ধূসর রংধনু পর্ব ৫৫

ধূসর রংধনু পর্ব ৫৫
মাহিরা ইসলাম

অপরূপ সকাল।মেঘে রৌদ্দুরের প্রেমশিক্ত খেলা চলছে আপন মনে। পূর্ব গগনে কখনো মেঘ, কখনো রৌদ্র, কখনো উভয় খেলছে কানানাছি।
তাসফি রেডি হচ্ছে আজ প্রথমদিন নতুন কলেজে যাবার উদ্দেশ্যে।
আরে বাবা এখন কি তার একাএকা কলেজে যেতে কি তার ভালো লাগবে? তার উপর দুদিন পর বাসন্তী আপার বিয়ে এখন এই মুহুর্তে কলেজে গিয়ে কি মন টিকবে তার আশ্চর্য।কিন্তু বেহায়া লোকটাকে বোঝাবে কে।
তার ডাক্তার মহাশয় তাকে নতুন কলেজে ভর্তি করেছে ঠিকই কিন্তু তাসফি যে শর্ত দিয়েছিল তার যেন সেখানে বোরিং না লাগে তার ব্যবস্থা করে দিতে।

এখন দেখা যাক লোকটা কি ব্যবস্থা করেছে তার জন্য। তাকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে নিস্তব্ধ গিয়ে নিজের চেম্বারে বসবে।
হ্যাঁ তার নিজের। মহাশয় ঠিক করেছেন আর কোনো মেডিকেল কলেজে তিনি শিক্ষকতা করাবেন না। আর কোনো মেয়ের তার দিকে চেয়ে থেকে নজর না লাগুক।আর তাদের জীবনের কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটুক।
নিজের রেস্টুরেন্টের ব্যবসাটাই বড় করবেন তিনি।সঙ্গে ডাক্তারী তো আছেই।নিজের চেম্বারে তিনি ইচ্ছে স্বাধীন মত বসবেন।
মাঝে মাঝে কোনো সরকারি হসপিটাল থেকে ডাক এলে সেখানে গিয়ে ঢু মেরে আসবেন।
জীবনে এত টাকা পয়সার দরকার কি।
তারা যা পাচ্ছে তাতেই তো কুলিয়ে রয়ে যাচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তাসফি গাড়িতে বসে নিস্তব্ধকে এই নিয়ে বোধহয় শতবার একই কথা জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে।
অথচ লোকটা কোনো উত্তরই দিচ্ছে না।
” কি হলো বলুন না একটু, কি ব্যবস্থা করেছেন সেখানে আমার জন্য। ”
এবারেও উত্তর না দেওয়ায় এবারে তাসফির মেজাজ সত্যি সত্যিই খিচিয়ে গেল।
আসলে এই লোকটা কোনোদিন সুধরাবার নয়।
তাসফি চিৎকার করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” গাড়ি থামানননন।এক্ষুনি গাড়ি থামান।এই মুহুর্তে গাড়ি থামাবেন আপনি।অসহ্য বর্বর লোক।”
নিস্তব্ধ থমথমে কন্ঠে বলল,

” আশ্চর্য চিৎকার কেন করছো।”
” তো বসে বসে কি আঙুল চুসবো? একটা কথা আপনাকে কত্তক্ষণ ধরে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছি একটা উত্তর দিচ্ছেন?”
” আরে বাবা কলেজে গেলেই তো দেখতে পাবে।এখন বলার কি কোনো প্রয়োজন আছে বলো তুমি?”
তাসফি মুখ ফুলিয়ে বাহিরের দিকে মুখ করে বসে রইলো। আর একটা কথা বলতে চায় না সে এই লোকটার সঙ্গে।
প্রেয়সীর নিরব অভিমানে নিস্তব্ধ মুঁচকি হাঁসে।
এখন অভিমান করে আছে ঠিকই কিন্তু কলেজে পৌঁছানোর পর এই অভিমান কতক্ষণ টিকে থাকে সেও দেখবে।
একটা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের সামনে গাড়ি এসে থামালো নিস্তব্ধ।
অর্ধাঙ্গিনীর ফুলিয়ে রাখা মুখশ্রীখানা হাতের আঙুলের সাহায্যে উঁচু করে ধরলো।
তাসফির ললাটে চুম্বন একে দিলো।
ফিসফিস করে বলল,

” সব কিছুতে এভাবে অভিমান করলে হয় বউ।একটু ধৈর্য্য ধরতে শিখো।জেনে রেখ ধৈর্যের ফল সমবসময় মিষ্টি হয়।”
” রাখুন তো আপনার লেকচার।”
” ওকে তাই সই।সাবধানে থাকবেন।
সাবধানে বাসায় ফিরবেন।আমি আসছি তবে।”
তাসফি বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে।
নিস্তব্ধ সাঁঈ করে গাড়ি ছুটিয়ে দৃষ্টিসীমানার বাহিরে বেরিয়ে গেল।
তাসফি কলেজের ভেতর প্রবেশ করতেই, কেউ তাকে পেছন থেকে এসে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো।
তাসফি চমকে উঠলো।
এই অচেনা কলেজে কে তাকে চিনবে?

” সারপ্রাইজ।”
প্রিয় বান্ধবীর পরিচিত কন্ঠস্বর পেতেই সে চট করে পেছনে ফিরলো।
আশার মুখশ্রীখানা অবলোকন করতেই খুশিতে আত্মহারা হলো তার চিত্ত।
এই তো সপ্তাহ খানেক আগেই আশা সুজনকে বলেছিল,
” আপনি আমার জন্য আর কিছু না করুণ একটা উপকার করুণ প্লিজ।”
সুজন ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বলল,
” হোয়াট।”
” তাসফি যেই কলেজে ভর্তি হবে আমায়ও প্লিজ সেই কলেজে মাইগ্রেশন করান।প্লিজ।”
সুজন খানিকক্ষণ ভাবার ভঙ্গিমা করে বলল,
” উমম, সম্ভব নয়। তোমায় ওই কলেজেই পড়তে হবে।
তাসফি নেই তাতে কি সমস্যা। বাকি দুই বন্ধু তো রয়েছেই। লাগলে আরো বন্ধু বান্ধব পাতিয়ে নেবে।”
আশা রেগে গিয়ে বলল,

” আপনি একটা অসহ্য লোক।
আমার রান্না করা খাবার চুরি করে খেতে পারেন অথচ একটা সাহায্য করতে পারবেন না। আশ্চর্য লোক।”
সুজন আশার রুম ছেড়ে যাওয়ার পানে চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে রইলো। বাহ মেয়েটার বিয়ের পর দেমাগ দেখা যাচ্ছে আরো খানিকটা বেড়েছ। এর কারন কি।বেশ ইন্টারেস্টিং চ্যাপ্টার।হাহ।
বিয়ের আগে ছিল বউ না থাকার প্যারা।এখন এক্সট্রা যুক্ত হলো বউ থাকার প্যারা।জীবনটাই শুধু প্যারাময় তোর সুজন।

লোকটা এই কথা বললেও কয়েকদিন পর দেখা গেল সে একদিন বেলকনিতে বসে বসে আচার খাচ্ছিলো।
রাহেলা বেগম তার জন্য বয়ম ভরে আচার বানিয়ে রেখেছে যানে মেয়েটা খায় ভালো।
হঠাৎ এসে সেখানে আগমন ঘটলো তার বর মহাশয়ের।
সে এসেই আশার হাতে একটা আইডি কার্ড ধরিয়ে দিলো।
আইডি কার্ডে তাসফির বর্তমান কলেজের নাম দেখে খুশিতে তার মন আত্মহারা হলো।
কিছু বলতে নেবে হঠাৎ নিজ গালে ঠোঁটের স্পর্শ পেল।পরপর তার গালে অর্ধেক বেরিয়ে থাকা আমের আঁঠি খানা নাই হয়ে গেল, লোকটা তার ঠোঁটের সাহায্যে চট করে তার মুখে পুরে নিয়েছে।
আশার কানে কানে ফিসফিস করে বলল,

” সো সুইট টেস্ট বউ। ”
সঙ্গে সঙ্গে সে স্থান ত্যাগ করেছে।
ঘটনার আকস্মিকতায় সে রিয়্যাকশন দিতেই ভুলে গেছে।কি থেকে কি হলো তার বোধগম্য হতেই খানিকটা সময় লেগে গেল।
আশা চোখ পিটপিট করে চেয়ে মাথা ঝাড়া দিলো।
কি আজব আশ্চর্য তার হ্যালুসিলেশন হচ্ছে না তো।
আশার থেকে এই কাহিনি শুনে তাসফি খিলখিল করে হাঁসতে লাগলো।
আশা রাগি চোখে তাকিয়ে সুধালো। কি ভাই তুই আমার দুঃখে হাঁসিস?
তাসফি হাঁসি থামিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“তো তোর কথা শুনে আর কিছু করার আছে বুঝি?
তোর বর মহাশয় তোকে চুমু খেল আর তুই দুঃখ পাচ্ছিস। ”

” দুর চুমু খেয়েছে তাতে কেন দুঃখ পাবো। অসভ্য লোকটা তো বাসর রাতেই লুকিয়ে লুকিয়ে চুমু খেয়েছিলো।
কিন্তু সে তো সেদিন আমার প্রিয় আমের আঁঠি খানা নিয়ে গেল।তাই তো দুঃখ পাচ্ছি। ইশশ কত্ত শখ করে গালে নিয়েছিলাম। ”
আশার কথা শুনে তাসফি হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো।
” সিরিয়াসলি ভাই। তোর মাথা তাঠা ঠিক আছে তো?”
আশা দাঁত কেলিয়ে হেঁসে বলল,
” তা একটু নষ্ট হয়েছেই বটে।ঘরে থাকা অসভ্য সুদর্শন লোকটার প্রেমে পড়ে এই আশার হৃদয়টা দুঃখে মরিয়া হয়ে আছে।”
তাসফি এবারে সিরিয়াস হয়ে বলল,
” আমার মনে হয় কি জানিস। সুজন ভাইয়া তোকে পছন্দ করে।হয়তো ভালোও বাসে কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না।”

” কি করে বলবে। পেস্টিস থাকবে না তো।”
তাসফি দুষ্টু হেঁসে বলল,
” এরা দুই বন্ধু একই কোয়ালিটির। তুই চাইলে আমার টেকনিক ফলো করতে পারিস।”
” কোনো দরকার নেই বাপ আমার।তারপর আমার আম ও যাবে ছালাও যাবে।দেখা গেল লোকটা আমায় সত্যি সত্যি ডিভোর্সই দিয়ে দিলো।তারপর আমায় কি উপায় হবে। লোকটার উপর আমার একদম বিশ্বাস নেই।”
কথা খানা বলে দুজনেই হাঁসলো।
আজ বাসন্তী আর মাহীনের বিয়ে সম্পূর্ণ হবে।ঘরোয়া ভাবে।
সকাল থেকে ওসমান ভিলার ব্যস্ত সকলে।
যেহেতু ঘরোয়া ভাবে সব হবে তাই আয়োজন তেমন বড় নয়।নিস্তব্ধ’র বন্ধু রা এসেছে সকলে।বাসন্তী মাহীনকে বিদায় দিয়ে তারাও পারি জমাবে যার যার আস্তানায়।
সকাল থেকে সবাই কাজে ধূম ব্যস্ত।
এরই মাঝে দুটো কুরিয়ার এলো।

একটা তাসফির নামে অপরটা নিস্তব্ধ’র নামে।
তাসফিও তা কোনো রকমে রিসিভ করে রেখে এলো রুমে।এতো ঝুট ঝামেলার আবার কুরিয়ারের জিনিস খুলে দেখার সময় কোথায়। অদ্ভুত ভাবে কে পাঠিয়েছে তার নাম ঠিকানাও কিচ্ছু লিখা নেই।
সারাদিন পেরুলো বক্স দুটো পরে রইলো নিস্তব্ধ’র রুমের এক কোনায়।
অপর দিকে একই বাক্স গুলো রাহেলা বেগম ওও রিসিভ করলেন।
একটার ওপরে সুজনের নাম লেখা অপরটি আশার।
ফোন করে সুজনকে বলতেই সে বলল,
” রুমে রেখে এসো মা। রাতে ফিরে দেখবো। কে পাঠালো নামধাম কিছু লেখা নেই মা?”
রাহেলা বেগম চিন্তিত কন্ঠে বলল,

” না তো।”
” আচ্ছা রেখে দাও এসে দেখবো মা।”
একই বক্সগুলো সৃজন, মাহীন, আরশী, আয়ানার কাছেও পৌঁছে গেল।
কি আশ্চর্য ব্যাপার-স্যাপার । এই নাম বিহীন বক্সগুলো হঠাৎ করে পাঠাচ্ছে কে।
বাসন্তীকে সাজানোর সময় তাসফি ফিসফিস করে বলল,
” আপা তোমায় না ভীষণ সুন্দর লাগছে।মাহীন ভাইয়া তোমায় বাসর ঘরে দেখে না আবার পাগল টাগল হয়ে যায়। পরে আবার আমাদের পাগলা গারদে ভর্তি না করতে হয়।উফস।”
বাসন্তী লজ্জা পেল।
” ধ্যাৎ কি যে বলিস না তুই।একটা মাইর দিবো।”
” সে তুমি আমায় মাইর দিতেই পারো।অবশ্য সত্যি বললে সবাই লজ্জা পায়। আপা কিছু ট্রিপস নিবে নাকি শিখিয়ে দেব হুমহুম?”
বাসন্তী বিস্মিত চোখে চাইলো।
তাসফির মাথায় চাটি মেরে বলল,

” ভীষণ দুষ্টু হয়েছো তাইনা। বলবো আমার ভাইকে।”
তাসফি ভাব নিয়ে বলল,
” বলো কে নিষেধ করেছে। তোমার ভাইকে আমি ভয় পাই নাকি।”
নিস্তব্ধ তাসফির পেছনে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে।
বাসন্তী ফিসফিস করে বলল,
” ওও আচ্ছা তাই নাকি। তবে পেছনে একটু তাকা।”
তাসফি ভাব নিয়ে পেছনে তাকাতেি নিস্তব্ধ কে দেখে আঁতকে উঠলো।
আমতাআমতা করে বলল,
” ককখন এলেন আপনি।”
নিস্তব্ধ’র চাউনি বুঝিয়ে দিচ্ছে একবার তোমায় হাতে পাই। মজা বুঝাবো।
রুমের সবাই ওদের কান্ড দেখে হেঁসে কুটিকুটি হচ্ছে।
আয়ানা আর আরশী এগিয়ে এসে বাসন্তীর কাঁধে হাত রেখে বলল,
” আমাদের মাহীন ভীষণ ভাগ্যবান যানো তো, যে সে তোমার মতো একটা লক্ষী মন্ত বউ পাচ্ছে। ”
বাসন্তী লজ্জা পাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।

ইশশ।এত লজ্জা মাহীন তার জন্য হাজির করিয়ে রেখেছিলো।খুব কি দরকার ছিল তার?
মন বলে দরকার ছিলো তো। তাই জন্যই তো মানুষটাকে তুই পাচ্ছিস নিজের করে।
অবশেষে কাবিন নামায় সাইন করে তিন কবুলের মাধ্যমে কপোত-কপোতীর বিবাহ সম্পূর্ণ হলো।
সঙ্গে মাহীনের এত বছরের ভালোবাসার পূর্ণতা পেল।
বাসন্তী পেল নতুন জীবন।নতুন করে বেঁচে থাকার উদ্যোম।
শেষ ভালো যার সব ভালো তার।

ধূসর রংধনু পর্ব ৫৪

বিয়ের পর্ব শেষ হতেই সকলে মেতে উঠলো মিষ্টি মুখের তাড়নায়।
কোথায়ও কেউ আনন্দে মেতে উঠে।তো কোথায়ও কেউ ঘরে বসে চুপটি করে নিজের বিষাদ গুলো ছেড়ে দেয় মুক্ত বাতাসে।
এই তো মানবজীবনে নিয়ম।

ধূসর রংধনু পর্ব ৫৬