহীন কাচুমাচু মুখ করে পুনরায় চেম্বারে এলো।
নিস্তব্ধ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” কতদিন চলছে এসব?”
” একদিন ওও না।”
” তবে..?”

” মানে ওই আরকি।এমনি কথা বার্তা বলতাম মাঝে মাঝে।কিন্তু এখন তো তের বোন ফোন ওও বন্ধ করে রেখেছ।”
” আমি তোকে সাফসাফ বলে দিচ্ছি। তোর যা করার আমার বাড়িতে গিয়ে কর। বোন রাজী হলে, বাবা মা রাজী হলে আমিও রাজী বুঝেছিস।
সো আমার কাছে এত প্যাচাল পেরে লাভ নাই।
জীবনটা সম্পূর্ণই আপার।কিন্তু তার ভালো খারাপ দেখারও আমার একটা দ্বায়িত্ব আছে। আমি তাই করবো।”
“তার মানে আমি তোদের বাড়িতে মাকে নিয়ে যেতে পারি তাইতো?”
নিস্তব্ধ নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,
” তুই যা ভাবিস।”
মাহীন নিস্তব্ধ জরিয়ে ধরে বলল,

” থ্যাংকিউ ভাই।থ্যাংকিউ।” মাহীন নিস্তব্ধকে কিস করতে যেতে নিতেই নিস্তব্ধ ঠাস করে তার গালে চর বসিয়ে দিলো।
” মেয়ে মানুষের মতো কথায় কথায় গায়ে পরিস কেন। ইডিয়েট।”
মাহীন মুখে হাত দিয়ে চোখ পিটপিট করে বলল,
” মেয়ে মানুষের মতো না?বউ যখন জরিয়ে ধরে তখন তো ঠিকই সুযোগের সৎ ব্যবহার করো।সালা।”
নিস্তব্ধ রাগী চোখে তাকাতেই মাহীন সুরসুর করে বেরিয়ে গেল।
আশা আজ রান্না করেছে।নিজের হাতে সব কিছু সে রান্না করেছে।
রান্না পদ সংখ্যা সর্বাধিক।
সুজন খেতে খেতে আড় চোখে আশার দিকে চেয়ে বলল,
” মা খাবার আজ তুমি রান্না করেছো? একটুও স্বাদ নেই খাবারে।না নুন, না ঝাল।এর থেকে তো ভাতের মাড় খাওয়াই উত্তম ছিলো।”

আশা সঙ্গে সঙ্গে কোথাও যেন গেল।
সুজন আড় চোখে চেয়ে সবই পরখ করছে।
রাহেলা বেগম ছেলের কথা শুনে চোখ গরম করে বলল,
” মিথ্যা কথা বলিস না সুজন।এই খাবারই আমরা সবাই খেয়েছি বুঝেছিস। ভীষণ মজা হয়েছ।আর আমি রান্না করিনি সব তোর বউ করেছে।”
” মা তোমাদের হুট করে জিহবার স্বাদ পরিবর্তন হয়েছে বুঝলে। আর তোমার বউমা রান্না করেছে দেখেই এত বিশ্রি স্বা হয়েছে।”

” বিশ্রি হয়েছে তো গপাগপ গিলছিস কেন।রেখে দে।”
” কি যে বলো না মা খাবার নষ্ট করতে নেই জানো না।”
আশা একটা বাটিতে করে কি যেন নিয়ে এসে সুজনের সামনে রাখলো।
তার সামনে থেকে ভাতের প্লেটটা সরিয়ে রাখলো।
সুজন হতবাক হয়ে চাইলো।
” এই নিন আপনার ভাতের মাড়।ভাতের বদলে বরং আপনি এগুলোই খান কেমন।”
সুজন কথা বলার ভাষা হারালো।
আশাকে চেঁতাতে গিয়ে দেখছে সে এবারে বেদম ফাঁসা ফেঁসে গেল।এবার কি হবে।
এমন সুস্বাদু খাবার গুলো কও তবে আর তার কপালে জুটবে না।
রাহেলা বেগম মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো।
যাক ছেলে তার জব্বর জব্দ হয়েছে।

সুজন চুপিচুপি গভীর রাতে উঠে বসলো।তার পাশেই আশা ঘুমিয়ে আছে
সে দেখেছে বউ তার সব খাবার ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখেছে।
সুজন পা টিপে টিপে রান্না ঘরে এলো।
ফ্রিজ থেকে যেই পায়েসটা বের করে এক চামচ মুখে নিলো ওমনি সামনে তাকিয়ে আশাকে রেখে চোখ বড় বড় করে ফেলল। গেলার আর শক্তি পেল না।
আশা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বউ তার উঠলো কখন। দেখে তো এলো ঘুমিয়ে ছিলো।
” খাবার নাকি ভালো হয় নি।তো আপনি ফ্রিজের কাছে কি করছিলেন শুনি?”
আশা সুজনের হাত থেকে পায়েসের বাটিতা কেড়ে নিলো।
সুজন করুণ চোখে তাকিয়ল সুধালো,

” একটু খাই, দাও না।”
আশা ভাব নিয়ে বলল,
“আগে সত্যিটা স্বীকার করুণ দেখি।তারপর ভেবে দেখবো।”
” সত্যি, সত্যিই, সত্যিই তিন সত্যি। খাবার গুলো ভীষণ সুস্বাদু হয়েছে। এবারে দাও।”
আশা মুচকি হেঁসে বাটিটা এগিয়ে দিলো।
বলল,
” ডায়নিংয়ে গিয়ে বসুন।আমি সবগুলো খাবার গরম করে আনছি।ভাতের মাড় যে আপনি খান নি তা আমি
খুব দেখেছি।পেটে যে ইদুর দাঁড়াচ্ছে তা বোঝাই যাচ্ছে। যান বসুন।”
সুজন অদ্ভুত চোখে আশার পানে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা খুব সুক্ষ্ম ভাবে তার প্রতিটা জিনিসের খেয়াল রাখে।
সুজনের হৃদয় শীতল হয় মেয়েটাকে রাগতে দেখলেও তার ভালো লাগে হাঁসতে দেখলেও তার ভালো লাগে।
তবে এটাই কি ভালোবাসা?

” নিস্তব্ধ’র কথা মতন কালই ওদের বাড়িতে এলো মাহীন মা,বোনের সাথে। ”
বাসন্তী সবাইকে দেখে খানিকটা উত্তেজিত হলো।
চিন্তায় ভার হলো মন। কি করতে এলো তারা হঠাৎ।
রাহেলা বেগম বিয়ের কথা তুলতেই ওসমান ভিলার ড্রয়িংরুমে চলছে পিনপতন নিরবতা।
সকলেই চেয়ে আছে বাসন্তীর পানে।
বাসন্তী মাথা নিচু করে অসহায় মুখ করে বসে আছে।
ফুফু মাহীনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সুধালো,
” এই যে ছেলে তুমি কি বাসন্তী কে সত্যিই ভালোবাসো?”
মাহীন বুক ফুলিয়ে বলল,
” জ্বী।”
ফুফু আবারো জিজ্ঞেস করলো,

” বাসন্তী তোমায় ভালোবাসে?”
মাহীন একপলক বাসন্তীর দিকে চাইলো।প্রত্যুত্তর করলো,
” জ্বী ”
বাসন্তী চমকে উঠে মাথা তুলে চাইলো মাহীনের পানে।
” কিন্তু বাসন্তী তো আমাদের একবারও বলেনি সে তোমাকে ভালোবাসে।”
” কেন বলেনি সেটা বরং আপনারা ওর কাছেই জিজ্ঞেস করুন।”
ফুফু জহুরির চোখে মাহীনকে দেখে নিয়ে বলল,
” তোমার থেকে আমাদের মেয়ের বয়স বেশি। তার ওপর কিছুদিন আগেই তার ডিভোর্স হয়েছে।এতকিছুর পরেও কি তুমি বাসন্তীকে ভালোবেসে সারাজীবন সুখী রাখতে পারবে।”
” ইনশাআল্লাহ। মাহীনের ভালোবাসা আজও একফোঁটা কমেনি তার বাসন্তী সুন্দরীর জন্য। ভবিষ্যতেও কমবে না আশা করি।”

” যদি তোমার পরিবারের সমস্যা হয়?”
রাহেলা বেগম বাঁধ সেধে বলল,
“এমনটা মোটেও ভাববেন না আপা। আমার মাহীনের পছন্দই আমার পছন্দ। তাছাড়া আপনাদের মেয়ে এমনিতেই লক্ষী। শুধু বয়সের জন্য যে আমি আপত্তি করবে এটা ভাববেন না আপা। ওপর ওয়ালা আমাদের জীবনকে কখন কোন দিকে মোড় নেয়।
আমাদের সবকিছুই মানিয়ে গুছিয়ে সাজিয়ে নেওয়া উচিত।
আমার পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি পাবেন না আপনারা আপা।ছেলেটার বাপ তো গত হয়েছে আরো কয়েক বছর আগে।সে বেঁচে থাকলে আমার মনে হয় না সেও কোনো আপত্তি করতো।”
রাহেলা বেগনের কথায় সবাই খুশি হলো।
রাহেলা বেগম বাসন্তীর পাশে গিয়ে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে স্বরে সুধালো,

” সেদিন তোমার কথাগুলোর মানে আমি বুঝেছিলাম মা।তোমার মনে যে আড়ষ্টতা কাজ করছে তার আমি বুঝেছি। শুনো মা, জীবনের পথে চলতে গেলে কখনো সমাজ কি বলবে, ভাববে সেসব নিয়ে চিন্তা করবে না।
নিজের পছন্দ অনুযায়ী কাজ করবে।”
নিলয় সাহেব বলল,
” বাসন্তী তুই যা বলবি আমরা তাই করবো।তোর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নেব না। তাই যা বলবে ভেবে চিন্তে বলবে।তোমার ওপর কোনো জোড় নেই।”
নিস্তব্ধ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” দেখ আপা জীবনে যাই করিস কখনো অন্যে কি ভাববে না ভাববে সেটা ভেবে জীবনের সুন্দর অনুভূতি মুহুর্ত গুলো নষ্ট করিস না।
মন যা চায় সেটাই কর।
তবে মনকে অবশ্যই বেস্ট জিনিসটা চুজ করতে বলিস।”
একে একে সবাই বাসন্তী কে বোঝালো।
একবারের ঝড়ে জীবন কখনো থেমে থাকবে না,সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে বহুদূর থেকে বহুক্রোস দূরে।
বাসন্তীর চক্ষু পানিতে টইটম্বুর হলো। আজ আরো একবার তার পরিবার প্রমাণ করে দিলো সে ফেলনা নয়।ডিভোর্সি মেয়েরা ফেলনা হয় না। তাদের স্বাধীনচেতা ভাবে বাঁচার অধিকার রয়েছে।ভালোবাসায় কোনো বয়সের বাচবিচার মানে না।
নিজের জীবন নিজে সুন্দর করে সাজাতে-গোছাতে পারলে সবই সুন্দর।
সে আত্মবিশ্বাসী স্বরে বলল,

” আমি মাহীনকে ভালোবাসি বাবা।
আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।ওর সঙ্গে সারাজীবন কাটাতে চাই। আমি বিয়েতে রাজী ফুপি।”
” আলহামদুলিল্লাহ। ”
সকলে আনন্দে আলহামদুলিল্লাহ পড়লো।
বাসন্তীর মুখশ্রী হতে প্রথমবার ভালোবাসার স্বীকারোক্তি শুনে মাহীনের হৃদয় পুলকিত হলো।
মুগ্ধ নয়নে সে তাকিয়ে রইলো বাসন্তীর পানে।
নিস্তব্ধ তার সে চাউনও লক্ষ করলো।সে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
” তোমরা সবাই তবে বিয়ের ডেট ফিক্স করো।ওরা দুজন একটু আলাদা কথা বলুক। আপা মাহীনকে তোর রুমে নিয়ে যা।”
বাসন্তীর রুমে আসতেই। মাহীন এক সেকেন্ড ওও দেরী করলো না। শক্ত করে জরিয়ে ধরলো নিজের প্রিয়তমা কে।
বাসন্তী লজ্জায় আড়ষ্টতায় বলে উঠলো,
” কি করছো মাহীন কেউ চলে আসবে।”
মাহীন তার কথাই পাত্তায়ই দিলো না।
উল্টো ঠাস করে বাসন্তীর গালে নিজের ওষ্ঠের সহিত ভালোবাসার পরশ একে দিলো।
বাসন্তী হতভম্ব হয়ে চাইলো।
চোখ গরম করে চেয়ে সুধালো,

ধূসর রংধনু পর্ব ৫৩

” কি করছো তুমি।ভুলে যেও না আমি তোমার বড়।একটু সম্মান তো করো।”
” কোনো সম্মান করা করি নেই বাসন্তী সুন্দরী।
এবারে শুধু ভালোবাসা বাসি হবে।এতদিন আমায় ইগনোর করেছেন বিয়ের পর আমি তার প্রতিশোধ নেব বুঝেছেন।”
বাসন্তী আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে নিচে নেমে এলো।
কথা বার্তা বলবে না ছাই।ছেলেটার শুধু দুষ্টুমি।
মাহীন ওও নিচে নেমে এলো।
ঠিক হলো পরবর্তী শুক্রবারেই কপোত-কপোতীর ঘরয়া আয়োজনেই দু হাত একত্রিত করে দেবে।

ধূসর রংধনু পর্ব ৫৫