নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ৩৭
ঝিলিক মল্লিক
“রিদি, ও রিদি। ঘরে আসো তো।”
আরবিনের চেঁচামেচি শুনে খুন্তি নাড়ানো বন্ধ হয়ে গেল রিদির। লোকটা অসুস্থ অবস্থায়ও একটুও স্বস্তি দিচ্ছে না ওকে। সারাক্ষণ চেঁচামেচি লাগিয়ে রেখেছে। কখনো এই দরকার, আবার কখনো ওই দরকার। কাজের আর শেষ নেই। সংসার করা কি চাট্টিখানি কথা!
কোমরে আঁচলটা আরো দৃঢ়ভাবে গুঁজে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে ড্রয়িংরুম পেরিয়ে সোজা শোবার ঘরের দিকে দৌড় দিলো রিদি।
ও ঘরে প্রবেশ করতেই আরবিনের ঝাড়ি খেল একটা। আরবিন পালঙ্কের সাথে বালিশে হেলান দিয়ে বসে ছিল৷ কিছু একটা খোঁজ করছিল বোধহয়। বিছানার পাশে হাতের কাছের মিনি ওয়ারড্রবটায়। দরকারি জিনিসটা না পেয়েই এমন চেঁচামেচি, রাগারাগি। হসপিটাল থেকে ফিরতে পারেনি একদিন হলো মাত্র। ডাক্তার বলছেনে, কমপক্ষে তিনদিন বেড রেস্টে থাকতে। জরুরি অসুস্থতার কারণে ছুটিও পাওয়া গেছে। আরবিন যদিও ছুটি নিতে চায়নি। এমনকি ও নিজে যথেষ্ট হাঁটাচালা করতে পারবে — এমন কথাও প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছে। তবে বাকি সবাই মানতে নারাজ। দুই পরিবারের লোকজন আরবিনের কোয়ার্টার অবধি আসা পর্যন্ত-ই থেকেছিলেন এখানে। আরবিনকে হসপিটাল থেকে কোয়ার্টারে আনার পরেই তারা নিশ্চিন্ত মনে ঢাকা ফিরেছেন। এদিকে রিদি পরেছে মহা জ্বালায়। লোকটা আগে ধারেকাছে থাকতো দৈনিক দশ-বারো ঘন্টা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আর এখন থাকছে চব্বিশ ঘন্টা। চব্বিশটা ঘন্টায়ও রিদির ধমকের ওপর থাকতে হয়। আরবিন চেয়েছিল, নিজে উঠে রান্না করতে। ওর রান্নার হাত এবং অভিজ্ঞতা ভালো বিধেয় খাবারটা উপাদেয় হয়; কিন্তু রিদি মোটামুটি রান্না পারলেও তা খাওয়ার উপযোগী নয়। মুখে দেওয়াও কষ্টকর। তবু রিদি আজ একপ্রকার ঠেলে আরবিনকে বিছানায় শুইয়ে রেখে নিজে মাতবরি করে রান্না করতে লেগে গেছে। এরমধ্যে লোকটার দু’বার ডাক দেওয়াও হয়ে গেছে৷ গতবার নেইল কাটারের জন্য ডেকেছিল। তবে সেবারের ডাকটা স্বাভাবিক-ই ছিল। এবার কী ক্ষেপেছে নাকি? এই মিলিটারিদের বিয়ে করার এক জ্বালা। সারাক্ষণ মেজাজ থাকে নাকের ডগায়। ভালোবাসবেও মেজাজ দেখিয়েই। মাঝখান থেকে বেচারি সহধর্মিণীদের ধমক খেতে খেতে আর অতিমাত্রায় কঠোর মেজাজ দেখতে দেখতে জান যায়।
রিদি বিছানার কাছে এগিয়ে গেল। আরবিনের তখন মেজাজ আসলেই সপ্তমে চড়ে আছে। রিদির দিকে এমনভাবে তাকিয়ে, যেন পারলে এখনই গিলে ফেলে। রিদি এবার কোমরে হাত রেখে প্রশ্ন করলো,
“কী সমস্যা? চেঁচামেচি করে ডাকছেন কেন এতোবার? আমার কাজ আছে না? ওদিকে রান্না ফেলে রেখে বারবার এখানে আসলে আর গিলে মরতে হবে না। অভুক্ত মরে ভূত হয়ে আফসোস করবেন পরে। এমনিতেই ওসব শাক-সবজি বেছে, মাছ কুটে, মাংস পরিষ্কার করে রান্না করতে করতে আমার জান যায় যায় অবস্থা। তারমধ্যে আবার আপনার ডাকাডাকি। এরপর রান্না খারাপ হলে তো তখন আবার দোষ ধরবেন।”
রিদির ত্যারছা কথাবার্তা শুনে আরবিনের মেজাজ আরো গেল বোধহয়। তবে যথেষ্ট কন্ট্রোলে রেখে রিদির দিকে তাকালো ও। রিদি এবার আরো কিছুটা এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“কী চাই?”
“বেনসনের প্যাকেট কই?”
“আমি কীভাবে জানবো?”
রিদি যেন আসমান থেকে পরলো। মারাত্মক বিস্ময় দেখালো আরবিনের প্রশ্ন শুনে। তারপর এদিক-ওদিক চাওয়াচাওয়ি করে খোঁজাখুঁজি করার ভান ধরলো। আরবিন এবার গলার স্বর আরো কিছুটা বাড়িয়ে রিদিকে একটা ধমক দিয়ে বললো,
“এই বেয়াদব! একদম নাটক করবে না আমার সাথে। তোমার ওসব মেলোড্রামা দেখে অভ্যস্ত আমি। বেনসনের প্যাকেটশুদ্ধ নিশ্চয়ই গিলে ফেলোনি?”
রিদি দুই পাশে ভদ্রোচিতভাবে মাথা নাড়ালো। না, ও সত্যিই বেনসনের প্যাকেটসহ গিলে ফেলেনি। আরবিন এবার কঠোরভাবে আবারও প্রশ্ন করে,
“তাহলে কী করেছো?”
“ফেলে দিয়েছি।”
“ফেলে দিয়েছো কেন? তোমাকে নিষেধ করেছি না? আমার জিনিসে না বলেকয়ে হাত দেবে না!”
আরবিন এবার রীতিমতো গর্জন করে উঠলো। রিদি কিছুটা ভড়কে গেল এবার। তবে তা ভেতরেই রেখে দিলো। বাইরে প্রকাশ করলে আরো সমস্যা। মেজাজ সামলে নিয়ে ও জবাব দিলো,
“ইচ্ছা হয়েছে তাই।”
“তোমার বাপের টাকায় কেনা? যে ইচ্ছা হলে অমনি ফেলে দেবে!”
“বাপ যদি জানতো, তার একমাত্র মেয়েজামাই এখনো সিগারেট খায়!”
“তাহলে কিছুই হতো না। তোমার বাপও এককালে খেতো।”
“সে তো এককালে। আব্বু এখন আর খায়না। কেন খায়না জানেন?”
“জানি। তোমার মায়ের জন্য।”
“হ্যাঁ। আব্বু আমার মায়ের জন্য সিগারেট খাওয়া ছেড়েছিল। তাহলে আপনি কেন আমার জন্য পারবেন না?”
“আমি তোমার বাপের মতো জেন্টেলম্যান নই।”
আরবিন দায়সারা ভাবে জবাব দিয়ে রিদিকে দেখতে লাগলো। রিদি এবার কঠের গলায় জবাব দিলো,
“তাহলে আমিও সিগারেটের প্যাকেট ফেলতেই থাকবো। দেখি, কার বাপে আটকায়!”
“কারো বাপে আটকাবে না। দেখি এখন এদিকে আসো তো।”
রিদি কথাটা বলে উল্টোদিকে ঘুরে পা বাড়িয়েছিল সবে। আরবিন ওর হাত টেনে ধরলো পেছন থেকে। রিদি ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল পেছনের দিকে। আরবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আরবিন রিদির কোমরে গুঁজে রাখা শাড়ির আঁচলের দিকে একপল তাকালো। তারপর আলতোভাবে টান দিলো রিদিকে। আরবিনের বুকের ওপরে গিয়ে পরলো রিদি। সরে যাওয়ার প্রয়াস করলো না। আরবিন রিদির চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থেকে কিছুক্ষণ সময় পার করে বললো,
“বেশ একটা গিন্নি গিন্নি ভাব এসেছে। যা মোটেও পছন্দ করি না।”
“কেন করেন না?”
রিদি ব্যাকুল হলো। আরবিন আবারও শক্ত কথা বলবে নাকি! আরবিন একই সুরে জবাব দিলো,
“তোমার না সামনে অ্যাডমিশন এক্সাম? ফরম তোলার ডেট পরবে কবে?”
“এইতো আর মাস দেড়েক পরে৷ কিন্তু এখন এসব কথা বলছেন কেন?”
রিদি উৎকন্ঠা নিয়ে প্রশ্নটা করে আরবিনের চোখের দিকে চেয়ে। এই লোকটাকে ও মাঝেমধ্যে বুঝে উঠতে পারে না। উহু, প্রায়সময়ই পারে না। লোকটা আসলেই কেমন যেন! খুব পাষাণ আর নির্দয়। আরবিন এবার রিদিকে আড়ষ্ট করার মতো একটা কাজ করে বসলো। শাড়ি আঁচল টান মে’রে কোমর থেকে খুলে পাশে সরিয়ে দিয়ে রিদির মসৃণ কোমরে নিজের লোহার মতো শক্ত হাতদুটো রাখলো। ধীরে ধীরে তা শাড়ির ভেতর দিয়ে গলে আরো প্রগাঢ় হলো। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো রিদিকে। রিদির তখন আড়ষ্টতায় মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। চোখে-মুখে আঁধার দেখছে। যতবার আরবিন কাছে আসে, ততবার এমন অনুভূতি হয় রিদির। আরবিনের আলতো ছোঁয়া এবার ধীরেধীরে কঠিন হলো। আরো অনেকটা কঠিন। রিদি সইতে না পেরে মূর্ছা যেতে চায়। শক্ত করে আরবিনের স্যান্ডো গেঞ্জির কাঁধের কাছটায় চেপে ধরে নতমুখে চোখ খিঁচে বন্ধ করে বসে রইলো বিমূর্তভাবে। আরবিন এবার শক্ত হাতে রিদির থুুঁতনি ধরে ওর মুখ তুলে বললো,
“চোখ খোলো।”
“পারবো না।”
রিদি আবদ্ধ অথচ চোখের পাতা কম্পিত অবস্থায় জবাবটা দিলো। মুহূর্তের মধ্যে আরবিনের ঠোঁট রিদির ওষ্ঠদ্বয়কে স্পর্শ করলো। রিদি প্রথমে আবেশে সংকুচিত হয়ে পড়লেও পরে আরবিনের ঠোঁটের আলিঙ্গনের পিষ্টতায় ও গাঢ়ত্বে দিশেহারা হয়ে পরলো। একবার বলার চেষ্টা করলো,
“আমাকে ছাড়ুন প্লিজ। ওদিকে মাংস ঢেকে রেখে আসিনি। বিড়ালে এসে খেয়ে..”
পুরো কথা আর শেষ করতে পারে না রিদি। তার আগেই আবারও আরবিনের স্পর্শে দ্বিকহারা হয়। খিঁচে আরবিনের চুল আঁকড়ে ধরে। আরবিন রিদির ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে কিছুক্ষণ দংশন চালানোর পরে রক্তিম, কঠোর মুখ উঠিয়ে দংশনে নিষ্পেষিত রিদির লালচে ওষ্ঠদ্বয়ের দিকে তাকিয়ে রাশভারী গলায় বলে,
“তোমাাকে বারবার ওয়ার্ন করেছি, এভাবে শাড়ি-চুড়ি পরে আসবে না আমার সামনে। ঢেকেঢুকে রাখবে। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না মাঝেমধ্যে। সামনে মাথা এলোমেলো করে দেওয়ার মতো পাবলিক ঘুরঘুর করতে থাকলে পাথরেও সঙ্গম করতে চাইবে৷ সেখানে আমি তো আল্লাহর সৃষ্ট সামান্য মানুষ মাত্র।”
“তো কী হয়েছে? কাছে আসতে সমস্যা কোথায়? এভাবে আদর করলে কী কেউ আপনার নামে মামলা করে দিচ্ছে? বউ তো আপনার-ই। মারবেন, কাটবেন, আদর করবেন, যা খুশি করবেন! তাতে কার বাপের কী?”
লাজ-লজ্জায় মাথা খেয়ে মুখ ফসকে কথাগুলো তো বলে দিলে, এখন আরবিনের দিকে তাকাতে পারছে না। নতমুখে আরবিনের কোলের ওপর গুটিসুটি মেরে পরে রইলো রিদি। আড়চোখে চেয়ে দেখলো, আরবিন শান্ত চাহনিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে৷ কিছুক্ষণ আগের সেই মেজাজটা এখন আর নেই। রিদি এবার আবারও বললো,
“তা করবেন কি করতে! আপনার যতো আদর, পেয়ার-মহব্বত সব তো ওই বেনসনের সাথে। ওই বেনসনকে ধরে চুমু খান, আদর করেন। তখন কোনো সমস্যা হয় না?”
“বেনসন মানুষ নয়। বেনসন প্রেগন্যান্ট হতে পারবে না। কিন্তু বেসামাল হয়ে তোমার সাথে একটু উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেললে তখন তুমি প্রেগন্যান্ট হয়ে যাবে। তার দায়ভার আমার ওপরে এসে পড়বে তখন।”
“ওমা! কি আশ্চর্যের কথা! বাচ্চার বাপ হবেন, আবার দায়ভার নেবেন না?”
“এখন এসব মাথায়ও এনো না রিদি। এখন একটা বাচ্চাকাচ্চা নিলে তুমি লাইফে আর কিছু করতে পারবে না—এটুকু মাথায় রাখো।”
“আমি তো আর কিছু করতে চাইও না। আপনার বাচ্চার মা হতে চাই।”
রিদি অনুরোধ করেই কথাটা বললো। আরবিনের চোখের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইলো জবাবের আশায়।
“থাপ্পড় মেরে বত্রিশটা দাঁত সব ফেলে দেবো বেয়াদব! বলেছি না? ওসব চিন্তাভাবনা এখন মাথায়ও আনবে না। এতোটা লাইফলেস হলে কবে থেকে? এজন্যই এতো আহ্লাদ দিতে হয় না। প্রথমে ঘাড়ে চড়ে বসবে। তারপর মাথায়।”
আরবিন রিদিকে কিঞ্চিৎ সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো। তবে রিদি সরলো না। হঠাৎ আরবিনের বাহু খামচে ধরে বললো,
“আমার বাচ্চা লাগবে। এবছর-ই।”
“রিদি জেদ ধরো না প্লিজ। অনুরোধ করছি। আমি কিন্তু মাথা ঠান্ডা রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করছি৷ আমাকে রাগিয়ো না। মেজাজ খারাপ হলে তখন কি করবো নিজেও জানি না। তারপর আমাকে দোষারোপ করবে।”
রিদি আরো জেদী, আরো বেশি নাছোড়বান্দা। আরবিনের কথার কোনো পরোয়া-ই করলো না। বরং এবার আরো শক্ত করে আরবিনের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
“বাচ্চার নাম কী রাখবো বলুন তো? আপনার নামে? নাকি আমার নামে? উমম ছেলে হলে আরব আর মেয়ে হলে রি. .”
রিদি আর বাকিটুকু উচ্চারণ করতে পারলো না। তার আগেই আরবিনের শক্ত পুরুষালি ঠোঁটজোড়া ওর ঠোঁট চেপে ধরলো দ্রুতগতিতে। ততক্ষণে রিদি আরবিনের বুকের নিচে অবস্থান করছে। আরবিন আর রিদি অনেকটা সময় একইভাবে রইলো। রিদির আঙুলগুলো বিচরণ করছে আরবিনের চুলের ভাঁজে। শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখেও ও। আরবিন এবার মুখ উঠিয়ে বললো,
“জান প্লিজ, আমার মুড হাইপার করে দিও না। শান্ত আছি। শান্ত থাকতে দাও। মাথা গরমে উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেললে প্রবলেম।”
রিদি চাইছে উল্টাপাল্টা কিছু হোক। এটাই আজ ওর একমাত্র চাওয়া। মাথায় জেদ চেপেছে ওর৷ যেভাবেই হোক বাচ্চাকাচ্চা নিতে হবে। বাচ্চাকাচ্চা হলেই আরবিনকে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে৷ মিলিটারি ব্যাটা তো এমনি নিয়ন্ত্রণে আসার নয়। রিদি এবার আরো একটা সর্বনাশা কথা বলে ফেললো। আরবিনের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো,
”আপনি যদি একটা বাচ্চাকাচ্চা না নেন, তাহলে আমি বাপেরবাড়ি চলেন যাবো।”
“তোমরা স্ত্রী-লোক কি এই বাপেরবাড়ি যাওয়ার হুমকি দেওয়া ছাড়া আর কিছু করতে পারো না?”
“না, পারি না।”
নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ৩৬
আরবিন এবার হালকা হেসে রিদির চোখদুটো দেখে গভীরভাবে। তারপর নিচু স্বরে বলে,
“চোখে কাজল না দিলেও চলবে। তোমার চোখ এমনিতেই সুন্দর। কাজল দিলে সৌন্দর্য অতিরিক্ত হয়ে যায়। সামলানো দায়।”