ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ২
মাহিরা ইসলাম মাহী
নিস্তব্ধতা আর সাদাফের এসএসসি পরিক্ষার পরের ঘটনা।
তাসফি নিস্তব্ধতাকে ভর্তি করিয়ে এলো হলি ক্রস কলেজে।
কিন্তু চান্স পাওয়ার পরেও সুজন সাদাফকে নিয়ে যখন নটরডেম কলেজে ভর্তি করাতে গেল সে কিছুতেই ভর্তি হবে না। একদম গো ধরে বসে রইলো। সে নিস্তব্ধতার কলেজেই ভর্তি হবে।এই কলেজে সে ভর্তি হবে না মানে হবে না।
আশার মেজাজ তুঙ্গে উঠলো ছেলের আবদারে।
আশা গর্জে উঠে বলল,
“হতভাগা তুই মেয়েদের কলেজে কি করে পড়বি।ওখানে তোকে এডমিশন দেবে?গাঁধার বাচ্চা গাঁধা।”
বউয়ের সম্মোধনে তার চোখ কপালে।সুজন আহাজারি করে বলল,
“তুমি আমায় গাঁধা বলতে পারলে বউ? এমন মিথ্যা অপবাদ তুমি আমায় দিতে পারলে? একটা জলজ্যান্ত মানুষকে এভাবে বন্য প্রাণীতে পরিণত করতে পারলে?
আশা মেজাজ খিঁচিয়ে বলল,
“ তো গাঁধার বাচ্চা কে তো গাঁধার বাচ্চাই বলবো।তাছাড়া আর কি বলবো।বন্য প্রাণী থাকবেন তো সেই মানুষের শহরেই। কি শিখিয়েছেন ছেলেকে?
হাইস্কুলে সাইন্স নিয়ে পড়ে এই শিখেছে ও? কমনসেন্স নেই ওর? মেয়েদের কলেজে কি করে পড়তে চায় ওও? কোনো কান্ডজ্ঞান নেই।হয়েছে বাপের মতন।“
সাদাফ সুইংগাম চিবুতে চিবুতে ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ তো নিরু কে হলি ক্রস য়ে ভর্তি করানোর আগে আমায় জিজ্ঞেস করে নিতে।”
আশা কটমট করে বলে উঠলো,
“ কেন রে তোর কাছে কেন জিজ্ঞেস করতে হবে? তুই কি ওর গার্জিয়ান? তুই যখন ভর্তি পরিক্ষা দিলি তখন তোর মাথাটা রেখেছিলিস কোথায়?”
সাদাফ উত্তর দিলো না। তার ভিডিও গেম খেলায় মনোযোগ দিলো।
ছেলের উত্তর না পেয়ে আশা ছেলের হাত থেকে ঝড়ের বেগে গেমের রিমোট টা নিয়ে দূরে ছুরে মারলো।
ক্রংকিটের ফ্লোরে নির্জীব বস্তুটি পড়ে মুহুর্তেই দু খন্ডে ভাগ হলো।
“এই ছেলেকে নিয়ে আমি কি করবো টা কি।উফস।বাপ বেটার যন্ত্রণায় এক মিনিট যদি শান্তিতে থাকা যায়।”
আশা স্টেথোস্কোপ টা হাতে নিয়ে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে।
সাদাফ সুজনের দিকে চেয়ে বিরক্ত হয়ে বলল,
“ মা সব সময় আমার পছন্দের জিনিসপত্রের উপরে কেন তান্ডব চালায় বলো তো বাবা?
সুজন হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলল,
“ আগে আমার জিনিস ছুরতো। এখন তুমি পর হয়েছ তাই তেমার জিনিসে তান্ডব চালিয়ে সে সুখ পায় বুঝলে।”
সেই মুহুর্তে কাশফি দৌড়ে এলো।মেয়েটার কথা বলতে একটু সমস্যা অনেক বড় শব্দ উচ্চারণ করতে গেলে সে তোতলায়।ছোট বেলার রোগটা মেয়েটার মাঝে স্থায়ী রয়ে গেল যে কেমন করে কে জানে।
হয়তো সেটা তাকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছিলো।তাই তো ছেড়ে যেতে নারাজ।
“ ভা..ভাইয়া। তোমার জ্যামিতি বক্সটা আমায় দেবে প্লিজ? আ..মার টা খুঁজে পা.পাচ্ছি না।”
সাদাফ রিমোট টা সারবার চেষ্টা চালাচ্ছিলো,
“ খুঁজে নে গিয়ে দেখছিস না কাজ করছি।”
কাশফির মাঝে মাঝে মনে হয় কথা বলে সে কাউকে বিরক্ত করছে না তো?
শেষমেশ নিস্তব্ধ আর সুজন উপায় না পেয়ে দুটোকে ঢাকা সিটি কলেজে ভর্তি করিয়ে এলো।
নিস্তব্ধতা দাঁতে দাঁত চেপে সাদাফের দিকে চাইলো।
সাদাফ দাঁত কেলিয়ে হাঁসলো।
নিস্তব্ধতা সাদাফের পায়ে লাথি মেরে বলল,
“ সজনেডাঁটার বাচ্চা তোর জন্য আমার এই কলেজে ভর্তি হতে হলো।তুই জানিস ইতোমধ্যে আমার কতজন ফেন্ড হয়েছিল ওই কলেজে?”
সাদাফ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ ক’জন ছেলে ফেন্ড পটিয়েছিলি?”
নিস্তব্ধতা কটমট করে চাইলো।
সাদাফ জ্বিবে কামড় দিয়ে বলল,
“ ওপস সরি, ওটা তো মেয়েদের গার্লস কলেজ। মাই মিস্টেক।তো তোর ফেন্ড গুলোর নম্বর দিস।”
নিস্তব্ধতা শয়তানি হেঁসে ঠোঁট গোল করে বলল,
“ হু হু হু। এই তো লাইনে এসেছো চাদু।তোমার ছেলে ফেন্ড গুলোর নম্বর আমায় দিও কেমন।দেখি কোনটাকে ভালো লাগে।তোর ফেন্ডগুলো তোর মত সবজি না হলেই হয়।”
সাদাফ ভ্রু কুঁচকে নিলো,
“ কেন আমার ফেন্ডদের দিয়ে তোর কি কাজ।আমি তো তোর ফেন্ডদের থেকে নোট নেওয়ার জন্য নম্বর চাইছিলাম অন্য কিছু নয়।তাছাড়া ছেলেদের কিছু মেয়ে ফেন্ড থাকতেই পারে। কিন্তু মেয়েদের এত কিসের ছেলে ফেন্ড এর দরকার।”
নিস্তব্ধতা বুকে হাত বেঁধে সুধালো,
“ ওও আচ্ছা আচ্ছা তাই নাকি? তো আমায় কটা ছেলে ফেন্ড জোটাতে দিয়েছিস তুই।”
“ জিরো।”
সাদাফ দাঁত কেলিয়ে হাঁসলো।
নিস্তব্ধতা ব্যাগের উপরে থাকা খাতা দিয়ে সাদাফের পিঠে বারি মারলো,
“ হাড়ামি।জিরো টা তাই না। জিরো টা। আমার ফেন্ড দেখলেই তোর চুলকানি উঠে কেন।”
“ উপস লাগছে তো মারছিস কেন।আমার এই ভোলাভালা মুখটা দেখে তোর মায়া হয় না বুঝি।”
নিস্তব্ধতা আরো কয়েকটা পিঠে বসাতে বসাতে বলল,
“ না হয় না।”
“উফফস।মেরে ফেলবি নাকি।”
“ শুধু মারবো না। মারার পর কুঁচি কুঁচি করে কেটে তোকে বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে দেব।”
“ইয়াক থু! বুড়িগঙ্গা কেন কত পরিষ্কার নদী রয়েছে তুই বরং আমায় পদ্মায় ফেলে দিয়ে আসিস কেমন।”
“ তবে রে।”
সাদাফ ছুটলো।তার পেছন পেছন নিস্তব্ধতা
কিছুদিন পর,
ক্লাসে বসে নিস্তব্ধতা মনোযোগ দিয়ে খাতায় কিছু লিখছিলো।
সাদাফ কোথা থেকে ফট করে এসে খাতাটা এক ঝটকায় নিয়ে নিলো।
নিস্তব্ধ চেঁচিয়ে উঠলো।
“এই দিয়ে দে বলছি দে।একদম খাতা খুলবিনা আমার।!
সাদাফ দিলো না। খুঁলতে নিতেই নিস্তব্ধতা চেঁচিয়ে উঠলো।
“ সাদাফ, সাদাফ, সাদাফ প্লিজ খুলিস না। আমার কসম।”
প্রথমবার নিস্তব্ধতার মুখে নিজের নাম শুনে থমকে দাঁড়ালো সাদাফ।
অবাক চোখে চেয়ে রইলো নিস্তব্ধতার করুণ মুখের দিকে।
নিস্তব্ধতা অসহায় চোখে চেয়ে সুধালো,
“ প্লিজ দিয়ে দে সাদাফ। তোকে আমি ফুসকা খাওয়াবো প্রমিস।”
সাদাফ কোনো কথা বলল না,তার হঠাৎ কি হলো কে জানে,
“ নিস্তব্ধতার হাতে হাতে খাতাটা ধরিয়ে দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল।”
নিস্তব্ধতা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
বছর পার হলো
মাহরিসা ও বড় হয়েছে সেই সঙ্গে তরতর করে বেড়েছে তার যৌবন।ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া মাহরিসার মনে আজ বিষাদের ছোয়া।ইদানিং তার মনটা প্রায় বিষন্ন থাকে।আজ অনেকগুলো দিন সে তার আদু ভাই কে দেখে না।অনেকদিন নানা বাড়ি যাওয়া হয় না।
আম্মুকে বাড়ি ফিরে বলতে হবে ওসমান ভিলায় যাওয়ার কথা।
কিন্তু এই যাওয়াই যে তার জীবনের কাল হবে কেই বা জানতো।উহু,ভবিষ্যত জানা যে অসম্ভব।
মাহরিসার মনে পড়ে যায় একটি ঘটনার কথা।
শত বিষন্নতার ভিড়েও তার মুখে ফুটে হাসির ঝিলিক।
সেদিন আদ্রিতের টি-শার্টে সর্দি মাখানোর পরেও পরেরদিন সে আবার গিয়েছিল তার আদর্শলিপির বইখানা তুলে তার আদু ভাইয়ের কাছে পড়া শিখতে।নিজেকে ভালো দেখানোর তারিফে সে গিয়েছিল নিস্তব্ধতা আপার রুমে। তারপর তার ড্রেসিংটেবিলে থাকা লাল লিপিস্টিক খানা দিয়ে আচ্ছা মত ঠোঁটে ঘসেছে।
ব্যস তারপর তাকে ভীষণ সুন্দর লাগছিল।একদম পাড়া মোড়ের সকিনার মতো সুন্দরী।
“ আদু ভাইয়া পড়িয়ে দাও।আম্মু বলেছে কাল ভালো করে পড়নি কেন। আজ সুন্দর করে স্পাডি করে আসবে।”
আদ্রিত দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ স্পাডি নয় স্টাডি।”
“ ওই একই হলো আদু ভাইয়া।”
“ মাই নেম ইজ আদ্রিত নট আদু। আদ্রিত বল নয়তো ডাকবি না আমায়।বেয়াদব।”
আদ্রিত এযাবত নিজের বইয়ে মনোযোগী ছিল।
মাহরিসার দিকে তাকাতেই তার চক্ষু চরকগাছ।
“ ইডিয়েট কি করেছিস মুখে?”
মাহরিসা ঠোঁট জোড়া উলোটপালোট করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলল,
“ সুনদর লাগছে না আমায় আদু ভাইয়া।”
আদ্রিত দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ হ্যাঁ ভীষণ সুন্দর লাগছে, বিউটিফুল। একদম আমার বাড়িতে মাঝে মাঝে আসে আনো পাগল টাকে দেখেছিস? ঠিক তার মতো।”
মাহরিসার মুখখানা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল।
সে ঠিক জানে পাগল কে ভালো দেখা যায় না, পঁচা দেখা যায়।আদু ভাই তাকে পঁচা বললো।
মাহরিসার ভীষণ রাগ হলো।
আদ্রিতের গায়ে ছিল সাদা শার্ট।
মাহরিসা দৌঁড় গিয়ে নিজের মুখের সমস্ত লিপস্টিক আদ্রিতের শার্টে ঘসে ঘসে মুছতে লাগলো।
আদ্রিত চোখ বড় বড় করে চাইলো।
তার দু হাত দিয়ে ঠেলে সরালো মাহরিসা কে।
ছোট্ট মাহরিসা আদ্রিতের কোমর জরিয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলল,
“ আমাকে ভালো লাগছে না বলো? বলো ভালো লাগছে?”
আদ্রিত কোনো ভাবেই তাকে ছাড়াতে না পেরে শেষমেশ অসহায় কন্ঠে বলল,
“ হ্যাঁ বাবা ভীষণ ভালো লাগছে তোকে। সত্যিই ভীষণ ভালো লাগছে।দেখি ছাঁড়।ছাড় মারু এই মেয়ে।”
আদ্রিত ভাইয়ের মুখে নিজের নাম মারু শুনতেই মাহরিসার চোখ দুটো চকচক করে উঠলো খুশিতে। তার মানে আদু ভাই ও তাকে আদর করে ডেকেছে।
সেই খুশিতে সে আদ্রিতের গালে টুপ করে একটা চুমু খেল। তারপর খিলখিল করে হাসতে হাসতে সারা ওসমান ভিলা দৌঁড়ে বেড়ালো।
আর আদ্রিত?
সে হতভম্ব হয়ে বসে রইলো।
পাঁচ মিনিট পর দেখা গেল মাহরিসা আবারো আদ্রিতের রুমে ছুটে এলো।
সঙ্গে আবারো আদ্রিতের কোমর জরিয়ে ধরে তার অপর গালে টুকুস করে চুমু খেয়ে দৌড় মারলো।
আদ্রিত কথা বলার ভাষা হারালো।
ওও গড।
মাহরিসার ভাবনার মাঝেই সূর্যিমামার উত্তাপ কমতে কমতে একটা সময় আকাশ মেঘলা হয়ে উঠলো।মাহরিসার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারাও বিষন্নতার খেলায় নামলো খুব করে।তাই তো তাদের অশ্রুগুলো ঝরে পড়লো জল হয়ে।
মেঘের গুরুম গুরুম শব্দে মাহরিসার হুঁশ ফিরলো।
স্কুলের ছুটির ঘন্টা পরে গেছে।
বৃষ্টি এখনো নামে নি। মাহরিসা চাইলো খুব করে বৃষ্টির আগেই কোনো রিক্সায় চরে বসতে।
কিন্তু সে বের হয়েই বাঁধালো বিপত্তি।
কে জানতো বিপদ তার জন্য ওঁৎ পেতে রয়েছে।সুযোগ পেলেই তাকে খপ করে ধরবে।
মাহরিসা বের হয়ে রিক্সা তো পেল না।
তার ওপর ঝমঝমিয়ে বর্ষনের আগমন ঘটলো।
মাহরিসার পরণের সাদা পায়জামা, নীল রঙের ড্রেসটা তার জন্য কাল হলো।
অদূরে দাঁড়ানো কিছু সিনিয়র ছেলেপেলে।সিগারেট টানছে আর তারা মাহরিসার নাস্তানাবুদ মুখখানা অবলোকন করছে আর হাসছে।যেন কোনো সার্কাস দেখে তারা ভীষণ মজা পাচ্ছে।
মাহরিসা ভীষণ করে চাইছে নিজের ব্যাগটা দিয়ে নিজের সামনে ঢেকে ছেলেগুলোর চোখ এড়াতে কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না।
সে যে স্কুলের ভেতরে যাবে তাও সম্ভব নয়।কারণ গেট ইতোমধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে স্কুল ছুটি হওয়ায়।
তার ভীষণ কান্না পেল।তার চোখের জল বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে খুব সংগোপনে।
নিজেকে ভৎসনা করলো খুব করে।তার আদু ভাই ঠিকই বলে সে আস্ত একটা গাধা, ইডিয়েট।
ছেলে গুলো এগিয়ে এলো,
“ কি খুকি যাবে নাকি।চলো তোমায় বাড়িতে দিয়ে আসি।”
মাহরিসা সমানে পেছাচ্ছে।বৃষ্টি কারণে সমস্ত দোকান পার্ট বন্ধ। একটা ছেলে মাহরিসার হাতে একটু স্পর্শ করতেই সে এবারে পিছু ঘুরে ছুটতে লাগলো।সে খুব করে বুঝতে পারছে আজ এদের হাত থেকে তার নিস্তার নেই। যদি না সৃষ্টিকর্তা কোনো মিরাক্কেল ঘটনা।
সত্যিই মিরাক্কেল ঘটলো।
পথিমধ্যে দেবদূত হয়ে হাজির হলো যেন আদু ভাই।
আদ্রিত আর তার দুজন বন্ধু, বিদ্যুৎ আর আবিদ বাইক নিয়ে বেরিয়েছিল একটা কনসার্টের উদ্দেশ্যে।কিন্তু পথিমধ্যে মাহরিসার এই অবস্থা দেখে আদ্রিতের মাথায় যেন রক্ত চরে বসলো।
আদ্রিত সঙ্গে সঙ্গে বাইক থামিয়ে মাহরিসা কে আগলে নিলো।
বিদ্যুৎ আর আবিদ সব কটাকে পেটাতে লাগলো।
সকলের মাঝে একটা দারুণ ফাইট শুরু হলো।
মাহরিসা আদ্রিত কে জরিয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
মাহরিসার হঠাৎ রিয়্যাক্ট করায় আদ্রিত থমকে দু হাত স্যারেন্ডারের মত উঁচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।
সে চায় না মাহরিসা কে অযাচিত স্পর্শ করতে।
মাহরিসা অবুঝ হতে পারে সে তো নয়।উহু মোটেও নয়।
আদ্রিত দু হাত দিয়ে মাহরিসা কে ছাড়িয়ে দাঁড় করালো।
আদ্রিত মাহরিসার ছলছল কান্না মিশ্রিত চোখের দিকে চেয়ে চোয়াল শক্ত করে চেয়ে সুধালো,
“ ওদের মধ্যে কেউ ছুঁয়েছে তোকে?”
মাহরিসা মাথা নাড়লো।
তার চোয়াল শক্ত হলো।হিংস্র বাঘের ন্যায় চোখ দুটো তার শিকারীর খোঁজে। যেন একথাবায় আলাদা করে দেবে ঘাঢ় থেকে মস্তকটা।
“ কে?”
মাহরিসা তার কম্পনরত হাত দিয়ে ছেলেটাকে দেখিয়ে দিলো।
আদ্রিত আর একমুহুর্ত দাঁড়ালো না
গিয়ে ছেলেটাকে বেদম পেটাতে লাগলো।
মাহরিসা শব্দ করে কেঁদে উঠলো।
বিদ্যুৎ বুঝতে পারলো আদ্রিতকে এই মুহুর্তে সামলানো কঠিন।
সে একটু দূরে দোকানের ঝাপটায় দাঁড়িয়ে নিস্তব্ধ কে ফোন করে সবটা বলল।
ওদিকে সব ছেলেগুলো পালিয়েছে।
নিস্তব্ধ দশ মিনিটের মাথায় ঘটনা স্থলে পৌঁছালো।
সে এসে দেখলো ছেলে তার মাহরিসাকে ধমকাচ্ছে আর মাহরিসা ঢেকচি তুলে কাঁদছে।
ছেলেকে এতদিন কিছু না বললেও নিস্তব্ধ আজ চুপ থাকতে পারলো না। নিজের বন্ধু মেয়েকে নিজের ছেলে এখাবে ধমকাবে কোন সাহসে।
মেয়েটার কিছু হলে বন্ধুর কাছে কি জবাব দেবে নিস্তব্ধ।
নিস্তব্ধ গিয়ে ছেলের গালে ঠাস করে চর বসিয়ে দিলো।
আদ্রিত চোয়াল শক্ত, হাত মুষ্টিকরে নিলো।
সঙ্গে পরিবেশটা আরো থমথমে হয়ে উঠলো।মাহরিসা আরো ডুকরে কেঁদে উঠলো।
আদ্রিত তার দিকে শান্ত চোখে চাইলো।
যেন তার শান্ত চোখ মাহরিসা কে বলল,
“ এবারে খুশি হয়েছিস তুই মারু?এভাবে আমায় জ্বালিয়েই তো তুই শান্তি পাশ সব সময়। “
মাহরিসাকে ওসমান ভিলায় নিয়ে আসার পরেও তার কান্না থামছেনা।
তা দেখে তাসফিও প্রচন্ড রেগে গেল ছেলের উপর।
ছেলেকে সেও চর বসালো ওপর গালে।
মাহরিসা আরো কাঁদতে লাগলো।
কেন সবাই তার আদু ভাইকে মারছে।কেন সবাই বুঝতে চাইছে না সে আদু ভাইয়ের ধমকে কাঁদছেনা বরং তাকে মারার জন্য কান্না করছে।
কিন্তু কেউ মাহরিসার কথা শোনার প্রয়োজন বোধ করছে না।
মাহরিসার সমস্যা সে অতিরিক্ত কোনো কিছুতে শকট হলে তৎক্ষনাৎ রিয়্যাক্ট করতে পারে না।
আদ্রিত চুপচাপ চোয়াল শক্ত করে সবটা সহ্য করে যাচ্ছে।
বাবা মায়ের উপর তার কোনো অভিযোগ নেই।সেও দেখতে চায় তার বাবা মা কতটা অবুঝ হতে পারে।
ওসমান ভিলায় বাসন্তী আর মাহীনের যাতায়াত ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগলো।সঙ্গে মাহরিসারও।কিন্তু নীবিড় নানা বাড়িতেই খুঁটি গেরে বসো। অনিমা বেগম তাকে দেখে দিয়েছেন নিজের সঙ্গে।
আদ্রিতের ছেলেবেলার সদ্য জন্ম নেওয়া এক মিশ্র অনুভূতির লেশ চাপা পরে গেল সেই সঙ্গে।
সেদিনের মাহরিসার চুমু খাওয়া স্থানটায় সে আজও হাত বুলায়। মাহরিসার মোছা লিপস্টিকের লাল রঙে রাঙা শার্ট টা আদ্রিত যত্ন করে রেখেছে।
সেটাও সযত্নে ব্যাগে ভরে নিলো সে।
অন্যের দেশে মাহরিসাকে মনে রাখার তার এটাই একমাত্র হাতিয়ার।
এইচএসসির পর আদ্রিত পাড়ি জমালো বিদেশের মাটিতে নিজের ডাক্তারী পড়া সম্পূর্ণ করতে।
তবে সবটাই যে তার মা তাসফির কারসাজি তা আদ্রিতের বুঝতে দু মিনিট সময়ও লাগলো।সবটাই যে মাহরিসার থেকে তাকে দূরে করতে সেটাও খুব ভালো করে বুঝেছে।
কিন্তু নিয়তির লিখন তা যায় কি খন্ডন? আজ কিংবা কাল যা ভাগ্যে আছে তা তো ফলবেই।
আদ্রিত বুঝেছে। মা চাইলেই তো তাকে দেশের কলেজে পড়াতে পারতো।
কিন্তু তা করেনি।
আদ্রিত ও আর টূ শব্দটি না করে চুপচাপ পাড়ি জমালো বিদেশে।সঙ্গে মায়ের প্রতি জমা হলো তার একরাশ অভিমান।
সে অভিমান কত কাল অতিবাহিত হলে ভাঙবে কে জানে।
প্রত্যেকটা মা বাবার প্রতি ছেলে মেয়েদের কিছু গোপন অভিযোগ থাকে।সেই অভিযোগ এক সময় অপ্রকাশ্যে থেকে থেকে গড়ে অভিমানের পাহাড়।
কিছু অভিযোগ তারা তা কখনো সামনাসামনি প্রকাশ করে না।কিন্তু বুকের মাঝে পুষে রাখে খুব যত্নে।
বিশেষ করে আদ্রিতের মত ঘ্যাড়ত্যাড়া,অভিমানী, স্বল্পভাষী ছেলেরা।
যারা চুপ করে থেকে নিজেদের অনুভূতি গুলো নিজেদের মাঝে দমিয়ে রাখে কিন্তু ভেতরে ফাটে জলন্ত লাভার ন্যায়।যেদিন সে লাভা ছুটবে সেদিন আর সেই অনুভূতি দলকেও দমিয়ে রাখা অসাধ্য।
তাড়াও ছুটবে।
রোশনী মাহরিসার কাধে হাত দিলে তার ধ্যান ভাঙে।
“ কি করছিলি এতক্ষণ জালার কাছে দাঁড়িয়ে? কখন থেকে ডাকছি তোকে।প্রাকটিক্যাল ক্লাসে যেতে হবে তো।আয় দ্রুত।”
রোশনীর হঠাৎ স্পর্শে মাহরিসা চমকে তাকায়।
বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে সুধায়
“ এই তো আসছি, তুই যা।”
ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ১
মাহরিসা জানালার ধারে শান্ত নির্মল ঠান্ডা বাতাসে চোখ বন্ধকরতেই হারিয়ে গিয়েছিল অতীতে।
কেমন আছে তার আদু ভাই? উহু আদু নয় তার আদ্রিত ভাই।সে তো এখন বলতে পারে তার আদ্রিত ভাইয়ের নাম।
মানুষটা দেশ ছাড়ার পর যে অনেক কিছু বদলে গিয়েছে।কেটে গেল কতগুলো বছর।
মাহরিসা নিজেও এখন বড্ড বড় হয়েছে। বড্ড। মেডিকেলের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে কিনা সে।এখন তো সে ছোট নয় উহু মোটেও ছোট নয়।