নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ৮
ঝিলিক মল্লিক
“প্রেম একটা মরণব্যাধি রোগের মতো।
মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও মনুষ্যকুল প্রেমে পড়ে।
প্রেম একটা ভুল। আর এই ভুল-ই মানুষ বারবার করে। প্রেম অ্যালকোহলের আসক্তির ন্যায়। একবার এই আসক্তিতে ডু্বে গেলে তা হতে বেঁচে ফেরার উপায় নেই। প্রেম বেঁচে থেকেও মরতে শেখায়। কখনোবা সুখের মরণে, কখনো আবার দহনের অনলে। প্রেম অমর, অসীম। হোক সে সুখময় সমাপ্তিতে, কিংবা পরিপূর্ণ আত্মত্যাগের বিনিময়ে…”
ডায়েরি খুব বেশি লেখে না রিদি। তবে ওর আব্বু ওকে দিনলিপি লেখার জন্য একটা ডায়েরি কিনে এনে দিয়েছিল বহুকাল আগে। রিদি ডায়েরিটার নাম দিয়েছিল— “নিষিদ্ধ পত্রালাপ।” যেখানে ইতিপূর্বে কখনো কোনোকিছু লেখা হয়নি। না কোনো নিষিদ্ধ শব্দ, অথবা বাক্য। তবে ইদানীংকালে রিদি একটু-আধটু মনের ভাব লিখে রাখে এই ডায়েরিতে। আজ-ও বহুক্ষণ যাবত কিছু কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল ওর। ভোরবেলা ঘুম ভেঙেছিল। শীতের সকালে রোদ ছোঁয়ানোর সৌভাগ্য হয়নি। আজ সূর্য বাবুমশাইয়ের দেখা নেই বলা চলে। কখন দেখা পাওয়া যাবে; তা-ও জানা নেই। কেমন যেন একটা শীতল শীতল আমেজ। ছাঁদ থেকে একবার ঘুরেও এসেছে রিদি। ওর আব্বা-আম্মা এখনো ঘুমে কাদা। গতকাল অনেক রাত পর্যন্ত জেগেছিলেন তারা। আজ আরবিনের পরিবার আসবে তাদের বাসায়। এজন্য নানান পরিকল্পনা, আলাপ-আলোচনা চলছিল। রাতেই বাজার করে এনেছেন সোহরাব হোসেন। রিদির আম্মা মশলা ব্লেন্ড করে রেখেছেন, টুকটাক রান্নার কাজ সেরে রেখেছেন রাতেই। আরবিন স্যারের পরিবারের আসার কথা রয়েছে বিকালে। সোহরাব হোসেন অনুরোধ করেছিলেন, দুপুরে তাদের বাসায় খাওয়ার জন্য। কিন্তু তা খারিজ করা হয়েছে। একারণে বিকালের জন্যই সবকিছুর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রিদি ঘরে এসে হাত-মুখ ধুয়েই ডায়েরি নিয়ে বসেছে এখন। জানালা খুলে দিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। জানালার ওপাশে একটা জারুল গাছ। জারুল গাছের মগডালে চড়ুই, বাবুই, টুনটুনিসহ আরো নাম না জানা বহু অতিথি পাখি এসে বসে এই মৌসুমে। কিচিরমিচির শব্দ করে ডাকে তারা। সুরেলা কণ্ঠে গান গায়। যদিও ওদের গানের অর্থ বোঝেনা রিদি। তবু মুগ্ধ হয়ে শোনে সে। প্রতিনিয়ত ওদের গানের প্রেমে পড়ে।
ডায়েরি লিখতে একসময় বেশ অনীহা ছিল ওর। যদিও এখন এতে ভালোলাগা মিশে যাচ্ছে। যত দিন যায়, ডায়েরিতে লেখালেখি করতে ততোই অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে ও।
বেশ অনেকটা সময় নিয়ে আরো কিছু বাক্য লিখে, তারপর আবার কাঁটাছেড়া করে শেষমেশ কম্বলের ভেতরে গেল ও। খোলা জানালার বাইরে তাকিয়ে পাখিদের সমাবেশ দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো, তা বুঝতেই পারলো না।
“রিদি, ও রিদি। ওঠ। আর কত ঘুমাবি?”
রিদির ঘুম ভাঙলো ওর মায়ের ডাকে। হঠাৎ করে ডাক শোনায় ধড়ফড়িয়ে উঠলো ঘুম থেকে। চোখ ডলে মায়ের দিকে তাকালো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। তানিয়া বেগম বললেন,
“দেড়টা বাজে। আর কত ঘুমাবি?”
“এতো বেজে গেছে! আজ আমি এতোসময় ঘুমিয়েছি! তুমি আমাকে ডাকলে না কেন আম্মা?”
“দুইবার এসে ডেকে গেছি। ঘুমে বেহুঁশ হয়ে ছিলে। ওই দুটো ডাক কানে পৌঁছায়? তারওপর তোমার আব্বু ডাকতে নিষেধ করলো এগারোটার দিকে। বললো, আজকে আরেকটু ঘুমাতে দিতে৷ ক্লান্তিভাব কম থাকবে। তাই আরো দেরি করলাম। সে যাকগে। এখন বরং উঠে সোজা গোসলে যাও। আমার একটা শাড়ি আর তোমার জন্য গড়িয়ে রাখা কিছু গয়নাগাটি এনে রাখছি। গোসল করে দুপুরের খাওয়া সেরে পড়ে নিও।”
“শাড়ি কেন আম্মা?”
রিদি বিরক্ত মুখে প্রশ্নটা করলো। তানিয়া বেগম জবাব দিলেন,
“পাকা দেখা হবে তোমার। এসব আচার-অনুষ্ঠানে শাড়ি পড়লে বেশি ভালো হয়। তাছাড়া, তোমাকে বড় বড়ও লাগবে।”
রিদি আর কোনো কথা বাড়ালো না। তানিয়া বেগম তাড়াহুড়ো করে বাইরে যেতে যেতে বললেন,
“রান্না প্রায় শেষ। তুমি গোসল করে বাইরে এসো। খাবার খেয়ে নেবে। আমার হাতে অনেক কাজ। তোমার আব্বা গেছেন মিষ্টি কিনতে। হালিমাদের আসার কথা ছিল তো। এখনো কেন যে এলো না!”
ছোট কাকিমণির কথা শুনে থমকে দাঁড়ালো রিদি। ইশশ! মানুষটাকে কতদিন দেখে না। খোঁজ নেওয়া হয়েছে সেই সপ্তাহখানেক আগে একদিন। মানুষটা বড্ড একগুঁয়ে। আরেকটা বিয়ে করে নিলেই পারতো। কিন্তু করেনি। নিজের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। তিতাস আর জামিয়াকে সঙ্গে নিয়ে স্বামীর ওই ইউনিফর্ম পরিহিত শেষ ফটোফ্রেমটা বুকে জড়িয়েই কোনোমতে বেঁচে আছে মানুষটা। একারণে কেউ আর চাপ দেয়নি তাকে। দিলেও সে নিতো না। রিদির হঠাৎ চোখে জল এলো। কাকাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। আজ মানুষটা নেই। আজকে রিদির জীবনের এমন একটা বিশেষ দিনে সে থাকলে খুব খুশি হতো। রিদির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতো,
“মামনি, তোমার কী লাগবে বলো তো? কী চাই কাকাইয়ের কাছ থেকে?”
রিদি তখন আবদার করতো, ওর ছোটবেলায় কাকাই যেমন ওর জন্য লাল আর সোনালি চুড়ি নিয়ে আসতেন; তেমনই যেন নিয়ে আসেন আবারও। কাকাইও নিশ্চয়ই সেই আবদার পূরণ করতো। কিংবা না!
পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ার সাথে সাথে কিছু বাজে স্মৃতিও মনে পড়ে গেল রিদির। তারপর এ-ও ভাবলো, আজকের দিনে কাকাই জীবিত থাকলে রিদির শুভকাজে হয়তো-বা না-ও আসতে পারতো। এমনকি নিজের সন্তানের ক্ষেত্রেও নয়। কাকাইয়ের মতো মানুষদের কাছে পরিবার কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না কোনোকালেই। আর কভু হতো বলে মনে হয় না। কাকাইয়ের মতো মানুষদের জন্য কত পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়! এমনটাই ধারণা রিদির।
মৃত কাকাইয়ের প্রতি রিদির রাগ-ক্ষোভ নেই। কিন্তু রয়েছে চরম অভিমান। যা ও কাউকে কখনো বলেও বোঝাতে পারবে না। কাকিমণি আর ছোট ছোট চাচাতো ভাই-বোন দুটোর জন্য মনের মধ্যে কি নিদারুণ যন্ত্রণা পুষে রেখেছে রিদি! মাঝেমধ্যে ঘরের কোণে একা বসে কাঁদে ও। যেই কান্নার শব্দ নেই। নিঃশব্দ কান্নার আওয়াজ পৃথিবীর কেউ শুনতে পায় না।
কাকিমণিরও কতটা কঠিন আত্মসম্মান। প্রতিনিয়ত মানুষটার প্রতি মুগ্ধ হয় রিদি। এই আত্মসম্মান আর দৃঢ় মনোবলের জন্যই এখনো পৃথিবীর বুকে টিকে আছে কাকিমণি। রিদি হলে এতোদিনে কবেই ভেঙে গুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো! মাঝেমধ্যে এসব কথা ভেবে ভীষণ অবাকও হয় ও। সত্যিই, কাকিমণি একটা স্যালুট পাওয়ার যোগ্য। একজন সৈনিকের যোগ্য স্ত্রী।
কিন্তু রিদি কখনোই কোনো সৈনিক বা তথাকথিত দেশপ্রেমীকে পছন্দ করে না। না মানে কখনোই না! বরং এদেরকে ঘৃণার চোখে দেখে৷ এধরনের মানুষদের পারলে এড়িয়ে চলে। এতে যদি কেউ ওকে স্বার্থপর, দেশদ্রোহী বলে; তো বলুক!
মরহুম এজহার হোসেন আর হালিমা খাতুনের ছেলে অর্থাৎ, রিদির চাচাতো ভাই পনেরো বছর বয়সী তিতাস আর রিদির আব্বা; দু’জনে মিলে বসার ঘরে সব চা-নাস্তার আয়োজন করছেন। ইকবাল জম্মাদারের পরিবার বসে আছেন সোফায়। আরবিনও এসেছে। ওর মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই যে, ওকে একপ্রকার ধরে-বেঁধে এখানে আনা হয়েছে। সোহরাব হোসেনকে দেখে শুরুতেই সালাম দিয়ে সৌজন্যতামূলক হাসিও দিয়েছে আরবিন। সোহরাব হোসেন তাদের যত্নআত্তিতে ব্যস্ত। ওদিকে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে তানিয়া বেগম সব গুছিয়ে সোহরাব সাহেব আর তিতাসের হাতে দিচ্ছেন।
রিদির ঘরে হালিমা খাতুন আর তার ছোট মেয়ে জামিয়া। হালিমা খাতুন রিদিকে পরিপাটিভাবে শাড়ি পরিয়ে ওর চুল বেঁধে দিতে ব্যস্ত। আজ বহুদিন বাদে তার মুখে হাসির ঝলক দেখা যাচ্ছে। জামিয়া পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে চাচাতো বড় বোনকে। রিদি ড্রেসিংটেবিলের আয়নার দিকে চোখ রেখে হালিমা খাতুনকে অভিমানের সুরে বললো,
“তোমাদের না সকালে আসার কথা ছিল কাকিমণি? এতো দেরি করলে কেন?”
হালিমা খাতুন ওর চুল বাঁধতে বাঁধতে বললেন,
“জামিয়ার মামাবাড়ি একটা কাজে গেছিলাম রে মা। এজন্য দেরি হলো। সোহরাব ভাই তো সকাল থেকে কয়েকবার কলও দিয়েছিল। আসছি আসছি বলেও শেষমেশ দেরি হয়ে গেল।”
রিদি নিশ্চল চোখে ওর কাকিমণির দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি না কেমন যেন হয়ে গেছো কাকিমণি। এখন আর আসো না এখানে।”
“সেসব বিষয়ে পরে কথা বলবো। এখন এসব নিয়ে কথা বলার সময় না। তুই চল তো বাপু।”
হালিমা খাতুন একপ্রকার এড়িয়ে গেলেন রিদির কথা। ওকে তাড়া দিতে লাগলেন। ইতিমধ্যে তানিয়া বেগম একবার এসে ডেকে গেছেন।
রিদির এবার উঠতেই হলো। আর কোনো উপায় নেই। বসার ঘর থেকে ডাক আসছে বারবার। কোনো উত্তেজনা, আবেগ-অনুভূতি কিংবা ভয়ডর কাজ করছে না ওর মাঝে। বরং যথেষ্ট স্বাভাবিকভাবে নিজের ঘর থেকে বের হলো ও। হালিমা খাতুন রিদিকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন বসার ঘরের দিকে। বসার ঘর থেকে উচ্চকণ্ঠে হাসির শব্দ ভেসে আসছে। বোঝা গেল, সবাই আলাপ-আলোচনা করছে বেশ। রিদি এগিয়ে চললো সেদিকে…
মেরুন রঙা শাড়ির আঁচল কাঁধে টেনে আরবিনের আম্মা আফসানা বেগমের পাশে বসে আছে রিদি। চোখ ওর নিজের পায়ের নখের দিকে। ওর সোজাসুজি সোফায় আরবিন স্যার, তার আব্বা, রিদির আব্বা আর তিতাস বসে আছে। রিদির হাত ধরে বসে আছেন আফসানা বেগম। হালিমা খাতুন আর তানিয়া বেগম ভেতরের ঘরে আছেন।
আফসানা বেগম রিদির দিকে ফিরে বললেন,
“ঘামছো যে। গরম লাগছে মা?”
রিদির জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। সবাই আলাপ-আলোচনা করছে। সামনে আরবিন স্যার অফ হোয়াইট টি-শার্টের ওপর লেদার জ্যাকেট পরিহিত সানগ্লাসটা বুকপকেটে রেখে বসে আছেন দুই হাত বুকের ওপর এঁটে। না তাকিয়েও রিদি বুঝতে পারছে, আরবিন মাঝেমধ্যে ওর দিকেই তাকাচ্ছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে, রিদির সাজগোজ। রিদির নাকের ছোট্ট বরইফুলের নকশার নাকফুলটাতেই বারবার নজর আটকে যাচ্ছে আরবিনের। একদৃষ্টে দেখছে সে। ওই দৃষ্টিতে কোনো আড়ষ্টতা নেই, না তো কোনো আড়ম্বরভাব। তবুও রিদির শ্বাস-প্রশ্বাস আঁটকে আসছে। শীতের পড়ন্ত বিকালেও দম বন্ধ লাগছে। হবু শাশুড়ীর কথা শুনে আরো বেশি নার্ভাস হয়ে পড়েছে ও। তবুও মাথা নেড়ে কোনোমতে “না” বোঝালো। সবাই শুক্রবার দিনটাকেই ফাইনাল করেছে বিয়ের দিন হিসেবে। বাদ জুম্মা ঘরোয়াভাবেই বিয়ের কার্যাদি সেরে ফেলা হবে।
নিষিদ্ধ শব্দের দিনলিপি পর্ব ৭
রিদির আরো বেশি অস্বস্তি হচ্ছে এই মুহুর্তটায়। এমনিতেও শাড়ি পরার কারণে শরীর রগরগে হয়ে আছে। জামদানী ব্লাউজের জন্য পিঠের দিকটাতে মনে হচ্ছে, কেউ খামচে ধরেছে যেন। তারওপর এসব আলোচনার মাঝে এতোক্ষণ বসে আছে। সামনে লজ্জা দেওয়ার মতো একজন মানুষ তো আছেই । রিদির অস্বস্তি সীমা ছাড়াবে, তখনই সামনে হতে একটা ভারিক্কি কন্ঠ শোনা গেল—
“আম্মা, ওকে এবার ভেতরে যেতে বলুন। এখানে থাকলে অস্বস্তি আরো বাড়বে।”