নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ২৬

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ২৬
ঝিলিক মল্লিক

আরবিন ছিল ক্যান্টনমেন্টে। ইউনিট কমান্ডার আবদুল মুহিত স্যারের অফিস কক্ষের ভেতরে চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছে ও। কিছুক্ষণ পরপর ঘড়িতে সময় দেখছে।
আজ সকালটা খুব একটা ভালো যায়নি ওর। রাতে ঘুমাতে পারেনি ঠিকমতো। বেশ কিছু ফাইল, ডকুমেন্টস জমা হয়ে ছিল। একবারে সেগুলো ক্লিয়ার করতে গিয়েই হিমশিম খেয়েছে আরবিন। তবে হাল ছাড়েনি। কফির পর কফি গিলে সারারাত বসে ঘাড়, ল্যাপটপে চোখ রেখে মাথা ব্যাথা করে সেগুলো শেষ করেছে। ভোরের দিকে ঘুমিয়েছিল আড়াই ঘন্টার মতো। তারপর উঠেই স্যারের কল পেয়ে সোজা ক্যান্টনমেন্টে আসা।

অনেকক্ষণ হলো আরবিন এসে বসেছে এখানে। অপেক্ষা করছে। বেশ বিরক্তও লাগছে ওর। অপেক্ষা করানো চরম অপছন্দ করে আরবিন। সে যেকেউ হোক না কেন। তবু কিছু করার নেই। আবদুল মুহিত স্যার আরবিনের নিকট খুবই সম্মানীয় ব্যক্তি। রসিকতা করে কাজের বাইরে বা কাজের ফাঁকে মাঝেমধ্যে দু’টো কথা বললেও রাগ-ক্ষোভের বশে তাকে কখনোই কোনোকিছু বলতে পারে না আরবিন। অন্যান্য অফিসাররা মাঝেমধ্যে নালিশ করলেও আরবিনের দ্বারা হয় না এসব। স্যার এখনো এসে পৌঁছায়নি দেখে আরবিন ফোন বের করলো পকেট থেকে। ডাটা অন করে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে সোজা সাব্বিরকে মেসেজ লিখলো। মেসেজটা এমন—

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তোমার আসতে এতো লেইট হচ্ছে কেন? স্যার এসে বসে আছেন অনেকক্ষণ। আমার সাথে আলোচনা করছেন। তুমি এখনো আসোনি দেখে রাগারাগি করছেন। যেখানেই থাকো, পাঁচ মিনিটের মধ্যে স্যারের অফিসে চলে আসো।”
লম্বা মেসেজটা টাইপ করে সেন্ট করার পর নিশ্চিন্ত হয়ে বসলো আরবিন। হাত দু’টো টানটান করে হাই তুললো। বিরক্তিকর একটা দিন। না জানি বাকি পনেরো ঘন্টা কীভাবে কাটে!
সাব্বির অফিস রুমে আসলো আরবিন মেসেজ দেওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই৷ একদম ঠিকঠাক টাইমে।৷ প্রচুর হাঁপাচ্ছে ও। খুব তাড়াহুড়ো করে এসেছে বোঝাই যাচ্ছে। বুকে হাত দিয়ে জোরে বারকয়েক শ্বাস টেনে শান্ত হয়ে নিলো সাব্বির। সামনে টেবিলের অপর পাশে আবদুল মুহিত স্যারের রয়্যাল চেয়ারটা খালি দেখে ভ্রু কুঁচকে আরবিনকে বললো,

“ক্যাপ্টেন আপনি যে বললেন, স্যার এসেছেন। আমাকে খুঁজছেন, রাগারাগি করছেন। কিন্তু স্যার কোথায়? চেয়ার তো খালি।”
সাব্বিরের বোকা বোকা প্রশ্ন শুনে ক্রুর হাসে আরবিন। ঘাড় ঘুরিয়ে বসে সাব্বিরের দিকে তাকিয়ে বলে,
“মিরাজ কাকার টঙের দোকানে বসে সিগারেট খাচ্ছিলে না?”
“জি ক্যাপ্টেন!”
সাব্বির মাথা নত করে জবাব দেয়৷ আরবিন এবার কিছুটা রাশভারী গলায় বলে,
“ডিউটি আওয়ারের বাইরে ওখানে যাবে না। স্যার জানতে পারলে রাগারাগি করবেন। ডিউটি টাইম যখন শেষ হবে, তখন যেতে পারো কোনো অসুবিধা নেই। তোমাকে এখানে আসতে বলা হয়েছে আরো আগে। আর তুমি সেসবের পরোয়া না করে ওখানে চলে গেছো? স্যার দেরিতে আসুক, তবু তার কমান্ড অনুযায়ী এখানে এসে অপেক্ষা করবে। ইট’স ইওর ডিউটি। ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?”

“ইয়েস স্যার!”
সাব্বির স্ট্রেইট দাঁড়িয়ে জবাব দিলো৷ আরবিন শান্ত হলো এবার। সাব্বিরের দিকে পাশের চেয়ারটা টেনে দিলো৷ সাব্বির গিয়ে বসলো সেখানে। তখনই আরবিনের সেলফোন ক্রিংক্রিং শব্দে কেঁপে উঠলো। আরবিন ফোন তুলে স্ক্রিনে নাম্বারটা দেখতেই চেয়ার ছেড়ে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে সাব্বিরের দিকে ঘুরে বললো,
“তুমি বসো। আমি আসছি পাঁচ মিনিটে।”
আরবিন বের হয়ে গেল অফিস রুম থেকে। বাইরে করিডোরের রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে ফোনকল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে যেন ঝড় উঠলো। না, কালবৈশাখীর ঝড় নয়। এটাকে বলা যায়, কথার ঝড়। কায়েস ফোনের ওপাশ থেকে রীতিমতো ধমকাধমকি করে বললো,

“তুই কই ছিলি রে ভাই? বিয়ের পর তো তোর পাত্তা-টাত্তাই পাই না। কোনে নিরুদ্দেশ হলি?”
“তোর সাথে আমার রবিবার সন্ধ্যায়ও টানা সাড়ে তিন ঘন্টার মতো কথা হয়েছে কায়েস। এমনকি মাসের মধ্যে দু-একদিন বাদে প্রতিদিনই হয়। বিয়ে হয়েছে ছয় মাসের বেশি। তাহলে তুই হিসাব কর, তোর সাথে আমি কতদিন কথা বলিনি।”
রাশভারী কন্ঠে আরবিন জবাবটা দিতেই কায়েস হিসাব করতে বসে গেল। সেকেন্ড পঞ্চাশেক পরে বললো,
“এইতো প্রায় তিনদিন হবে। তোকে তো গ্রুপেও পাইনি।”
“মাত্র তিনদিন! তাতেই এতো হাইপার হচ্ছিস কেন?”
“আরে বন্ধু তোকে ছাড়া আড্ডা জমে নাকি?”
“আমি একটু ঝামেলায় ছিলাম গত কয়েকদিন। এমনকি এখনও আছি। তারমধ্যে আরেকটা ঝামেলা ঘাড়ে চেপেছে।”
“কী ঝামেলা?”

কায়েস কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলো। আরবিন বললো,
“প্রফেশনাল লাইফে কিছু ঝামেলা চলছে। ওসব বাদ দে। তোর কথা বল।”
আরবিন কথা এড়াতে চাইলো। কিন্তু কায়েস চেপে ধরলো ওকে। বললো,
“প্রফেশনাল ঝামেলা না-হয় বাদ দিলাম। আরেকটা ঝামেলা কী? তোর ওয়াইফকে এনেছিস নাকি?”
“হুঁ।”
“কিন্তু এই ব্যাপারটা আবার ঝামেলা হলো ক্যামনে? তুই না সবকিছু ঠিকঠাক করে নেওয়ার প্ল্যানিং করেছিলি?”
“করেছিলাম। আসার সময় অবধিও। কিন্তু মাঝপথে আমার মত পাল্টে গেছে। ওকে দিয়েই আমি ডিভোর্সের প্রসেসিংটা করাবো।”

“মানে? আবার কী হয়েছে তোদের মধ্যে? ভাই, তোরা দু’টো কী ভালো হবি না?”
“আমি আমার জায়গায় ঠিকঠাক আছি কায়েস। কিন্তু পরিস্থিতি আর ও ঠিক নেই। আর ওর ঠিক হওয়ার সম্ভবনাও দেখি না। তারপর আবার এরমধ্যে বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে। সেসব বাদ দিই। তোর কী খবর?”
“আরে আমার খবর ছাড় দোস্ত। তোর কথাবার্তা শুনেই তো আমার মাথা আউলা-ঝাউলা লাগতেছে। তোরা তার মানে সত্যিই আলাদা হয়ে যাবি? আর কোনো সুযোগ নেই?”
“সুযোগটা আমি হতে দিচ্ছি না। ইভেন ফিউচারেও দেবো না। ওকে আমার সাথে না জড়ানোই বেটার। যতটুকু জড়িয়ে ফেলেছি, সবকিছু ভুল। ভুলেও গেছি। আমরা আলাদা-ই ভালো থাকবো। ও আমার জন্য একটা অশান্তি। ওর অনেক দোষ-ত্রুটি আছে৷ ভুল করেছে বারবার। ওকে লাস্ট টাইম একটা উচিত শিক্ষা দিয়ে তবে ছেড়েছি। তারপর আর মনে হয় না, ও আমার প্রতি আর দুর্বল হবে। বরং, নিজের পথ বেছে নেবে। নিক। আমি শুধু এটুকুই চাই, ও আমার থেকে দূরে সরে যাক।”

“কিন্তু তোর হঠাৎ এমনটা চাওয়ার মানে কী? তুই তো বলেছিলি, ওকে বুঝাবি। আর এটাও বলেছিলি, কিছুদিন কাছাকাছি থেকে বোঝালে ও শিওর বুঝবে। তাহলে হঠাৎ তোর এমন মত পরিবর্তন হওয়ার কারণ কী?”
“ঢাকা থেকে সিলেট আসার পথে আমাদের ওপর হা’ মলা হয়েছিল কায়েস। সাথে ও ছিল। ওকেও জড়ানো হয়েছিল।”
আরবিন শান্ত স্বরে কথাটা বলে। কায়েস উত্তেজিত হয়ে এবার তড়িঘড়ি করে বললো,
“তারমানে তুই..”
“ফোন রাখছি। কমান্ডার স্যার আসছেন। উনার সাথে কথা বলতে হবে। কোয়ার্টারে ফিরে সন্ধ্যার পরে মেসেজ দেবো।”
আরবিন ফোন কেটে দিলো। যথেষ্ট বলা হয়েছে কায়েসকে। বরং অনেককিছুই বলে দিয়েছে৷ কায়েস ফোন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। ও নিজেও খুব ভালো করে জানে, পরবর্তীতে আরবিন আর এই টপিক উঠাবে না। বরং এড়িয়ে যাবে যথাসম্ভব।

আবদুল মুহিত স্যার সামনে একটা ছোট রাবারের বল কাঁচের টেবিলের ওপর এক হাতে ঘোরাচ্ছেন দক্ষতার সাথে। আরবিন আর সাব্বির চেয়ারে বসে চুপচাপ দেখছে তার কাজকর্ম। আরবিন এবার মুখ খুললো,
“স্যার, আই থিংক এটা তার কাজ।”
সাব্বির আরবিনের কথা শুনে চমকে উঠে ওর দিকে ফিরে প্রশ্ন করলো,
“মেজর? মেজর কেন এমনটা করবেন?!”
“এখন মেজর-টেজর ছাড়ো। তাকে যে বরখাস্ত করা হয়েছে মাস দুয়েক আগে, তা কী ভুলতে বসেছো?”
সাব্বিরের কথার জবাবটা বেশ রুক্ষভাবে দিলেন ইউনিট কমান্ডার আবদুল মুহিত স্যার। আরবিনও তার সাথে মাথা নাড়িয়ে সহমত জানালো। সাব্বির চেহারায় অনুতপ্ততার ভাব এনে “স্যরি” বলে মাথা ঝাঁকালো৷ আবদুল মুহিত এবার আরবিনের দিকে ফিরে বললেন,

“তুমি এতোটা নিশ্চিন্ত হচ্ছো কীভাবে?”
“অনেকগুলো পয়েন্ট আছে স্যার। আর আমি অল পয়েন্ট অব ভিউ থেকেই ভেবে দেখেছি প্রথম দিনেই। ও যেই সংস্থার হয়ে দালালি করতো, তারা এখনো এক্টিভ। ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমনকি ওদের টার্গেট করা ডকুমেন্টসগুলো এখনও আমাদের কাছে রয়েছে। তাছাড়াও নেওয়াজ, হাতেম এরা আমাদের টিম মেম্বার। আমরাও ওর চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়ার কারণ— এটা অনেকেই জানে৷ এমনকি ও তো খুব ভালোভাবে জানে। পরপর আমাদের টিম মেম্বারদের সবার ওপর হা’ মলা হচ্ছে। আমাদেরকে দীর্ঘ সময় ধরে ফলো করা হচ্ছে। ঢাকা থেকে ফেরার পথে ঘটনা ঘটার আগে পর্যন্তও আমি আন্দাজ করতে পারিনি৷ কিন্তু পরে খুব সূক্ষ্মভাবে ভেবে দেখলাম। ম্যাথ সলিউশনে ওর নামটাই সবার আগে উঠে আসছে৷ আর এখন ওর দলবল আরো বেশি ভারী এবং সিচুয়েশন ডেঞ্জারাস লাইনে আপ-ডাউন করছে।”

কথাগুলো বলে থামে আরবিন। জোরে শ্বাস নেয় কয়েকবার। আবদুল মুহিত কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে বলেন,
“প্রুফ ছাড়া কোনো কথা তোলা যাবে না আরবিন। গতবারও খুব বেশি প্রমাণের অভাবে ওকে শুধুমাত্র চাকরি হতে বরখাস্ত করার ব্যবস্থা করতে পেরেছি। এ নিয়ে হৈচৈ যদিও কম হয়নি। পুরো ক্যান্টনমেন্টে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। তবে যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হয়নি। এবারের বিষয়টা খুবই সেনসিটিভ। তাই বুঝেশুনে কথা বলতে হবে। আর তোমার ধারণা যদি সঠিক হয়, তাহলে ওকে দেশদ্রো’হিতার মামলায় শাস্তি পাওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবে না।”
আরবিন এবার কিছুটা ভেবে বললো,

“স্যার, প্রুফ তেমন হাতে আসেনি এখনো৷ আমি যথাযথ চেষ্টা করে যাচ্ছি। খুব শীঘ্রই আপনাকে জানাবো। তবে আপাতত এটুকু জেনে রাখুন, ও ফেরার। মানে নিজের বাসায় নেই। ও যেই বাসায় এখন ফ্যামিলি নিয়ে থাকে, সেখানে একজনকে ছদ্মবেশে পাঠিয়েছিলাম। জানা গেছে, ও নাকি এখন ব্যবসা করছে৷ আর ব্যবসার কাজে চট্টগ্রাম গেছে। যদিও কথাটা আমার বিশ্বাস হয়নি।”
আবদুল মুহিত এবার বেশ রাশভারী কন্ঠে বললেন,
“তুমি এতোটা শিওর হচ্ছো কীভাবে ওর বিষয়ে?”
আরবিন এবার উঠে দাঁড়ালো। টেবিলের ওপর দুই হাত রেখে বললো,

“স্যার, আপনারা এতো বছরে ওকে না চিনলেও আমি কিন্তু মাত্র চার মাসেই চিনে গিয়েছিলাম ওকে৷ একথা অস্বীকার করতে পারবেন? আমি-ই সর্বপ্রথম ওর কার্যকলাপ তুলে ধরেছিলাম অথোরিটির সামনে। তাছাড়াও ও আমাকে সবচেয়ে বড় শত্রু মনে করে৷ সে হিসেবে আমিও ওকে শত্রু ধরে নিয়েছি। আমার দেশের শত্রু। সেই হিসেবে শত্রুর গতিবিধি সম্পর্কে সচেতন থাকা একজন আর্মাড অফিসারের ডিউটি। আশা করি, বুঝবেন।”
আরবিন কিছুটা ক্ষোভ নিয়েই কথাটা বললো। আবদুল মুহিত এবার মৃদু হেসে ওকে শান্ত করতে বললেন,
“আরো বসো বসো। কথায় কথায় এতো তেতে ওঠো কেন বাপ? আমাকেও মেজাজ দেখাতে ছাড়ো না৷ তোমাকে কবে অথোরিটি ধরে বসে।”
শেষের কথাটা রসিকতা করেই বললেন আবদুল মুহিত৷ আরবিন শান্ত হয়ে বসলো৷ আবদুল মুহিত স্যারের সাথে এটা ওর আর সাব্বিরের পার্সোনাল একটা মিটিং। কমান্ডারের সাথে আরো কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনা হলো ওদের৷ টিমের সকল অফিসারদের নিয়ে একটা সিক্রেট মিটিং করার পরিকল্পনা হলো।

আরবিন সবে কোয়ার্টারে ফিরছিল তখন। হঠাৎই ভেতরের গেইটের কাছে যেয়ে থমকে দাঁড়ালো ও। ধরণীর বুকে সন্ধ্যা নেমেছে সবে। সেই আলো-আঁধারির খেলায় আরবিন দেখলো, রাস্তার বিপরীত পাশে একটা রিকশা দাঁড়ানো। রিকশা থেকে নামছে রিদি। ওর এক কাঁধে ব্যাগ। এক হাতের মুঠোয় এক থোকা টকটকে লাল গোলাপ ফুল। রিকশায় বসে আছে একজন ছেলে। ছেলেটার মুখ ভালোভাবে খেয়াল করে দেখতেই চমকে উঠলো আরবিন। দুই পা পিছিয়ে গেল কি মনে করে যেন৷ ভয়ে নয়; হতভম্ব, বিস্মিত হয়ে। রিদির গাউনের ওড়নাটা রিকশার সাথে বেঁধে গেছে। রিকশায় বসে থাকা ছেলেটা সেটা আলতোভাবে টান দিয়ে ছাড়িয়ে দিতেই রিদি সম্ভবত তাকে “থ্যাংকস” বললো। তারপর হাসিমুখে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালো।

আরবিন সবকিছু স্পষ্ট দেখলো বিমূঢ় হয়ে। রিদি গেইটের কাছে এগিয়ে আসতেই আরবিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রথমে চমকে গেল। তারপর স্বাভাবিক হয়ে হাসিমুখে এগিয়ে গেল। ওই হাসিতে আরবিনের মন-মস্তিষ্কে জ্বলন ধরলো যেন। রিদি ওকে পেরিয়ে আগে আগে হাঁটতে লাগলো।
আরবিন তখনও কিছু বললো না। চুপচাপ ওর পেছনে কোয়ার্টারের ভেতরের দিকে হাঁটা ধরলো।
রিদি বেশ অবাকই হচ্ছিল। এই-যে এতোটা লম্বা পথ পেরিয়ে কোয়ার্টার ভবনের দোতলা অ্যাপার্টমেন্টে সিঁড়ি বেয়ে আসা পর্যন্তও আরবিন একটা টুঁশব্দ পর্যন্ত করেনি।
রিদির ভুল ভাঙলো ফ্ল্যাটের ভেতরে প্রবেশ করা মাত্র। সোজা নিজের ঘরের দিকেই যাচ্ছিল ও। পেছন থেকে জোরে দরজা আটকানোর শব্দে বুক ধড়ফড় করে উঠলো ওর। এতোটা প্রতিক্রিয়া দেখানোর তো কোনো মানে হয় না। আহামরি কিছুই করেনি ও।
রিদি নিজের ঘরে যেতে পারলো না। তার আগেই পেছন থেকে আরবিন ওর হাতের বাহু টেনে ধরে বললো,

“দাঁড়াও।”
রিদি দাঁড়িয়ে গেল। আরবিন সামনে এগিয়ে এসে ওকে বললো,
“আজ যেই ছেলেটাকে দেখলাম, ওকে চেনো কীভাবে?”
“গতকাল না বললাম আপনাকে? বন্ধু হয় আমার৷ স্যরি, খুব ভালো বন্ধু। বেস্টফ্রেন্ডও বলা যায়।”
আরবিন এবার বেশ শান্ত স্বরে প্রশ্ন করে,
“শিহাব?”
“হুঁ।”
“ওর সাথে আর মিশবেনা তুমি।”
আরবিন যথেষ্ট শান্ত গলায় কথাটা বললেও রিদির খুব গায়ে লাগলো। আরবিনের হাত টান মেরে সরিয়ে দিয়ে বললো,

“কেন? মিশবোনা কেন? আমি যার সাথে খুশি মিশবো, যাকে খুশি বন্ধু বানাবো। তাতে আপনার কী?”
আরবিন এবার কিছুটা ক্ষিপ্ত হলো। তবুও নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললো,
“সবার সঙ্গে মেশা ঠিক নয় রিদি৷ ওই ছেলে কে, তা তুমি জানো?”
“কে?”
“বাশারের ছেলে ও।”
“এই বাশারটা আবার কে?”
“চাকরি থেকে বিতাড়িত হওয়া একজন আইটি অফিসার। মেজর পদে ছিল ও। এককথায়, দেশদ্রোহী। শিহাব ওর ছেলে। নাম জানা ছিল না বাশারের ছেলের। তবে ফেইসে চেনা। ওর রক্ত খুব খারাপ। দেশদ্রোহীর র’ক্ত। ওর বাপ খুব ডেঞ্জারাস লোক। এজন্য বলছি ওর সাথে মিশলে তোমার ক্ষতি হবে৷”
আরবিন ভেবেছিল, ওর এই কথার পরে অন্তত রিদি ওর কথা মেনে নেবে। কিন্তু রিদি ওকে আরো বিস্মিত করে বললো,

“তাহলে তো ভালোই হলো। রতনে রতন চেনে। আমিও দেশদ্রোহী — আপনার কথায়। আর শিহাবও দেশদ্রোহীর ছেলে। এককথায় দেশদ্রোহী। আপনারই ভাষায়। এখন তো শুধু বন্ধুত্ব করেছি। আপনার সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে এরপর ওর সাথে প্রেম করবো। কপালে থাকলে বিয়েও করে নেবো। কি ভালো হবে না বলুন?”

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ২৫

রিদির কথা শেষ হওয়া মাত্রই আরবিন হঠাৎ ওর বাম গালে ঠা’ স করে একটা চ’ড় মা’রলো। জীবনে এই প্রথম আরবিন রিদির গায়ে হাত তুললো। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে আরবিনের। কি ভয়াবহ রাগ ওর! রিদি এই প্রথম ওর এমন রাগ দেখলো। কিছুটা পিছিয়ে গেল ও। দাঁতে দাঁত চেপে নিলো। আরবিনের কপালের শিরা ফুলে গেছে। হাত মুঠো করে নিয়েছে। এবার ও রিদির দিকে তাচ্ছিল্যভরে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে কঠোর গলায় বললো,
“তোমাকে পারলে এখন খু’ ন করে ফেলতাম!”

নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ২৭