না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ২২ (২)
মাইশা জান্নাত নূরা
ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় শপিং মলের সামনে বাইক থামালো তেজ। ইলমা নীরবে বাইক থেকে নেমে দাঁড়ালো। তেজ নিজের প্যান্টের পকেট থেকে ক্রেডিট কার্ড বের করে ইলমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো….
—“এই নিন, ভিতরে গিয়ে যা যা প্রয়োজন সব কিনে নিন।”
ইলমা কার্ড হাতে না নিয়ে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো…
—“আপনি আমার সঙ্গে ভিতরে যাবেন না?”
তেজ বললো…
—“না। মেয়েদের সঙ্গে শপিং মলে ঢোকা মানেই জীবন ত্যনা-ত্যনা হয়ে যাওয়া। আমি বাইরে থাকবো। কেনাকাটা শেষ হলে এখানেই এসে দাঁড়াবেন। আমি আবার নিয়ে যাবো।”
ইলমার দৃষ্টি খানিক নেমে এলো। দ্বিধা মিশ্রিত কণ্ঠে বললো….
—“আসলে আমি কখনো এতো বড় জায়গায় কেনাকাটা করতে আসি নি। ভিতরের পরিবেশ অনেক উন্নত হবে। আমি জানি না কোথায় যাবো, কীভাবে টাকা পরিশোধ করবো। যদি কষ্ট করে আমার সঙ্গে যেতেন তাহলে সত্যিই উপকার হতো। তবে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমি অন্য মেয়েদের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট করবো না।”
তেজ ভ্রু উঁচিয়ে ইলমার দিকে তাকালো। সেই দৃষ্টির ভারে ইলমা আরো খানিকটা মাথা নুইয়ে নিয়ে নরম গলায় বললো….
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
—“আমি অনাথ। অনাথ আশ্রমেই বড় হয়েছি। যেই বয়সে অন্যরা নিজের ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, সেই বয়সে আমি কেবল অভাবকে চিনেছি। চাহিদা প্রকাশ করতে জানি না ঠিকঠাক ভাবে। নেহাতই সঙ্গে কোনো কাপড় ছিলো না। তাই বাধ্য হয়ে আপনাদের বলতে হলো।”
সকালবেলার কথাবার্তায় ইলমার পরিচয় জানা হয় নি তেজের। এখন ওর মুখ থেকেই শুনে তেজের মুখশ্রী খানিকটা নরম হলো। ইলমার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো…..
—“আপনি এখানেই দাঁড়ান, আমি বাইকটা পার্কিং-এ রেখে আসছি।”
তেজ চলে গেলো পার্কিং এর দিকে। ইলমা তেজের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর বাইক রেখে ফিরে এসে তেজ গম্ভীর কণ্ঠে বললো….
—“ভিতরে যাওয়া যাক।”
ইলমা আস্তে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। শপিং মলের কাঁচের তৈরি মূল দরজা পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই ইলমার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেলো। রং-বেরঙের লাইটের আলোয় চারপাশ ঝলমল করছে। সপিংমলটা সম্ভবত ৪-৫ তলা বিশিষ্ট হবে। প্রতিটি ফ্লোরে ফ্লোরে দামী-দামী জিনিসপত্র, পোশাক-আশাক এ ভরপুর অগুনিত শোরুম রয়েছে। শত শত মানুষ নিজেদের মতো কেনাকাটা করতে ব্যস্ত। তাদের পোশাক-পরিচ্ছেদ, চলনের দিকে লক্ষ্য করলেই বুঝা যায় তারা সবাই ধনী পরিবার থেকে বিলং করেন।
তেজ নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে আগে আগে হাঁটছে। ইলমা পেছনে পেছনে অনুসরণ করছে। হঠাৎ মাঝ বরাবর এসে ইলমা দাঁড়িয়ে পড়লো। একটা কৃত্রিম ঝর্ণা রয়েছে সেখানে কয়েকটা সাদা রঙের মূর্তি রাখা। দৃশ্যটা মুগ্ধ করেছে যেনো ইলমাকে।
তেজ পিছনে ঘুরে বললো….
—“চলুন। উইমেন সেকশন দ্বিতীয় তলায়। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো দেখাচ্ছে না।”
চমকে উঠে ইলমা দ্রুত মাথা নাড়লো। ভিড়ের মাঝে নিজেকে ভিষণ বেমানান লাগছিলো ইলমার।
চলন্ত সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই ওর পা জমে গেলো। ভ*য়া*র্ত চোখে তাকিয়ে রইলো সিঁড়ির দিকে। তেজ ইতিমধ্যেই অর্ধেক উঠে গিয়েছে। হঠাৎ খেয়াল করলো ইলমা নিচেই থেমে আছে। মুখ দিয়ে “চ্” শব্দ উচ্চারণ করে আবারও নিচে নেমে এলো তেজ। ইলমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো….
—“হাতে হাত রাখুন।”
ইলমা ভী*তু কণ্ঠে বললো….
—“উপরে যাওয়ার আর কোনো রাস্তা নেই?”
তেজ ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলো….
—“না। যেতে হলে এভাবেই যেতে হবে।”
ইলমা নিচু স্বরে বললো…
—“তাহলে বাইরে যাই। ছোট কোনো দোকান থেকেই কিছু কিনে নেবো। আমি তো সস্তা কাপড় পরিধান করেই অভ্যস্ত।”
তেজ চোখ কুঁচকে বললো….
—“আপনি অভ্যস্ত হতেই পারেন। কিন্তু আমি সে পথে যাই না। আমার সঙ্গে এসেছেন যখন তখন এখান থেকেই কিনতে হবে যা কেনার।”
ইলমা মাথা নুইয়ে নিলো। তেজ একটু থেমে নরম গলায় বললো…..
—“সরি, কিছু মনে করবেন না।”
এই বলে আচমকাই ইলমাকে পাঁজাকোলে তুলে নিলো তেজ। ইলমা আঁতকে উঠে বললো….
—“এই এই! নামান আমাকে। চারপাশে সবাই দেখছে।”
তেজ দাঁতে দাঁত চেপে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বললো….
—“এখন যদি নিচেই ফেলে দেই, তাহলে কিন্তু আরো খারাপ হবে।”
ইলমার শরীর কেঁ*পে উঠলো। ছটফট করা থামিয়ে দিয়ে তেজের শার্ট শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই উপরে পৌঁছে ইলমাকে নামিয়ে দিলো তেজ। ইলমার হাত-পা এখনও কাঁপছে।
তেজ ঠান্ডা গলায় বললো….
—“আপনার ভবিষ্যৎ স্বামীর জন্য এখন থেকেই খারাপ লাগছে।”
ইলমা চোখ কুঁচকে বললো….
—“মানে?”
—“আপনাকে কয়েক সেকেন্ড কোলে রাখতেই আমার যা অবস্থা হলো! বিয়ের পর আপনার স্বামীকে তো প্রতিদিনই এসব করতে হবে। তাই বলছি, খাওয়া-দাওয়া একটু কমান। অনেক মুটিয়ে গিয়েছেন।”
ইলমার মুখ লাল হয়ে উঠলো। প্রতিবাদী স্বরে বললো….
—“আমি তো নামিয়ে দিতেই বলেছিলাম। আপনিই নামালেন না। এখন আবার আমাকে মোটা বলছেন! শুনেছি আপনাদের মতো বড় ঘরের ছেলেরা নিয়মিত ব্যয়াম করে। ভারি ভারি জিনিস তুলতে অভ্যস্ত হয়। আপনি করেন না?”
তেজ হেসে উত্তর দিলো…
—“হ্যাঁ, প্রতিদিনই করি। না করলে শরীর-মন কোনোটাই ফ্রেশ লাগে না।”
ইলমা ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো….
—“তাহলে! আমি তো ষাট কেজিরও কম হবো। এতেই আপনার বেহাল দশা হলো! কেমন ব্যয়াম করেন আপনি? ছিঃ।”
তেজ ইলমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে গম্ভীর গলায় বললো….
—“কেমন মেয়ে আপনি, মজাটুকুও বুঝতেই পারলেন না। ছিঃ!”
ইলমা বিরক্ত হয়ে মুখ বাঁকালো। অতঃপর ওরা আবারও হাঁটা শুরু করলো। একটি লেডিস শপের সামনে এসে ইলমার চোখ আটকালো। কাঁচের ভিতরে ঝুলে থাকা গাউনটাইপ ড্রেসের দিকে ওর দৃষ্টি স্থির হলো।
তেজ বিষয়টা লক্ষ্য করে বললো…
—“পছন্দ হয়েছে জামাটা?”
ইলমা ঠোঁট কামড়ে নিচু স্বরে বললো….
—“অনেক দাম হবে, তাই না?”
তেজ বললো….
—“দাম নিয়ে ভাববেন না। পছন্দ হয়েছে কিনা সেটাই বলুন।”
—“কিন্তু একদিন না একদিন সব টাকা আমাকে পরিশোধ করতে হবে। তাই জানাটা জরুরি।”
তেজ মৃদু হেসে বললো….
—“ঠিক আছে। যখন উপার্জন করবেন তখন না হয় শোধ দিয়ে দেবেন। আপাতত ভিতরে চলুন। জামাটা ট্রায়াল দিয়ে দেখুন। মাপটাপ ঠিক হয় কিনা। পাশাপাশি আরও কিছু দেখবেন।”
ইলমা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। অতঃপর ওরা দু’জনে একসাথে শোরুমের ভেতরে প্রবেশ করলো।
চুপচাপ ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে পিহু। দুপুর হয়ে এসেছে প্রায়। আজ রোদের তেজ নেই বললেই চলে। হালকা বাতাসে পিহুর হাঁটু ছুঁই ছুঁই চুলগুলো উড়ছে। শ্যম বর্ণের মায়াভরা মুখশ্রী ওর হরিণের ন্যয় টানা টানা চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে একটু পর পর। মনের এই অবস্থা নিয়ে নিচে থাকলে অনেকের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো ওকে তাই তখন রুম থেকে বেড়িয়ে সরাসরি ছাদে চলে এসেছে পিহু।
সৎ মায়ের অ*ত্যা*চা*রে , জন্মদাতা পিতার অবহেলাতে পিহু হাসতে ভুলে গিয়েছিলো কিন্তু কাঁদতো না। আজ সারফারাজের সামান্য ধ*ম*কে ওকে কাঁদিয়েছে। আসলেই কোনো মানুষ খুব বেশি প্রিয় হয়ে উঠলে তার ছোট ছোট কথা যেমন আনন্দ দেয়, মুখে হাসি ফুটায় তেমনই তার একটু রুড আচারণেই দু’চোখ অশ্রুতে সিক্ত হয়ে যায়। পিহুর ক্ষেত্রে ঠিক এমনটাই হয়েছে।
এদিকে সারফারাজ রুম থেকে বেরিয়ে পিহুকে খুঁজতে শুরু করেছে। বারান্দা, ড্রইংরুম, বাগান প্রায় সব জায়গাতেই খোঁজা শেষ করেছে সারফারাজ। কিন্তু কোথাও পিহুর দেখা না পাওয়ায় নিজের ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত শ*ঙ্কা জেগে উঠেছে সারফারাজের। সেইসময় একজন মধ্যবয়সের মহিলা সার্ভেন্ট এসে বললেন….
—”বড়বাবা, কিছু লাগবে আপনার?”
সারফারাজ নরম কন্ঠে বললো….
—”পিহুকে দেখেছিলেন আপনি, মালতি চাচী?”
সার্ভেন্টটি বললেন….
—”বড়বউমাকে তো অনেকক্ষণ আগেই ছাদের দিকে যেতে দেখেছিলাম।”
—”আচ্ছা, ঠিক আছে।”
এই বলে সারফারাজ ছাদের দিকে ছুটে গেলো। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ছাদের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখলো পিহু নিরবে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।
সারফারাজের বুক চিঁড়ে ভারী নিঃশ্বাস বের হলো। ফিসফিস করে বললো….
—”আলহামদুলিল্লাহ, পাওয়া গেলো অবশেষে।”
সারফারাজ ধীর পায়ে পিহুর দিকে এগিয়ে গেলো। শান্ত স্বরে বললো….
—”হায়াতি…”
পিহু সঙ্গে সঙ্গে দু’হাতে রেলিং চেপে ধরলো। সারফারাজের দিকে ঘুরলো না। পিহুর চোখের কোণ ভিজে আছে এখনও। সারফারাজ পিহুর আরো কাছে গিয়ে বললো…..
—”সরি প্রিটিহার্ট, আমার তখনের আচরণের জন্য। আমি জানি তোমার খারাপ লেগেছে। কিন্তু আমি…”
পিহু তৎক্ষণাৎ ঘুরে সেখান থেকে চলে যেতে চাইলে সারফারাজ ওর হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে আহত স্বরে বললো….
—”যেও না, প্লিজ।”
পিহু হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু সারফারাজ পিহুর হাত না ছেড়ে বরং ওকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো। এরপর পিহুর সামনে দু’হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। গাঢ় নীল মণি বিশিষ্ট চোখজোড়া পিহুর দিকে স্থির করে ভেজা গলায় বললো…..
—”আমি ভুল করেছি, প্রিটি। কিন্তু বিশ্বাস করো একটু আগে পর্যন্ত তোমায় কোথাও না পেয়ে আমার বুকের ভেতরে কেমন অসহ্যকর য*ন্ত্র*ণা অনুভব হচ্ছিলো তা যদি তোমায় বুঝাতে পারতাম! মনে হচ্ছিলো তোমায় হারিয়ে ফেললাম না তো! এইটুকু সময়ে তোমায় খুঁজতে খুঁজতে আমি বুঝেছি তুমি আমার জন্য কতটা প্রয়োজনীয়, কতটা মূল্যবান।”
পিহু ঢো*ক গি*ল*লো একবার। ওর চোখে জল টলমল করছে। ঠোঁটের ভাঁজ পেরিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। সারফারাজ এবার হাত জোড় করে অনুনয়ের স্বরে বললো…..
—”ক্ষমা করো আমায়। আমি রাগী, জেদী। তাই মাঝেমধ্যে না চাইতেও এমন কিছু কাজ করে বসি যা আমার আপনজনদের হার্ট করে। পরে অনুভব করি পুরো বিষয়টাই। তোমার ক্ষেত্রেও একই কাজ করে ফেলেছি আজ। তবে আর কখনও এমন না করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। শুধু আমি যা করতে নিষেধ করবো তা কষ্ট করে মেনে চলিও, প্লিজ।”
না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ২২
পিহুর বুকটা হু-হু করে উঠলো। ধীরে ধীরে চোখ তুলে সারফারাজের দিকে তাকালো। সারফারাজ পিহুর হাত দুটো নিজের কপালে সাথে ঠেকিয়ে বললো….
—”তুমি আমার শান্তি, তুমিই আমার শক্তি। রাগে যা-ই বলি না কেনো, শেষমেশ আমার তোমাকেই লাগবে প্রিটিহার্ট। তাই একটা প্রতিশ্রুতি চাই তোমার কাছে। আমায় আর একা ফেলে চলে যেও না কখনও কোথাও।”