নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ২৩
ঝিলিক মল্লিক
আরবিনের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস রিদিকে আরো বেশি শোকাচ্ছান্ন করে দিচ্ছে। শোকের অতল গহ্বরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রিদি এখন আরবিনের পিঠের র’ ক্ত পরা বন্ধ করার চেষ্টা করছে।
উত্তেজনার বশে এবং আকস্মিক এমন দুর্ঘটনায় রিদি ভেবে পাচ্ছিল না, কিভাবে আরবিনের পিঠের গভীর ছোরাঘাতে পতিত স্থানের রক্ত পরা বন্ধ করা যায়। তখনই যেন বৈদ্যুতিক গতিতে মাথায় বুদ্ধি ক্ষুরধার হলো ওর। দ্রুত কাঁধের সেফটিপিন খুলে সেটা দিয়ে শাড়ির লম্বা আঁচলে কয়েক ইঞ্চি সমান জায়গা রেখে একটা টান দিলো জোরে৷ এতোটা জোরে যে, জামদানী শাড়ির আঁচলটি একটানেই অর্ধেক ছিঁড়ে গেল। অবশ্য সহজে পদদলিত হওয়ার মতোই কাপড় বটে!
রিদি কখনো আগে এতোটা জোর অনুভব করেনি নিজের ভেতর। এতোটা সাহসী হয়ে উঠতে পারেনি। অবশ্য সেই ইচ্ছা কোনোকালেই হয়নি ওর। ও এমন একজন মানুষ, যে সামাজিকতা প্রায় এড়িয়ে চলতে পারলেই বাঁচে। রিদির দর্শন হলো— জীবনটা নিজের। আমরা বাঁচবোও নিজেদের জন্য। নিজের খেয়ে, নিজের পরে কেন অন্যের গুণ গাইবো? কেন অন্যের জন্য মাথা ঘামাবো?
এজন্য সুযোগ পেয়েও কোনোদিন কোনো সামাজিক কাজ-বাজের ধারেকাছেও যায়নি রিদি। একবার ওর এক পরিচিতজনের ভীষণ রক্তের প্রয়োজন পরলো। AB- ব্লাড গ্রুপ। হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে বরাবরের মতোই রক্তের সংকীর্ণতা। রক্ত জোগাড়ের দায়-দায়িত্ব দেওয়া হলো রোগীর পরিবারের ওপরই। দুর্ভাগ্যবশত উপস্থিত কারো রক্তের গ্রুপের সাথে রোগীর রক্তের গ্রুপ মিলছিল না। রিদির রক্তের গ্রুপ একই ছিল এবং সে ওখানে উপস্থিতও ছিল। তবু ও মুখ ফুটে স্বীকার গেল না যে, ওর রক্তের গ্রুপ একই।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রিদির তখন রক্তদানের বয়স হয়েছে। শারীরিক গঠনও নেহাতই মন্দ নয়। চাইলেই ওর রক্ত নেওয়া যেতো। কিন্তু রিদি বরাবরের মতোই সেই মানবিকতার ধারেকাছেও ঘেঁষেনি।
তারপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে রক্তের সন্ধান মিললো একেবারে শেষ মুহূর্তে।
এমন একটা ঘটনা নয়, কাকাই মরার পর থেকে বিগত কিছু বছরে রিদি অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। মানবিকতা হারিয়েছে। কখনো মানবিক হওয়ার মতো সাহস দেখায়নি। দেশটাকে আপন করে নিতে পারেনি।
না আজও দেশটাকে আপন করতে পারলো না রিদি। বিশেষত আরবিনের এই অবস্থা দেখে। তবে রক্তদানের ওই কাহিনী মনে পরায় ভীষণ অনুশোচনায় ভুগতে লাগলো ও। এই অনুশোচনার দাম অবশ্য কেউ দেবে বলে মনে হয় না। বিশেষত, আরবিন যদি ঘুনাক্ষরেও কখনো রিদির এমন সব কাণ্ডকীর্তির কথা জানতে পারে; তখন যে কিভাবে রিদিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে তিরস্কার করবে— সেসব ভাবলেই বুক কাঁপে রিদির। দম বন্ধ হয়ে আসে৷ অস্থিরতা জেঁকে ধরে।
আরবিন সবে পিটপিট করে চোখ মেলেছে৷ রিদি ওর সাড়া পেয়ে যেন জানে পানি ফিরে পায়৷ আরেকটু এগিয়ে বসে উত্তেজিত কন্ঠে আরবিনের উদ্দেশ্যে বলে,
“ঠিক আছেন আপনি?”
“হুঁ। জ্ঞান হারিয়েছিলাম মাত্র। অ্যাগ্রেসিভ হওয়ার মতো কিছু হয়নি।”
আরবিন ধীরে জবাব দেয়ম রিদি তবু বিশ্বাস করে না আরবিনের কথা। আশ্বস্ত হতে পারে না। আজ নিজেকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে আরবিনের সামনে৷ আচ্ছা আরবিন কী তা শুনতে পেয়েছে?
রিদি ঠিক করলো, আরবিন যদি এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করে; তাহলে রিদি জানাবে, ঝোঁকের বশে বলে ফেলেছে ওসব।
না, আরবিন তেমন কিছুই জিজ্ঞাসা করলো না। মুখ চড়া লোকটার অবশ্যই জিজ্ঞাসা করার কথা ছিল। তাহলে শুনতে পাইনি নিশ্চয়ই। রিদি গা ঘেঁষলো আরো। আবহাওয়া অনুকূলে। রিদির মনের পরিস্থিতি ভালো নেই। আরবিনের গালে ঠান্ডা হাতটা রেখে এবার ও বলে ওঠে,
“পিঠের ব্যাথা কেমন?”
“আহামরি কিছু নয়।”
কথাটা বলে আরবিন উঠে বসার চেষ্টা করে৷ রিদি ওর বুকে দুই হাতে আঁকড়ে ধরে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করে বলে,
“উঠছেন কেন এখন?”
“বাইরে যাওয়া প্রয়োজন এখন একটু। পরিস্থিতি বুঝে আসি।”
“না, এখন আপনার কোথাও যাওয়া হচ্ছে না। চুপ করে শুয়ে থাকুন।”
“বললেই হলো নাকি? দেখো রিদি, আমাকে কোনো বাঁধাধারা নিয়মের মধ্যে বাঁধতে চাইবে না। আমি আমার মর্জিমতো চলি। আমার মর্জিতে অন্যের হস্তক্ষেপ পছন্দ করি না। সে যেকোউ হোক না কেন!”
‘যে-কেউ’ শব্দটার ওপর একটু বেশি জোর দিয়ে কথাটা বলে উঠে দাঁড়ায় আরবিন। রিদি কিছুক্ষণ ভ্রুক্ষেপহীনভাবে তাকিয়ে দেখে ওকে। বিষন্ন মন আরো বিষিয়ে ওঠে। আরবিন বাইরের দিকে যেতে যেতে বলে,
“চুপ করে বসে থাকবে ওখানে। একটুও নড়াচড়া করবে না। ওরা ওঁত পেতে বসে থাকতে পারে আশেপাশে। বলা যায় না। সাবধানের মার নেই।”
রিদি কোনো পাল্টা জবাব দিলো না আরবিনের কথায়। একটু কাঁত হলো ও। শরীরটা বড্ড ক্লান্ত লাগছে। গায়ে আর একরত্তি শক্তি নেই বসে থাকবার৷ দমকা হাওয়া বাইরে থেকে কিছুক্ষণ পরপর ভেতরে প্রবেশ করে খড়কুটো এলোমেলো করে দিচ্ছে এদিক-ওদিক। সেই খড়ের গাদায় শুয়ে বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো রিদি। অন্ধকার কুঠি। গা ছমছমে পরিবেশ। ঝড়ো হাওয়া। বাইরে শত্রুরা। বর্তমানে স্বামী নামক একমাত্র ছায়াটি ধারেকাছে নেই। রিদি ভয়টা বেশ ভালোই পেল। সূরা-কালাম পড়ে বুকে ফুঁক দিতে লাগলো বারবার। ভীতসন্ত্রস্ত এবং সতর্ক দৃষ্টিতে আশেপাশের পরিবেশ অবলোকন করতে ব্যস্ত হলো তখনই আরবিন ফিরলো দ্রুত পায়ে হেঁটে। কুঠির ভেতরে ঢুকে বেড়া দিয়ে বানানো দরজাটা ভেড়িয়ে দিয়ে ভেতরে এসে বসতেই তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো রিদি। আরবিন তখন ক্লান্ত-শ্রান্ত। মুখ ঘেমে-নেয়ে একাকার অবশ্য। হাতের পেশিতে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। হঠাৎ রিদির শাড়ির আঁচল টেনে মুখ, হাতের বাহু মুছতে লাগলো আরবিন। রিদি কিছু বললো না তৎক্ষনাৎ। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কিছুক্ষণ আরবিনের কাজকর্মকে সায় দিয়ে বললো,
“কী করতে গিয়েছিলেন বাইরে?”
“দেখতে গিয়েছিলাম, ওরা আছে কিনা। খুব সতর্কভাবে খোঁজ নিতে হয়েছে। চারপাশটা ভালোভাবে ঘুরে আসলাম। এই অঞ্চলের ধারেকাছেও সম্ভবত নেই ওরা। যেহেতু দু’জন জখম হয়েছে, সেই হিসাবে না থাকারই কথা।”
“আপনি বুঝলেন কীভাবে? ওরা জখম হয়েছে?”
“আমি অনেককিছুই বুঝি। যা তুমি বোঝো না। বোঝার কথাও নয়। কারণ তুমি আমার প্রফেশনে নেই। ওরা হচ্ছে মুরগী। গর্দভ। কাঁচা খিলাড়ি৷ সম্ভবত পর্যাপ্ত অস্ত্রসস্ত্র ছিল না ওদের কাছে৷ তাই রাতের আঁধারের সুযোগ নিয়ে দু’টো খেলনা পিস্তল আর দু’টো আসল পিস্তল নিয়ে এসেছিল হামলা করতে। ভেবেছিল, রাতের আঁধার তো! লেফটেন্যান্ট আরবিন ধরতে পারবে না। হাউ রিডিকিউলাস! ফানি না?”
“হুঁ।”
“আমি ইচ্ছাকৃতভাবে এলোপাতাড়ি বু’লেট ছুঁড়েছিলাম। যাতে গু’রুতর না হলেও ঘায়েল হওয়ার মতো জখম হয় ওরা। আর তাই-ই হয়েছে। যেই পথ দিয়ে এখানে এসেছিলাম, সেই পথের শুরুতে সড়কের কাছটাতে রক্তের খোঁজ পেয়েছি। খুব বেশি নয়। তবে চোখে লাগার মতোই।”
“আমরা এখান থেকে ফিরবো কখন?”
“ড্রাইভারকে ইশারা করে বলেছিলাম, সুযোগ বুঝে যেন একটু সামনের দিকে এগিয়ে যায় মাইক্রো নিয়ে কারণ, আমার লাগেজের মধ্যে এক্সুয়ালি-ই কিছু ডকুমেন্টস ছিল। ইম্পর্ট্যান্ট বা সিক্রেট নয়৷ তবে আমাদের টিমের৷ ওগুলো ওরা কোনোভাবে গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে খুঁজে পেলে পরে ঝামেলায় পরতে হতো আমাকে। এজন্য ড্রাইভারকে ইশারা করেছিলাম, সামনে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করতে৷ আমরা ফিরবো অবশ্যই। কিন্তু ব্যাটা যে কি বুঝেছে কে জানে! সড়কপথের অনেকটা দূর এগিয়ে গিয়েও কোনো খোঁজ পেলাম না মাইক্রোবাস, ড্রাইভার কারো৷ এখানে আবার নেটওয়ার্ক টাওয়ার নেই বহুদূর পর্যন্ত। কোনো নেটওয়ার্কও পাচ্ছি না। সুতরাং, ভোর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। ভোরে এখান থেকে বের হবো।”
রিদি এবার সোজা হয়ে বসলো। আরবিনের মুখোমুখি। ওর চোখে চোখ রাখলো দৃঢ়ভাবে। ওই চোখে বরাবরের মতোই নেই কোনো সংকোচ, আড়ষ্টভাব কিংবা অস্পষ্টতা। স্বচ্ছ পরিষ্কার গলায় রিদি আরবিনকে বললো,
“তাকান আমার দিকে।”
“তাকালাম।”
আরবিন বিনা দ্বিধায়, বিনা তর্কে রিদির দিকে তাকালো। ওর সরু চোখের দিকে। ওই দৃষ্টিতে খেলা করছে একরাশ চাপা অনুভূতি। সেটা যে কি, তা এখনো বুঝে আসছে না আরবিনের। রিদি এবার ওর হাতের মুঠোর নিজের হাত গলিয়ে আরবিনের বুক ঘেঁষে বসলো৷ আরবিনের হাতদুটো নিজের কোমরে পেঁচিয়ে নিলো শক্ত করে। ওর হালকা খোঁচা খোঁচা দাঁড়িযুক্ত মুখে নিজের নরম মুখ ঘষে বললো,
“একটা প্রশ্ন করলে জবাব দেবেন?”
“করার মতো হলে করো।”
আরবিনের নির্বিঘ্ন স্থির জবাব৷ কিছুটা ভরাট গলা৷ রিদি এবার কিছুটা অভিমান বা অভিনয় — যা-ইহোক দেখানোর চেষ্টা করে বলে,
“একদম আমার কাকিমণির মতো করে কথা বলেন। ভীষণ কঠোর। শুনুন না।”
“বলুন।”
আরবিন জবাব দিলো স্বাভাবিকভাবেই। রিদি এবার ভীষণ আহ্লাদ দেখিয়ে আরবিনের গলা জড়িয়ে ধরলো দুই হাতে। তারপর ওর অনেকটা নিকটে গিয়ে প্রশ্ন করলো,
“আজ যারা এভাবে আপনার ওপর হা’ মলা করার চেষ্টা করেছে, ওরা কারা?”
“আমি জানি না রিদি।”
আরবিন যেন এমন প্রশ্ন-ই আশা করেছিল রিদির কাছ থেকে। তাই প্রশ্ন করার সাথে সাথে এক বাক্যে জবাব দিলো ও। রিদি হতাশ হলো। তবু আরবিনের গলা ছাড়লো না। আরো গাঢ়ভাবে স্পর্শ করলো। এতে যদি পাষাণ পুরুষের মন গলে! তারপর স্তিমিত কন্ঠে আবারও বলে,
“আপনি জানেন। বলুন না!”
“আমি সত্যিই জানি না রিদি৷ জানলে অবশ্যই তোমাকে জানাতাম। তবে যতদূর ধারণা করতে পারছি, ওরা ছিনতাইকারী ছিল। আমার ওপর কোনো ব্যক্তিগত বা কর্মসূত্রে আক্রোশ নেই ওদের।”
রিদি মানলো না। আরো শক্তভাবে চেপে ধরলো আরবিনের গলা। এবার পেছন থেকে চুলের মুঠো। ওর কোলের ওপরে বসেই বললো,
“মিথ্যে বলবেন না আমার সাথে। একদম মিথ্যে বলবেন না! ওরা আপনার কাজের জন্যই আপনাকে আক্রমণ করতে এসেছিল। সবটা জানেন আপনি। খুব ভালোভাবে জানেন। অস্বীকার করতে পারবেন?”
আরবিন এবার অন্য পন্থা অবলম্বন করলো৷ যাকে যেভাবে জব্দ করা যায় আরকি! যেমন চতুরতা আর ধূর্ততার খেলায় রিদি মেতেছে, সেই খেলাতেই ওকে বাজিমাত করার পালা। রিদির প্রশ্রয়কে অবগাহন করে ওর চুল আঁকড়ে ধরলো আরবিন। আরেক হাত শক্ত শাড়ি ভেদ করে কোমরে চেপে ধরতেই কিঞ্চিৎ শব্দ করে ওঠে রিদি। সরে যেতে চায়। পালাতে চায়। আরবিন আরো কাছে টেনে নেয় ওকে। ওর গলায় হালকা খোঁচা দাঁড়িযুক্ত গাল ঘষে উষ্ণ কন্ঠে বলে,
“আহা! ছাড়ো না ওসব। ঘরের বউ তুমি। পরিবেশ, আবহাওয়া, মুহূর্ত — সব-ই ভালো। কোথায় স্বামীর কাছাকাছি থাকবে। তাকে ভালোবাসবে৷ তা না, কখন থেকে সব উৎকট প্রশ্ন করে যাচ্ছো। এসবের কী কোনো মানে হয়ে বলো?”
“খুব হয়। বলুন, ওরা আপনার ওপর আপনার প্রফেশনাল ম্যাটারের জন্য-ই আক্রমণ করেছে। একথা কী সত্যি নয়।”
আরবিন বিজ্ঞদের মতো সামনের দিকে মাথা নাড়ায়। যার অর্থ, ”হ্যাঁ খুব সত্যি।” রিদি কথাটা শোনা মাত্রই আরবিনের হাতের পেশি খামচে ধরে ধারালো নখ দিয়ে। তারপর হিংস্র বাঘিনীর ন্যায় ওর বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পরে ওর শার্ট টেনেহিঁচড়ে চিল্লাপাল্লা করে একাকার অবস্থা। চেঁচাতে চেঁচাতে বলে,
“আপনি এই প্রফেশন ছাড়বেন। আজ-ই। এখুনি। কীভাবে কি করবেন জানি না। কিন্তু আমি আপনাকে আর একমুহূর্তও এই জবে দেখতে চাই না। একমুহূর্তও না।”
“উহ কি করছো! পাগল হলে নাকি?”
চেঁচামেচি করে হাঁপিয়ে উঠলো রিদি। তারপরই সুর করে কাঁদতে বসে গেল। আরবিন এতোক্ষণ বেশ শান্ত আর চুপচাপ থাকার যথেষ্ট চেষ্টা করেছে ধৈর্য ধরে। কিন্তু সবসময় কী আর ধৈর্যে কুলায় সবকিছু? সহ্যসীমা-ই বা কতক্ষণ থাকে?
“চুপ বেয়াদব! একদম চুপ! কান্নাকাটির নয়েজ যেন আমার কানে না আসে বলে রাখছি।”
রিদি তবু কান্না থামালো না। ওই কান্না এখন থামবে বলে মনেও হয় না। আরবিন এবার কিছুটা জোরে হৃদয় কাঁপানোর মতো শব্দে দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো,
“ওই জব আমি ছাড়বো না। কখনোই না৷ নো নেভার! তোমার যদি এতোই অসুবিধা হয়, তাহলে তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারো। যাও, আর আঁটকাবো না তোমাকে। মুক্ত করে দিলাম। যা খুশি করো। ডিভোর্স দিতে চাইলে দিতে পারো৷ কোনো অসুবিধা নেই তাতে।”
আরবিন সরলো কিছুটা। রিদি কান্না থামিয়ে এবার কিছুক্ষণ এক নাগাড়ে চেয়ে থাকলো আরবিনের কঠোর মুখপানে। ওখানে কোনো সহানুভূতি, ভালোবাসা, আকাঙ্ক্ষা নেই। রিদির খুব রাগ হলো। খুব! হঠাৎ আরবিনের ওপর ঝাঁপিয়ে পরে ওর শার্টের কলার চেপে ধরে বললো,
“আপনি কখনো আমার কথা ভাবেন না। কখনো না!”
“না, ভাবি না। ভাববার মতো কেউ তুমি?”
“কেউ না বলছেন?”
“না কেউ না।”
বাকবিতন্ডতার মধ্যেই আরবিন হঠাৎ রিদিকে খড়ের গাদায় নিজের শরীরের নিচে টেনে নিলো। রিদিও সায় দিলো। তপ্ত, দু’জনের জ্বলন্ত হৃদয়ের দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা অনল বুঝি দপ করে নিভে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। সুযোগ খুঁজছিল। রিদি আরবিনের গলা জড়িয়ে ধরে টেনে ওকে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। আরবিন নিজের শরীরের নিচে প্রায় পিষে ফেললো ওকে। রিদি তাতে একটুও হতচকিত হলো না আজ। সংকুচিত হলো না ওর ছোট্ট কায়া। আড়ষ্ট ভাবটাও আর আগের মতো নেই৷ শুধু ছলছলে দৃষ্টিতে আরবিনের দিকে তাকিয়ে থাকলো ও। আরো গভীরভাবে আঁকড়ে ধরলো আরবিনের গলা। দু’জনের নিঃশ্বাস মিলেমিশে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিবিধি ঠাহর করা যায় বুঝি। আরবিন তখন রিদিকে অনাবৃত করতে ব্যস্ত। তুমুল ঝগড়াঝাটির মধ্যেই কখন যে অজান্তে তারা একত্র হলো; তা দু’জনেই প্রথমে ধরে উঠতে পারলো না। রিদির রাগ, আক্রোশ যতটা ছিল; আরবিনের ছোঁয়া পেয়ে তা পুরোপুরি মিইয়ে গেল৷ জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড যেন নিভলো মাত্র। আরবিন রিদির উন্মুক্ত কাঁধে ওষ্ঠদ্বয় চেপে ধরে নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে থাকলো অনেকক্ষণ। রিদি এবার মুখ ঘুরিয়ে আরবিনের চোখে চোখ রেখে অভিমানি সুরে বলে,
“আপনি আমাকে ভালোবাসেন না৷ একটুও ভালোবাসেন না!”
“না বাসি না। ”
“কখনোই ভাবেন না আমার কথা।”
“আসলেই ভাবি না।”
“কখনোই আমাকে একটু আদর করেন না।”
“করি না তো।”
জবাবটা দিয়ে রিদির হাতের বাহু ধরে ওকে একেবারে কাছে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো আরবিন৷ আজ ও রিদিকে খুব আদর করলো। দীর্ঘক্ষণ ঠোঁটে চুমু খেল। এই সময়কালটা দীর্ঘ হলো। উন্মত্তের ন্যায় দু’জন দু’জনকে আঁকড়ে ধরে আরো একবার বোঝাপড়া করতে চাইলো বোধহয়। রিদির আর আক্রোশটা নেই তেমন। কেমন যেন ঠান্ডা শীতল বরফের মতো হয়ে গেছে ও। ভীষণ চুপচাপ। আবেশে চোখ বুঁজে নিয়েছে৷ আরবিনের চুল মুঠিতে চেপে ধরে ওর বুকে মুখ গুঁজে পরে রইলো অনেকটা সময়।
নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ২২
আরবিন কিছু বললো না। শুধু ওর সর্বাঙ্গে অবগাহন করতে লাগলো। রিদির ঠোঁট আরো অনেকটা সময় নিয়ে ভিজিয়ে দিয়ে সস্নেহে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“তুমি থাকবে কি না থাকবে সেটা তোমার ইচ্ছা। আমার কাজ আমাকে করতে দেবে৷ খবরদার, বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করবে ন কখনো। আদর করে কাছে টানলে তখন খুব শান্ত থাকো। অন্যসময় কী হয়? সারাক্ষণ আমি থাকবো আদর করে সামলে রাখার জন্য?’