ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ২৮
মাহিরা ইসলাম মাহী
নাওমীর কাপড়ের ব্যাগখানা নীবিড় উপরে রেখে এসে ঢলতে ঢলতে নিচে নামে।
কতবার বলেছে তার বাবা মাহীন কে বাসায় একটা লিফট লাগাতে।
তার কথা দোতালা বাসায় আবার লিফট কিসের।এই যে এখন লিফট থাকলে নীবিড়ের কি এত কষ্ট হতো? হতো না তো।সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠা নামা করতে হতো? উঁহু হতো না তো। একদমই হতো না।
এসব কে বোঝাবে তার বাবাকে।
দ্বিতীয় বারে যখন নীবিড় উপরে উঠে ব্যাগ রাখতে যাবে বাসন্তী মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“ আরে আরে কি করছিস তুই বাজান, এখানে নয় তো।”
“ এখানে নয় তো আমার মাথার উপরে রাখবো? আশ্চর্য। “
“ একদম ঠিক ধরেছিস মাথার উপরেই।নাওমীর জন্য ছাঁদ ঘরের রুমটা পরিষ্কার করেছি।ওটা তো ফাঁকাই পরে ছিল।যাহ যাহ ওপরে নিয়ে যা।”
নীবিড় চরম হতবাক হয়ে মায়ের পানে চেয়ে রয়।
“ অসম্ভব। তুমি বুঝতে পারছো নাউডুবা চশমিশের এক একটা ব্যাগ কতটা ভারী?
তারওপর তোমায় বলিনি আমি? ওপরের ঘরটায় আমি উঠবো?”
“ থাম তুই।উপরের ঘরটায় ওও যাবে।কেন তোর আস্ত একটা রুমে হচ্ছে না? ওখানে যাওয়ার দরকার কি? আর ব্যাগ ভারী তো কি? পুরুষ মানুষ হয়েছিস কি জন্য? তোকে আমরা ভাত খাওয়াই না? শক্তি নাই শরীরে।”
“ তো ভাত খাওয়ালেই শক্তি খরচ করতে হবে? শক্তি খরচ করতে হবে আসল কাজে।তুমি বুঝতে পারছো না মা।ডিজগাস্টিং। ছাঁদের গাছের সঙ্গে হিমেল হাওয়া তুমি আমায় দিতে পারবে রুমে?”
অভদ্র মেয়েটা আসতে না আসতেই আমার জিনিসে ভাগ বসাতে শুরু করেছে। কি আশ্চর্য। চশমিশের চশমাটা এবারে তার দখল করতেই হবে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নীবিড় নীচে নামতেই নাওমী দাঁত কেলিয়ে হাসে।
নাওমী নীবিড়ের হাতে আরো একটা ব্যাগ ধরিয়ে দেয়।
নীবিড় হনহন করে হেঁটে উঠে সিঁড়ি বেয়ে।
শেষ বারের মাথায় নীবিড় নিচে নামে,মেজাজ ক্ষিপ্ত করে সুধায়,
“ এবার কি তোমায় ওও নিতে হবে।”
“ নিবেন? নিন তবে।”
নাওমী নির্লিপ্ত স্বর।
রিক্সাচালকের বয়স বেশি নয়।এই তেইশ কিংবা চব্বিশ হবে বোধহয়।
দুজনের কান্ড দেখে সে মিটিমিটি হাসে।
ছেলেটার হাসি দেখে নীবিড়ের মেজাজ আরো খারাপ হয়।
“ এই তুমি হাসছো কেন? সার্কাস চলছে।যাও এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন যাও।”
ছেলেটা নীবিড়ের ধমকে চুপসে যায়।
“ আরে আরে ভাইয়া কে বকছেন কেন? টাকা পরিশোধ করা হয়নি তো।”
“ তো টাকা পরিশোধ না করে তুমি বসে বসে কি আঙুল চুসছো এখানে?”
নাওমী দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“ উহু আপনার অপেক্ষা করছিলাম।ওনার কাছে পাঁচশ টাকা ভাঙটি নেই।”
“ কতটাকা পাবে তুমি?”
নাওমী বলল,
“ ভাইয়ার থেকে আমি বিশ টাকা পাবো।”
নীবিড় হতভম্ব চোখে চেয়ে সুধালো,
“ মাত্র বিশ টাকার জন্য তুমি ওকে দাঁড় করিয়ে রেখেছ?”
“ অবশ্যই বিশ টাকা কি আপনার কাছে টাকা মনে হয় না? ওটা দিয়ে আমি দুই প্যাকেট চিপস পাবো ভাবতে পারেন।”
নীবিড় কটমট করে চায়।ছেলেটাকে বলে,
“ এই তুমি যাও তো। নাউডুবা চশমিশকে বিশ টাকা আমি দেব যাও।”
“ তোমার মতো কিপ্টে মেয়ে মানুষ আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি।”
“ দেখবেন কি করে আপনার সঙ্গে আবার চোখ আছে নাকি? আমি তো জানতাম আপনার চোখই নেই।”
“ সাটআপ।তোমার মতো অভদ্র মেয়ে মানুষ আমি আর দুটো দেখিনি। “
“ দেখবেন কি করে।আমি এই একপিসই আছি।আপনি হাজার খু্ঁজেও বাড়তি আর একপিসও পাবেন না।”
“ তোমায় কে বলল আমি খুঁজতে যাবো? তোমার মতো মেয়ে মানুষ খুঁজবে নীবিড়? অসম্ভব। দুনিয়ায় মেয়ে মানুষের সংখ্যা শূন্য হলেও নয়।”
“ চ্যালেঞ্জ করছেন।”
“ অবশ্যই। “
“ ওকে ডান।”
শেষ ব্যাগটা নিয়ে নীবিড় পাঁচ পা বাড়ায়।কি ভেবে চট করে পিছু ফিরে।
পিছু ফিরে নাওমীর মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়।
নাওমী প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চেয়ে,
“ আবার কি হলো আপনার? কি চাই? আমাকেও নেবেন নাকি?”
“ হুউউম তোমাকেও নিতে এসেছি। আসো কাঁধে নেই।”
নীবিড় হাত বাড়াতে নিতেই নাওমী দেয় এক দৌঁড়। তাকে আর পায় কে।এক দৌঁড়ে সে গিয়ে উঠে ছাঁদে।
যাক বাবা এযাত্রায় বেঁচে গেছে সে।
নীবিড় গাঁ দুলিয়ে হাসে।
কেমন জব্দ হলো বোকা মেয়েটা।তার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ নেওয়া তাই না।
শেষ ব্যাগটা রুমে রেখে নীবিড় রুমে থাকা চেয়ারে গাঁ এলিয়ে বসে ফ্যান ছেড়ে।
“ আশ্চর্য আপনি এখানে বসছেন কেন? আমার পুরো ঘর ঘোছাতে হবে।বের হন।”
“ তোমার তো সাহস কম নয়।আমার বাড়ি থেকে আমাকেই বের করে দিচ্ছো।”
“ হুহ।এটা আপনার বাড়ি নয় এখনো আঙ্কেলের।”
নাওমী ভেঙচি কাটে।
“ তো তোমার সেই আঙ্কেলের ছেলেটা কে? আমিই তো। তবে বাড়ির মালিক হলো কে?”
নাওমী সুর টেনে বলে,
“ অসব ভুজুংভাজুং মালিক কত দেখলাম। একটাও টিকলোনা।”
“ টিকলোনা মানে কি? আর তোমার মাঝে কোনো ভদ্রতা আছে? দেখছ একটা ছেলে তোমার এত হেল্প করলো তাকে সামান্য একগ্লাস পানি তো খাওয়াতে পারো? “
নাওমী জবাব দিলো না।নিজের ব্যাগ থেকে চিনির কৌটা টা বের করলো।সঙ্গে অপর ব্যাগ হতে একটা মগ বের করে টেপ থেকে পানি নিয়ে তাতে চিনি গুলিয়ে নীবিড়ের হাতে ধরিয়ে দিলো।
“ নিন।পানি নয়,নতুন মেহমান আপনি আপনাকে সরবত দিয়ে আপ্যায়ন করা হলো।হ্যাপি?”
“ তোমায় যতটা খারাপ ভেবেছিলাম ততটাও খারাপ তুমি নও নাউডুবা চশমিশ। “
নীবিড়ের বিরবির করে বলা কথা নাওমীর কর্ণগেোচর হলো না।
সে পিছু ঘুরে নিজ কাজে মগ্ন হলো।
নীবিড় এক চুমুকে সরবতটুকু শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। মগটা রাখলো চেয়ারে।
নীবিড় চট করে পিছু ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা নাওমীর বাঁধা চুলের খোঁপাটা টান দিয়ে খুলে নিলো।
মুহুর্তে কোমর সমান চুলগুলো নাওমীর ছড়িয়ে পরলো পিটময়।
“ পারফেক্ট।এবার ঠিক আছে।কোনো ছেলেকে নিজের কোমর দেখিয়ে আকর্ষণ করিয়ে সিডিউস করা একদম ঠিক না ।বড্ড বেয়াদব তুমি নাউডুবা চশমিশ,বুঝলে। বড্ড বেয়াদব। “
নাওমী চোখ বড় বড় করে চাইলো।
“ আরেএএ এটা কি করলেন।”
নীবিড় সে কথা শোনার অপেক্ষায় নেই, সে নাওমীর খোঁপাটা হাতে নিয়েই ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে।
নাওমী হতভম্ব দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো নীবিড়ের যাওয়ার পানে।
কি বলে গেল অসভ্য ছেলেটা।
বাহিরে আজ রোদের প্রখরতা প্রচন্ড।
সূর্যিমামা নিজের সকল আক্রোশ ঢেলে দিয়েছেন পৃথিবীর বুকে।
ওসমান ভিলার পরিবেশ বেশ শান্ত।আদ্রিত হসপিটালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রেডি হয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে,সঙ্গে নিস্তব্ধ । অনিমা বেগম তাদের খাবার পরিবেশন করতে ব্যস্ত।
তাসফি বেরিয়েছে সাত সকালে। কোথাও যাওয়ার আছে তার। অতীতের কিছু ভুল সুধরানোর আছে তার।
নিলয় সাহেব ড্রয়িংরুমে বসে স্যুট বুট পরে।হাতে তার কেসের ফাইট।খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছেন তিনি।
খাওয়া শেষে দুই বাপ-বেটা উঠে দাঁড়ায়। গিয়ে বসে নিলয় সাহেবের মুখোমুখি।
নিস্তব্ধ আদ্রিতের পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে সুধালো,
“ বিয়ে টা করছো কবে? ঘরে একটা শিশু বাচ্চার বড্ড অভাব বোধ করছি বুঝলে।”
“ আমি নিজেও কিন্তু আরো একটা বোনের ভীষণ অভাব বোধ করছি দাদু।তোমার ছেলেকে বলো আমার আরো একটা ভাই বোন চাই।অবশ্যই।”
নিলয় সাহেব খুকখুক করে কেশে উঠলেন।
নিস্তব্ধ ছেলের পানে চোখ বড় বড় করে চেয়ে।
দিন দিন ছেলেটা এত নির্লজ্জ,বেহায়া হচ্ছে কেমন করে।
ছোট সময়ের তার ভদ্র-শান্ত আদ্রিত একদম এভাবে বিলীন হয়ে গেল কি করে।
হাহাকার করে উঠে নিস্তব্ধ’র হৃদমাঝে।
“ ফাজলামো করো তুমি আমার সঙ্গে। “
ধমকে উঠে নিস্তব্ধ ছেলেকে।
“ একদমই না।”
“ ফাজলামো না তো কি তোমার সঙ্গে আমি কাবাডি খেলতে বসেছি? কি প্রশ্ন করেছি আমি তোমায়। তার উত্তরে অসভ্য কথা শুনতে চেয়েছি আমি?“
“ বিয়ের ব্যাপারটা আপাতত ক্লোজ করুণ।বউ আমার আর একটু বড় হবে।”
“ সেই বউটা কোথায় তোমার? আমাদেরও একটু দেখাও।”
নিলয় সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
“ বাচ্চাদের মত ঝগড়া থামাও তোমরা।”
“ আমার বয়সে তোমার ছেলে করেনি তোমার সঙ্গে ঝগড়া দাদু? সময় থাকতে ছেলেকে বোঝাও।”
নিলয় সাহেবের পুনরায় কাশি উঠে গেল।খুক খুক করে কাশতে লাগলেন তিনি।
আদ্রিত তার দিকে একগ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে নিস্তব্ধ’র পানে চেয়ে সুধালো,
“ আসছি বাবা তোমার বউমা অপেক্ষা করছে।”
“ অসভ্য ছেলে।বউমা পেলে কোথায় তুমি?”
আদ্রিত জবাব দেয় না, ছন্দ তুলে হেঁটে বেরিয়ে যায় প্রবেশ দরজা দিয়ে।
নিলয় সাহেব মাত্র পানি মুখে দিয়েছে, সঙ্গে হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিচে নামিয়ে টেবিলে রাখতে যাবে।তার মাঝে নিস্তব্ধতা ব্যাগ কাঁধে নিচে নামে।
” দাদু তোমার কোর্টে চলো তো একজনের নামে মামলা করতে হবে।”
নিস্তব্ধতার কথায় এবারে নিলয় সাহেবের মুখে থাকা পানিটুকু বেরিয়ে এলো। তা গিয়ে লাগলো নিস্তব্ধ’র শার্টে।
হাত থেকে পরে যেতে নেওয়া কাচের গ্লাসটা কোনো রকমে ধরলেন ভদ্রলোক।
নিস্তব্ধ হতভম্ব হয়ে বাবার দিকে চেয়ে।বাবা কি কোনো ভাবে তার থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার ট্রাই করছে?
” কার নামে মামলা করবে দিদিভাই? কেউ কি কলেজে তোমায় ডিস্টার্ব করে।”
“উহু। একদমই না। সাদাফের নামে, ওকে কাল রাত বারোটার সময় বললাম আমাকে আইসক্রিম কিনে দিয়ে যেতে।আর ও কিনা তা না করে নাক ডেকে ডেকে ঘুমালো? আমার মানসম্মান কে এভাবে বলিদান দিতে পারলো? আমার কথার কোনো দাম নেই? বলো? মানহানির মামলা দেব আমি ওর নামে এখুনি।চলো?”
নিস্তব্ধ অবাক স্বরে সুধায়,
“ তুমি একটা ছেলেকে বলেছ তোমায় রাত বারোটায় আইসক্রিম দিয়ে যেতে? তাও আবার ঘুমন্ত মানুষকে জাগ্রত করে?”
“ সেটাই তো বললাম বাবা।”
“ সিরিয়ারলি মামনী?”
“ ইয়েস বাবা আ’ম সিরিয়াস।”
“ বাট মামনি তোমার তো তার প্রতি কোনো অধিকার নেই। সাদাফের কাছে তোমার এমন আবদার করা তো সাজে না।তোমার উচিত ছিলো তোমার ভবিষ্যত হাসবেন্ডের কাছে আবদার করা। সাদাফের কাছে আবদার করবে ওর ওয়াইফ।”
“ ওয়াইফ মাই ফুট।জ্বলন্ত চুলোয় যাক ওয়াইফ।
দাদু তুমি মামলা নিবে কি নিবে না?”
নিলয় সাহেব থতমত ভঙ্গিতে নাতনীর দিকে চেয়ে।
তার চোখেমুখে স্পষ্ট বিস্ময়। কেউ বুঝি কাউকে আইসক্রিম না খাওয়ার অপরাধে ও মানহানির মামলা দিতে পারে। আধুনিক দুনিয়ায় আর কি কি দেখতেন তিনি জীবন?
“ কিন্তু এভাবে তো মামলা হবে না মামনী।তোমার দুজনের পক্ষের স্টেটমেন্ট লাগবে।”
“ কিচ্ছু লাগবে না।তুমি করবে কি না বলো।”
নিলয় সাহেব করুণ চোখে নাতির পানে চেয়ে মাথা নাড়লেন,অর্থাৎ না।
“ ওকে লাগবে না।পরবর্তী ওর একটা কিছু হয়ে গেলে আমায় দোষারোপ করতে আসবে না।
“ নীরু মামনী তুমি কথা শুনো..”
নিস্তব্ধতা পিছু ফিরলো না রাগে গজগজ করতে করতে চলল ভার্সিটি।
জাওয়াদ ক্লাস নিচ্ছে। দক্ষ হাতে মার্কারের সহিত লিখছে কিছু সে হোয়াইট বোর্ডে। পুরো ক্লাস নিরবতা পালন করছে।শুধু শ্রবণগোচর হচ্ছে খাতায় তোলা কলমের ঘসঘস ধ্বনি।
কিন্তু কাশফি আর নাওমীর মাঝে বসা অদিতির কোনো দিকেই ধ্যান নেই।
সে নিরব অন্য কারণে।
সুদর্শন প্রফেসর জাওয়াদকে একধ্যানে মুগ্ধ হয়ে দেখতে ব্যস্ত সে। স্বপ্নের জগতে বাস করছে যেন সে। স্বপ্নে লজ্জায় অদিতির তনু লাল হচ্ছে আর তা ফুটে উঠছে বাস্তবে ক্লাসে।
অদিতির ভাবসাব দেখে নাওনী আর কাশফি ভ্রু কুঁচকে চেয়ে তার পানে।
নাওমী ধাক্কা দিলো অদিতির কাঁধে তাতে রমণীর হুঁশ ফিরে।
“ কোন জগতে হারিয়েছিস তুই? সামনে কি? প্রফেসর? কিন্তু তাতে কি?”
কাশফি মুচকি হেসে বলল,
“ এ..ই অদিতি স..সত্যি করে বলতো।তোর লক্ষণ দুদিন ধরে ভালো দেখছি না। প্রফেসরের উপর ক্রাশ খেয়েছিস নাকি? “
অদিতির গাল লাল হয় লজ্জায়।
“ তোরা খাস নি? আমায় বলছিস?”
নাওমী প্রতিবাদ করে,
“ ধূর আমরা কি তোর মতন জান প্রাণ দিয়ে দেওয়ার মতন ক্রাশ খেয়েছি নাকি।”
“ আর আমি কি খেয়েছি?”
“ সেটা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি কি বলিস রে কাশফুল।”
অদিতি লজ্জা পায় তবে কাশফি অন্যমনষ্ক হয়ে পরে।কাশফুল। কাশফির মনে পরে যায় নিজের নামের এই সম্মোধন টুকুর কথা।
একই সম্মোধনে সে সেদিন ও একখানা চিরকুট পেয়েছে নিজের ব্যাগে।
কাশফুল,
“শুনো মেয়ে অতিরিক্ত সাহস ভালো নয়।মনে রাখবেন আমায় জ্বালাতন করলে আপনাকেও না জ্বালিয়ে আমি ছাড়ছি না।কাশফুল।”
চিঠিতে প্রিয় সম্মোধন ছিল না।আর নাতো ছিলো প্রেরকের নাম।তবে এ চিঠির মানে কি?
প্রিয় সম্মোধন যেহেতু নেই তার মানে নির্ঘাত কাশফি ওই ব্যক্তির প্রিয় কেউ নয়।
তবে এসব চিঠির মানে কি।
নাওমী কে জানালে সে বলেছে,
“ তোকে কেউ এসব বলে বোকা বানাচ্ছে রে কাশফুল। খবরদার টই ফাঁদে পা দিস না।”
কাশফি নিজেও ভাবনায় পরে যায়।
নিঝুম রাত।অদূরে জ্বলজ্বল করছে শুকতারা।
কোথাও থেকে ভেসে আসছে বুনো শেয়ালের হাক।
অদিতি শুয়ে মায়ের কোলের মাঝে।
তৃপ্তি মেয়ের মাথায় পরম আদরে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে।
“ চুলে ওয়েল ব্যবহার করো না তুমি কতদিন অতিথি?”
“ বেশি দিন নয় মা। এই তো গত সপ্তাহের মঙ্গলবারে দিয়েছিলাম।”
“ এটা ঠিক নয় অতিথি। সপ্তাহে অন্তত দুটো দিন তোমার চুলে ওয়েল ব্যবহার করা উচিত।”
অদিতি সেই জবাব দেয় না।বরং প্রশ্ন করে,
“ আচ্ছা মা তুমি আমায় অতিথি বলে কেন ডাকো? সবাই অতিথিই যদি বলবে তবে অদিতি রাখার দরকার টা ছিলো কি বলোতো?”
তৃপ্তি মেয়ের অভিমানী কন্ঠের আভাস পেয়ে মুচকি হেসে বলল,
“ আমার আর তোমার বাবার জীবনে তুমি শীতকালে উঁড়ে আসা ছোট একটা অতিথি পাখিই বটে।
প্রচন্ড হার কাঁপানো শীতে তুমি এসেছিলে আমার কোলে।তোমার বাবা ভীষণ খুশি হয়েছিলেন।
তুমি পৃথিবীতে আসায় আমাদের ধূসর পৃথিবীটা হঠাৎ করেই রঙিন হয়ে গিয়েছিলো বুঝলে।
তাই তো আমি তোমায় ডাকি অতিথি বলে।অদিতি তোমার বাবার দেওয়া নাম।”
“ আমি আসার পূর্ববর্তী তোমাদের জীবন কেন ধূসর ছিল বলোতো? বাবা তোমায় ভালোবাসতো না?”
তৃপ্তি অতীতের স্মৃতির পাতা হাতরায়।
মেয়েকে উত্তর দিতো পারে না।ওদেশে যাওয়ার পর তার মরহুম স্বামী নিখিল নয় বরং তৃপ্তিই প্রথম প্রথম ভালোবাসতে পারেনি নিখিল কে বরং নিখিলই নিজের চূড়ান্ত ভালোবাসায় আপন করে নিয়েছিল তৃপ্তিকে।
আর তার পরিনতিই তো এই যে তার কোলের মাঝে মাথা দেখে শুয়ে থাকা ছোট্ট মিষ্টি অতিথি পাখিটি।
“ মা তুমি কি জানো ? তুমি ব্যতীত এই একই সম্মোধনে আমায় অন্য এক সুদর্শন পুরুষ সম্মোধন করেন।”
“ তাই নাকি সুদর্শন?”
অদিতি লজ্জা পায়।মাথা নাড়ায়।
“ উমম, ভীষণ।”
“ আমি যদি বলি আমার ছোট্ট অতিথি পাখি সেই সুদর্শন পুরুষটিকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে তবে কি বিশাল ভুল হবে?”
“ উহু, একদমই না।
আর আমি যদি বলি সেই সুদর্শন পুরুষটিকে আমি তোমার ভাবনার চাইতেও অধিক ভালেবেসে ফেলেছি তবে কি তুমি একটুও মন খারাপ করবে?”
“ উহু একফোঁটাও নয়।”
অদিতি হাসলো।তৃপ্তির হাসি।তৃপ্তির মেয়ের হাসিটাও ঠিক তৃপ্তির ন্যায়।
তবে এবারে তৃপ্তি মেয়ের কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
“ তবে দেখ কিন্তু মামনী ভুল মানুষ কে ভালোবেসো না।ভুল মানুষকে ভালোবাসার যন্ত্রণার চেয়ে অধিক যন্ত্রণা বোধহয় আর কিছুতে নেই।শরীরের একটা অঙ্গ ক্ষয়ে গেলেও আমাদের সেই যন্ত্রণা অনুভব হয় না যত টা না এই একটা ব্যথায় হয়।
তোমার সুদর্শন পুরুষে একদম আষ্টেপৃষ্টে জড়ানোর আগে তার দিকে নজর রেখ,তার মনেও অন্যকারো নারীর বাস কিনা খুব সুক্ষ্ম ভাবে খুঁজে দেখ।নয়তো পস্তাতে হবে গোটা জীবন।
আমি তোমায় নিষেধ করবো না তাকে ভালোবাসতে।আমি বলবো তাকে ভালোবাসো তোমার মায়ের চাইতেও অধিক ভালোবাসো।তবে সেই পুরুষটি যদি তোমার জন্য সঠিক হয় তবেই।
আর যদি ভুল হয় আমি বলবো ততক্ষণাৎ পিছিয়ে এসো।মায়ের মতন একই ভুল আমার মেয়ে হয়ে দ্বিতীয় বার’টি করো না।একদমই না।
ধূসর রংধনু ৩ পর্ব ২৭
ভুল কিংবা সঠিক যাইহোক আমায় জানাতে ভুলো না কিন্তু আমার ছোট্ট অতিথি পাখি।”
অদিতি বুঝদারের ন্যায় মাথা নাড়লো।
অদিতি জানে অতীতে তার মায়ের জীবনে দুজন পুরুষ ছিলো।
একজন তার মায়ের ভীষণ ভালোবাসার মানুষ অপর জন তার মাকে আড়ালে যত্নে রাখা খুব সম্মানের একজন।যাকে তার মা আজও স্মরণ করে। উহু ভালোবেসে নয়।সম্মান করে।
কিন্তু অদিতি জানে বর্তমানে তার মায়ের হৃদয় জু্ঁড়ে শুরু সে আর বাবা থাকে।
তাইতো অদিতিও যাকে ভালোবাসে তার অতীতের কিছু দেখতে যাবে না সে।
সেই পুরুষের বর্তমানই হবে অদিতির বর্তমান।
অতীতকে আঁকড়ে না ধরে বর্তমান নিয়ে যে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে পারে সেই হয় প্রকৃত সুখী।
অদিতিও হতে চায় প্রকৃত সুখী।
হোক না কারো সেকেন্ড চয়েজ, কিন্তু বর্তমানে অদিতি থাকবে শুরুমাত্র তার সুদর্শন পুরুষের ফাস্ট চয়েজ।দ্যাট’স ইনাফ।