নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ১৩+১৪

নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ১৩+১৪
আহমেদ হৃদ

মধ্যরাত্রে’র নিকষ কালো আধারে ঢাকা চারপাশ। আকাশে চাঁদ নেই, তারা নেই। রয়েছে মন মাতানো দক্ষিনে বাতাস। সাঁ সাঁ শব্দ তুলে ছুটছে তারা। চারিদিক নীরব-নিস্তব্ধ। এই সুন্দর মুহুর্তে দুজন মানব-মানবী একে অপরকে জড়িয়ে রেখেছে শক্ত বাঁধনে। আরু ভারহীন ভাবে মাথা গুঁজে রুদ্র’র প্রসস্থ বুকে। উষ্ণ বুকে মাথা গুজে ফোপাঁচ্ছে আরু। খোলা দুটি বোতাম ভেদ করে আসা রুদ্র’র ফরসা বুক; আজ থেকে শান্তির দ্বিতীয় স্থান আরুর। সব কষ্ট, খারাপ লাগা আজ থেকে মিটবে এই বুকে মাথা গুঁজে। ভাবলেই অবাক লাগে, এই মানুষটা আরুর নিজের। তার সুখ, দুঃখের ভাগিদার। সম্পূর্ণ নিজের! আরুর বারবার চোখ পড়ছে ওই বুকে। খোলাস্থানের ক্ষুদ্র একটি জায়গা দখল করে রয়েছে একটি তিল। ফরসা বুকে কি সুন্দর সে তিলটি! অদ্ভুত টান অনুভব করছে আরু। তার কারন কি ওই ছোট্ট তিলটা? আরু নিজেকে সামলাতে পারলো না। চট করে ঠোঁট বসিয়ে দিলো।

রুদ্র চোখ বুজে বুকের তৃষ্ণা’র আহুতি দিতে ব্যাস্ত তখন। হুট করে আরুর কান্ডে বক্ষস্থলের ধিপধিপ আওয়াজ জোড়ালো ভাবে শব্দ করে উঠলো৷ চোখ মেলে তাকালো রুদ্র। হৃদপিন্ড ছুটতে লাগলো দ্রুত গতিতে। মেয়েটি সত্যি’ই চুমু দিলো? রুদ্র আনন্দে মাতোয়ারা। তবে কি ক্ষমা পাবে রুদ্র? রুদ্র যে কল্পনায় কতবার আরুকে এভাবে জড়িয়ে ধরেছে; গুনতি করা হয়েছে? হয়নি! কতোবার ‘ভালোবাসি উড়নচণ্ডী’ বলেলে, তা-ও তো জানেনা কেউ!
আরুর কান্না থামলেও, এখনো হেঁচকি উঠছে। রুদ্র মাথায় হাত রাখলো আরুর। খোলা চুলগুলো উন্মুক্ত হয়ে ছুটছে এদিক-ওদিক। রুদ্র আগলে নিলো সেগুলো। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। বুকে যে কি পরিমাণ শান্তির স্রোত বইছে, কেউ কল্পনাও করতে পারবে না!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কাটলো আরও কিছু মুহুর্ত। ফোনে মেসেজ আসতেই পকেট একহাতে ফোন বের করলো রুদ্র। মেসেজটি পড়ে মুচকি হেঁসে ‘ওকে’ টাইপ করে পাঠিয়ে দিলো কাউকে। অতপর আবারো ফোন রেখে দিলো। এই রাতটা সৃতিময় হোক! কষ্ট, প্রতিক্ষার সমাপ্তি ঘটুক। আরুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ডাকলো রুদ্র,
‘মিস অরোনিতা।’
মাথা তুললো আরু। তার লজ্জা লাগছে। এই মুখ কিভাবে দেখাবে আরু লোকটাকে? তখনের চুমুর কথা ভবলেই; ছুটে পালাতে ইচ্ছে করছে আরুর। কেন এমন করলো আরু? রুদ্র আরুর লজ্জায় রাঙা মুখে হাত রাখলো। আকাশের দিকে হাত উঁচিয়ে বললো,

‘তাকাও ওদিকে।’
রুদ্র’র ইসারা করা হাতের দিকে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো আরু। ভেতরে যেটুকু রাগ ছিলো, মুহুর্তে উবে গেলো কর্পূরের মতো। তাদের থেকে কয়েক মিটার দূরেই ফানুস উড়ছে অনেকগুলো। কালো আধারে ঢাকা আকাশে হলদে আলোয় জ্বলজ্বল করা ফানুসগুলো কি মোহনীয়! সবচেয়ে বড়ো ফানুসটার গায়ে ইংরেজি অক্ষরে গোটা গোটা করে লেখা,’SORRY’. রুদ্র আবারো আরুকে ডাকলো। আরুর কোন হুস নেই। সেদিক থেকে চোখ ফেরানো যে বড্ড দায়!
‘ভূল আমারো, আপনারো। সমান সমান।’ দূর আকাশে চোখ রেখেই বললো আরু।
‘এবার বাসায় চলো। রাত অনেক হয়েছে।’

রুদ্র’র বলা কথাটা কর্নকুহরে পৌছাতেই আরুর বুক ধক্ক করে উঠলো। এতো তারাতাড়ি চলে যেতে হবে? সবে-ই তো এলো তারা। প্রথমে আরুর ভালো না লাগলেও, এখন লাগছে। আরু যদি পারতো, সময় পিছিয়ে দিতো। তাহলে নিশ্চয়ই রুদ্র আরুকে যেতে বলতো না? আরও বেশি সময় ধরে থাকতে পারতো রুদ্র’র সাথে। আরু উঠলো। রুদ্র আরুর হাত ধরলো। আরু লজ্জা পেয়ে মাথা নত করে নিলো। রুদ্র আরুকে ধরে হাঁটতে লাগলো। কি সুন্দর অনুভূতি! এ স্নিগ্ধ, সুন্দর অনুভূতি আরু সারাজীবন চায়। নিজের করে চায় লোকটাকে। আচ্ছা, রুদ্র কি তাকে সারাজীবন এভাবে ভালোবাসবে? না বাসলে আরু মেরে তক্তা বানিয়ে দেবে। অফিসে গিয়ে বসে থাকবে। তাকিয়ে দেখবে লোকটাকে। ইশশ্! কি সুন্দর হবে তখন।

গাড়ির সামনে যেতেই আরু আবারো তাকালো ফানুসগুলোর দিকে। টিমটিমে আগুনের আলো নিয়ে তারা চলে যাচ্ছে দূরে, বহুদূরে।
আরু গাড়িতে বসলো। রুদ্র পাশে বসে স্টার্ট দিলো গাড়ি। আরু আড়চোখে দেখলো একবার রুদ্র’কে। রুদ্র’র পুরো মনোযোগ তখন ড্রাইভিং-এ। চকলেট কালারের শার্ট পড়েছে রুদ্র। হাতা ফোল্ড করা কনুই অব্ধি। আরুর মনে হচ্ছে, ঠিক যেন ডার্ক চকলেট তার পাশে বসে। এই মানুষটার বুকে আরু মাথা গুঁজে ছিলো; ভাবলেই বুক ধরফর করে উঠছে আরুর। লোকটা আসলেই সুন্দর! মারাত্মক সুন্দর!

বাড়ির সামনে আসতেই আরুর মন খারাপ হয়ে গেলো। গাড়ি থামলো বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে। আরু নেমে পড়লো। রুদ্র ও নামলো। ইতিমধ্যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করেছে। বৃষ্টি দেখেই আরুর মনে নিষিদ্ধ ইচ্ছে জেগে উঠলো। ইচ্ছেটা এই, বৃষ্টিতে রুদ্র’কে নিয়ে ভেজা। ভিজলে কেমন লাগে লোকটাকে? হিরোদের মতো নিশ্চয়ই! ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো আরুর মুখশ্রী।
কিন্তু রুদ্র আরুর মনের আশা ঘেটে ঘ’ করে বলে উঠলো,
‘দাড়িয়ে রইলে যে? বৃষ্টি জোরে আসতে পারে। এখান থেকে এক দৌড়ে বাড়িতে চলে যাবে। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো।’

আরু বিরক্ত হলো। কি আনরোমান্টিক লোক! আরু মুখ কালো করে হাঁটা ধরলো। এতো সুন্দর সাধ আরুর পূরন হবে না; ভাবলেই কান্না পাচ্ছে আরুর। আরু কি একবার বলে দেখবে? যদি রাজি হয়ে যায়? হুট করে থামলো আরু।
সঙ্গে সঙ্গে রুদ্র’র আওয়াজ,
‘আবার কি হলো?’
আরু ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড। এরপর দৌড়ে এসে জড়িয়ে নিলো রুদ্র’কে। আরুর আকস্মিক আক্রমণে রুদ্র থমকে গেলো। আরু তড়িৎ গতিতে আবারো ছেঁড়ে দিলো রুদ্রকে। এক সেকেন্ড না দাড়িয়ে ছুটে পালালো। আরু এক ছুটে আড়াল হয়ে বাড়িতে ডুকলো। রুদ্র কল্পনাও করেনি আরু এমন করবে। আচমকা হেঁসে ফেললো রুদ্র। বিরবির করে বললো, ‘উড়নচণ্ডী!’

এদিকে আরু এসেই বুকে হাত গুজে শ্বাস টানলো কয়েকবার। আরুর যে এতো সাহস, আরুতো জানতো’ই না। এরপর ধীর গতিতে দরজা খুললো আরু। আশপাশ নির্জন। আরু দরজা লাগিয়ে ছুটে উপরে গেলো। ঘরে ডুকে তোফাকে বিছানায় না দেখে অজানা ভয় গ্রাস করলো আরুকে। এতো রাতে তোফা গেলো কই? আরু বিচলিত চোখে চারপাশ দেখলো। না! তোফা নেই৷
‘কই গিয়েছিলি আরু?’
অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো আরুর। পিছু ফিরে দেখলো তোফা ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছে। তোফা বিছানায় এসে বসলো। আবারো জিজ্ঞেস করলো,
‘কি রে? বল!’
‘আ্ আসলে প্ পানি! হ্যা, পানি খেতে গিয়েছিলাম নিচে।’
আটকানো স্বর আরুর। তোফা হাই তুলতে তুলতে বললো,’কবে বুদ্ধি হবে তোর? ওইতো পানি। দেখে নিবি তো। আচ্ছা, ঘুমো।’ বলে শুয়ে পড়লো আগের মতো তোফা। আরু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কিছু বোঝেনি তাহলে।পাশে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লো আরু। আজকের মনোমুগ্ধকর সৃতিগুলো কি আরুকে ঘুমাতে দেবে? মনে তো হয় না..!

সকাল নয়টা। অসহ্যকর জ্যামে আঁটকে তানিয়া। রিকশা এগোচ্ছে পিঁপড়ে’র গতিতে। এই গতিতে গেলে আজ আর অফিসে যাওয়া হবে না তানিয়ার। ঘরিতে চোখ বোলালো তানিয়া। গুনেগুনে নয়টা এক বাজে। তানিয়ার অফিস নয়টায়। আজ অভ্র কি করবে ভাবলেই, তানিয়া ভয়ে গুটিয়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড গরমেও শীত শীত লাগছে তানিয়ার। অভ্র’র রুলস্ অনুযায়ী অফিসে এক মিনিট লেট ডোকা যাবে না। এর পরিবর্তে যদি বেতন কাটে, তবুও ভালো তানিয়ার কাছে। তবুও কোন শাস্তি না দিক।
প্রায় বিষ মিনিট পর জ্যাম কাটিয়ে রিকশা চলতে লাগলো দ্রুত গতিতে। ক্ষণেক্ষণে তাড়া দিচ্ছে তানিয়া। আর দেরি করলে আজ অভ্র কি না কি করতে বলে বসে!

আরও দশ মিনিট পর রিকশা থামলো অফিসের সামনে। তানিয়া ভারা মিটিয়ে সাড়ে নয়টায় অফিসে ডুকলো। পরশুদিন করিম সাহেব তানিয়াকে একটি ডেস্ক দেখিয়ে দিয়েছিলো। তানিয়া ওটাতেই গিয়ে আটষাট হয়ে বসলো। অভ্র কি দেখেছে? সিসি টিভি’তে তো ঘেরা চারপাশ। দেখেনি মনেহয়। ও ব্যাটার সময় কোথায় এগুলোতে চোখ রাখা? কিন্তু তানিয়ার মনটা খুব করে চাইছে অভ্র’কে একপলক দেখতে। কিন্তু আপাতত নিজের এই ইচ্ছেকে দমালো তানিয়া। এখন যাওয়া যাবে না অভ্র’র সামনে। তানিয়া কম্পিউটারে চোখ রাখলো। কিন্তু কি কাজ করবে সে? তাই চারিদিকে দেখতে লাগলো তানিয়া। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না, টু শব্দটি-ও করছে না। কি ম্যানার্স!
তানিয়া নিজের পাশের ডেস্কটায় তাকালো। মুখে মাস্ক পড়ে কম্পিউটারে কি যেন করছে ছেলেটা। কিন্তু মাস্ক কেন পড়ে? একবার বলবে? না না, তানিয়া নিজের অভ্র ছাড়া আর কোন ছেলের সাথে কথা বলবে না।

‘হ্যালো,কিছু বলবেন?’
পাশে বসা ছেলেটার কথায় ধ্যান ভাঙলো তানিয়ার। যখন দেখলো, সে ছেলেটার দিকে ড্যাপড্যাপ করে তাকিয়ে ছিলো; তখন তানিয়া অস্বস্তিতে চোখ ফেরালো। ছোট করে উত্তর দিলো,
‘না।’
‘তো কি দেখছিলেন তাকিয়ে তাকিয়ে?’
‘মুখে মাস্ক কেন পড়ে আছেন?’
তানিয়ার কথায় তড়িঘড়ি করে মাস্ক খুললো ছেলেটি। হাসফাস করে বললো,
‘আসলে দেরি করে আসায়, কোনদিকে হুস ছিলো না। যে কড়া বসের আন্ডারে কাজ করছি! বাই দা ওয়ে, আমি তুর্য। আপনার নাম কি?’

‘আমি তানিয়া।’
‘নতুন?’
তুর্যের করা প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগেই করিম সাহেব এসে দাঁড়ালেন তানিয়ার সামনে। রোবটের মতো বললেন,
‘তানিয়া, আপনাকে অভ্র স্যার ডাকছেন।’
তানিয়া শুকনো ডোগ গিললো। তুর্যকে ‘জ্বি, নতুন।’ বলে উঠে দাড়ালো। করিম সাহেব চলে গেলেন। তানিয়া গুটিগুটি পায়ে এগোলো অভ্রের কেবিনের দিকে। দরজার সামনে দাড়িয়ে দোয়া করলো যেন সব ঠিকঠাক থাকে। নক্ করলো,’স্যার আসব?’
‘আসুন।’ গম্ভীর কন্ঠ অভ্র’র। তানিয়া ভেতরে ডুকে দরজার সামনে’ই দাড়ালো জুবুথুবু হয়ে। অভ্র মনোযোগ দিয়ে ফাইল ঘাটছে। হুট করে চোখ তুলে তাকালো তানিয়ার দিকে। বুকটা ছ্যাত করে উঠলো তানিয়ার। অভ্র ভ্রু কুঁচকে বললো,

‘ওখানে দাড়িয়ে আছেন কেন?’
তানিয়া এগিয়ে এসে দাড়ালো। ততক্ষনে অভ্র আবারো ফাইলে ডুবে গেছে। তানিয়া সেদিন খেয়াল না করলেও, আজ খেয়াল করছে এই রুমটা অনেক বড়ো। কতগুলো সিঙ্গেল সোফা-ও রয়েছে কেবিনের এক কোনে। আলমিরার তো দোকান বলা যায়। তবুও বেশ পরিপাটি, সুন্দর।
অভ্র ফাইল টেবিলে রেখে উঠে দাড়ালো। একটু এগিয়ে এসে দু’হাত বুকে গুঁজে বাবু হয়ে দাঁড়ালো। তানিয়া মাথা নিচু করে নিলো। অভ্র আবারো গম্ভীর স্বর তুললো,
‘পরো একত্রিশ মিনিট লেট আপনি। কেন?’
এবার তানিয়া কেঁপে উঠলো ভয়ে। আজকাল ভয় কেন লাগে? কই, কাল অব্ধি তো এতো ভয় ছিলো না। চোখে চোখ রেখে তানিয়া কথা বলেছে। তাহলে আজ? কালকের ঘটনার জন্য?

‘চুপ করে আছেন যে?’
তানিয়া ধীর গলায় জবাব দিলো,’জ্যামে আঁটকে গেছিলাম। তাই..’
‘আপনার চাকরিটা যেন কিসের?’
তানিয়া মাথা তুলে তাকালো। অভ্র কি তাকে প্যাঁচে ফেলতে চাইছে? ভাবুক হয়ে উত্তর দিলো তানিয়া,’সেক্রেটারির।’
‘একজন সেক্রেটারির কাজ চব্বিশ ঘণ্টা বসের পাশেপাশে থাকা। আর আপনি? একেই দেরিতে এসেছেন, তার উপর আবার ডেস্কে গিয়ে বসে আছেন। ওহ্ হ্যা, আবার গল্প ও করছিলেন। সেদিন তো খুব বলেছিলেন,একশোবার পারবেন এই চাকরিটা করতে। ভূলে গেছেন?’

তানিয়া বিমুঢ় হয়ে তাকালো অভ্রে’র দিকে। অভ্র সব জানে? সব দেখেছে? একটু কথা বলেছে কি বলেনি, তাতেই গল্পের তকমা? তানিয়া উত্তরে কিছুই বলতে পারলো না। মাথা নামিয়ে নিলো পূর্বের মতো। রুদ্র ফের বলে উঠলো,
‘ত্রিশ মিনিটের জন্য তিন ঘন্টা পারফেক্ট। তাইনা? বাড়তি তিন ঘন্টা কাজ করে অফিস থেকে বের হবেন।’
তানিয়া চমকে উঠলো। বাড়তি তিন ঘন্টা মানে সন্ধ্যা ছয়টা। এতোক্ষণ বাইরে থাকলে তার বাবা নিশ্চিত জান নেবে। তানিয়া অনুনয়ের স্বরে অভ্রকে বলে,
‘আর হবে না। আজকের মতো যদি মাফ করে দিতেন..’ অভ্র না শোনার ভান করে গিয়ে বসলো চেয়ারে। বললো,
‘একটা কফি আনুন তো।’
তানিয়া এবার অগ্নিচক্ষু মেলে তাকালো। কফি আনবে? তা-ও তানিয়া? তানিয়া এগিয়ে গেলো, কিছু কড়াকড়া কথা শোনাবে বলে,
‘আপনি..’ কথা শেষ করার আগেই নক্ করলো কেউ। অভ্র আসতে বলতেই ধোঁয়া ওঠা গরম কফি নিয়ে প্রবেশ করলো অথৈ।

অথৈর হাতে কফি দেখে মুচকি হাসলো তানিয়া। যাক, তাকে আর কফি বানাতে হবে না তাহলে! অথৈ ডুকতেই, তানিয়া একটু সরে দাড়ালো। অথৈ কফির মগটা আলতো করে টেবিলে রাখলো। তার যত্ন ভীষন! তানিয়ার মনে হচ্ছে, অথৈ সবেমাত্র পার্লার থেকে এসেছে। হলুদ রঙের স্লিকি থ্রি-পিচ, মুখে গাঢ় করে দেয়া লাল লিপস্টিক, হাতে নেলপলিশ, হালকা প্রসাধনী আর মুখে চকচকে হাসি। ব্যাস, যেন রাজকন্যা এসেছে অভ্র’র কেবিনে। তানিয়া ভ্রু কুঁচকে ফেললো। এতো সেজে ঘোরাফেরা কিভাবে করে এরা? তার বাবা তাকে প্রতি মাসের শেষে হাজার দশেক টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে বলবে,’যা প্রয়োজন নিয়ে নিও।’ অথচ, তানিয়া মাসে’ও একবার পার্লারের মুখ দেখে না। টাকাটা বেশ সুন্দর ভাবে নিয়ে আলমারিতে তুলে রাখে। প্রয়োজন মতো খরচ করে। তানিয়ার জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, মেয়েটা সত্যি’ই কি পর্লার থেকে ল্যান্ড করলো?

ল্যাপটপের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে অভ্র। মন দিয়ে কি-বোর্ড এ টাইপ করছে কিছু। জিজ্ঞেস করলো অথৈকে,’তোমায় কফি আনতে বলেছি?’
অথৈ হাঁসলো। এই প্রশ্নটা অভ্র প্রতিদিন করে। নিয়ম করা সবকিছু সুন্দর হয়। তেমনি এই প্রশ্ন’টি শুনলে অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করে অথৈর ভেতরে। উত্তরে অথৈ হেঁসে উড়িয়ে দেয় বারবার। কেন আসে, অভ্র কি বোঝে না? বোঝে! তাইতো কখনো নিষেধ করেনা, ফেরায় না। তৃপ্তি নিয়ে খায়। অথৈর ভাবনা মতে, আজকেও অভ্র আর কিছু বলবে না। কিন্তু অথৈর ভাবনাকে ভূল প্রমান করে অভ্র তিরিক্ষি কন্ঠে বলে উঠলো,

‘কফিটা নিয়ে যান।’
অথৈ যেন বুঝলো না অভ্র’র কথাটা। জিজ্ঞেস করলো,
‘এ্যাহ্?’
‘হ্যা, নিয়ে যান। ওটা নিয়ে আপনি নিজের ডেস্কে যান।’
‘কিন্তু..’ কথার মাঝেই অথৈকে থামিয়ে দিলো অভ্র। শান্ত গলায় বললো,
‘যেটা বলেছি সেটা করুন।’
অথৈর মুখে আধার নেমে এলো। পাশেই তো সদ্য জয়েন করা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। তার সামনে এরকম না করলেও পারতো অভ্র। অথৈ অপমানবোধে মাথা নত করে নিলো। কিন্তু, অভ্র’র হলো কি হঠাৎ আজ? অথৈ আড়চোখে একবার তানিয়াকে দেখে নিলো। তার দিকেই তাকিয়ে। অথৈ লজ্জা পেলো, কফিটা নিয়ে বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই অভ্র ডেকে উঠলো,

‘মিস অথৈ!’
অথৈ থামে। পিছু ফিরে অভ্র’র পাণে তাকায়। এখনো ল্যাপটপে চোখ অভ্র’র। সেভাবেই বললো,’আজ থেকে আপনার আর কফি আনার দরকার নেই। কথাটা করিম সাহেবকেও বলে দেবেন।’
অথৈ হাসফাস করে উঠলো অভ্র’র কথায়। কফি খাওয়া কি ছেড়ে দিলো অভ্র? চা খাবে? কিন্তু, অফিসে তো চা বানানোর ব্যাবস্থা নেই। অথৈ কন্ঠ খাদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করে,’কফি খাওয়া কি ছেড়ে দিলেন স্যার?’
শিতল চোখে তাকালো অথৈর দিকে অভ্র। অথৈ গুটিয়ে গেলো। তড়িঘড়ি করে কেবিন ত্যাগ করে অথৈ। অথৈ ভালোভাবে অবগত, ওই শিতল চোখ তখুনি আগ্নেয়গিরির রুপ নিতো। অথৈ যেতেই, তানিয়ার দিকে তাকালো অভ্র। তপ্তশ্বাস ফেলে বললো,

‘আপনি দাড়িয়ে রইলেন যে?’
তানিয়া বোকা বোকা হাঁসলো। বললো,
‘তো কি করবো?’
‘আপনাকে কি বলেছি আমি?’
তানিয়া মনে করার চেষ্টা করলো। কিছু মনে না পড়ায় জিজ্ঞেস করলো,’কি আবার বলেছিলেন?’
‘বললাম না,কফি বানিয়ে আনুন।’
তানিয়া চমকে উঠলো। এইমাত্র’ই তো অভ্র কফি ফিরিয়ে দিলো। আর যেন না আনে, সেটাও বুঝিয়ে দিলো নিখুঁতভাবে। তাহলে? তানিয়া শুকনো ডোগ গিলে অবাক কন্ঠে বললো,’এই মাত্রই তো রিফিউজ করলেন। তাহলে এখন কফি বানাতে বলার কারণ কি?’
‘বিশিষ্ট বিজনেসম্যান আরিফ সেরহানের একমাত্র মেয়ে আমার ব্যাক্তিগত এসিস্ট্যান্ট। তার হাতের কফির স্বাদ নিশ্চয়ই ভিন্ন হবে?’

তানিয়ার পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠলো অভ্র’র কথায়। অভ্র তার বাবার ব্যাপারে জানলো কিভাবে? কে বললো? যদি তানিয়ার বাবা কোনভাবে জেনে যায়, তানিয়া চাকরি করছে; তা-ও একজন সেক্রেটারির! তাহলে কি হবে ভাবলেই চারপাশ অন্ধকার দেখছে তানিয়া। মুখ কাচুমাচু করে অভ্র’র দিকে তানিয়া তাকালো। নতজানু কন্ঠে বললো,
‘আপনি জানলেন কিভাবে? প্লিজ, প্লিজ আব্বুকে এসব বলবেন না। নাহলে খুন করতেও দু’বার ভাববে না আমায়। প্লিজ অভ্র। এই একটি কথা রাখুন।’
অভ্র চেয়ার ছাড়লো। আটষাট হয়ে সামনে এসে দাড়ালো তানিয়ার। হুট করে ঝুঁকে গেলো একটু। আকম্মিকতায় মাথা পিছিয়ে ভীতিগ্রস্ত চাহনিতে তাকালো তানিয়া। অভ্র’র কন্ঠ গুরুগম্ভীর,

‘অভ্র?’
কি শীতল ভয়ংকর কন্ঠ! তানিয়া চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ধীর গলায় বললো,
‘সরি, স্যার।’
অভ্র সরে গেলো। অভ্র সরতেই তানিয়া যেন প্রান ফিরে পেলো। লম্বা শ্বাস টানে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
‘এতো বড় বিজনেসম্যান এর মেয়ে, এখানে চাকরি করছে! ব্যাপারটা অদ্ভুত না? তা কেন চাকরি করছেন? তা-ও আবার কাউকে না জানিয়ে?’
অভ্র’র করা প্রশ্নে তানিয়া ভাবনার অতল গহ্বরে তলিয়ে গেলো। এই চাকরি তো শুধু এবং শুধুমাত্র অভ্র’র জন্য’ই নেয়া। তানিয়া মিথ্যে বললো সন্তর্পণে, ‘নিজের পায়ে দাড়াতে। নিজে কিছু করতে।’
অভ্র কিছু একটা ভাবতে ভাবতে মাথা দোলালো। বললো,
‘গুড। তবে এখানে আপনি কে, কোথা থেকে এসেছেন, এগুলো কেউ দেখছে না। আপনাকে যা বলেছি তাই করুন। ব্লাক কফি আনবেন।’

তানিয়া স্ব-শব্দে মুখ ভেঙালো। তানিয়া কি যে-চে নিজের পরিচয় দিতে গিয়েছিলো? আর কি সখ ব্লাক কফি খাওয়ার। অভ্র ইচ্ছে করেই যে ব্লাক কফি চাইছে, তানিয়া ভালোমতো বুঝছে। কারন ব্লাক কফি নিজে বানাতে হবে। মেশিনে নেই। তাহলেই তো খাটাতে পারবে তানিয়াকে অভ্র।
‘কি হলো? যান..!’
ধ্যান ভাঙলো তানিয়ার। তানিয়া কটমটে চোখে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। এরপর আবারো মুখ ভেঙিয়ে বেরোলো কেবিন থেকে। বাইরে আসতেই তুর্য তাকালো তানিয়ার দিকে। কিছু বলবে, তার আগেই গটগট করে চলে গেলো তানিয়া। এদিকে,তানিয়া ভাবছে কফিতে চিনি দেবে? নাকি দেবে না? তানিয়ার মাথায় বদ বুদ্ধি চাপলো। চিনি ছাড়া অতিরিক্ত কফি দিয়ে কড়া এক কাপ কফি বানালো। মুখে দুষ্টু হাঁসি নিয়ে তানিয়া কফির মগ হাতে নিলো। ঘ্রাণেই মনে হচ্ছে জঘন্য হয়েছে এটা। অভ্র আবার অসুস্থ না হয়ে পড়ে! পড়ুক! খুব সখ না তাকিয়ে খাটানোর?
তানিয়া মুখভর্তি আনন্দ নিয়ে আবারো একই পথে কফি নিয়ে হাঁটতে লাগলো। কফি নিয়ে যেতে দেখে তুর্য এবার ডাকলো তানিয়াকে। বললো,’কফি নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?’

তানিয়া হেঁসে বললো,’স্যারের জন্য।’
‘অভ্র স্যার?’
‘হুম।’
‘তুমি কি আয়ার চাকরি করছো?’
তুর্য’র কথায় মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো তানিয়ার। রক্তিমবর্ন ধারন করলো তানিয়া। তাকে দেখে কোন এ্যাংগেলে আয়া বলে মনে হলো এই ছেলের? তুর্য আবারো গম্ভীর মুখে আওড়ালো, ‘আমাকেও একটা দিও। মাথাটা ধরেছে।’
তানিয়া এবারে রাগে ফেটে পড়লো। হাতের কফিটার দিকে তাকাতেই, তানিয়া বাঁকা হাঁসলো। মিষ্টি করে হেঁসে হাতের কফি এগিয়ে দিলো তুর্যকে। সেধে বললো,’আপনি এটা খান। আমি স্যারের জন্য আরেকটা বানিয়া দিচ্ছি।’
তানিয়া একটু দূরুত্ব রেখে দাড়ালো। বলা তো যায় না, এই কফি আবার তার আগেই এসে না পড়ে। মুখ টিপে হাঁসলো তানিয়া। ‘খা না খা!

তানিয়াকে আয়া বলা? খেলে বুঝবি কত ধানে কত চাল। অভ্রকে না হয় আরেকটা বানিয়ে দেব। একবার আবদার’ই তো করেছে। আর একবার করলে তানিয়ার কিছু হবে না।’ মনেমনে বললো তানিয়া। তুর্য একচুমুক মুখে নিতেই সারামুখ কুঁচকে ফেললো। তানিয়া এটা দেখেই দ্রুত ত্যাগ করলো সেই স্থান। আরেকটি কফি বানিয়ে নিয়ে গেলো কেবিনে। আরেকবার তুর্য’র দিকে তাকানোর সাহস হয়নি তানিয়ার। তানিয়া নক্ করে প্রবেশ করলো। কফিটা টেবিলে রেখে তাকালো অভ্র’র দিকে। হাতে একটা ছবি অভ্র’র। তানিয়া আঁতকে উঠল। কোন মেয়ের ছবি? অভ্র কি তার সামনে থাকা সুন্দরী রমনীকে চোখে দেখে না? প্রেম-ট্রেম করে নাকি এই লোক? তানিয়া কফিটা আরেকটু এগিয়ে দিয়ে উঁকি দিলো ছবিটায়। কিছু দেখতে পেলো না। খুব বেশি মনোযোগ অভ্র’র। যেটা তানিয়ার চিন্তাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে শতগুনে। কে হতে পারে?

‘নিন, খেয়ে উদ্ধার করুন। আর হাতে ওটা কি?’
অভ্র একপলক তানিয়াকে দেখে আবারো ছবিতে ডুবে গেলো। কি এমন সুন্দরী এই মেয়ে, যে নির্বাক হয়ে গেছে অভ্র? তানিয়া এগিয়ে গেলো। কিন্তু তার আগেই ছবিটা ছুড়ে মা`রলো তানিয়ার মুখে অভ্র। তানিয়া প্রথমে ভরকালেও, কোনমতে ছবিটা ক্যাচ করে নিজেকে সামলে নিলো। ছবিতে চোখ রাখলো। সুদর্ষন চেহারার অধিকাররি এক যুককের ছবি। কিন্তু, কে এই ছেলেটি? একে এতো দেখার-ই বা কি আছে?
‘কেমন দেখতে ছেলেটি?’ প্রশ্ন অভ্র’র।

তানিয়ার কপালে ভাজ পড়লো। একটি ছেলের সৌন্দর্য নিয়ে আরেকটি ছেলে মাথা ঘামাবে কেন? জিজ্ঞেস কেন করবে? তানিয়া শুকনো গলায় বললো,’ভালোই।’
‘খুব বেশি সুন্দর, স্মার্ট না?’
তানিয়া এবার অবাকের চরম পর্যায়! সন্দিহান চোখে আগা গোড়া পরখ করলো অভ্রকে তানিয়া। নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করলো,’হুম। কিন্তু এসব কেন বলছেন?’
অভ্র হুট করে হাঁসলো। যেটা সচারাচর তাকে করতে দেখা যায়না। এরপর আরও বিশ-ত্রিশটার মতো ছবি এগিয়ে দিলো তানিয়া কাছে। তানিয়া সবগুলো উল্টেপাল্টে দেখলো। সব এই ছেলের-ই ছবি। এতো ছবি দিয়ে কি করে অভ্র?

‘আমার পছন্দ হয়েছে। আপনার কেমন লাগে?’
তানিয়ার বুক ছ্যাত করে উঠলো অভ্র’র কথায়। তানিয়ার মাথায় ডুকছে না কিছু। ছেলেটাকে পছন্দ হয়েছে, হাঁসছে, এগুলো তো ভালো লক্ষন নয়। একটা ছেলের আরেকটা ছেলের উপর তখনি ইন্টারেস্ট থাকে, যখন ছেলেটা…
তানিয়া চোখ বুজলো। এসব কি ভাবছে সে? নিজেকে নিজেই শাসালো তানিয়া। তার অভ্র এমন নয়। এগুলো আসছেই বা কেন তানিয়ার মাথায়। তানিয়া অনুমতি ছাড়াই অভ্র’র সামনের টেবিলটার চেয়ার টেনে বসে পড়লো। সহ্য হচ্ছে না তানিয়ার। নিজেকে সামলাতে পারছে না। তার যে জানতেই হবে! একটু ঝুঁকে অভ্রকে আমতা আমতা করে বললো,

নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ১১+১২

‘আচ্ছা স্যার, আপনার কি কোন মানে..আসলে কোন..’
অভ্র ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,’কি মানে, আসলে করছেন?’
তানিয়া কপালে দু’আঙ্গুল দিয়ে স্লাইড করলো। দপদপ করছে মাথাটা। এরপর চোখ বুজে রুদ্ধশ্বাস কন্ঠে বলে উঠলো,
‘আপনার কি কোন গোপন সমস্যা আছে? মানে..মানে.. লাইক গে..!’

নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ১৫+১৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here