নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ২১+২২
আহমেদ হৃদ
পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরতেই হকচকিয়ে উঠলেন মহুয়া। ভেতরটা কেঁপে আকস্মিকতায়। হাতের খুন্তি’টা শব্দ করে পড়ে গেলো মেঝেতে। চেঁচিয়ে ওঠার আগেই আরু মুখ চেপে নিলো। আরও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো মহুয়া বেগমকে। ঠোঁটের কোনে হাসি লেগে আরুর। তার ভেতরে সীমাহীন আনন্দ আজ। খুশিতে চোখ-মুখ উজ্জ্বল। মনে বসন্ত। এদিকে মহুয়া বেগমের দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। একেই হুট করে এসে ধরেছে, তারউপর আবার শক্ত করে। এতো জোরে কেউ ধরে? তিনি ছিটকে সড়িয়ে দিলেন আরুকে। গ্যাসের আঁচটা কমিয়ে রাগান্বিত চোখে তাকালেন আরুর দিকে। আরু পিছিয়ে গেলো কিছুটা। আটষাট হয়ে দাড়ালো। কর্কষ কন্ঠে বললেন মহুয়া,
‘এমন করে কেউ করে? একটু হলেই হার্ট অ্যাটাক করতাম।’
মগুয়া বেগমের কথায় আরু গালভর্তি হাসলো। স্নিগ্ধ হাসিটুকু প্রমান দেয়, আরুর মন ভীষন ভালো। আরু এগিয়ে এলো আরেকটু। হাতের ফোনটা তুলে ধরে কিছু একটা দেখালো মহুয়া বেগমকে। মহুয়া চোখ তুলে চাইলেন। আরুর নড়ানড়ি’র জন্য ঠিকমতো দেখতে পেলেন না কিছুই। আরেকটু এগিয়ে ফোনটা ধরতে নিলেই, আরু সাথেসাথে সড়িয়ে নিলো ফোন। একচোখ টিপে ছুটে এসে মায়ের গালে চুমু বসিয়ে দিলো আরু। মহুয়া স্তব্ধ হয়ে গেলেন মেয়ের এহেম কান্ডে। আরুর কন্ঠ গদগদ শোনালো,
‘অবশেষে..অবশেষে মর্কট লোকটা রাজি মা..! আমায় নিয়ে যাবে বলেছে।’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
খুশিতে শ্বাস আঁটকে আসছে আরুর। আঁটকে আসার মতো ঘটনা-ই যে! আরু তো কল্পনাও করেনি রুদ্র রাজি হবে; নেবে আরুকে তাদের সাথে। আরু তখন ছবি দেয়ার মিনিট কয়েকপর’ই অতিষ্ঠ রুদ্র আরুকে মেসেজ দেয়। সেখানে সু-স্পষ্টভাবে লেখা, আরুকে নিয়ে যাবে রুদ্র। প্রথমে আরু তাকিয়ে থাকলো কিয়ৎক্ষন। দু’নয়নে তার ঘোর অবিশ্বাস! সত্যিই নিয়ে যাবে? নাকি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে আরু? যখন বুঝলো সত্যিই রুদ্র নিয়ে যাবে,মেসেজটা সত্যিই তার,তখনি-ই আরু উরাধুরা নাঁচতে আরম্ভ করলো। বিছানার বালিশগুলো এদিক-ওদিক ছুঁড়ে উৎযাপন করলো এই খুশি। আরু রুদ্র’কে অনেকগুলো রেড হার্ট ইমোজি দিয়ে, ছুটে গেলো ড্রেসিং-এর সামনে। আরও গাঢ় করে লিপস্টিক দিয়ে নিলো। নিজের প্রতিবিম্বে ফ্লাইং কিস ছুড়লো আরু। নিজের বুদ্ধি’র তারিফ করলো সময় নিয়ে। এরপর নিচে চলে এলো। ড্রইংরুমে মহুয়াকে খুঁজে না পেয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিলো। এখানে পেতেই আরু ছুটে এসে জড়িয়ে নেয় পেছন থেকে।
মহুয়া গম্ভীর হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন মেয়ের দিকে। শুধালেন,’কোথায় নিয়ে যাবে? আর মর্কট লোকটা কে?’
আরুর মুখের হাসি প্রসস্থ হলো। নির্মল কন্ঠে বললো,
‘তোমার বেয়াই এর ছেলে। ওনাদের অফিস ট্যুরে নিয়ে যাবে।’
‘রুদ্র?’
‘ইয়েস!’
‘তোর কি মনে হয় আরু? তোর আব্বু তোকে যেতে দেবে?’
মুহুর্তে মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো আরুর। ধক্ক করে উঠলো বুকটা। এটা তো আরু কল্পনাতেই আনেনি। আরু টলোমলো চোখের চাহনি নিয়ে তাকালো মায়ের দিকে। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,’কেন দেবে না? তুমি ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেই দেবে।’
‘ওসব ব্যাপার-স্যাপার তুই গিয়ে বোঝা তোর বাপকে। যেই না তার চেহারা, রাগ যেন শিরায় শিরায় গাঁথা! আমি বলেই এই সংসার টিকে আছে এখনো। অন্য কোন মেয়ে হলে কক্ষনো করতো এমন লোকের সংসার। আমি পারবো না ওসব বলতে।’
আরু এগিয়ে এলো। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
‘তুমি বললে আব্বু ঠিক রাজি হবে, তুমি দেখো।’
‘বেঁচে থাকলে তো দেখব!’
আরু করুন চোখে তাকালো। আজ একটু বেশি’ই রেগে আছে মনে হচ্ছে। তাহলে কি, আহমেদ সাহেব আজকেও রাগ দেখিয়ে গেছে? নির্ঘাত করেছে! নাহলে তো আর আরুকে এতো তেল দিতে হতো না। আরু নিষ্পাপ চোখে চাইলো। নতজানু কন্ঠে বললো,’আম্মু..তুমি না গ্রেট? তোমার দ্বারাই হবে। প্লিজ আম্মু, প্লিজ!’
মহুয়া মেয়ের কথায় পাত্তা দিলেন না। মেঝে থেকে খুন্তিটা তুলে ময়লা বাসনের উপর রাখলেন। আরু আরেকটু এগিয়ে এলো। মহুয়া চুলো থেকে কড়াই নামাতে নিলেই, আরু হাত থেকে ছিনিয়ে নিলো তা। উদ্দেশ্য, মহুয়া বেগমকে তার দিকে ফেরানো। মহুয়া বেগমের মাঝে তবুও কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। আরু কড়াইটা পাশে রেখে, নিজের দিকে ফেরালো মহুয়াকে। ত্বরান্বিত কন্ঠে বললো,’তুমি বললে আব্বু নিশ্চয়ই যেতে দেবে। একবার বললে কি হয়?’
মহুয়া গরম চোখে তাকালেন। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললেন,’কি বলতে বলছিস? বলবো যে, তোমার মেয়ে জামাই এর অফিস থেকে ঘুরতে যাবে সবার সাথে?’
আরু নিভু গলায় নললো,’তানিয়াও তো যাচ্ছে।’
‘আরু কথা বানাস না। ছাড় আমায়।’
আরু ছাড়লো না। বললো,’বানিয়ে বলছি না। তানিয়া ওই অফিসে চাকরি করে। কয়েকদিন আগেই জয়েন করেছে।’ আরুর কথায় চমকে উঠলেন মহুয়া। মানুষের ছেলে-মেয়েরা এই বয়সে চাকরি করছে; নিজ পায়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই মেয়ে? এখনো মায়ের কাছে এসে বানোয়াট বায়না জোড়ে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন মহুয়া। নিজ কাজে মন দিলেন আবারো। আরুর চোখ চিকচিক করে উঠলো নোনাজলে। জোরে জোরে শ্বাস টানলো কয়েকবার আরু। এবারে? তার কি যাওয়া হবে না? এতো কষ্ট করে রুদ্র’কে রাজি করিয়ে, শেষ সময়ে কি-না অনুমতি’ই পাবে না? আরু এলোমেলো ভাবে রান্নাঘর একবার পাক দিলো। হুট করে ছুটে এলো মহুয়া বেগমের কাছে। শক্ত গলায় বলে উঠলো,
‘না যেতে দিলে, আমি কিন্তু হারপিক খাবো।’
মহুয়া তাকালেন না। শান্ত গলায় বললেন,’খা। আর শোন, আমাদের রুমে নতুন এক বোতল আছে। বাথরুমে এখন যা আছে সব এক্সপায়ার্ড ডেট। ওগুলো খেলে কিছুই হবে না। নতুনটা খাইস। কাজ জলদি হবে।’
আরুর রাগ যেন তরতর করে বাড়লো মহুয়া বেগমের কথায়। চিবুক শক্ত হয়ে এলো। আবারো কয়েকবার শ্বাস টেনলো আরু। রাগ যেন কিছুতেই কমছে না। আরু আবারো পাক দিলো পুরো রান্নাঘর। এককোনায় থম মেরে দাড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। আবারো ছুটে এলো মহুয়া বেগমের কাছে। কাঠকাঠ গলায় বললো,
‘ইন্দুর মারা বিষ খাবো কিন্তু।’
অতিষ্ঠ চোখে তাকালেন মেয়ের দিকে মহুয়া। বিরক্ত কন্ঠে বললেন,
‘তুই কি চাইছিস আমি তোর বাপের হাতে মা’রা পড়ি?’
‘হ্যা..ইয়ে মানে না।’
মহুয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই মেয়ে কথা শোনার মেয়ে নয়। মাথায় যা চেপেছে, তা করেই খ্যান্ত হবে। তিনি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। অতঃপর নিষ্প্রুভ কন্ঠে বললেন,’আচ্ছা, বলবো।’
চোখ জ্বলে উঠলো আরুর। খুশিতে আটখানা হয়ে জিজ্ঞেস করলো,’সত্যি?’
‘হ্যা।’
আরুর সস্তির শ্বাস ফেললো। আবারো ফট করে চুমু বসিয়ে দিলো মহুয়া বেগমের গালে। আরুর তো এখন নাঁচতে ইচ্ছে করছে খুশিতে। আরু ছুট দিলো রান্নাঘর থেকে।
মহুয়া বেগমের হুট করে মনে পড়লো, আরুর হাতের ফোনটার কথা। আরুর তো ফোন নেই। তিনি ডেকে উঠলেন,’আরু শোন।’
আরু থামলো। হেঁসে ফিরলো মায়ের দিকে। মহুয়া সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,’ফোন কই পেলি তুই? তোর ফোন তো হাড়িয়ে গিয়েছিলো।’
আরু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে জিভ কাটলো। এইরে! একটু যদি মনে থাকে! এবার কি বলবে? আরু বোঁকাবোঁকা হেঁসে ঘার ঘুরিয়ে তাকালো। বললো,
‘তোমার হবু জামাইয়ের ইনবক্সে মেয়েদের হোস্টেল। তাই নিয়ে এসেছি সবগুলোকে বের করে দিতে।’
বলেই আরু মিলিয়ে গেলো বাতাসের সাথে। মহুয়া গহীন থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
নতুন একটি ঝলমলে সকাল। তির্যক রোদের তপ্ততা ছড়িয়ে চারপাশে। বেলা তখন আটটা আটচল্লিশ। তানিয়া অসহ্য জ্যাম, তাপদাহ পেড়িয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে প্রবেশ করলো অফিসে। অফিস শুরু হতে এখনো দশমিনিট বাকি। সবাই একে-অপরের সাথে গল্পে মশগুল। তানিয়া কাঁধের ব্যাগটা ডেস্কে রেখে, আরাম করে বসলো চেয়ারে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে তার। সেগুলো রুমাল দিয়ে সন্তর্পণে মুছে শ্বাস ফেললো তানিয়া। আগমন ঘটলো তুর্য’র। পাশে বসে গলা খেঁকিয়ে মনোযোগ কারলো তানিয়ার। তানিয়া তাকালো। হেঁসে জিজ্ঞেস করলো,
‘কেমন আছেন?’
‘ভালো, আপনি?’
‘কালকের জন্য অনুভূতি কেমন?’
তানিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মনেমনে বললো,’খুবই বাজে; জঘন্য!’ কিন্তু মুখে বললো,
‘ভালোই। আপনার?’
‘আমি বেশ এক্সাইটেড। বরাবরই আমার ঘোরাঘুরি’র প্রতি প্রবল ঝোঁক। তাই আমার কাছে এটা ভীষন আনন্দের। অফিস আর বাড়ি করে-ই তো জিবন কাটছে।’
উত্তরে হাঁসলো তানিয়া। তখনি হুরমুরিয়ে দাঁড়াতে লাগলো সবাই। এমনকি পাশে থাকা তুর্য-ও উঠে দাঁড়ালো। অবুঝ তানিয়া সকলের দিকে ভীত চোখে তাকালো। এভাবে সবাই দাড়াচ্ছে কেন? এমন একসঙ্গে সবাইকে উঠতে তো কখনোই দেখেনি সে। তবুও, দেখাদেখি নিজেও চটপট উঠে দাড়ালো তানিয়া। করিডোর পেড়িয়ে অফিসে ডুকলো রুদ্র। তার অনেকটা পেছনে অভ্র। পাশেই করিম সাহেব। তানিয়া বুঝলো সকলের দাড়ানোর কারন। অভ্র’র গায়ে আজ কোট নেই। সাদা শার্ট ইন করে পড়েছে। চোখ আঁটকে গেলো তানিয়ার। আজ যেন বড্ড বেশি সুদর্শন লাগছে অভ্র’কে। মনেহচ্ছে,বছর তিনে’ক কমে গেছে। তানিয়া কোমল হাঁসলো। অভ্র যেতেই, বসে পড়লো তানিয়া। আজ প্রথম কম্পিউটার অন করলো তানিয়া। ঠিক করলো, করিম সাহেবের মুখে ‘যন্ত্রের ডাক’ না শুনে অভ্র’র সামনে যাবে না। কিন্তু কম্পিউটারে’ই বা কি করবে? কোন তো আর কাজ নেই। তখনি ধপ কিছু পড়ার শব্দ হলো। কেঁপে উঠলো অন্তরাত্মা তানিয়ার। পাশ ফিরতেই দেখতে পেলো করিম সাহেবের যান্ত্রিক, শক্ত মুখ-চোখ। শব্দ এসেছে অনেকগুলো ফাইল একসঙ্গে রাখার কারনে। আর সেগুলো রাখা তুর্য’র ডেস্কে।
তুর্য চমকালো, ভরকালো। এতো ফাইল এখানে রাখার মানে কি? ভ্রু কুঁচকে করিম সাহেবের দিকে তাকালো তুর্য। ছোট করে জিজ্ঞেস করলো,’এগুলো?’
‘এগুলো স্যার পাঠিয়েছেন। সবগুলো চেক করে কেবিনে দিয়ে আসতে বলেছে আপনাকে। আর হ্যা, আজকের মধ্যেই সবগুলো শেষ করতে বলেছেন!’
পিলে চমকে তাকালো তুর্য। এতো ফাইল একদিনে শেষ করতে হবে? কিভাবে সম্ভব? তুর্য ঠোগ গিলে কিছু বলার আগেই করিম সাহেব তানিয়ার ডেস্কের কাছে গেলেন। একই স্বরে বললেন,
‘আপনাকে স্যার ডেকেছেন।’
তানিয়া অবাক হলো না। এটা হওয়ার’ই ছিলো। কিন্তু তুর্য’র জন্য খারাপ লাগছে তানিয়ার। অসহায় মুখে তাকালো তানিয়া। কপালে ঠেস দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে তুর্য। এখনি ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তুর্য’র মুখশ্রী। নিশ্চয়ই সক্ পেয়েছে! তানিয়া উঠলো। কেবিনের সামনে গিয়ে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করলো ভেতরে। কেবিনে ডুকতেই পরিচিত একটি বিদঘুটে গন্ধ নাকে লাগলো তানিয়ার। সিগারেটের গন্ধ! চোখ-মুখ বিকৃতি করে তাকালো তানিয়া। অভ্র দূরে দাড়িয়ে। কাঁচের ছোট্ট একটা জানালার সামনে দাড়িয়ে সে। মন দিয়ে দূরে কিছু দেখছে। হাতে জলন্ত সিগারেট। এই লোক সিগারেট ও খায়? কবে থেকে? কই, এ কয়দিনে তো দেখেনি একবারও। তানিয়া ডোগ গিলে হজম করলো ব্যাপারটা। এই লোকের এখনো কত রুপ যে দেখা বাকি; তা সয়ং সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানে! ক্ষীণ গলায় ডেকে উঠলো তানিয়া,
‘স্যার, আমায় ডেকেছিলেন?’
অভ্র তাকালো না। সিগারেটে সুখটান দিয়ে শান্ত গলায় বললো,
‘কফি নিয়ে আসুন।’
তানিয়া একবাক্যে কফি করতে চলে গেলো। লোকটার সাথে তর্কে জড়ানোর কোন মানে হয় না। কফি করে, এনে রাখলো টেবিলে। অভ্র তখনো সেভাবেই দাড়িয়ে। শান্ত স্বরে বললো,
‘এবার চলে যান।’
তানিয়া যেন বুঝলো না। গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,’জ্বি স্যার?’
‘বেড়িয়ে যান।’
কন্ঠ শক্ত অভ্র’র। হকচকিয়ে উঠলো তানিয়া। এইতো এক্ষনি শান্ত ছিলো। হঠাৎ এমন রাগ দেখানোর মানে কি? কাজ শেষ, আর খোদা হাফেজ? কি অসভ্য লোক! একদিন নিশ্চিত তানিয়া কফিতে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে দেবে লোকটাকে। মুখ ভেঙিয়ে বেড়িয়ে এলো কেবিন থেকে তানিয়া। আজ এতটুকুই? আর অপমান করবে না? আজ কি সূর্য দক্ষিণ দিকে উদয় হয়েছে?
আরু ব্যাগ গোছাচ্ছে। আহমেদ সাহেব প্রথমে বারন করলেও, তানিয়ার সাথে কথা বলে তিনি রাজি হয়েছেন। সেই থেকেই আরু শুরু করেছে গোছগাছ। রাত কতো হলো? এগারোটা? নাকি তার-ও বেশি? হয়তো তার-ও বেশি! আরুর খেয়াল নেই। দূরে রাখা সাইলেন্ট ফোনটায় আলো জ্বলছে থেকেথেকে। নিশ্চয়ই কেউ ফোন করছে! আরুর এখন ফিরে তাকানোর-ও সময় নেই। নিজের ছোট্ট একটা লাগেজে ঠেসে-ঠুসে কাপর গুঁজছে সে। এখনো তো স্কুল ব্যাগটাও বাকি। আরু ব্যাস্ত হয়ে এদিক-ওদিক ছুটে এটা-সেটা এনে লাগেজে ঠেসছে। একরাশ উন্মাদনা বুকে আরুর। লাগেজটা ভরে চেন লাগাতে গিয়ে ফ্যাসাদে পড়লো আরু। কিছুতেই লাগছে না! লাগবে কিভাবে? আরু তো হাবিজাবি সব ঢুকিয়েছে ওটায়। এখন? আরু লাগেজের উপর উঠে বসলো। নিচু হতেই চেন’টা লাগিয়ে দিলো। সস্থির শ্বাস ফেলে স্কুল ব্যাগটায় মেকাবের সমস্ত সামগ্রী ডুকিয়ে নিলো আরু। ফুটবলের মতো এটাও ফুলে গেলো কয়েক মিনিটের মাঝেই। আরুর যেন তবুও মন ভরে না। কি এমন নিলো? এতো দ্রুত ভরে গেলো কেন?
আরু রুমের লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লো। পাশ থেকে ফোন নিতেই দেখলো, অনেকগুলো কল দিয়েছে রুদ্র। আরু ছোট করে লিখলো,’ব্যাস্ত ছিলাম।’
এরপর ফোনটা পাশে রেখে চোখ বুজলো আরু। ঘুম কি আজ আসবে? মনে তো হয় না!
আজকের সকালটা ভিন্ন। হালকা শিত পড়েছে। তপ্ত দিনে হালকা শিতে আরাম বই খারাপ লাগছে না। আরু লাল রঙা ‘পাখি ড্রেসটা’ পড়েছে আজ। এই ড্রেস’টা আরুর ভীষন,ভীষন পছন্দের। বিশেষ কিছু না হলে আরু এই ড্রেসটা বের করে না। আরুর আবার এই ড্রেসগুলোর প্রতি খুব ঝোঁক। এইতো কয়েকদিন আগেই নিউ বের হওয়া ‘কাঁচা বাদাম’ ড্রেসটা নিতে চেয়েছিলো আরু। আরুর বাবা কিছুতেই দিলেন না! এ নিয়ে পুরো একদিন রাগ করে কিছু খায়নি আরু। আরু এসব আজগুবি চিন্তা ঝেড়ে ফেললো মাথা থেকে। চুলগুলো খোঁপা করে মাথায় লাল রঙা কৃতিম গোলাপ গুজলো আরু। মুখে হালকা প্রসাধনী, আর গাঢ় করে লাল লিপস্টিক দিয়ে, ওড়না গলায় জড়িয়ে ব্যাগ-প্যাগ নিয়ে বের হলো আরু। নিচে এসে আহমেদ সাহেব’কে দেখে আরু থামলো। ভয়হীন কন্ঠে হেঁসে বললো,
‘আব্বু, আসছি আমি।’
আহমেদ সাহেব তখন পত্রিকা পড়ছেন। আরু যাবে বলেই আজ তারাতাড়ি উঠেছেন তিনি। এগিয়ে এলেন আরুর কাছে। মাথায় হাত রেখে কোমলপ্রাণ কন্ঠে বললেন,
‘সাবধানে যাবে। তানিয়ার সাথেসাথে থাকবে সবসময়।’
আরু মাথা নাড়লো। দূর থেকে মহুয়া বেগম তৃপ্তি’র সহিত হাঁসলেন। আরু মা’কে বিদায় জানিয়ে বাইরে চলে এলো। আরুকে ভ্যানে উঠিয়ে দিলেন আহমেদ। জায়গার নাম বলতেই চালক রওনা দিলো। আরু গুছিয়ে নিলো নিজেকে। আরুকে দেখে রুদ্র’র রিয়েকশন কেমন হবে আজ? নিশ্চিত হার্টফেল করবে লোকটা! আরু মুখ টিপে হাঁসলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভ্যান থামলো ‘ইরহাম এন্টারপ্রাইজ’ এর সামনে।
অফিসের সামনে বাস দাড়িয়ে। পাশেই অফিসের সকল স্টাফ গল্পে মজেছে একে-অপরের সাথে। সবার চোখেমুখে উন্মাদনা। বোঝা যায়, এই ট্যুর’টা তাদের অনেক প্রতীক্ষার। সবার কাছেই ছোটখাটো ব্যাগ-পত্র। কেউ কেউ আবার অফিসে আসার ব্যাগটাতেই কাজ সারিয়ে নিয়েছে। দু’দিনের তো ব্যাপার! কতোই বা জিনিস লাগে? তানিয়াও ব্যাতিক্রম নয়। সে-ও তার একটা ছোটখাটো ব্যাগ কাধে নিয়ে দাড়িয়ে। পাশে তুর্য। কালকের খাটুনির রেশ এখনো মুখে বেচারার। তার অবশ্য কারনও আছে। আর তা হলো, আধঘন্টা যাবৎ কালকের দুঃখের কথা শুনিয়েছে সে তানিয়াকে। অফিস টাইমের পরেও কাজ করিয়েছে অভ্র। আবার নাকি অকারণে’ই ধমকিয়েছে কাল। সে-সব শোনাতে শোনাতেই সে আপাতত ক্লান্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে। কোন কথা বলছে না।
সবার ছোটখাটো ব্যাগপত্রে’র মাঝে আরু হাজির হলো নিজের তৈজসপত্র নিয়ে। হাতে তার গোলাপি রঙের লাগেজ। কাঁধে প্রিয় পুতুলওয়ালা আরেকটি ব্যাগ। আরুকে দেখতেই, সবাই হতভম্ব চোখে তাকালো আরুর দিকে। লালে লালটু হয়ে থাকা আরুকে দেখে হতবাক তাদের মুখশ্রী। আরু অবশ্য এসবে তেমন পাত্তা দিলো না। এসেই, চোখ বুলিয়ে খুঁজলো রুদ্র’কে। আশেপাশে কোথাও পেলো না। এখনো কি আসেনি? যার অফিস সে-ই লেট? খানিক দূরেই তানিয়াকে দেখতে পেলো আরু। সব চিন্তা পেছনে ফেলে, দ্রুত এগিয়ে গেলো তানিয়ার দিকে। তানিয়াকে আগাগোড়া পর্যবেক্ষন করে নিলো আরু। পর্যবেক্ষন করে বুঝলো,তানিয়া খুব-ই স্বাভাবিক সাজে এসেছে। শুধু গায়ে নতুন থ্রি-পিসটাই যা নতুনত্ব। গলায় একটা চেন অব্ধি দিয়ে আসেনি মেয়েটা। কানে সাদা পাথরের ঝুলত্ব দু’টি দুল। ব্যাস! এতোটুকুই। তবুও অদ্ভুতভাবে সুন্দর লাগছে তানিয়াকে। আরুর মাঝেমাঝে মনে হয়, তানিয়া গোপন রুপচর্যা করে। কাউকে জানতে দেয় না। তাইতো এতো সুন্দর দেখায় না সেজেও। আরু গলার নেকলেস’টা ঠিক করে নিলো। তানিয়া দূর থেকে আরুকে দেখছে। তানিয়া এগোলো। আরুর পাশে গিয়ে দাড়াতে’ই হাসফাস করে বললো,
‘ভাগ্যিস তুই যাচ্ছিস জান। আমিতো ভেবেই পাচ্ছিলাম না ওখানে একাএকা গিয়ে কি করবো।’
পাশ থেকে তুর্য কথার মাঝে ডুকে পড়লো। বিদ্বেষ করে বললো,
‘ওমা, একাএকা কেন থাকবেন? আমার সাথে গল্প করতেন।’
তানিয়া একবার আড়চোখে তাকালো। কোথায় কি কথা বলতে হয়, এই ছেলে জানেনা। দৃষ্টি সরিয়ে আরুর দিকে তাকালো তানিয়া। আরু জিজ্ঞেস করলো,
‘আমায় কেমন লাগছে তনু?’
তানিয়া মিষ্টি হাঁসলো। কোমল কন্ঠে বললো,
‘খুব মিষ্টি লাগছে তোকে।’
আরু নিজের প্রশংসা শুনে চমৎকার হাঁসলো। বেবি হেয়ারগুলো কানে গুজে, কৃতজ্ঞ স্বরে বললো,
‘তোকেও সুন্দর লাগছে, ন্যাচারাল বিউটি।’
উত্তরে হাঁসলো তানিয়া। আরু হুট করে গা ঘেঁষে দাড়ালো তানিয়ার। ফিসফিসিয়ে বললো,’তোর স্যার কই?’
আরুর কথায় ধাক্কা খেলো তানিয়া। আসলেই তো! যার জন্য তানিয়ার কোন উৎসাহ,আনন্দ নেই এই ট্যুরে; সে কোথায়? লোকটা আসেনি কেন এখনো? চারপাশে সচেতন দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো তানিয়া। না! নেই আশেপাশে। তানিয়া জপলো মনেমনে, আসলে আসুক; না আসলে নাই। আসলেই তো অপদস্ত করতে শুরু করে দেবে। তানিয়া তুর্য’র থেকে কিছুটা দূরে নিয়ে গেলো আরুকে। স্বাভাবিক গলায় বললো,
‘আমি জানি না।’
আরু আশ্চর্যন্বিত চোখে চাইলো। অবাক হওয়ার ভান ধরে বললো,’তুই জানিস না মানে? তোর’ই তো জানার কথা!’ আরু থামলো। কি যেন ভেবে দুষ্ট হাঁসলো আরু। বললো,
‘রাগ করেছে নাকি আমার দেবর?’
আরুর ইঙ্গিত বুঝে তানিয়া হতাশ শ্বাস ফেললো। হতাশ গলায় বললো,
‘রাগ তো তার জন্মগত সঙ্গি।’
‘তুই কমিয়ে দিস বিয়ের পর। তা, কবে আমরা দুজন জা হচ্ছি?’
শব্দ করে হেঁসে উঠলো তানিয়া। যেন জোকস্ বলেছে আরু।
‘বিয়ে? সে তো জল্পনাকল্পনা’র ব্যাপার! ওসব ভুলে যা বইন।’
‘ওমা, কেন কেন? এখনো কি লাভ স্টোরি শুরু হয়নি?’ অবাক চিত্তে বললো আরু।
‘লাভ এর ‘এল’ ও এন্ট্রি নেইনি এখনো। আর তুই আছিস বিয়ে নিয়ে। দেখ গিয়ে তোর দেবরের ডিকশনারিতে হয়তো প্রেম-ভালোবাসা নামে কোন শব্দ’ই নেই!এক্কেবারে কাঠখোট্টা লোক।’
তানিয়ার কথায় ঠোঁট টিপে হাসলো আরু। রুদ্র ও তো এমন। দুই ভাই একে-অপরের জেরক্স কপি তাহলে। আরু হাসি থামিয়ে তানিয়ার কাঁধে হাত রাখলো। ঠাট্টা করে উঠলো,
‘বাদ দে বইন, ব্যাডা মানুষ।’
‘আসলেই।’
‘আচ্ছা তনু,তোর বিসবেসম্যান বাপ তোকে যাওয়ার পার্মিশন দিলো?’
তানিয়া সূদুরে চোখ রাখলো। শ্রান্ত কন্ঠে বললো,’বলেছি আমরা পিকনিকে যাচ্ছি। আর এটা মাস্ট, মাস্ট, মাস্ট যেতে হবে। অনেক বলে-কয়ে তবে রাজি হয়েছে। কি বলছিলো জানিস?’
মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো আরু। জিজ্ঞেস করলো,’কি বললো?’
‘বললো,সন্ধ্যার আগে ফিরে আসতে।’
আরু হাঁসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারলো না। বললো,
‘এমন তো আমার মা-ও বলেনা।’
তখনি অফিসের ভেতর থেকে বেড়িয়ে এলো রুদ্র। রুদ্র বেরোতেই তানিয়া মানে মানে করে সরে গেলো আরুর থেকে। রুদ্র’র চোখ সবার প্রথমেই গিয়ে আটকালো আরুতে। চোখে আটকানোর মতো সেজেছেই যে আরু। রুদ্র এগিয়ে গেলো আরুর দিকে। রুদ্র’কে আসতেই পরিপাটি হয়ে দাড়ালো আরু। গুছিয়ে নিলো নিজেকে। এখন আয়নাটা থাকলে আরেকটু লিপস্টিক দেয়া যেত। আরু মুখে হাঁসি ঝুলিয়ে তাকালো রুদ্র’র দিকে। লজ্জা লজ্জা কন্ঠে বললো,
‘কেমন লাগছে আমায়?’
রুদ্র পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো আরুর দিকে। রুদ্র’র মনে হচ্ছে, সে চোখে শুধু লাল দেখছে। পায়ের হিল থেকে শুরু করে মাথার খোপায় গোঁজা ফুল, সব লাল! এতো লাল রঙ প্রিয় মেয়েটার? জেবা আর জুঁইয়ের ছোটখাটো সপিং করতে করতে রুদ্র ধরে নিয়েছিলো; লাল মানেই দু’চোখের বিষ মেয়েদের। এরা যেমন স্বামীর সাথে অন্য কোন মেয়েকে সহ্য করতে পারে না, তেমনি লাল রঙ চোখে দেখতে পারে না। কিন্তু আরুকে দেখে ভুল ভাঙলো রুদ্র’র। এই সাজে অন্যদিনের তুলনায় আজকে আরুকে আরও ছোট দেখাচ্ছে। বাচ্চা-বাচ্চা লাগছে। রুদ্র’র মনে হচ্ছে এই বুঝি আরু বলে উঠবে,’আমায় কোলে নিন। পায়ে ব্যাথা করছে।’ আরুর লজ্জায় মাখা মুখখানার দিকে তাকিয়ে চোখে হাঁসলো রুদ্র। আরুর প্রশ্ন উপেক্ষা করে,শান্ত স্বরে বললো,
‘আমরা দু’দিনের জন্য যাচ্ছি মিস অরোনিতা। তুমি যা প্যাকিং করেছো, তাতে দু’বছর অনায়াসে পাড় করিয়ে দেয়া যাবে।’
নিজের প্রশ্নের ত্যাড়া উত্তর পেয়ে লজ্জায় মাখা মুখ ধপ করে জ্বলে উঠলো আরুর। কপোট রাগে কপালে ভাজ পড়লো তার। কি প্রশ্নের কি উত্তর! এতোটা অসভ্য কেউ হয়? লোকটা কি জানে না, মেয়েরা প্রসংশা শুনতে কতো ভালোবাসে? জানেনা, যখন কোন মেয়ে জিজ্ঞেস করে ‘কেমন লাগছে তাকে’ তখন কি বলতে হয়? জানেনা! কেউ শিখিয়েছে নাকি! খালি জানে রাগ আর গম্ভীর হয়ে থাকতে। আরু শব্দ করে মুখ ভেঙিয়ে অন্যদিকে ফিরলো।
রুদ্র আগের মতোই শান্ত, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে। নিজের ফর্মে চলে গেছে আরু। এইতো শুরু তার অভিমানের পালা। চলছে, দু’দীন জোর-সে চলবে। রুদ্র হতাশ শ্বাস ফেললো। হুট করে মনে হলো, এই মেয়েকে এইসব না করলেই বোধহয় বেমানান লাগতো। খাপছাড়া লাগতো খুব!
তুর্য এগিয়ে এলো তানিয়ার কাছে। রুদ্র-আরুর দিকে দৃষ্টি রেখেই জিজ্ঞেস করলো,
‘উনি কে? আর আমাদের সাথেই কি যাবেন?’
তানিয়া উত্তর দিতে গিয়ে আঁটকে গেলো। হা হয়ে গেলো মুখ। অফিস থেকে বেরোচ্ছে অভ্র। তারমানে এতক্ষণ অফিসেই ছিলো? অভ্র’র সাথে একপ্রকার ছুটছে করিম সাহেব আর অথৈ। অভ্র কি দিনদিন আরও সুন্দর হচ্ছে? নাহলে চোখ লেগে আসছে কেন তানিয়ার? মুগ্ধ নয়নে তানিয়া চোখে গিলতে লাগলো অভ্র’কে। কালকের থেকেও নজরকাড়া সৌন্দর্য নিয়ে এদিকেই দিকে আসছে অভ্র। এদিকেই আসছে! সাথেসাথে সম্ভিত ফিরলো তানিয়ার। কাঠ হয়ে দাঁড়ালো সে। এদিকে আবার কেন আসছে অভ্র? আকস্মিকতায় তানিয়া বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
তুর্য অভ্র’কে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। অভ্র তানিয়ার চৈতন্যহারা দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থেকেই, হাতের ফাইলটা এগিয়ে দিলো তুর্য’র দিকে। আড়চোখে তুর্য’র দিকে তাকিয়ে রুক্ষ গলায় বললো,
‘কারেকশন করুন।’
তুর্য চমকালো, পায়ের নিচে শিরশির অনুভব করলো। অভ্র’র এই আচরণ একদম অচেনা তুর্য’র কাছে। কই, আগে তো অভ্র এমন করেনি তার সাথে! কি এমন ভুল করলো যে কাল থেকে জিবন তেজপাতা বানিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছে অভ্র? এই ছুটি, আনন্দের দিনে এসব ভালো লাগে?
আরেক পলক তানিয়াকে দেখে অভ্র পিছু ফিরে এলো। সবারইকে উদ্দেশ্য করে, উৎফুল্ল কন্ঠে বললো অভ্র,
‘আপনারা সকলে প্রস্তুত তো?’
সবাই একসাথে বলে উঠলো,’ইয়েস!’
এনাউন্সের পরপরই একে একে সবাই উঠতে লাগলো বাসে। রুদ্র করিম সাহেবকে বলে আরুর লাগেজ উঠিয়ে নিলো। একে একে উঠে পড়লো সবাই। আরু আগেভাগে গিয়ে বসলো রুদ্র’র পাশে। একেবারে গা ঘেঁষে।
এদিকে অভ্র যে সিটে বসেছে, তার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে অথৈ। সে চাইছে অভ্র’র পাশে বসতে। কিন্তু বলতে পারছে না। এভাবে ঘুরঘুর করতে দেখে,অভ্র ধমকে তুর্য’র পাশে বসিয়ে দিলো অথৈকে। তুর্য তখন ফাইল চেক করছে মনোযোগ দিয়ে। ভুলগুলো আন্ডারলাইন করছে সে। অথৈ থমথমে মুখ করে বসলো তুর্য’র পাশে। তার সব আশায় পানি ঢেলে দিলো একদম অভ্র!
তানিয়া তখনো দাড়িয়ে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, একটা সিট-ও ফাঁকা নেই। শুধুমাত্র অভ্র’র পাশে ছাড়া। ওখানে কি যাবে? যদি অথৈর মতোই ধমক দেয়? তানিয়া শুকনো ডোগ গিললো। এভাবে দাড়িয়ে তো আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। যাবে একবার? গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো তানিয়া। বুকটা ধুকপুক করছে তার। বিশাল একটা ধমক খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে দাড়ালো অভ্র’র সামনে।
অভ্র শান্ত চোখে তাকালো একবার। কিছু না বলেই উঠে গেলো। কিছুটা সরে গিয়ে বসতে ইসারা করলো তানিয়াকে। তানিয়া চমকালেও তা প্রকাশ করলো না। টক করে জানালার পাশে গিয়ে বসলো। একদিকে তার যেমন ভালো লাগছে, আরেকদিকে তেমনি ভয় হচ্ছে। জড়তা ঘিরছে। তাকে ধমকালো না কেন?
পাশ থেকে অথৈ এসব দেখতেই কটমটে চোখে তাকালো। তানিয়াকে মোটেও সহ্য হয়না অথৈর। মেয়েটা খুব ধুরন্ধর! ইচ্ছে করেই হয়তো দেড়ি করে উঠেছে মেয়েটা। যেন পাশে বসতে পারে।
অভ্র স্বাভাবিক ভাবেই বসলো পাশে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। দৃষ্টি সামনে রেখে, ক্ষিন গলায় বললো তানিয়াকে,
‘বয়ফ্রেন্ডের সাথে বসলেন না যে?’
চকিত দৃষ্টিতে তাকালো তানিয়া। অভ্র কি কথাটা তাকে বললো? আর বললো তো বললো, এটা কি বললো? বয়ফ্রেন্ড? সে আবার কে? তানিয়া কিছুক্ষণ থম মেরে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো অভ্র’কে। বুঝতে অসক্ষম হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কে আবার আমার বয়ফ্রেন্ড?’
অভ্র সেভাবেই উত্তর দেয়,’কেন,তুর্য।’
চোখদুটি রসগোল্লার মতো হয়ে গেলো তানিয়ার। তুর্য’কে অভ্র তানিয়ার বয়ফ্রেন্ড ভাবছে? শেষমেশ এমন চিন্তা এলো তানিয়াকে নিয়ে লোকটার? তানিয়া উত্তর দিলো না কথার। এই তানিয়া যে নিজের থেকেও কত বেশি এই পাশে বসা ছেলেটাকে ভালোবাসে; সেটা বোঝেনা লোকটা? আর দু’দিনের পরিচিত একটা ছেলেকে বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে দিলো? তানিয়া হতাশ শ্বাস ফেললো। একে একে সবটা বুঝে ফেললো তানিয়া। হুট করে রাগ, তুর্য’কে কাজ করানো, জলের মতো পরিষ্কার হলো। তবে কি অভ্র জেলাস? মুখ টিপে হাঁসলো তানিয়া। হাঁসি দমিয়ে গম্ভীর হওয়ার ভান ধরে বললো তানিয়া,
‘আপনিও তো আপনার গার্লফ্রেন্ডের সাথে বসেননি। আমি কিছু বলেছি?’
কথা শেষ হওয়ার আগেই চট করে তাকালো অভ্র। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
‘আমার আবার গার্লফ্রেন্ড কে?’
তানিয়া রয়েসয়ে বসলো। খোঁচা দিয়ে বললো,
‘কেন? অথৈ ম্যাম।’
দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো অভ্র’র। চেয়াল শক্ত করে ভারী গলায় বললো,
‘নিজের মতো সবাইকে ভাববেন না।’
একটু ভয় পেলেও,প্রকাশ করলো না তানিয়া। ঠেস দিয়ে বললো,
‘হেহ্! অফিসের সবাই জানে অথৈ ম্যাডাম আপনাকে পছন্দ করে। হয়তো আপনিও করেন। কাউকে বুঝতে দেন না। এইযে আমি আপনার পাশে বসেছি, দেখুন কিভাবে আমায় দেখছে।’
অভ্র সামনে তাকিয়ে জোরে শ্বাস ফেললো। আড়চোখে সত্যিই তাকালো অথৈর দিকে। আসলেই মেয়েটা তাকিয়ে আছে। অভ্র রাগটা যেন চওড়া হলো। হুট করে এই রাগটা দিনদিন বেসামাল হয়ে যাচ্ছে অভ্র’র। আর তার রাগের কারন যে তানিয়াকে ঘিরেই, তাও সে বুঝতে পারছে। তার ধারনা আদতেও ভুল নয়। তানিয়া আর তুর্যের ব্যাপারটা সত্যি! নাহলে তো বলে দিতো তানিয়া। আচ্ছা,তাদের সম্পর্ক কতটা গভীর? সত্যিই কি খুব বেশি ভালোবাসে দু’জন দু’জনকে? অভ্র নিজেকে দমালো। এসব কি ভাবছে সে? কেন ভাবছে? তার এতো কিউরিসিটি কেন? এতো আগ্রহ জাগার তো কোন কারন নেই। তবে অভ্র বুঝলো, তার মনটা একটু খারাপ হয়েছে।
বাস ছুটছে হাইওয়ে রোড ধরে তিব্র গতিতে। সময় তখন নয়টা। তানিয়া চোখ ছোটছোট করে অভ্র’কে দেখছে। অভ্র ফোন ঘাটছে। তার মনোযোগ বেশ! এভাবে চুপ থাকতে মোটেও ইচ্ছে করছে না তানিয়ার। সাহসে কুলিয়ে যে দু-একটা কথা বলবে, সেটাও পারছে না সে। খোলা জানালা দিয়ে আসা দমকা বাতাসে শরীর নিস্তেজ হয়ে এলো তানিয়ার। ঘুম পাচ্ছে ভীষন। কোথাও যাওয়ার জন্য বেরোলেই পথে-ঘাটে ঘুম পাবে তানিয়ার। ব্যাপারটা অসহ্যকর! চেয়েও এই ঘুমকে পিছু ছাড়াতে পারে না তানিয়া। ঘুমে চোখ ঢুলে আসছে। তানিয়া বড়সড় হাই তুললো। আর নিজেকে আটকাতে পারলো না। মাথা এলিয়ে চোখ বুজলো। বড়বড় শ্বাস ফেলতে ফেলতে পাড়ি দিলো ঘুমে রাজ্যে।
নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ১৯+২০
অভ্র একবার তাকালো আঁড়চোখে। এরপর আবারো মন দিলো ফোনে। খানিক বাদে, তানিয়ার মাথা অভ্র’র ঘারে পড়তেই অভ্র স্ব-চকিত হলো। অজানা এক অনুভূতি’তে শিউরে উঠলো শরীর। অভ্র তাকালো না। কাঠ হয়ে রইলো। হাত দিয়ে আলগোছে মাথাটা সরিয়ে দিলো অভ্র। আগের মতো চেয়ারে হেলিয়ে ছোট করে শ্বাস ফেললো। বিরবির করে বললো,
‘নিজের বয়ফ্রেন্ডের ঘারে মাথা রাখুন। আমি আপনার বয়ফ্রেন্ড নই যে আগলে রাখবো।’
