নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ৭+৮
আহমেদ হৃদ
খাওয়া শেষে সবে রুমে এসেছে আরু। বাইরে হাওয়া বইছে। হয়তো বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি’র কথা ভাবলেই মন নেঁচে ওঠে আরুর। বৃষ্টি নামবে মানেই, আরুর গোসল হবে ছাঁদে। এর থেকে আনন্দের কথা কি হতে পারে? রাতে বৃষ্টিবিলাস; উফফ! আরু খুশিতে গদগদ হয়ে বেলকনিতে উঁকি দিলো। কি যেন ভেবে আবারো ছুটে রুমে এলো। বালিশের তল থেকে চিঠি আর ফোনটা নিয়ে নিলো। ‘মিনি ড্রয়ার’ থেকে সিম নিয়ে বলকনিতে পাতানো চেয়ারে গিয়ে বসলো। আরুর বেলকনি থেকে পুরো রাস্তা দেখা যায়। আরু দেখলো,সোডিয়ামের আলোতে দূরে কারো অবময়। কানে ফোন গুজে প্রান খুলে হাঁসছে অবময়ের আগুন্তকঃ। নিশ্চিত প্রেম করছে! প্রথমে ভালো লাগলেও, হুট করে আরুর বুক হাহাকারে মাতলো। বুকে নামে বিভৎস যন্ত্রণা! এমন হাসির সাথে তো আরু-ও পরিচিত। আশিকের সাথে মেসেজিং করার সময় আরু এমন হাঁসতো। মিটিমিটি হাঁসতো। আরু কি আসলেই নির্বোধ?
সিম ডুকাতেই কতগুলো মেসেজ এলো আরুর ফোনে। আরু একে একে পড়লো মেসেজগুলো। মেসেজগুলো এসেছে আন্নন নাম্বর থেকে। ‘যদি চাও, ধন্যবাদ জানাতে পারো।’,’ওই মহিলা’, ‘কই ভাবলাম প্রেম করবো, মিস অরোনিতা তো ফোন’ই এখনো খোলেনি।’ এরকম কিছু মেসেজ।
আরু বুঝলো এগুলো কার কাজ। লোকটা ‘প্রেমের’ মানেও বোঝে? আরুর কেন হাসি পেলো। প্রেম না ছাই! কিচ্ছুটি তো ঘটে নেই। রুদ্র’র সাথে বড্ড বেমানান প্রেম শব্দটি। আচ্ছা, আজ কলেজের মেয়েগুলো যেভাবে রুদ্র’কে দেখছিলো; নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগেছে! লোকটার কতগুলো গর্লফ্রেন্ড থাকতে পারে? অনেকগুলো নিশ্চয়ই। থাকবেই তো। এভাবে হিরো সেজে গেলে কার না পছন্দ হয়?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অরু অবাক হলো। ধ্যাত! এগুলো ভাবছে কেন সে? নিজেকে পাগল মনে হচ্ছে আরুর। বিয়েটা ভন্ডুর করার কতোই না প্লান বানিয়েছে, আর এখন? বিয়েটা কি হয়ে যাবে? আচ্ছা, আরুর কি ভালো লাগছে লোকটাকে? নিজেকে কষে চড় দিতে মন চাইলো আরুর। এগুলো অবান্তর ভাবনা। এখন তার মুখ্য কাজ শাশুড়িকে ভড়কানো। আবারো দ্বিধা ঘিরলো আরুকে। আরু বিয়ে ভেঙে দেয়ার পর, রুদ্র যদি কলেজের মেয়ে গুলোর মধ্যে থেকে কাউকে বিয়ে করে নেয়?
আবারো নিজের চিন্তাকে গালমন্দ করলো আরু। করলে করবে! করুক বিয়ে। আরুর কি? ছোট করে রিপ্লাই দিলো আরু ,
‘ধন্যবাদ।’
ওপার থেকে রিপ্লাই এলো না। লোকটা কি ঘুমিয়ে পড়েছে? সবে তো আটটা বাজছে; এতো জলদি? আরু মাথা ঘামালো না এ বিষয়ে। যেথায় খুশি যাক! আরু ফেসবুকে লগ ইন করলো। ভিডিও দেখতে লাগলো মন দিয়ে। প্রায় দেড় ঘন্টা পর মেসেজ এলো,
‘শুধুই ধন্যবাদ?’
আরুর চোখ ছোটছোট তাকালো। আর কি শুনতে চায় লোকটা? ধন্যবাদ না বলে কি এটা বলা উচিত ছিলো, আসো বিয়ে করি, সংসার করি।’
আরু জিভ কাটলো। বিরক্ত হয়ে এবার সত্যিই নিজের গালে আলতো থাপ্পড় দিলো। দুনিয়ার এতো শব্দ থাকতে ‘বিয়ে’ ‘সংসার’ কেন আসছে চিন্তায়। অসহ্যকর! আরু লিখলো,
‘আর কি?’
‘তুমি এতো ইয়ে কেনো? কিচ্ছু বুঝ না।’
‘ইয়ে আবার কিয়ে? কি বুঝি না?’
‘এই মেয়ে এই, তুমি না পুরো ত্রিশ দিন প্রেম করেছো? তাও কিছু বোঝনা?’
আরু ভেবাচেকা খেলো। প্রেম করেছে মানেই কি সে ইয়ে’র মানে বুঝবে নাকি। আশ্চর্য! আরু রিপ্লাই দিলো না। যতক্ষন ভালো করে কথা না বলবে, ততক্ষন দেবেই না। আবারো রুদ্র’র মেসেজ আসলো,
‘কই ভাবলাম বিয়ের দু’দিন চুটিয়ে প্রেম করবো। চোখে বাঁধ দিয়ে রাত তিনটা-চারটা পর্যন্ত জেগে গল্প করবো। আর তুমি? এতোটুকু-ও রোমান্টিক নও।’
আরু বিমুঢ়! একচোখে চেয়ে আছে মেসেজটার দিকে। লোকটা প্রেম বিষয়ে জানে, রোমান্টিক বিষয়েও জানে, প্রেমিকার সাথে রাত জেগে কথা বলতে হয়; এটাও জানে! আরুর কপালে সূক্ষ্ম তিনটি ভাজ পড়লো। এই লোক সামনা-সামনি তো এক্কেবারে সুফি! নিষ্পাপ শিশু। আর ভেতরে ভেতরে এতো কিছু? নিশ্চয়ই প্রেম করে, করেছে অনেকগুলো। ইয়া মাবুদ! শেষে কি-না একটা প্লে-বয় এর সাথে আরুর বিয়ে হবে? আরুর ভেবেই ঘেমে উঠেছে। কপাল থেকে ঘাম মুছে শুকনো ডোগ গিলে লিখলো,
‘কতগুলো প্রেম করেছেন এ যাবত?’
ওপারে রুদ্র চমকালো, থমকে তাকিয়ে রইলো। কি বললো, আর উত্তর এলো কি! বেশ সময় নিয়ে লিখলো রুদ্র,
‘দু’টো।’
‘প্রেজেন্ট?’
‘না, প্রেজেন্ট অনলি ওয়ান।’
‘কে সে?’
‘তোমায় কেন বলবো?’
আরুর আজব লাগলো। সাথে হলো কপট রাগ। তাকে বলবে না তো কাকে বলবে? পরমুহূর্তে ভাবলো না বললে নাই। আরু চেয়ার ছাড়লো। রেলিং ঘেঁষে দাড়িয়ে আবারো ল্যাম্পপোস্টে উঁকি দিলো। অবময় নেই। ঠান্ডা বাতাস বইছে। আরু চুলগুলো মৃদু দুলছে। কেন জানি কৌতুহল জাগে রুদ্র’র ব্যাপারে। সবাইকে মুখের উপর সব কথা বলে দিতে পারলেও রুদ্র’কে বলতে পারেনা। কেন পারেনা? প্রথম দিন তো পেরেছিলো। আজকাল আরু পাল্টে যাচ্ছে। সে নিজেও বুঝছে। আলাপ চললো আর-ও দীর্ঘক্ষন।
উদোম শরীরে বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে রুদ্র। বিছানার তল থেকে ভাইব্রেট করা ফোনের ভিম ভিম শব্দে ঘুমের সুতো ছিড়লো। একপ্রকার তিক্ত মেজাজে বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করলো। অভ্র ফোন করেছে। রুদ্র ফোন রিসিভ করতেই ওপাড় থেকে আওয়াজ,
‘কাউকে রেকমেন্ড করেছেন স্যার?’
‘স্যার’ শব্দটি বুকে এসে লাগলো রুদ্র’র। বিষাদ এই শব্দতেই ঘুম কাটলো পুরোপুরি। তার ভাই তাকে ভাই ডাকেনা। স্নেহময় সম্পর্ক কি নিকষিত! রুদ্র নিঃশব্দে শ্বাস ছাড়লো। কাষ্ট কি কমলো? না! কমেনি। রুদ্র ছোট করে বললো,
‘না।’
‘দু’জন মেয়ে এসেছে। আপনার নাম’ই বলছে।’
রুদ্র’র মনে পড়লো আরুর কথা। তার কোন বান্ধুবিকে নিয়ে আসার কথা। রুদ্র বললো,
‘আচ্ছা। আমার আসতে দেড়ি হবে। ইন্টারভিউ নিয়ে নিও।’
‘জ্বি, স্যার।’ বলেই খট করে ফোন কেটে দিলো অভ্র।গহীন থেকে উঠে এলো আর-ও এক দীর্ঘশ্বাস রুদ্র’র! রুদ্র বিছানা ছাড়লো। আটটা বাজে। এতো বেলা অব্ধি ঘুমোয় না সে। কাল অনেক রাতে ঘুমোনো হয়েছে। কথা শেষ হয়েছে বারোটার কাছাকাছি। তবুও ঘুমোতে পারেনি রুদ্র। আরুর প্রতিটা কথা চিন্তা করতে করতেই সময় কেটে গেলো কর্পূরের মতো।
ওয়েটিং রুমে জুবুথুবু হয়ে বসে আরু, তানিয়া। আরুর ঘুমেতে চোখ বুজে আসছে। সকাল সকাল আরুকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এসেছে এই মেয়ে। এক দেখায় এতো প্রেম আসে কিভাবে? আরু বোঝেনা! বোঝার দরকার’ইবা কি? কেউ কি মুখচোরা, গম্ভীর লোকের প্রেমে পড়ে? পড়েনা! এই মেয়ে পড়েছে! আরে বাবা নিজের প্রেমের কথা সরাসরি বললেই তো পারে। এভাবে চাকরি-বাকরি করলেই কি হবে নাকি?
আরুর চিন্তার মাঝেই রুমে ডুকলেন করিম। তানিয়া আরও গুছিয়ে নিলো নিজেকে। যেন বললেই দৌড় দিবে এমন ভাব। করিম গম্ভীর মুখে বললেন,
‘ডাকছে আপনাকে।’
তানিয়া উঠে দাড়ালো। আরুর দিকে তাকিয়ে দেখলো,দিন-দুনিয়ার কোন হুস নেই আরুর। মাথা এলিয়ে চোখ বুজে ঝিমাচ্ছে। তানিয়া আরুকে এখানেই থাকতে বলে চলে গেলো করিম সাহেবের সাথে। তানিয়া, করিম সাহেবের সাথে অভ্রের রুমের সামনে গেলো। তানিয়াকে রেখে চলে গেলেন উনি। তানিয়া শুকনো ডোগ গিলে একবার নক্ করলো। ভেতর থেকে কোন সারা নেই। অভ্রের কক্ষ পুরোটা কাঁচের। সেখানে অবময় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। তানিয়া প্রতিবিম্ব দেখে আরও একটু ঠিক হয়ে নিলো। অভ্র যদি সেদিনের কথা ভেবে না করে?
‘মে আই কাম ইন স্যার?’ বললো তানিয়া।
‘ইয়েস।’
তানিয়ার বুক এতেই ধরফর করে উঠলো। দরজা আলতো সরিয়ে ভেতরে ডুকলো তানিয়া। অভ্র মন দিয়ে ল্যাপটপ ঘাটছে। অভ্রকে দেখলেই হৃদপিণ্ড লাফায় তানিয়ার। তানিয়া গুটিগুটি পায়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দু’পলক চেয়ে থাকলো নির্নিমেষে। এ যে চোখের তৃষ্ণা! এতো দেখতে কেন মন চায়?
‘বসুন।’
অভ্র’র গম্ভীর কন্ঠ। তানিয়া ধীরে সুস্থে বসলো। অভ্রের চোখ তখনো ল্যাপটপে। অভ্র কি তানিয়াকে দেখতে পাচ্ছে না? তানিয়া কত ফিটফাট হয়ে এসেছে; অথচ তাকাচ্ছেই না ছেলেটা। তানিয়া জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। বুকটা টিপটিপ করছে।
ল্যাপটপ থেকে চোখ ফেরাতেই যখন তানিয়াকে দেখলো অভ্র, ভ্রু জোড়া বেঁকে গেলো আপনা-আপনি। এটাতো সেই বজ্জাত মেয়েটা, যে ইট ছুঁড়েছিলো গাড়িতে। অভ্র নিজেকে সামলে নিলো। শান্ত স্বরেই জিজ্ঞেস করলো,
‘এখানে কি চাই আপনার?’
তানিয়া ভরকে গেলো। এটা কেমন প্রশ্ন? নিজেকে ধাতস্থ করে উত্তর দিলো তানিয়া,’কি আবার? চাকরির জন্য এসেছি।’
‘এখানেই কেন?’
‘আজব তো। যোগ্যতা থাকলে করবো না?’
‘যোগ্যতা? তা-ও আপনার! সিরিয়াসলি?’
অভ্রের কন্ঠে স্পষ্ট ঠাট্টা। তানিয়া কিছু বলার আগেই অভ্র আবারো বলে উঠলো,
‘এটা কোন মশকরার জায়গা নয়। গেট আউট!’
‘আপনার কি এটা মনে হচ্ছে, আমি মশকরা করতে এসেছি?’
অভ্র ল্যাপটপে আবারো চোখ রাখে। বলে,’অবশ্যই।’
‘আপনার তো দেখি ইন্টারভিউ নেয়ারও যোগ্যতা নেই।’
অভ্র চোখ তুলে তাকালো। শীতল দুটি চোখ। এই শীতল চোখদুটি’ই অন্তস্থ কাঁপিয়ে দিতে সক্ষম তানিয়ার। তার কেন জানি মনে হচ্ছে অভ্র রেগে গেছে। অভ্র থম মেরে বসে থেকে গলা খিঁচে বলে উঠলো,
‘হাউ ডেয়ার ইউ! কাকে কি বলছেন জানেন? আমি চাইলে এখনি বের করে দিতে আপনাকে।’
তানিয়া ভয় পেলেও প্রকাশ করলো না। ভয় পেলে চলবে না। তাকে রেকোমেন্ড করেছে সয়ং রুদ্র। অতো সহজ নাকি তাকে তাড়ানো? আটকানো স্বরে বললো তানিয়া,
‘ ঠ্ ঠিকিই ত্ তো বলেছি। এখনো তো কিছু জিজ্ঞেস ও করেননি। পর্সোনাল ইসু’র জন্য আপনি এমনটা করতে পারেন না।’
নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ৫+৬
‘ওহ্ রিয়েলি? ওকে, লেটস্ স্টার্ট..’
বলে একে একে প্রশ্নের ঝুড়ি খুললো অভ্র। তবে তেমন লাভ হলোনা; সব প্রশ্নের সঠিক জবাব সেকেন্ড বরাবর দিচ্ছে তানিয়া। প্রশ্ন পর্ব শেষ হতেই অভ্র বাকা হেঁসে বললো,
‘স্যারের হুট করে কেন লোক নিলো আমি জানি না। পোস্ট বলতে একটা পোস্ট-ই ফাঁকা আছে, আর সেটা আমার সেক্রেটারি। করবেন?’
‘একশোবার।’
হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো আনন্দ তানিয়ার কন্ঠে। অভ্র শব্দ করে কেশে উঠলো। মেয়েটা বলে কি!
