না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ৬

না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ৬
মাইশা জান্নাত নূরা

বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্রই সোনালী হ*ন*হ*নি*য়ে নিজের ঘরে গিয়ে ভিতর থেকে ঠা*স করে দরজাটা লাগিয়ে দিলো। পিহুর ভিষণ ক্লান্ত লাগছে। শারীরিক-মানসিক দুই ভাবেই। পিহু কল তলায় গিয়ে হাত-মুখ ধুচ্ছিলো সোমা মেইন গেইটটা বন্ধ করে পিহুর কাছে এসে দাঁড়ালো। কমোরে একহাত রেখেছে। তার চোখে-মুখে রা*গ, বি*র*ক্তি, হিং*সা*র মিশ্রিত ছাপ স্পষ্ট। সোমা বললেন…..

—”ও বাড়ি ঢোকার সময় কি বলেছিলাম তোকে আমি?”
পিহু শীতল চোখে সোমার দিকে তাকিয়ে বললো….
—”তোমাদের আশেপাশেও যেনো না ঘেঁ*ষি সেটা বলেছিলে।”
সোমা বি*ষ মেশানো কণ্ঠে বললেন….
—“হ্যাঁ, আমাদের আশেপাশে ঘেঁ*ষিস নি ঠিকই। কিন্তু সুযোগ পেতেই বড়লোক, ক্ষমতাওয়ালা বেটার দিকে ঢলে পড়েছিস। লোভ সামলাতে পারিস নি তাই না?”
পিহু আ*হত চোখে তাকালো সোমার দিকে। চাপা রাগও কাজ করছে ওর ভিতর। পিহু বললো….
—“এসব কী বলছো তুমি মা!”
সোমা গর্জে উঠা কন্ঠে বললেন….
—”এই চুপ। একটা শব্দ মুখ দিয়া বের করবি তো চুলার পার থেকে খু*ন্তি গরম করে এনে মুখের উপর বসিয়ে দিবো একদম।”
পিহুর চোখে-মুখে ভ*য়ের কোনো ছাপ স্পষ্ট হলো না সোমার এমন হু*ম*কি মূলক কথা শুনে। পিহু দৃঢ় কণ্ঠে বললো…..

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—“আমার আত্মসম্মান এতোটা ঠু*ন*কো নয় যে আমি কোনো পুরুষের দিকে নিজে থেকে ঝুঁকে পড়বো। এমপি সাহেবের সঙ্গে যা হয়েছিলো তা পুরোটাই ভু*ল বোঝাবুঝি ছিলো। প্রজেক্টরে তুমিও দেখেছিলে মা, ঐ অ*সভ্য লোকটা আমার কোমরে হাত দিয়েছিল। আমি তো তাকে বলি নি আমাকে ছোঁয়ার জন্য! আর না এমপি সাহেবকে এমন অবস্থানে দাঁড়াতে বলেছিলাম যাতে ভু*ল বুঝে তার গালেই আমি থা*প্প*ড়*টা বসাতে পারি। এমপি সাহেবকে আমি এটাও বলি নি আমাকে দেখে তার মুগ্ধ হতেই হবে। আর সবার সামনে আমাকে তার হবু স্ত্রী হিসেবে ঘোষণা না করলে আমি তার পদ-ই ছি*নিয়ে নিবো। সবটাই তিনি নিজে থেকেই করেছিলেন।”
সোমা দাঁতে দাঁত পি*ষে বললেন….

—”আমার মেয়েটা এখনও কোনো ভালো ছেলের নজরে পরে নি ওর আগেই তোর গতি এতো ভালো জায়গায় হয়ে যাবে তা যে আমি চুপচাপ বসে দেখবো না সেটা এখুনিই মাথায় ভালো ভাবে ঢুকিয়ে নে। তোকে আমি কিছুইতেই এতো সুখ হজম করে নিতে দিবো না রে পিহু।”
এই বলে সোমাও স্থান ত্যগ করলেন। পিহু ধীরপায়ে এগিয়ে বারান্দায় এসে বসলো। দৃষ্টি ওর মাটির আঙিনার উপর স্থির হয়ে আছে। পিহুর দু’চোখ মূহূর্তেই নোনাজলের পুকুরে পরিণত হয়ে উঠলো। ওর মন যেনো ওর মস্তিষ্ককে প্রশ্ন করলো….

‘কি দোষ পিহুর? কেনো শুধু ওকেই এতো ছোট নজরে দেখা হয়? পিহুর জীবনে যদি সত্যিই একটু ভালো থাকার মাধ্যম হিসেবে এমপি সাহেব এসে থাকেন তাহলে এ নিয়েই সোমা-সোনালীর মাঝে এতো হিং*সা*ত্মকতার সৃষ্টি কেনো হতে হবে? কেনো পিহুকেই বারবার ক*ষ্ট সহ্য করতে হবে? ওর কি সুখ কুড়িয়ে একটু ভালো থাকার কোনো অধিকার নেই? কেবল য*ন্ত্র*ণা*রা*ই কি ওর সঙ্গী হওয়ার যোগ্যতা রাখে? কেনো সুখ ওর সই হয় না কেনো যন্ত্রণারাই ওকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে ধরে থাকে সর্বক্ষণ?’
পিহুর দু’চোখ আর বাঁধ মানলো না। টপটপ করে অশ্রুরা ঝড়ে পড়লো ওর কোলের উপর। পিহু সেদিকে পাত্তা দিলো কই?

অন্যদিকে…..
ঢাকার উপকণ্ঠে জনবসতি থেকে অনেক দূরে একটা পুরোনো গু*দা*মের মতো জায়গা। যার রূপ-নকশা বাহিরে থেকে একরকম মনে হলেও ভেতরে তা পুরোপুরি ভিন্ন। পুরো জায়গাটি হাই সিকিউরিটি বেষ্টিত। চারপাশে উঁচু প্রাচীর তোলা রয়েছে। প্রাচীরের উপরে আরো একহাত উচ্চতার ইলেকট্রিক কাঁটা*তা*রের ব্যবস্থা করা রয়েছে। যে অংশটুকু সর্বক্ষণ কারেন্ট হয়ে থাকে।
মূল গেইট পেরিয়ে ভিতরে ঢোকার জন্য মুখের ফেস-রিকগনিশন স্ক্যানার লাগে। যেটা ছাড়া কেউ-ই ভিতরে ঢুকতে পারবে না। গেইট দিয়ে ঢোকার পরই সেখানে দাঁড়ানো গার্ডসদের হাতে অত্যাধুনিক অ*স্ত্রের পাশাপাশি স্নাইপার পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। চারদিক অত্যাধুনিক সিসিটিভি ক্যামেরা ও ড্রোনের আওয়াত থাকে সর্বক্ষণ। এই জায়গাটির একদম ভিতর পর্যন্ত ঢুকতে হলে তিনটা চেকপয়েন্ট পার হতে হয়। প্রথম ধাপকে বলা হয় গাড়ি স্ক্যানার। ২য় ধাপকে বায়োমেট্রিক স্ক্যানার। আর শেষ ধাপকে বলা হয় কনফার্মেশন কোড ডায়াল।

এই তিন ধাপ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই লম্বা হালকা আলো-অন্ধকার করিডোর থাকবে। যেই করিডোরের দেওয়ালে লাল আলো টিমটিম করে জ্বলা-নেভা করে সর্বক্ষণ। ভেতরের দেওয়াল গুলো সাউন্ডপ্রুফ হওয়ায় বাহির পর্যন্ত কোনো শব্দ পৌঁছাতে পারে না। নিচতলায় বিশাল হল রুম রয়েছে। যেখানে সারফারাজের সব গার্ডসরা ট্রেনিং করে। মার্শাল আর্ট, অ*স্ত্র চালনা সব ধরণেরই ট্রেনিং হয়।
দোতলায় একটা বিলাসবহুল অফিস আছে। সারফারাজ ওর সিক্রেট কাজগুলো এখানে বসেই সম্পন্ন করে। রুমটির ভিতরে বড় আকারে একটা টেবিল আছে। রয়েছে নরম গদি বিশিষ্ট কয়েকটা চেয়ার। দেওয়ালে সারফারাজের নিজের একটা বিশাল সাইজের ছবি বাঁধানো অবস্থায় টাঙানো রয়েছে। এছাড়াও পাশেই একটা শেলফ ভর্তি বিভিন্ন ফাইল রাখা রয়েছে। সেই ফাইলগুলোর ভিতরে কি আছে তা কেবল সারফারাজ আর ওর পারসোনাল এসিসট্যান্ট আহাদ জানে।

এছাড়াও একটা বিশেষ ট*র্চা*র রুমও আছে এখানে। যা সম্পূর্ণই লোহা দ্বারা তৈরি। রুমের ভিতর লোহার শিকল ঝুলছে যার হুক ছাদের সাথে লাগানো। এই রুম জুড়েও আলো খুব অল্প। কেবল যেই চেয়ারে ব*ন্দী*কে বসানো হয় তার মাথার উপর জ্বলে যা চারপাশ মিলিয়ে হাত দেড়েক জায়গা ভালোভাবে আলোকিত করতে পারে।
সারফারাজের গার্ডসরা রায়হানকে বিয়ে বাড়ি থেকে উঠিয়ে থানায় না দিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে। লোকসম্মুখে সারফারাজ রায়হানকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার কথা বললেও ওর আসল হুকুম ছিলো রায়হানকে নিজ আস্তানায় নিয়ে আসতে বলা। গার্ডসরা রায়হানের হাত-পা লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে টে*নে নিয়ে আসছে ট*র্চা*র রুমের দিকে। রায়হানের চোখেও কাপড় বাঁধা রয়েছে। ভ*য়ে রায়হানের মুখ থেকে কেবল তাকে যেনো ছেড়ে দেওয়া হয় সেই আ*কু*তি মূলক শব্দ গুলো বের হচ্ছে। ট*র্চা*র রুমের ভেতরে ঢোকার পর গার্ডসরা রায়হানকে লোহার চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে খুব শক্ত ভাবে ওকে বেঁধে ফেললো।

সারফারাজ দোতালায় ওর বিলাসবহুল সেই অফিস কক্ষের ভিতর চেয়ারে বসে সিসিটিভি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। রায়হানের ভ*য়ে কাঁপতে থাকা মুখটা সারফারাজের সামনে জ্বল জ্বল করে ভাসছে। কিয়ৎক্ষণ পর সারফারাজ আহাদের সাথে অফিসকক্ষ থেকে বের হয়ে সোজা ট*র্চা*র কক্ষে প্রবেশ করলো। সারফারাজ রায়হানের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। সারফারাজের থেকে খানিকটা পিছনে আহাদ দাঁড়িয়ে আছে। রুমের ভিতরে আরো চারজন গার্ডসের উপস্থিতি রয়েছে। চারজনের হাতেই রা*ই*ফে*ল ধরা।
সারফারাজ আহাদকে ইশারা করতেই আহাদ এগিয়ে এসে রায়হানের চোখের উপরে থাকা পট্টিটা খুলে ফেললো। রায়হান নিজের চারপাশে একবার চোখ বুলাতেই ভ*য়ে মাত্রা ওর এবার আকাশ ছুঁই হয়ে দাঁড়ালো। রায়হান এর কলিজা কাঁপছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে পুরোপুরি। সারফারাজ রায়হানের দিকে কিছুটা ঝুঁকে গা হিম করা কন্ঠে বললো….

—“থানায় দিলে তো তুই জামিনে বের হয়ে আসতি খুব সহজেই। আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতি। কিন্তু তোকে নিখুঁতভাবে বোঝানো দরকার, মেয়েদের দিকে কু-দৃষ্টি দিলে আর তাদের বা*জে ভাবে স্পর্শ করলে আসলে কী হয়! তাই তোকে এখানে আনা হয়েছে।”
রায়হান কাঁপান্বিত কন্ঠে বললেন….
—”আ-আমায় জা*নে মা*র*বেন না এমপি সাহেব। আল্লাহর দোহাই লাগে আপনাকে।”
সারফারাজ বাঁকা হেসে বললো…
—”না না জানে কেনো মা*র*তে যাবো বো*কা! এই একটু খাতিরযত্ন করবো। আল্লাহর দেওয়া যেই সুন্দর হাত দু’টোর অ*প*ব্যবহার করেছিস তুই ব্যস সেই হাত দু’টো তোর শরীর থেকে চিরতরের জন্য আলাদা করে দিবো।”
সারফারাজের মুখে এমন কলিজা কাঁ*পি*য়ে তোলার মতো কথা শোনার পর রায়হানের ভ*য় এমন চূড়ান্ত রূপ নিলো যে সে মুহূর্তের মধ্যেই নিজের ভিজিয়ে ফেললো। সারফারাজ বিরক্ত হয়ে নাক ছিঁ*টকে বললো….
—”এসব কি আহাদ। সামান্য হাত কা*ট*বো বললাম এতেই শা*লা প্যন্ট ভিজিয়ে ফেললো! দিস ইজ নট ফেয়ার।”

আহাদ কি বলবে কিছুই যেনো বুঝে উঠতে পারছে না। সারফারাজ আবারও বললো….
—”শুভকাজে কখনই দেড়ি করা উচিত না। ইলেকট্রিক কাঁ*টা*র মেশিনটা আনার ব্যবস্থা করো আহাদ।”
কোনো প্রশ্ন না করেই আহাদ দ্রুত চলে গেলো মেশিনটা আনতে। এদিকে রায়হান অনুনয়-বিনয়ের স্বরে চিৎকার করে বলছে…..
—“না! না! আমাকে ছেড়ে দিন এমপি সাহেব! আমার হাত কা*ট*বেন না প্লিজ! আমি আর কোনোদিন এমন ভু*ল করবো না। আল্লাহর কসম, আর কোনোদিন করবো না!”
কিন্তু সারফারাজ নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের বাম কানে বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙুল ঢুকিয়ে আলতোভাবে নাড়াতে শুরু করলো সে। যেনো রায়হানের চিৎকার তার কান অব্দি পৌঁছাচ্ছে না।

আহাদ মেশিনটা নিয়ে এসে সারফারাজের হাতে তুলে দিলো। সারফারাজের ঠোঁটে তখনও ফুটে আছে সেই শীতল, ভ*য়ং*কর বাঁকা হাসির রেখা। মেশিনটা চালু হতেই তার ঘূর্ণনের শব্দে ও সারফারাজকে ধীরে ধীরে নিজের দিকে অগ্রসর হতে দেখে লোহার শি*কল দ্বারা বাঁ*ধা অবস্থায় থাকা রায়হান প্রাণপণে ছটফট করছে ছুঁ*টা*র জন্য। কখনো ডানে, কখনো বাঁয়ে শরীর টেনে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে সে। কিন্তু কোনোভাবেই নিজেকে ছাড়াতে না পেরে রায়হানের অবস্থা হয়ে উঠছে আরো বে*হাল।

মুহূর্তের মধ্যেই সারফারাজ রায়হানের ডান কাঁধের একটু নিচ থেকে হাতের বাকি অংশ কেঁ*টে ফেললো কাঁ*টা*র মেশিন দিয়ে। য*ন্ত্র*টির দ্বারা রায়হানের মাংস ও হাড় চূর্ণ হওয়ার শব্দ ট*র্চা*র ঘর ছাড়িয়ে বাহির পর্যন্ত চলে গেলো যেনো। সাথে রায়হানের অ*স*হ*নীয় য*ন্ত্র*ণায় আ*র্ত*না*দের স্বর তো আছেই। সারফারাজ এবার রায়হানের বাম হাতটাও ঠিক একইভাবে কেঁ*টে ফেললো। প্রচণ্ড র*ক্ত*ক্ষ*রণে রায়হান সেন্স*লে*স হয়ে গেলো।
লাল র*ক্তে মুহূর্তেই ভি*জে গিয়েছে সারফারাজের পরণে থাকা শুভ্র সাদা পাঞ্জাবিটা। তবু ওর চোখে বিন্দুমাত্র দয়ার ছাপ ফুটে উঠে নি। সারফারাজ মেশিনটা বন্ধ করে পাশেই মেঝের উপর ছুঁ*ড়ে ফেলে দিয়ে আহাদকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“এর ট্রিটমেন্ট করো ঠিকভাবে। বেঁচে থাকতে হবে একে। আর কে*টে ফেলা দুই হাতের অংশ আমার পোষা কু*কু*রদের খেতে দিও।”
এই বলে সারফারাজ দ্রুত গতিতে ট*র্চা*র রুম থেকে বের হয়ে গেলো। আহাদ সারফারাজের বলা কথানুযায়ী কাজ শুরু করে দিলো।

ভোর বেলা…..
আজানের সুরে পিহুর ঘুম ভাঙলো। শোয়া থেকে উঠে বসে দু’চোখ আলতো করে ড*লে ঘুমের রেশ কাটানোর চেষ্টা করলো পিহু। গতরাতে অনেক দেরি করে ঘুমিয়েছিলো সে। একজন মানুষের সুস্থ থাকার জন্য অন্তত ছয় ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। কিন্তু আজ পিহুর ঘুম পূর্ণ হয় নি। ফলে মাথাটা ভারী হয়ে আছে। শরীরটাও ক্লান্ত ক্লান্ত লাগছে ওর।
বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে হাঁটু ছুঁই ছুঁই চুলগুলো খোঁপা করে নিলো পিহু। রাতে বিনুনি করার মতো শক্তি আর ছিলো না ওর। তাই চুলগুলো ওভাবেই এলোমেলো অবস্থাতে রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে। পাশবালিশের নিচ থেকে ওড়নাটা টেনে গায়ে জড়িয়ে ঘর থেকে বের হলো পিহু।

বারান্দায় আসতেই দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িতে চোখ পড়লে পিহু দেখলো সময় তখন ভোর ৪টা বেজে ৫০ মিনিট। দিনের সময়টা যেনো দীঘ হয়ে গিয়েছে তাই রাতটিও শেষ হয়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি।
পিহুর গায়ে এখন একটি পুরোনো থ্রি-পিচ রয়েছে। যার রঙ চ*টে যাওয়ায় আকাশী না নীল তা বোঝা দায়। এই জামাটি আগে সোনালী দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করেছিলো তারপর পিহুকে দিয়েছে পরিধানের জন্য। আসলে পিহুর ঘরে যে কয়টা জামাকাপড় আছে সবই একসময় সোনালীর ব্যবহৃত। ছোট থেকেই সেই পুরোনো জামাগুলো পরিধান করে করেই দিন কাটিয়ে আসছে পিহু।

কলতলা থেকে ওজু করে ফজরের নামাজ আদায় করলো পিহু। নামাজ শেষে নিজের রুম, বারান্দা আর আঙিনা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে নিলো। সোমা আর সোনালী তখনও নিজেদের ঘরে গভীর ঘুমে। ওদের রুমের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। আসলে ওরা কেউ-ই নিয়মিত নামাজ-কালাম পড়ে না। সোমা সাধারণত সকাল আটটার পর ঘুম থেকে উঠেন। আর সোনালী প্রায়ই এগারোটার আগে ঘুম থেকে উঠে না।
হাতের টুকটাক কাজ সেরে পিহু প্রতিদিনের মতো নাস্তা প্রস্তুত করতে রান্নার স্থানে গিয়ে বসলো। সোমা আর সোনালী রোজ সকালে পরোটা, ডিমভাজি আর চা খায়। কিন্তু পিহুর ভাগে এসব কিছুই থাকে না। এমনিতেও তেলে ভাজা কোনো খাবার পিহুর পছন্দ নয় খুব একটা। সেটা অনেক আগে থেকেই। তাই প্রতিদিন সকালে পিহু কেবল ১টা-ই সাদারুটি খায় সাথে গতরাতের কোনো বাসি তরকারি থাকলে সেটুকু নেয়। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই কেবল রুটিটাই খেতে হয় পিহুকে কোনো তরকারী ছাড়াই।

কারণ সোমা রাতেই আটার পরিমাণ মেপে রেখে দেন যেনো বাড়তি ভাবে পিহু নিতে না পারে। ডিমও গুণে গুণে ফ্রিজ থেকে বের করে দেন কেবল তাদের দু’জনের জন্য। এরপর ফ্রিজে তালা লাগিয়ে চাবিটা নিজের সাথে নিয়েই ঘুমাতে যান সোমা।
………..বর্তমান……….
কাজের মেয়ে কমলার ডাকে হুস ফিরলো পিহুর। এতোসময় নিজের অতীতের মাঝে ডুবে ছিলো সে। কমলা বললো…..
—”আপামনি কি ভাইসাহেবের কথা ভাবতেছিলেন?”
পিহু বললো….

—”কোন ভাইসাহেবের কথা বলছেন আপনি?”
—”আরে, আমাগো এমপি সাহেবে। যার হুমুকে আমি এইখানে আসছি আপনের কাছে কাছে থাকতে।”
—”ওনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই ওনার বিষয়ে ভাবার কোনো প্রশ্নই আসছে না।”
—”সম্পর্ক তো আছে আপামনি। এমপি সাহেব আমারে নিজে কইয়া দিছেন আপনে তার হবু বউ লাগেন। আমি যেনো আপনের যত্ন-আত্তিতে কোনো ত্রু*টি না রাখি। যদি ফাঁ*কি বা*জি দেখাতে যাই তাইলে আমার গ*র্দা*ন চইলা যাবে তার হাতে।”
পিহু নাক ছিঁ*ট*কে মিনমিনিয়ে বললো….
—”এই বে*হা*য়া, অ*সভ্য লোকটা পারেন তো সারাদেশে মাইকিং করে বেড়াতে নিজের নি*র্লজ্জ*প*নার।”
কমলা তা শুনতে না পেয়ে শুধালো….
—”আপামনি কি কিছুই কইলেন?”
—”না, কিছু বলি নি। আপনি আপনার কাজ করুন।”
কমলা ‘আইচ্ছা’ বললো প্রতিত্তুরে শুধু।

খান ভিলায় ড্রয়িংরুমে রাগান্বিত ভাব মুখশ্রীতে ফুটিয়ে পায়চারী করছেন জামাল খান। তার হাতের ডান পাশে সোফায় বসে হু হু কাঁদছে একজন ২২ বছরের আশেপাশে থাকা অতি আধুনিক পোশাকধারী মেয়ে। এই মেয়েটাই হলো নিশা যার কথা নির্ঝর তেজকে বলেছিলো। অন্যপাশে সোফায় বসে একবার সেই মেয়েটির দিকে তো আরেকবার নিজের স্বামীর দিকে তাকাচ্ছেন তাহমিনা খান। তার পাশেই গম্ভীর মুখ নিয়ে হাতে থাকা লাঠির উপর ভর দিয়ে বসে আছেন জামালের বাবা মোস্তফা খান। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছেন মোস্তফা খানে মেজো পুত্র বধু শিউলি ও ছোট পূত্র বধু আতুশি। সার্ভেন্টরা নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। শিউলি আতুশির দিকে কিছুটা ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো….

—“ছোট তোর কি সত্যিই মনে হয় তেজ এই মেয়ের সন্তানের বাবা হতে যাচ্ছে?”
আতুশি বললো…
—“আরে না কি যে বলো তুমি মেজোভাবী! আমাদের তেজ কতো ইনোসেন্ট। কোনোদিন একটা সিগারেট পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখে না প্যকেটের গাঁয়ে ধুপমান শরীরের জন্য ক্ষতিকর লেখা আছে জন্য। সেই ছেলে নেশা করে মা*তা*ল হয়ে তলে তলে এতো বড় একটা কান্ড ঘটাবে? এটা অবিশ্বাস্য বিষয়। আমার মনে হয় এই মেয়ে এখানে এসেছে এমন লজ্জাজনক দাবি করে টাকা হা*তা*নো*র জন্য।”
—“হুম, আমারও তো তাই মনে হচ্ছে। এখন তেজ আসলেই পুরো বিষয়টা খোলাসা হবে।”
ওদের কথপোকথন শেষ হতে না হতেই খান ভিলার মূল দরজা পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো তেজওয়ার ও নির্ঝর দু’জনে একসাথেই। শিউলি তেজকে দেখা মাত্র বললো….

—“ঐতো তেজ এসেছে।”
সকলের দৃষ্টি এবার গিয়ে পড়লো তেজের উপর। নিশা তেজের দিকে তাকাতেই ওর কান্না বন্ধ হয়ে গেলো মুখটাও অটোমেটিক হা হয়ে গিয়েছে। তেজের পড়নে ঢোলাঢালা একটা ফুল হাতা শার্ট আর ঢোলা একটা প্যন্ট রয়েছে। চোখে মোটা ফ্রেমের বড় আকারের একটা চশমা রয়েছে। চুলগুলো একপার্শে সিধি উঠানো। তেল চিটচিটে অবস্থা। শার্টটার একদম গলা পর্যন্ত থাকা বাটন টাও দেওয়া। এ কোন তেজকে দেখছে সে! নিশা যেনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তেজ ওর চোখে থাকা চশমাটা ঠেলে কিছুটা উপরে তুলে ওর বাবা জামালের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে মাথা নোয়ানো অবস্থায় বললো…..

—“বাবা, আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আপনার কল ধরতে পারি নি। আমি গতকাল থেকে একটা গ্রামে ছোট ছোট বাচ্চাদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। ফোনটা সেখানেই আমার জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো যেখানে সেখানে ব্যগের ভিতর ভুলে রেখেছিলাম।”
তেজের থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে নির্ঝর মনে মনে বললো….
—“মধ্যরাত পর্যন্ত পার্টি করে, ওয়াইন খেয়ে খানিক্ষণ পূর্ব পর্যন্তও নেশায় বিভোর হয়ে থাকা ব্যক্তিটিই যে ইনি তা কি কেউ তাকে দেখে বলতে পারবে! তেজ ভাইয়ার বাড়ির সবার সামনে থাকা রূপ আর বাহিরে আমাদের সামনে থাকা রূপ এর মাঝে পার্থক্য বের করে দু’জনকেই একজন ব্যক্তি বলে চিহ্নিত করা, অসম্ভব একটি কাজের মধ্যে এইটা একটা।”
আতুশি হাসিমুখে দূর থেকেই ইশারায় তেজের নজর কাটিয়ে বললো….

—“মাশাআল্লাহ। এমন নিষ্পাপ, মাসুম ছেলেটার উপর ঐ ব*জ্জা*ত মেয়েটা এতো বড় একটা কে*চ্ছা*র দাগ লাগাতে এসেছে। ইচ্ছে করছে ওর মাথার সব গুলো চুল টেনে ছিঁ*ড়ে ফেলি।”
জামাল একবার নিশার দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই তেজের উপর দৃষ্টি স্থির করে গম্ভীর স্বরে বললেন…
—“এই মেয়েকে চিনো তুমি?”
তেজওয়ার মাথা তুলে নিশার দিকে তাকালো। নিশার মুখ এখনও হা হয়ে আছে। তেজ নিশার উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বললো….

না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ৫

—“এই হা করা আন্টিকে আমি এর আগে কখনও দেখি নি বাবা। কে উনি?”
নিশা সঙ্গে সঙ্গে নিজের মুখ বন্ধ করে চোখের আকৃতি ছোট করে মনে মনে বললো…
—“অ*সভ্য ছেলে, আমাকে আন্টি বললো!”
শিউলি আর আতুশি মুখ চেপে নিজের হাসি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।

না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here