নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ৩৩+৩৪

নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ৩৩+৩৪
আহমেদ হৃদ

অন্ধকারে নিমজ্জিত হাইওয়ে ধরে দ্রুত গতিতে ছুটছে পরপর ছয়টি গাড়ি। গোলাপসহ হরেক রকমের ফুলে সুসজ্জিত বরের গাড়ি সবার সামনে। ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িখানার কাঁচ খুলতে দেখা গেলো। হাতের উপর ঠেস দিয়ে বাইরে তাকায় আরু। মুখে এখনো বিষন্নতার ছাপ তার। একের পর এক রোডের ধারের বিরাটকার গাছগুলো সরে সরে যাচ্ছে। আরু নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো। খানিক বাদে আকাশপাণে তাকালো আরু। তারার মেলা আজ আকাশে। চাঁদ নেই। সাঁ সাঁ শব্দ করে ছুটছে বাতাস। লক্ষ্যাধিক তারার মাঝে একসাথে দু’টো তারা আশেপাশের তারাদের থেকেও অধিক আলোয় জ্বলকজ্বল করছে। এরা এতো উজ্জ্বল কেন? আরু বুঝলো না। মহুয়া বেগমের বাধ ভাঙা কান্নার মুখখানি বারবার চক্ষুপটে ভেসে উঠছে। হু হু করে উঠছে আরুর মন। চোখ ছলছল করে ওঠে আরুর।

কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেতেই, আরু চোখের কোনে জমা পানিটুকু মুছে নিলো। রুদ্র নরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো এতক্ষণ আরুর দিকে। এই সময়ে মন খারাপ হবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এভাবে বাইরে মাথা রাখাটা ঠিক নয়। আরু সরে এলো জানালা থেকে। মাথা নামিয়ে নতজানু হয়ে রইলো। রুদ্র ধাতস্থ গলায় বললো,
‘বেশি মন খারাপ হলে বলো। এক্ষুনি গাড়ি ঘোরাবো। যেতে হবে না তোমায় ও বাড়ি।’
তড়িৎ গতিতে মাথা তুলে তাকালো আরু। গোলাপি রঙের সেরোয়ানি পড়া রুদ্র’কে এতক্ষণে দেখলো সে। নরম চোখে তার’ই দিকে তাকিয়ে রুদ্র। আরুর চোখ পড়লো রুদ্র’র গালে। খোঁচা খোঁচা চাপদাড়ি’র দরুণ তার সৌন্দর্য আরও ফুটে উঠেছে। আরুর মনে হুট করেই নিষিদ্ধ ইচ্ছে জাগে। ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে দাঁড়িগুলো। পরক্ষনেই এসব কি ভাবছে ভেবে, একটু লজ্জা পেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। এতো বেহারা কেন সে? কি ভাবতো রুদ্র?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘বলবো গাড়ি ঘোরাতে?’
বললো রুদ্র। এবারে শব্দ করে হেঁসে ফেললো আরু। আকস্মিক হাসার কারন বুঝতে অসুবিধা হলো রুদ্র’র। ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে রইলো আরুর দিকে। আশ্চর্যন্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘হাসছো কেন? হাসার মতো কি বলেছি?’
আরু নিজেকে সামলায়। গুরুতর ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে। যার অর্থ কিছু হয়নি। রুদ্র বুঝি বিশ্বাস করলো না। ফের জিজ্ঞেস করলো,
‘তাহলে হাসলে কেন?’

জবাব দিলো আরু,’এমনিই। আর এখন বাড়ি যাওয়া সম্ভব নয় দু’দিনের আগে।’
‘কেন নয়? তোমার খারাপ লাগলে, তুমি যাবে না কেন?’
‘উম, আমি জানি বিয়ের পর শশুরবাড়ীতেই থাকতে হয়।’
‘কে বলেছে?’
‘আমার মা।’
‘তাহলে কাঁদছিলে কেন?’
‘এতো প্রশ্ন কেন করছেন? বাই এনি চান্স,আপনার আবার ঘর জামাই হয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না তো?’
রুদ্র বিষম খেলো আরুর নিরুদ্বেগ উত্তরে। আরু যে তার কথার এই মানে বের করবে, কল্পনাও করেনি রুদ্র। শুকনো ডোগ গিলে বললো,

‘এ-কথা কখন বললাম?’
‘বাদ দেন। আচ্ছা, আপনাকে একদিন বলেছিলাম; আপনি বিয়ের পর আমায় পড়াবেন কি পড়াবেন না। আপনি বলেননি। কেন?’
‘এই কথা কেন হঠাৎ?’
আরু কপাল কুঁচকায়। এতো প্রশ্ন কেন করে লোকটা? বিরক্ত গলায় বলে আরু,’আপনি কি বলবেন?’
‘না।’

কপালের ভাঁজ গাঢ় হলো আরুর। পড়াশোনার কথা উঠলেই লোকটা এড়িয়ে যেতে চায়। এতে এড়িয়ে যাওয়ার কি আছে? সোজাসাপটা ‘পড়াবে না’ বললেই তো হয়! আর উত্তর ও যে এটাই, আরু তো ভালোমতোই জানে। কেন বলেনা লোকটা? সারপ্রাইজ দিয়ে বলতে চায়? আরু ভাবার মাঝেও বিরক্তি বোধ করলো। এটা কি কোন সারপ্রাইজ দিয়ে বলার মতো কথা হলো? জোর করলো আরু,
‘বলুন নাআআ!’
‘তুমি কি চাও?’
‘পড়বো না।’

‘কাল থেকেই তোমার কলেজে যাওয়ার ব্যাবস্থা করছি। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি।’
আরু হকচকিয়ে তাকালো। রুদ্র ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে। কি সহজ-সরল কথা! এখন যা বললো লোকটা, তার মানে কি সে জানে? এরমানে হলো কলেজে যেতে হবে আরুকে! পড়তে বসতে হবে! রুদ্র কি আরুকে তার বাপের মতোই পড়াবে? পড়া না পেরে ফেইল করলে, কড়া কড়া ভাবে কথা বলবে? দূরে দূরে থাকবে? তাহলে বিয়ে করে কি লাভ হলো? আরু সারা শরীর আসাঢ় হয়ে আসতে লাগলো। হুট করেই গরম লাগতে শুরু করলো। নিশ্বাস আঁটকে আসতে লাগলো।
আরুকে হাসফাঁস করতে দেখে পানির বোতল এগিয়ে দিলো রুদ্র। আরু তারাতাড়ি হাতে নিলো বোতল। ছিপ খুলে এক নিশ্বাসে আধবোতল পানি খেয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেললো। তাকালো রুদ্র’র দিকে। তাজ্জব গলায় বললো,
‘আপনার মাথা ঠিক আছে তো?’

রুদ্র মাথা নাড়ে বোঝালো ঠিক আছে। আরু আবারো পানি খেলো কিছুটা। তাকালো রুদ্র’র পাণে। এতক্ষণ সে এই মানুষটাকে নিয়ে গুনগান গাইছিলো? যে আরুকে পড়াতে চায়! আচ্ছা, আহমেদ সাহেব বুদ্ধি করে আরুকে পড়ানোর জন্য বিয়ে দেয়নি তো? আরুর মনে হচ্ছে, তার পাশে সদ্য বিয়ে করা বর নয় যেন সয়ং আজরাইল বসে আছে। কি সুন্দর তার মাথা নাড়ার ভঙ্গি!

আরুকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতে দেখে রুদ্র মৃদু কাশলো। আরু চোখ সরিয়ে নেয়। রুদ্র তা দেখে ক্ষিণ হাসে। শক্ত করে আরুর এক হাত ধরে। আরু সাথেসাথে হাত ছিটকায় ছাড়ানোর জন্য। কিন্তু চাইলেই কি এই শক্তপোক্ত হাত থেকে ছাড়ানো যায়? তবুও কিছুক্ষণ বৃথা প্রচেষ্টা চালালো আরু। না পেরে শান্ত হয়ে বসে থাকলো। রুদ্র একচোখে দেখতে থাকে আরুকে। তার যে কতশত কথা জমে আছে। বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে রুদ্র’র হৃদয়। অথচ মেয়েটাকে দেখো, কেম মুখ গোমড়া করে বসে আছে। এটা কি অভিমান করার সময়? করুক! এখন রুদ্র অভিমান ভাঙাবে না। ভাঙাবে বাসর ঘরে। রুদ্র’র এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, পাশে বসা অভিমানী, ছোট্ট মেয়েটা নাকি নিজের বউ!

কয়েক মিনিটের মাঝেই গাড়ি থামলো রুদ্র’দের অট্টালিকা বাড়িটার সামনে। গাড়ি থামতেই, রুদ্র আরুর হাত ছেড়ে দিলো। আরু কটমটে চোখে তাকালো। হুট করেই ফিক করে হাসলো। আবারো মুখ গোমড়া করে বললো,’কেন ছাড়লেন? ধুরুন! আচ্ছা, আমিই ধরছি। একটা চুমুও দেই বরং।’
আরু এগিয়ে আসতে নিলেই, রুদ্র সরে গেলো কিছুটা। সে নিশ্চিত, মেয়েটার মাথার স্ক্রু ঢিলে আছে। নাহলে এমন আচরণ কেউ বিয়ে করা বরের সাথে করে?
খানিক বাদে জেবা, জুঁই নামাতে এলো আরুকে। দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে ডাকলো,
‘ভাবিজী, আসেন। নামুন এবারে বরের পাশ থেকে।’

ইলিমা পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। মেয়ের কথা শুনে রামধমক দিয়ে বলে উঠলেন,
‘এসব কেমন কথা জুঁই? দিনদিন অসভ্য হচ্ছো।’
জুঁই অবশ্য পাত্তা দিলো না। আরু বের হতেই বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলো। পিছুপিছু আসতে লাগলো সবাই। ড্রইংরুম এসে বসলো সকলে। সবার চোখেমুখে ক্লান্তি। ইলিমা এখানে আরুকে এক সেকেন্ড রাখতে চাইলেন না। এগিয়ে গেলেন আরুর কাছে। আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
‘আরু, কিছু খাবে?’

আরু মাথা নেড়ে বোঝালো সে খাবে না। ইলিমা জুঁইকে ইসারা করলেন আরুকে উপরে নিয়ে যেতে। জুঁই মাথা নেড়ে আরুর দু’কাধে হাত রেখে নিয়ে এলো উপরে। ডান পার্শের একেবারে কোনার রুমটায় নিয়ে এলো আরুকে জুঁই। এটাই কি রুদ্র’র রুম? আরু আগের বার যখন এসেছিলো, তখন দেখতে পায়নি। আরুকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে জুঁই। ভেতরে ডুকতেই সারা অঙ্গে শিহরণ বয়ে গেলো আরুর। রজনীগন্ধা আর গোলাপ ফুলে সাজানো পুরো রুম। দেখেই বোঝা যায়, পুরো রুম দক্ষ হাতো ডেকোরেশন করা। রজনীগন্ধার সুগন্ধ গোটা রুমজুড়ে বিচরণ করছে। আরু বুক ভরে শ্বাস টানলো। আরুকে নিয়ে বেডের কাছে গেলো জুঁই। বেডের দিকে তাকিয়ে আরেকদফা চমকালো আরু। বেডের উপরে গোলাপের লাল টকটকে পাপড়ি দিয়ে হার্ট সাইন আঁকা। তার’ই একপাশে ইংরেজি’তে ‘রুদ্র’, আরেকপাশে ‘আরু’ লেখা। আরু প্রথমে অবাক হলেও, এখন শুধু লজ্জাই পেলো। জুঁই আরুকে বসালো একপাশে। পাশের চেয়ারটা টেনে নিজে বসলো। বললো,

‘কেমন সাজানো হয়েছে, ভাবি?’
আরু সাদা চাদরের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে জবাব দেয়,’খুব সুন্দর।’
‘দেখতে হবে না, কে সাজিয়েছে!’
আরু চকিতে তাকালো জুঁইয়ের দিকে। অবাকসুরে জিজ্ঞেস করলো,
‘তুমি, মানে তোমরা সাজিয়েছো এগুলো?’
জুঁই দুষ্ট হেঁসে মাথা নাড়ে। আরু আবারো একপলক সারাঘরে চোখ বোলায়। কি সুন্দর সাজানো! দেয়ালে সামান্য দূরুত্ব রেখে রেখে ফুলের তোড়া লাগানো। আরুর যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, এগুলো ডেকোরেট করা নয়।
‘ও মিথ্যে বলছে ভাবি। এগুলো লোক দিয়ে সাজানো।’

ঘরে প্রবেশ করতে করতে বললো জেবা। পাশে আরও তিনজন মহিলা। অচেনা মুখ। আরু চিনলো না কাউকে। একজনের হাতে দুধের গ্লাস। সেটা এনে পাশের টেবিলে রাখলেন তিনি। জেবা জুঁইয়ের পাশে এসে দাঁড়ালো। জুঁইকে আলতো খোঁচা দিয়ে চাপা গলায় বললো, ‘ট্রিকস্ টু গেট ক্রেডিট!’
আরু বাঁকা চোখে তাকালো জুঁইয়ের দিকে। জুঁই আরুর দিকে তাকিয়ে গালভর্তি হাসলো। মহিলা তিনজনের মধ্য থেকে এগিয়ে এলেন একজন। মিষ্টি করে হেঁসে বললেন আরুকে,

‘আমায় চিনেছো? আমি সম্পর্কে রুদ্রর মামী হই। তারমানে, তোমার মামীশাশুড়ি আমি।’
আরু ক্ষিণ হাসলো। মহিলা দুধের গ্লাসটির দিকে ইসারা করে বললেন,’রুদ্র এলে প্রথমে সালাম করবে। দুধটা নিজ হাতে খাইয়ে দেবে। রুদ্র পান খায় না বিধায় পান আনা হয়নি। বুঝেছো তো?’
আরু বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়লো। মনেমনে বললো,’আসুক শুধু। বলে কি-না পড়াশোনা করাবে! আরে বাবা বিয়ে হয়েছে, এখন সংসার করবে আরু। বাচ্চা সামলাবে। ওসব বইটই পড়ে কি হবে?’
মহিলা সবাইকে তাড়া দিলেন বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য। একে একে লাইন ধরে বেরোতে লাগলো সবাই। সবাই বেরোতেই আরু হাত পা ছড়িয়ে বসলো। খুব গরম পড়েছে। আরু হাতের চুরিগুলোর দিকে চোখ পড়লো। সেদিন রুদ্র যে চুরিগুলো দিয়েছে, তন্মধ্যে আরু চুপিচুপি দু’টো পড়ে নিয়েছে। আরু মিষ্টি করে হাসলো চুরিদুটো দেখে। হাতের সোনার চুরি গুলোর মাঝে বড্ড খাপছাড়া লাগলেও, আরু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

‘আরে বাহ্, বেশ সুন্দর লাগছে তো!’
আরু হকচকিয়ে সামনে তাকালো। রুদ্র দাড়িয়ে। শুকনো ডোগ গিললো আরু। ভয় পেয়ে গিয়েছিলো সে। এভাবে এসে কেউ কথা বলে? গাড়ির কথাটা মাথায় এলো আরুর। কপট রাগ নিয়ে অন্যদিকে ফিরলো সাথেসাথে। যার অর্থ সে কথা বলবে না। মহিলাটির দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী উঠে দাঁড়ালো আরু। সালাম দিলো৷ রুদ্র হেসে সালামের উত্তর দিলো। আরু পাশের টেবিলে রাখা দুধের গ্লাসটা রুদ্র’র মুখ বরাবর তুলে গম্ভীর গলায় বললো,
‘নিন, খেয়ে নিন।’

রুদ্র গ্লাস হাতে নিলো। আবারো পাশের টেবিলে তা রেখে দিলো। অভিমানী কন্ঠে বললো,’খাইয়ে দিতে বলতে কি ভুলে গেলো মামী?’
আরু জবাব দিলো না। গাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রুদ্র উঠে দাঁড়ায়। বলে,
‘কথা বলবে না?’
আরু তবুও নিশ্চুপ। আকস্মিক আরুর হাতে টান দেয় রুদ্র। টাল সামলাতে না পেরে রুদ্র’র পেশিবহুল দৈত্যাকার বুকে আছড়ে পড়লো আরু। রুদ্র আরুর চুলে চুমু খায়। সারা অঙ্গে শিহরণ বয়ে যায় সারা শরীরে। আরু মাথা তুলতেই, কপালেও চুমু দিলো রুদ্র। আরু আপোষে চোখ মুদে নিলো। এতোক্ষণ জমে থাকা রাগ, অভিমান মুহুর্তেই যেন উধাও!

ঘরিতে আটটা ত্রিশ বাজছে। প্রায় ত্রিশ মিনিট আগে আজ অফিসে এসেছে তানিয়া। হ্যা, যে তানিয়া প্রায়শই দেরি করে অফিসে আসে, সে আজ এতোটাই জলদি এসেছে অফিসে। এর অবশ্য কারনও রয়েছে। আর তা হলো ভুলবশত-ও তাকে যেন অভ্র’র সামনে যেতে না হয়। দেরি করলে যদি লোকটা ডেকে বসে? কোনমুখে গিয়ে সামনে দাঁড়াবে তানিয়া? কৈফিয়ত তো দূর, তানিয়ার তো সাহস নেই ওই লোকের সম্মুখীন হওয়ার। কালকের কথা মনে পড়লেই তানিয়ার শ্বাস আঁটকে আসছে এখনো। চোখ, মুখ, কান লাল হয়ে উঠছে। গোটা একটা রাত কাল নির্ঘুম কাটিয়েছে তানিয়া। এতোটাই ঘোরে ছিলো যে, কখন সকাল হয়ে গেলো; তানিয়া বুঝলোই না। এরপরও আরও ওই লোকের সামনে? কল্পনাতেও নয়! কাল কেন এমন করলো অভ্র? অভ্র তো তানিয়াকে ভালোবাসে না। তাহলে? তানিয়া জুবুথুবু হয়ে বসে আছে ডেস্কে। চিন্তায় মাথা ধরে যাচ্ছে তানিয়ার। এখনো অনেকেই আসেনি। প্রায় ফাঁকা পুরো অফিস। অভ্র এসেছে কি? আসলে আসুক, না আসলে নাই! তানিয়া আর ওই লোকের সামনে যাবে না। ভুলেও না!

‘আরে, আপনি আজ এতো জলদি?’
ভাবনার সুতো কাটলো তানিয়ার। তুর্য কাঁধের ব্যাগটা চেয়ারের সাথে সিঁটিয়ে আরাম করে বসলো। তাকালো তানিয়ার দিকে। তানিয়া স্মিত হাসে। ছোট করে বলে,
‘এমনিই।’
‘তো তিনদিন আসেননি কেন?’
‘ব্যাস্ত ছিলাম একটু।’
‘ওহ্।’
তানিয়া আর কোন কথা বললো না। চুপচাপ বসে রইলো। তুর্য ততক্ষণে কম্পিউটার অন করে ফেলেছে। ছেলেটা কাজ ভালোবাসে খুব। তাইতো সময় হওয়ার আগেই প্রতিদিন অফিসে আসে। তানিয়া ছোট করে শ্বাস ছাড়ে। সে যে কবে এমন হতে পারবে!
‘মিস তানিয়া।’

পুরুষালি একটি ভরাট কন্ঠ কানে আসতেই চমকে উঠলো তানিয়া। ঘার ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই অভ্র’কে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, কলিজা ছলকে উঠলো। হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলো অভ্র’র দিকে। অভ্র হঠাৎ এখানে কেন? তানিয়া ঘার ঘুরিয়ে তুর্য’র দিকে তাকিয়ে দেখলো, তুর্য দাঁড়িয়ে গেছে অলরেডি। তানিয়া তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো। ছোট করে বললো,’সরি, স্যার।’
‘কেবিনে আসুন।’
সোজাসাপ্টা কথাটা বলেই উল্টোপথে হাঁটতে লাগলো অভ্র। তানিয়া কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো। নড়বার শক্তিটুকুও বুঝি খুঁইয়েছে সে। আজ পর্যন্ত অভ্র যতবার ডেকে পাঠিয়েছে, প্রতিবার করিম সাহেব এসেছেন। আজ কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ অভ্র’র? যে নিজেই এলো ডাকতে?
অভ্র হুট করে থামে। পিছু ফিরে তানিয়াকে একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু উঁচিয়ে তাকায়। বিরক্তি গলায় ডেকে ওঠে,

‘মিস তানিয়া?’
ধ্যান ছুটলো তানিয়ার। ফাঁকা ডোগ গিলে সামলে নিলো নিজেকে। ডেস্ক ছেড়ে বেড়িয়ে এলো তানিয়া। অভ্র আবারো উল্টো ফিরে হাঁটতে আরম্ভ করেছে। তানিয়া কয়েকপা এগিয়ে থেমে যায়। জোরে জোরে শ্বাস টানে। যেটার ভয় সে পেয়েছিলো, ঠিক সেটাই হলো। সে-ই সামনে যেতে হবে লোকটার। লোকটার কি লজ্জা-টজ্জা কিছু নেই? কালকে ওমন বিচ্ছিরি একটা কান্ড ঘটিয়ে, নিজে ডাকতে এসেছে? তানিয়া গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো কেবিনের সামনে। বুকে কিঞ্চিৎ থু থু ছিটিয়ে ক্ষীণ গলায় বললো,
‘মে আই কামিং স্যার?’
আওয়াজ এলো ভেতর থেকে,’কামিং।’

তানিয়া কম্পিত পায়ে প্রবেশ করলো ভেতরে। টেবিলের সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে রইলো। কাঙ্খিত রোগটার উপশম ঘটলো আবারো; একফোঁটা পানি প্রয়োজন তানিয়ার।
‘নতুন বউদের মতো মাথা নিচু করে আছেন কেন? সামনে তাকান।’
তানিয়ার কান গরম হয়ে উঠলো অভ্র’র কথায়। লোকটা দিনদিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। লজ্জা দিতে একচুল ছাড়ে না। তানিয়া ধীর গতিতে চোখ তুলে তাকায়। অভ্র ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে তাকিয়ে। বললো,
‘দূরে সোফাটা দেখছেন?’

তানিয়া তাকালো সেদিকে। বিরাট একটা সোফা সেখানে পাতা। এটা এখানে কেন? আগে তো ছিলো না! তানিয়া প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো অভ্র’র দিকে। জিজ্ঞেস করার সাহস পেলো না। অভ্র উঠে দাঁড়ায়। তানিয়া যখন লজ্জা পায়, তাকে দেখতে বেশ লাগে। তাইতো বারবার লজ্জায় ফেলে মেয়েটাকে অভ্র। এইযে এখন! কেমন চোরা চোরা মুখ। অভ্র ক্ষিণ হাসলো। গম্ভীর হওয়ার ভান ধরে বললো,
‘ওখানে গিয়ে বসুন।’
ভ্রু-যুগল কুঁচকে তাকায় তানিয়া। ওখানে গিয়ে বসবে মানে? বসে কি হবে? জিজ্ঞেস করলো,
‘ওখানে বসবো কেন?’
‘কাজ আছে। গিয়ে বসুন।’

বললো অভ্র। তানিয়া একপলক অভ্র’র দিকে, আরেকপলক সোফাখানার দিকে তাকাচ্ছে। ওখানে আবার তানিয়ার কি কাজ? জিজ্ঞেস করার সাহস পেলো না তানিয়া। বিনাবাক্যে সোফায় গিয়ে বসলো। অভ্র চেয়ারে বসে। তার ঠিক সামনেই সোফা। একবার তানিয়াকে দেখে ল্যাপটপে মন দিলো অভ্র। তানিয়া তাজ্জব হয়ে বসে রইলো। আজব তো! লোকটা তাকে এখানে বসিয়ে ল্যাপটপে কি করছে? তানিয়া বলতে গিয়েও কি যেন ভেবে বললো না। এভাবেই বসে রইলো কিয়ৎক্ষন। এভাবে বসে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে তানিয়ার।লোকটা কি পাগল হয়ে গেলো? এভাবে বসে রাখিয়ে রাখার মতো তো মানুষ নয় লোকটা। তানিয়া বিরক্ত হলো। হেড়ে গলায় বলে উঠলো,
‘এখানে বসিয়ে রেখেছেন কেন আমায়?’
তানিয়ার প্রশ্নে চোখ তুলে তাকালো অভ্র। স্বাভাবিক গলাতেই বললো,
‘আজ থেকে আপনি অফিসে এসেই এখানে এসে বসবেন। অফিস যতক্ষণ না ছুটি হচ্ছে, এখানেই বসে থাকবেন।’
‘কেন?’
‘আমি আপনাকে সারাক্ষণ দেখবো, তাই।’

সকাল গড়াতেই পাড়া-প্রতিবেশি এসে ভীর জমিয়েছে ইরহাম বাড়ির ড্রইংরুমে। তার কারন, নতুন বউকে দেখা। আরু নব বধুর মতো চুপটি করে বসে আছে সবার মাঝে। তাকে ঘিরেই আলোচনা সবার। জিজ্ঞেস করছে এটা-সেটা। আরু না চাইতেও লজ্জার ভান ধরে উত্তর দিচ্ছে। ইলিমা ট্রে-ভর্তি খাবার সাজিয়ে নিয়ে এলেন। সবাইকে তাড়া দিয়ে বললেন আগে খেয়ে নিতে। জেবা চুপচাপ বসে আরুর পাশে। জুঁই গিয়েছে স্কুলে। সামনেই ওর এসএসসি। হুট করে ফোনটা বেজে উঠলো জেবার। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে ‘রাফিদ’ নামটি। নামের শেষে রেড হার্ট ইমোজি। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটলো জেবার। ভীরের মাঝ থেকে দ্রুত বেড়িয়ে বারান্দায় এলো জেবা। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তির্যক কন্ঠ ভেসে এলো রাফিদের,
‘আর কত অপেক্ষা করতে হবে আমায়, জেবা? সিঙ্গাপুর থেকে কাল মেইল এসেছে। চাকরিটা কনফার্মড্! বাড়ি থেকে এই বিয়ের চাপ আমি নিতে পারছি না।’

জেবা মুহুর্তেই থমকে যায়। হাসিটুকু উবে যায় কর্পূরের মতো। ছুরির মতো বুকে এসে বিঁধে রাফিদের কথাগুলো। রিসিভ করেই এমন কিছু শুনবে, কল্পনারও করেনি সে। তাকে কি বলে সম্মোধন করলো রাফিদ? জেবা? আজ তার মুখে ‘প্রিয়’ ডাকটি কোথায়? দীর্ঘ তিন মাস পর এই নাম রাফিদের মুখে শুনলো জেবা। বুকটা বিতৃষ্ণায় ভরে উঠলো। ছলছল করে উঠলো চোখদুটি। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো নিশ্চুপ হয়ে।
ওপাশে রাফিদ কিছুটা নরম হলো। বুঝলো, রাগের মাথায় বলে সে ভুল করে ফেলেছে। অনুতাপ নিয়ে বললো,
‘আমি দুঃখীত, প্রিয়।’

জেবা কেঁদে ফেললো নিঃশব্দে। নোনাজলের স্রোত বইতে লাগলো গালবেয়ে। রাফিদ আবারও বললো,
‘তুমি যদি বলো, আমি আজকেই তোমাদের বাড়িতে যাবো। প্রস্তাব দেব। এখনো আমি যথেষ্ট টাকা আর্ন করছি। নিশ্চয়ই ফিরিয়ে দেবে না তোমার বাবা?’
‘রাফিদ..’ বলতে গিয়ে আঁটকে গেলো জেবা। গলা ভেঙে আসছে কান্নায়। কাল সবে বড়ো ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে। আর আজকেই তাকে দেখতে আসবে? রাফিদ কি বুঝছে না? অবশ্য রাফিদের দোষ দেয়া যায় না। ছেলে চাকরি করে, বয়স হয়েছে; এখন তো মা-বাবা চাইবেই, ঘরে বউ আসুক।
জেবার নিশ্চুপতাই রাফিদকে বুঝিয়ে দিলো মেয়েটা কাঁদছে। রাফিদ সামলালো নিজেকে। প্রতিনিয়ত পরিবারের সাথে যুদ্ধ করে সে ক্লান্ত। মলিন গলায় বললো,

‘আমিও তোমায় ভালোবাসি, প্রিয়। তোমায় নিজের করে চাই। সিঙ্গাপুরে যাওয়াটা আমার ড্রিম, তুমি তো জানোই! আর গেলে কম করে হলেও পাঁচ বছরের আগে ফেরা হবে না। এখন তুমিই বলো, আমার কি করা উচিত? আম্মা কিছুতেই বিয়ে না দিয়ে পাঠাবেন না।’
‘রাফিদ আর একটু সময় দাও। আমি চেষ্টা করছি..’
‘আর কত, প্রিয়? মার্চের তিন তারিখে জয়েন ডেট।’
জেবা ঠোগ গিললো। গলা জ্বলছে। মনে হচ্ছে দলা পাকিয়ে আসছে। কোনমতে বললো,
‘আজকে ভাইয়াকে বলবো আমি। অভ্র ভাইয়া নিশ্চয়ই ব্যাবস্থা করবে।’
‘আর যদি না হয়?’
চেয়েও এবারে নিজেকে আটকাতে ব্যার্থ হলো জেবা। হু হু করে কেঁদে উঠলো। ক্রন্দনরত গলায় বললো,
‘তুমি না হয় অন্যকারো সঙ্গে বেঁধো ঘর।’
‘জেবা!’

ধমকে উঠলো রাফিদ। মুখে হাত গুজে ফুপিয়ে ওঠে জেবা। নিজেকে সামলে ভাঙা গলায় বলে,
‘আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।’
ফোন কেটে, আঁকড়ে ধরে বুকে চেপে নিলো জেবা। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে বুকে। এই রাফিদ নামক মানুষটাকে ছাড়া কিভাবে বাঁচবে সে? প্রতিটা মুহুর্ত যার কারনে প্রানবন্ত, যে মানুষটা ছাড়া নিজেকে কল্পনা অব্ধি জেবা করেনা, সে অন্য কারো হবে? অন্যকারো সাথে ঘর বাঁধবে? মরে যাবে জেবা! বাঁচতে পারবে তো বাকিটা জীবন? খানিকটা সময় নীরবে কাঁদলো জেবা। আজকেই অভ্র’কে রাফিদের ব্যাপারে বলবে সে। যে করেই হোক! জেবা চোখের পানি মুছে নিলো। পিছু ফিরে আরুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকালো জেবা। আরু এগিয়ে আসে। জেবার কাঁধে হাত রেখে বলে,
‘আমার কাছে একটা প্লান আছে।’

দেওয়াল ঘরিতে সাতটা বাজে। ড্রইংরুমে চিন্তিত হয়ে বসে আছে আরু, জুঁই, জেবা। ইলিমা একটু পরপর এসে দেখে যাচ্ছেন মেয়েগুলোকে। চোখেমুখে সবার কেমন অস্থির অস্থির ভাব। জিজ্ঞেসও করছেন কিছু হয়েছে কি-না। তিনজন বরংবার মাথা দুলিয়ে বোঝাচ্ছে, কিছু হয়নি। সবথেকে উত্তেজিত জেবা। হাত পা রীতিমতো কাঁপছে। মাথা তুলে সদর দরজার দিকে তাকালো জেবা। অভ্র আজ এতো দেরি কেন করছে? অফিস তো কত আগে শেষ হয়েছে! আশাহত হয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতেই, কলিংবেলের আওয়াজ এলো। জেবা কিঞ্চিৎ কেঁপে ওঠে। চকচক করে ওঠে চোখদুটি। আরু নিজেকে সামলে নেয়। আন্দাজে ঠিল ছুড়তে হবে; তার প্রস্তুতি নিলো আরু। জুঁই প্লান মাফিক দরজা খুলতে গেলো। দরজা খুলতেই, অভ্র সিধবিধ বাড়িতে ডুকলো। ড্রইংরুমে আসতেই জুঁই স্ব-শব্দে শুনিয়ে জিজ্ঞেস করলো আরুকে,

‘তারপর ভাবী, তুমি বলছিলে তানিয়ার আপুর নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে? কার সাথে? আপুরা তো বিশাল বড়লোক! তাদের মতোই কারো সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে নিশ্চয়ই?’
অভ্র নিজ মনে হেঁটে যাচ্ছিলো। কথাগুলো শুনতেই থেমে গেলো সিঁড়ির অভিমুখে। কপালে সূক্ষ্ম তিনটি ভাজ পড়লো অভ্র’র। তানিয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে মানে? আজকে তো সারাদিন তার সামনেই বসে ছিলো তানিয়া।বিয়ে ঠিক হলে, বলতো না একবারও? কপালে ভাজ রেখেই জুঁইয়ের প্রশ্নের উত্তর পেতে পিছু ফিরলো অভ্র। আরু জবাব দিলো,

‘হুম। ঠিক হয়নি। তবে কাল দেখতে আসার কথা। এমনটাই তো বললো তানিয়া।’ বলল আরু।
কপালের শিরা-উপশিরা জ্বলে উঠলো অভ্র’র। এতো বড়ো কথা, মেয়েটা তাকে বললো না? জানানোর প্রয়োজন বোধ করলো না? চেয়াল শক্ত হয়ে এলো অভ্র’র। পিছু ফিরে হনহনিয়ে উপরে উঠে চলে গেলো। নিজ রুমে গিয়ে গায়ের কোর্টটা ছুঁড়ে ফেললো মেঝেতে। কপালে এতক্ষণে ঘাম জমেছে। সন্তোর্পণে তা মুছে নিলো অভ্র। দিকসারা লাগছে তার।

আরুর কথাগুলো কানে বাজছে বরংবার। কাল দেখতে আসবে তানিয়াকে, অথচ এ প্রসঙ্গই তোলেনি তানিয়া। আর, এতো সহজ বুঝি তার তানিয়াকে তার থেকে আলাদা করা? কার সাধ্যি অভ্র’র থেকে তানিয়াকে কেড়ে নেবে? ভূ-খণ্ডে প্রলয় উঠিয়ে দেবে অভ্র। তানিয়ার সাথে যদি কারো বিয়ে হয়, সেই মানুষটা হবে শুধু অভ্র। তানিয়া শুধু তার নিজের! একান্ত, অতি আপনজন। অভ্র তরিঘরি করে প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করলো। ডিরেক্ট কল দিলো তানিয়াকে। একবার, দুইবার কল দিলো। রিং হচ্ছে, কিন্তু ধরছে না। ফোন কেন ধরছে না মেয়েটা? মাথা ধরে যাচ্ছে অভ্র’র। যদি তার অগোচরে সত্যিই এমন কিছু হয়ে যায়? অভ্র দু’হাতে মাথার চুলগুলো শক্ত করে টেনে ধরলো। কপালের শিরা-উপশিরা দপদপ করছে। অজানা ভয়ে হাত পা কাঁপছে!

অন্ধকার ঘরে একচোখে ফোনের তাকিয়ে আছে তানিয়া। চোখের সামনে ভাসছে অপ্রিয় ব্যাক্তিটির নাম্বর। যার ফোন করার কথা, তার কোন খবর নেই! অথচ এই উদ্ভট লোকটা ফোন করছে! সেদিনের পর আর কোন মেসেজ কিংবা কল আসেনি এই নাম্বর থেকে। তানিয়া ভেবেছিলো হয়তো করবেও না আর। কিন্তু আজ চারদিন পর হুট করে কোত্থেকে উদয় হলো এই লোক? সামনে যখন আসবেই না, তখন ফোন কেন করে? এমনিতেই তানিয়া চিন্তিত। ভীষণ চিন্তিত! আজ অভ্র’র ছোটখাটো একটা পরিক্ষা হবে।

সেই পরিক্ষার রেজাল্ট নিয়েই তানিয়া মূলত ডিপ্রেশনে। তার উপর এই লোকটা! আরু যা যা বললো, তা যদি সত্যি হয়; তবে তো একটা হলেও ফোন দেবে অভ্র। জিজ্ঞেস করবে সত্যিই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে নাকি। আচ্ছা, তার বিয়েতে লোকটার কিছু যায়-আসে তো আদেও? নাকি এতটুকু আগ্রহ নেই? মন খারাপ হলো তানিয়ার। ফোনটা আস্তে করে বিছানায় রেখে উঠে বসলো। অভ্র কি তাকে ভালোবাসে না? তবে আজকের ঘটনা? সোফা পাতিয়ে তাকে দেখা; সেটা কি নিছকই শখ? বা কোন শাস্তি? না, না! তা কি করে হয়? অভ্র’র শাস্তি দেয়ার কিছু নিয়ম আছে। চোখ লাল টকটকে থাকবে, হাত মুষ্টি করে দাঁতে দাঁত পিষে শাস্তি দেবে। কিন্তু আজ চোখে রাগ তো দূর, কাঠিন্যতার ছিটেফোঁটাও ছিলো না! অন্যকিছু ছিলো। যা হৃদয়ে এসে লাগে। তানিয়া লজ্জা পায় ওই দৃষ্টির দিকে তাকাতে।

ফোনে মেসেজের শব্দ আসতেই বিরক্ত হয়ে ফোন হাতে নিলো তানিয়া। সে-ই অপ্রিয় ব্যাক্তির ম্যাসেজ। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তানিয়া পড়লো,
‘আপনাকে নাকি কালকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে?’
পিলে চমকে তাকালো তানিয়া। ভালো করে পরখ করে নিলো নাম্বারটা। না না, এটা সেই গিফট্ দাতার’ই নাম্বর। এই লোক জানলো কিভাবে পাত্রপক্ষ দেখতে আসার কথা? এটা তো শুধু আরু আর সে জানে। আর ‘তুমি’ থেকে ‘আপনি’?

তানিয়া কিয়দাংশ সময় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো মেসেজটার দিকে। হঠাৎ-ই ঠোঁটের কোনে ক্রুর হাসি ফুটলো তানিয়ার। লোকটা কি তানিয়াকে বোকা ভাবে? রিপ্লাই দিলো ধীরেসুস্থে তানিয়া,
‘হ্যা, ভাবছি আপনার দেওয়া সেই গাউনটাও পড়বো। কালকেও তো আমার জিবনে একটা স্পেশাল দিন। আর আপনিই তো বলেছেন যেন স্পেশাল কোন দিনে গাউনটা পড়ি। ভালো হবে, বলুন?’
‘আপনি কোন পাত্রপক্ষের সামনে যাবেন না! আর আপনার না বর আছে? লজ্জা করে না আরেকটা বিয়ে করতে?’
তানিয়া ঠোঁটের হাসি প্রগাঢ় হয়। লিখে,

‘বাতাসে কেমন জেলাস জেলাস গন্ধ।’
‘বেয়াদব।’
‘হি হি।’
‘লজ্জা করছে না, সেদিন বরের নামে এতো এতো গুনগান গেয়ে এখন এসব বলতে?’
‘ওমা,লজ্জা কেন লাগবে? সবাই ক্ষণে ক্ষণে ক্রাশ পাল্টায়, আমি না হয় জামাই পাল্টালাম। সমস্যা কোথায়?’
‘আপনি কি মজা নিচ্ছেন? আপনার বর কিন্তু সবকিছু ধ্বংস করে দেবে! মাইন্ড ইট!’
তানিয়া শব্দ করে হাসলো। দিক না! তানিয়াও তো এটাই চায়। সব ধ্বংস করে হলেও, তাকে যেন নিয়ে যায় তার সপ্নের সেই মানুষটা। আবারো মেসেজ এলো,

‘আপনি আমার দেওয়া গিফটে্ হাতও দেবেন না। ওটার যোগ্য নন আপনি! আপনারা মেয়েরা এক পুরুষে আসক্ত হতে পারেন না কেন?’
ধপ করে আগুন জ্বলে উঠলো তানিয়ার মাথায়। লোকটা কি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে অপমান করলো তাকে? তানিয়া লিখলো,
‘দশ পুরুষে আসক্ত হবো। আপনার কি? কে আপনি?’
‘ফোন রিসিভ করুন। বলছি..’

হ্যা, দিক! কি ভাবে কি নিজেকে? তানিয়া কি ভয় পায় নাকি? মুখ ফুটে নিজের মনের কথা বলতে পারে না, আবার বড়বড় কথা! সাথেসাথে ফোন এলো। বুকে সাহস জমিয়ে রিসিভ করলো তানিয়া। পরিচিত একটি শক্ত কন্ঠ হানা দিলো কর্নকুহরে,
‘এবার বলুন। কি যেন বলছিলেন?’

দু’টি বাক্যেই জোগানো সাহস মুখ থুবড়ে পড়লো। থতমত খেয়ে চুপ করে রইলো তানিয়া। এভাবে কথা বলে কেন এই লোক? মেসেজে তো ঠিকিই বকবক কথা বলতে পারছিলো, তবে এখন কেন পারছে না সে? তানিয়া কিছু বলার সাহস না পেয়ে চুপ করে রইলো। অভ্র ফের বলে উঠলো,
‘বলুন! দশ পুরুষ না কি যেন বলছিলেন তখন?’
তানিয়া ডোগ গিলে। কিছু বলতে না পেরে আমতা-আমতা করে জবাব দেয়,
‘না মানে..’

‘আমি ছাড়া অন্য কোন ছেলে যদি চোখও তুলে তাকায় আপনার দিকে, আমি সেই চোখ তুলে নিতে একবারও ভাববো না, মিস তানিয়া।’
স্তব্ধ হয়ে গেলো তানিয়া। সারা শরীরের নিউরনে নিউরনে রক্তস্রোত বয়ে গেলো। অভ্র’র কথাগুলো প্রতিধ্বনি হয়ে কানে বাজছে তানিয়ার। অভ্র কি তবে সত্যি সত্যি ভালোবেসে তাকে? একরাশ ভালোলাগায় ছেঁয়ে গেলো তানিয়ার হৃদয়। চারিদিকে বসন্ত যেন আজ! তানিয়া এক লাফে বিছানায় উঠে দাঁড়ায়। আকস্মিক দরজায় কারো করাঘাতে কেঁপে উঠলো তানিয়া। একনাগাড়ে এলোপাতাড়ি কেউ কড়া নেড়েই চলেছে। এই সময়ে কে এলো আবার? ঝর্না তো ঘুমিয়েও পড়েছে এতক্ষণে।
‘তানিয়া, দরজা খোলো।’

আরিফ সেহরানের কন্ঠ। তানিয়া দ্রুত বিছানা থেকে নামে। আজ এতো তারাতাড়ি? আর এই ঘরে হঠাৎ, কেন? বিছানা থেকে ওড়না তুলে গায়ে জড়িয়ে নিলো তানিয়া। ধীর পায়ে এগিয়ে খুলে দিলো দরজা। দরজা খুলতেই, আরিফ সেহরানকে রণমুর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কলিজা ছলকে উঠলো তানিয়ার। শক্ত চোখমুখ, রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে তিনি। তানিয়া ডোগ গিললো। কিছু বলবে, তার আগেই গালে স্ব-শব্দে চড় বসিয়ে দিলেন আরিফ। আকম্মিকতায় মেঝেতে ছিটকে পড়লো তানিয়া। ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো কর্ন। হাতের ফোনটা ছিটকে মেঝেতে পড়ে। আরিফ এগিয়ে এলেন। তুলে নিলেন ফোন। কেউ হ্যালো, হ্যালো করছে। রাগের মাত্রা তরতর করে বাড়লো আরিফের। খট করে লাইন কেটে তানিয়ার দিকে তাকালেন তিনি। চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,
‘এতো বড়ো স্পর্ধা তোমার! কোন সাহসে চাকরি করতে গিয়েছো তুমি? তাও পার্সোনাল সেক্রেটারি পদে? তোমায় দেখে আমার ঘৃণা হচ্ছে!’

কেঁপে উঠলো তানিয়া। অবাক চিত্তে মাথা তুলে তাকালো। কে বললো এই কথা? কিভাবে জানলেন আরিফ? ছলছল করে ওঠে তানিয়ার আঁখিদ্বয়। মা হারা হওয়ার পর আজ প্রথম গায়ে হাত তুললেন আরিফ। তানিয়া কোনমতে উঠে বসে। মাথা নামিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে রয়। আরিফ ঝাঁঝালো গলায় ফের বললেন,
‘তোমায় নিয়ে আমি গর্ব করতাম। আর সেই তুমি? কলেজ এর নাম করে এই বয়সে চাকরিতে যাও? এই আমার মেয়ের শিক্ষা? ছিহ্! তবে শুনে রাখো, পরশু আমার বন্ধুর ছেলে আসছে ইংল্যান্ড থেকে। আর সেদিনিই কোর্ট ম্যারেজ হবে! তৈরি থেকো।’
তড়িৎ গতিতে মাথা তুলে তাকালো তানিয়া। আরিফ হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেলেন রুম থেকে। তানিয়া বাকরুদ্ধ! তন্দা মেরে তাকিয়ে রইলো। শুধু এতোটুকু বুঝলো, তার চারপাশ ঝাপসা হয়ে আসছে..

আরেকটি সকাল। সূর্য এখনো ওঠেনি পুরোপুরি। অভ্র পা টিপেটিপে নিচে নেমে এলো। কেউ ওঠেনি এখনো। এইতো সুযোগ! সদর পেড়িয়ে বাগানে গেলো অভ্র। গ্রীষ্ম বিধায় তেমন ফুল নেই বাগানে। গোলাপের গাছগুলোয় কড়ি এসেছে কেবল। এখনো ফুল ফোটেনি। অভ্র আশাহত হলো। বাড়িমুখো ফিরে এলো পুনরায়। উপরে উঠে ধপ করে কাউচে বসে পড়লো। তাদের অফিস থেকে বাজার প্রায় অনেকটা দূরে। আজ জলদি বেরোতে হবে তাহলে। অভ্র ল্যাপটপ অপেন করে। মন দেয়ার চেষ্টা করে কাজে। কিন্তু চাইলেই কি মন বসে? কালকের কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে অভ্র’র। ভাবলেই স্মিত হাসলো অভ্র। কালকে রাতে জেবা এসেছিলো। সবটা বললো। তারমানে তানিয়াও সব জানতো! জেনেও কেমন ঘাটিয়ে সব কথা বের করেছে মেয়েটা। অভ্র’র মুগ্ধতা আরেকটু বাড়ে। কিন্তু, কাল ওমন হুট করে কেটে কেন দিলো ফোন? আজ শুধু আসুক, হচ্ছে!

অভ্র ল্যাপটপে মন দিলো। খানিক পর স্কাই কালারের টি-শার্ট’টা খুলে গলায় টাওয়াল পেঁচিয়ে ওয়াশরুমে গেলো অভ্র। শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে দেখলো, প্রায় আটটা বাজে! আজ তো তারাতাড়ি যেতে হবে অভ্র’কে। অভ্র দ্রুত চেঞ্জ করে নিলো। তারাহুরো করে চুলগুলো সেট করে বেড়িয়ে পড়লো। নিচে নেমে এলো অভ্র। ইলিমা তখন রান্নাঘরে। ছেলেকে সময়ের আগে বেরোতে দেখে তিনি বেড়িয়ে এলেন। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলেন,
‘আজ এতো জলদি যাচ্ছো অভ্র? খেয়ে যাবে তো!’
অভ্র থামলো। কিছু একটা ভেবে উত্তর দিলো,’আসলে আজ খুব ইমপর্টেন্ট একটা মিটিং আছে। আসছি আমি..’
‘খেয়ে যাবে..অভ্র..’

অভ্র না শুনেই বেড়িয়ে গেলো। গাড়ি বের করে দ্রুত গতিতে চালিয়ে বাজারের দিকে গেলো। প্রায় আধঘন্টার মধ্যে বাজারে পৌছে গেলো অভ্র। গাড়ি পার্ক করে একটি ফুলের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো। সকাল সকাল তাজা ফুলে দোকান ভর্তি। অভ্র’র ভাবতেই অবাক লাগছে, সে একটা মেয়ের জন্য ফুল কিনতে এসেছে! যে অভ্র ফুলের দোকান দেখলেই মনেমনে তাচ্ছিল্য হাসতো; হ্যা, আজ সেই অভ্র’ই ফুল নিতে এসেছে। তার প্রিয়তমা’র জন্য। অভ্র আনমনে হেঁসে ফেললো। একটি তরতাজা লাল গোলাপ আর সাথে বিভিন্ন রঙের গোলাপের একটি তোড়া কিনে নিলো। এরপর অনেকগুলো চকলেট কিনলো অভ্র। সবগুলো একটি ব্যাগে নিয়ে নিলো অভ্র। ততক্ষণে ন’টা বেজে গেছে প্রায়। ইশশ্! অনেক দেরি হয়ে গেছে।

তানিয়া চলে এসেছে নিশ্চয়ই? অভ্র গাড়িতে গিয়ে বসে। স্পিডে গাড়ি চালিয়ে অফিসে পৌছায়। অফিসে ঢুকে তানিয়াকে নিজের ডেস্কে না দেখে মনেমনে খুশি হলো অভ্র। মেয়েটা মনে রেখেছে তাহলে! অভ্র দ্রুততার সাথে কেবিনে গেলো। কিন্তু, তানিয়া কেবিনে নেই! অভ্র দেয়াল ঘরির দিকে তাকায়। নয়টা পঁচিশ বাজে। আজ এতো দেরি কেন করছে মেয়েটা আসতে? অভ্র মাথা ঘামালো না বেশি। আসুক দেরিতে। অভ্র পাশের রুমে গিয়ে ফিটফাট হয়ে নিলো।

নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ৩১+৩২

আজ সে তার মনের কথা বলবে। উম, কিভাবে বলবে? অভ্র মৃদু লজ্জা পেলো। লজ্জা ঢাকতে দ্রুত সরে এলো আয়নার সামনে থেকে। এমন পরিস্থিতি’তে যে কখনো তাকে পড়তে হবে, অভ্র কি ভেবেছিলো আদেও? অভ্র কেবিনে যায়। নিজ চেয়ারে বসে। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটাচ্ছে যেন। হৃদপিন্ডের ধুকপুকানির শব্দ নিজে শুনতে পাচ্ছে। অভ্র আনচান করতে লাগলো। উঠে দাঁড়ালো। আবারো বসলো। দেখতে দেখতে ঘন্টা পেরিয়ে গেলো। অভ্র এবার একটু চিন্তায় পড়লো। এখনো আসছে না কেন মেয়েটা? অভ্র টেলিফোন তুলে ফোন দিলো করিম সাহেবকে। মিনিটের মধ্যেই করিম সাহেব চলে এলেন। অভ্র ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘মিস তানিয়া আসেনি এখনো?’
‘জ্বি না, স্যার।’

নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ৩৫+৩৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here