নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ২২
ঝিলিক মল্লিক
তাজরীন চনামনার ঠ্যাং খেতে খেতে সামনের দিকে হাঁটছে। পেছনে ফোনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছে রুবায়েত। তাজরীন একাই বকবক করে চলেছে। আরেকটা চনামনার ঠ্যাং মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে ও রুবায়েতকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“কুট্টুসকে নিয়ে আসলে ভালো হতো না? ও থাকলে বেশি মজা হতো।”
রুবায়েতের মনোযোগ এতোক্ষণ ওর দিকে ছিল না। ফোনালাপে ব্যস্ত ছিল ও। এবার ফোনটা কান থেকে সরিয়ে তাজরীনের দিকে গম্ভীর চাহনিতে তাকালো ও। তাজরীন আরেকটা চনামনার ঠ্যাং মুখে দিতে যাচ্ছিল। রুবায়েতকে অমন অদ্ভুতভাবে তাকাতে দেখে হাত থেমে গেল ওর। রুবায়েতের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকেই গায়ের চাদরটা আরো টেনে জড়িয়ে নিলো। রুবায়েত আবারও ফোনটা কানের কাছে নিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,
“ইয়াসিফ, তোমার সাথে পরে কথা বলছি আমি। রাখো।”
রুবায়েত নিজেই কল কেটে দিলো। ফোন রেখে পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে তাজরীনের সামনা-সামনি দাঁড়ালো। দাঁতে দাঁত পিষে ঠোঁটের কোণে হালকা অদ্ভুত হাসি বজায় রেখে জ্বলন্ত চাহনিতে জিজ্ঞাসা করলো,
“আমরা কি মজা করতে যাচ্ছি সিস্টার?”
সিস্টার! এ আবার কি জিনিস! আশ্চর্য। অতি আশ্চর্যজনক শব্দ ঠেকলো! তাজরীনের মনে একে একে অনেকগুলো প্রশ্ন জেঁকে বসলো। মাথায় যেন বাজ পরলো। বাজখাঁই গলায় বেশ জোরে ও বলে উঠলো,
“সিস্টার! কে সিস্টার? আপনি আমাকে সিস্টার বললেন? এই আমি কী আপনার সিস্টার লাগি?”
তাজরীন যে রেগে গেছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। ব্যাপারটা আঁচ করতেই সন্ধ্যার মিয়মান আলোয় অগোচরে হাসি পেলো রুবায়েতের। তবে হঠাৎ কি মনে করে যেন গম্ভীর হয়ে বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আপনি আমার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকবেন তাজ। আমার একটা বাজে অভ্যাস হচ্ছে, মানুষকে কারণে-অকারণে, যেকোনো সময়ে আঘাত করে ফেলি। লোকে খুব বলে। আর জানেন তো, কথার আঘাত ধারালো তরবারির আঘাতের চেয়েও গভীর আর মারাত্মক। আপনি মেয়েলোক। নাজুক কায়া আর মন। সহ্য করতে পারবেন না। আর পারলেও আমি আপনাকে মহীয়সী নারী উপাধি দেবো না। মেয়ে হওয়া সহজ, কিন্তু চাইলেই সবাই সহজে নারী হয়ে উঠতে পারে না। অন্তত আমার কাছে তো না।”
তাজরীন হঠাৎ কোথায় যেন থমকালো। কি হলো আচনক? রুবায়েত এমন কথা কেন বললো? কথার সুর কেমন অন্যরকম না? তাজরীনের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু এটা তো স্পষ্ট প্রমাণিত, লোকটা ওকে সরাসরি অপমান করলো, করতে চাইছে। কিন্তু কেন? কি সমস্যা? তাজরীন কী করেছে? প্রশ্নটা অনেকক্ষণ ধরে নিজের নিকটেই অনুসন্ধান করলো তাজরীন। কোনো উত্তর পেল না। আসলে তাজরীনের-ই দোষ। লোকটা ওকে এড়িয়ে চলতে চাইছে। বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছে, “আমি তোমাকে ইগনোর করতে চাইছি, আমার থেকে দূরে থাকো।” এবার তো সরাসরি মুখের ওপর বলেই দিয়েছে। কিন্তু তাজরীন বোকা। বুঝেও বোঝার চেষ্টা করেনি। কি আছে? কীসের এতো আকর্ষণ? এমন অন্ধ হলো কবে থেকে সে? বুঝতে পারছে না তাজরীন। মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মস্তিষ্ক আরো বেশি জটিল হচ্ছে। তারচেয়েও বড় কথা, তাজরীনের মন সবচেয়ে বেশি বেপরোয়া। এই অভদ্র জিনিসটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। অথচ সে এমন ছিল না।
কখনোই ছিল না। সে তো শান্ত নদীর স্রোতের মতো বহমান, বসন্তের আগমনে জেগে ওঠা নতুন পাতার মতো সতেজ, কাঠগোলাপের ঘ্রাণের মতো সুমিষ্ট, ডানা ঝাপটানো পাখির মতো স্বাধীনচেতা আর নির্মল। সবসময় হাসিখুশি থাকা মেয়েটারও ইদানীং হঠাৎ হঠাৎ কি যেন হয়। অন্যমনস্ক হয়ে থাকে সে। এই উৎসব-অনুষ্ঠানের মাঝেও আসমানের দিকে আনমনে চেয়ে থাকে। কি যে ভাবে, কি যে করে; তা নিজেও জানে না। সব প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া গেলেও প্রশ্নগুলো একত্র হয়ে খাদ্যজালের মতো একটা মূল নামে গিয়ে আটকায়। “রুবায়েত!” নামটা সাবলীল হলেও মানুষটা জটিল। এই-যে যেমন এখন এই জটিল, অমীমাংসিত স্বভাবের মানুষটা তাজরীনের সামনে কঠিন মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তাজরীনকে রীতিমতো শাসাচ্ছে। তাজরীন একটা কথাও বলছে না। চুপচাপ শুধু শুনে যাচ্ছে। কথাগুলো কানে আসছে ওর। ভালোমতো ঢুকছে কানের ফুঁকোয়।
“আমি আপনার জন্য কী এখন বাইরেও যেতে পারবো না হ্যাঁ? যেখানেই যাই, সেখানে আপনি। বাট হোয়াই? আমি কী আপনার পাসপোর্ট? যে আপনার আমাকে সব জায়গায় যাওয়া-আসার জন্য প্রয়োজন! আজ একটু দরকারে বাইরে বের হলাম, এখানেও আপনি। নেহাতই লোকলজ্জার ভয়ে কিছু বলতে পারি না সবার সামনে। নাহলে এইভাবে যাওয়ার জন্য বাচ্চাদের মতো জোরাজুরি করায় তখন আপনার কানের ওপর ঠাটিয়ে একটা চড় মে’রে বাচ্চামো ছুটিয়ে দিতাম। শুধু বয়সে ধাড়ি হয়েছেন আপনি। এতো ইমম্যাচিউর কেন হ্যাঁ? এই ভর সন্ধ্যায় গ্রামাঞ্চলে একটা প্রাপ্তবয়স্ক ছেলের সাথে একা বেরিয়ে পরলে কোন ধরনের বিপদ হতে পারে, আইডিয়া আছে আপনার? ওহহ না! কাকে কী বলছি আমি! জাস্ট লিভ মি অ্যালোন। যান এখান থেকে। কী হলো? কথা কানে যায় না?!”
এতগুলো কথা বলার শেষে ধমকটা দিতেই কেঁপে উঠলো তাজরীন। চোখ বুঁজে ঠোঁট চেপে সহ্য করে নিলো। রুবায়েত তখন আবার যথেষ্ট ঠান্ডা থাকার চেষ্টা করে বললো,
“লিসেন তাজ, ব্যাপারটা আরো বাড়ার আগেই একটা কথা ক্লিয়ার করে দিই। আফটারঅল তুমি আমার বন্ধুর বোন। তাই আমারও বোন হও। সিস্টার, অন্য মেয়ে হলে এতোটা ভাবতাম না৷ তুমি আমার বন্ধুর বোন। এজন্য একটা উপদেশ দেবো তোমার ভালোর জন্য, তুমি পারলে আমার থেকে দূরে থেকো।”
তাজরীন আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে পারছে না। কিসব যে হচ্ছে! একবার তুমি, আবার আপনি। তারওপর আবার এক্সট্রা ‘সিস্টার’ তো আছেই। আবার হঠাৎ এসব কঠোর কথাবার্তা। তাজরীন এখুনি মূর্ছা যেতো। কিন্তু ওকে একটুর জন্য বাঁচালো কুট্টুস। রুবায়েত আর তাজরীন তখন গ্রামের মেঠোপথ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। মাগরিবের আজানের পরপরই বের হয়েছিল ওরা। তাজরীন তো একপ্রকার জোরপূর্বক এসেছে রুবায়েতের সাথে। কুট্টুস সেই অন্ধকারে কুঠিবাড়ির রাস্তা ধরে দৌড়ে এসেছে। কাঁদছে বাচ্চাটা। তাজরীনকে দেখেই “তাজ বাবু” বলে কেঁদেকেটে ওর কোলে ঝাঁপিয়ে পরলো। তাজরীন ওকে কোলে উঠিয়ে জরিয়ে ধরে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞাসা করলো,
“তুমি কার সাথে এসেছো কুট্টুস সোনা? এই ভর সন্ধ্যায় কেউ একা আসে?”
কুট্টুস জবাব দেওয়ার আগেই দূর থেকে মাহমুদ ভাইকে ছুটে আসতে দেখা গেল। মাহমুদ এগিয়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে তাজরীনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“আর বোলো না। জ্বালিয়ে মারছে ব্যাটা। তুমি ওকে রেখে চলে আসার পর থেকেই ভরা আড্ডার মধ্যে সে কি কান্নাকাটি। ওর মাম্মা তো ওকে রাগারাগি করছিল। তখন রুস্তম ভাই-ই বললো, ওকে দিয়ে যেতে তোমাদের কাছে। তোমরা কী জরুরি কাজে হাটের দিকে যাচ্ছো? নাহলে ওকে একটু নিয়ে যাও প্লিজ। তাজ যে কি পানি পড়া খাইয়েছো ওকে! এখন তোমাকে ছাড়া কিছু চেনেই না।”
কথা শেষ করেই হোহো করে হাসতে লাগলো মাহমুদ ভাই। তাজরীনও মুচকি হেসে রুবায়েতের দিকে চোখ পরতেই চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগের কথাগুলো কানে বাজতে লাগলো যেন। ভেবেছিল, এতো অপমানের পর আর এখানে থাকা ঠিক হবে না। ফিরে যাবে কুঠিবাড়িতে। দরকার নেই কোনো ফুলের মালা, গাজরা কেনার। সেই ইচ্ছা-বাসনা না-হয় তোলা-ই থাকুক। কিন্তু কুট্টুস এসে সব গোলমেলে করে দিলো। এখন নাকি তাকে ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে। তাজরীন আর রুবায়েত যেখানে যাচ্ছে, কুট্টুসও সেখানে যাবে। রুবায়েত এবার এগিয়ে গিয়ে মাহমুদের কাঁধে হাত রেখে হালকা হেঁসে জবাব দিলো,
“প্রবলেম নেই। আমরা এইতো হাটের ওদিকে যাবো। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আবার ফিরে আসবো। ওকে দেখে রাখবো। কোনো চিন্তা কোরো না।”
আজ রাতে একটা আসর বসবে। সেজন্য কাজ না থাকলে মাহমুদও যেতে পারতো রুবায়েতদের সাথে। এই দুঃখ প্রকাশ করে ও আবার ফিরে গেল কুঠিবাড়ির দিকে। রুবায়েত এবার আগের মতোই গম্ভীর মুখ করে এগিয়ে গেল। তাজরীনের কাছ থেকে কুট্টুসকে টেনে নিয়ে বললো,
“সরো। বাচ্চাকাচ্চা তুমি সামলাতে পারবে না। ফেলে দেবে। ও বরং আমার কাছেই থাকুক।”
তাজরীন একথার জন্য প্রতিবাদ করতো। কিন্তু কুট্টুস রয়েছে বলে আগ বাড়িয়ে কিছু বললো না। কুট্টুসকে কাঁধের ওপরে বসালো রুবায়েত। পেছনের দিকে ঠিক ঘাড়ের কাছটায়। কুট্টুস তো মহাখুশি। সড়ক এখনো অনেকটা দূরে। কুট্টুস রুবায়েতের কান ধরে, চুল টেনে খেলা করতে লাগলো। দুই কান টেনে ধরে ”ঘ্যাঘো-ঘ্যাঘো” বলে বলে খেলতে লাগলো। তাজরীন পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে কুট্টুসের কান্ড দেখছে। আড়ে আড়ে রুবায়েতকে দেখলো। গোছানো, পরিপাটি চুল এলোমেলো হয়ে গেছে। কানদু’টোর বেহাল দশা। অনেকটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। রুবায়েতকে দেখে বোঝা যাচ্ছে, বহুকষ্টে সহ্য করছে। তাজরীনের হাসি পেলো। দাঁতে দাঁত পিষে এবার বিরবির করে বললো,
নক্ষত্রের যাত্রাপথে পর্ব ২১
“ঠিক-ই আছে ব্যাটা। কর্মের ফল সবাই পায়। আমাকে হার্ট করে কথা বলা না? সহ্য করেন এবার। আজকে জাস্ট এই ঝামেলাটা যাক, তারপর থেকে আর জীবনেও কখনো আপনার সাথে কথা বলবো না। পণ করলাম!”
তাজরীনের হঠাৎ মনে হলো, ও মরীচিকার পেছনে ছুটছে। কিন্তু সেই মরীচিকা যে কি, তা নিজে ঠাহর করতে পারছে না! অথৈ সাগরে কূল হারানোে আগে বেঁচে ফেরা দরকার। নাহলে ধ্বংস নিশ্চিত!