নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ১৩
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা
সময়টা সূর্যোদয়ের, সমুদ্র ধারে মানুষজন ভিড় লাগিয়েছে তাদের প্রিয় মানুষদের সাথে সূর্যোদয় দেখার জন্য।
কতই না উচ্ছাস, আনন্দে প্রিয় মানুষটার হাত আঁকড়ে কাঁধে মাথা দিয়ে সূর্যোদয় দেখছে জোড়া কবুতর অর্থাৎ দম্পতিরা।
এতো মানুষের মাঝে স্নিগ্ধা একা দাঁড়িয়ে নির্বাক দৃষ্টিতে সূর্যোদয় হওয়া দেখছে।
বর্তমানে সে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে আছে। শুধু সে নয়, পুরো ফ্যামিলিই এখানে এসেছে।
সেদিন রাতের ঘটনার প্রায় দু মাস কেটে গেছে। এতদিন স্নিগ্ধা চার দেয়ালের মাঝে নিজেকে আটকে রেখেছিলো, প্রয়োজন ছাড়া একটাও কথা বলেনি কারো সাথে এমনকি নিজের মায়ের সাথেও। কক্সবাজার ঘুরতে তারা আরও আগে আসতো কিন্তু সারুর পরীক্ষার জন্য আসা হয়নি। সারুর পরীক্ষা কিছুদিন আগে শেষ হয়েছে তাই সবাই মিলে ঠিক করে এখানে এসেছে ঘুরতে। অবশ্য সবার মাঝে স্নিগ্ধা ছিলোনা, সবাই কতই না জোরাজুরি করেছিল কোথায় আসা যায় তা বলার জন্য। কিন্তু স্নিগ্ধা, সে একটাও কথা বলেনি। নির্বাক থেকেছিল। সব ভেবে স্নিগ্ধা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
চারদিকে একবার নজর বুলালো। চারদিকে সব অচেনা মানুষের ভিড়। রিসোর্ট থেকেও আসার সময় কাউকে বলে আসেনি স্নিগ্ধা যে সে বাহিরে যাচ্ছে।
অদূরে অথৈ জলরাশি বারবার স্নিগ্ধাকে আকর্ষণ করছে। বহুদিন পর স্নিগ্ধার ইচ্ছে করছে পানি ছোড়াছুড়ি করতে।
ধীর পায়ে স্নিগ্ধা এগিয়ে যাচ্ছে জলের দিকে। অনেকদিন তো নিজেকে বিষণ্ণ রেখেছে আজকে নাহয় পাখির মতো একটু উড়ুক, নিজেকে একটু ভালো লাগার রেশে ছোঁয়াক।
“তোমার ক্লাসমেটসরা সবাই এক দু বাচ্চার বাবা মা হয়ে গেছে, সেখানে তুমি একত্রিশ বছরে পা দিয়েও বিয়ে অব্দি করছোনা! আমার কি তোমার ছেলে মেয়েকে নিয়ে খেলার স্বাধীনতা দিবেনা? সমস্যাটা কি তোমার?”
সূর্যোদয় উপভোগ করতে এসে মায়ের এমন প্রশ্নে ভ্রু, চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো উৎস চৌধুরী। গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,,
“বলেছিলে হয় কক্সবাজার আনতে নাহয় বিয়ে করতে। বেস্ট অপশন হিসেবে কক্সবাজার নিয়ে এসেছি তোমাকে। সূর্যোদয় হচ্ছে, মনোমুগ্ধকর পরিবেশে তুমি সেই আবারো বিয়ে বিয়ে করে পরিবেশটা অনুপভোগী করছো? এসবের মানে কি? বিয়ের কথা যখন বলবেই তাহলে কক্সবাজার কেনো এসেছি হসপিটাল থেকে এক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে?”(গম্ভীর কণ্ঠস্বরে)
উৎসের গম্ভীর কণ্ঠস্বরের বাণী শুনে মুখ ফুলিয়ে ফেললেন উৎসের মা কানন দেবী। মুখ ফুলিয়ে বলে উঠলো,,
“কক্সবাজার এসেছি যাতে এখান থেকে তোকে বিয়ে করিয়ে বউ নিয়ে বাড়িতে যেতে পারি।”( মুখ ফুলিয়ে)
উৎস ভ্রুকুটি করলো, অ’গ্নি’পি’ন্ডের ন্যায় জ্ব’ল’ন্ত হয়ে অম্বরে নিজের রাজত্ব বিস্তার করছে সূর্য। উৎস সেদিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,,
“বিয়ে অর্থ কি? দুটো মানুষ একসাথে থাকা এরপর দু তিনটা বাচ্চা জন্ম দেওয়া। ছোট ছোট বিষয় নিয়ে ঝগড়া করা এরপর অজুহাত দেখিয়ে আরেকজনের হাত ধরে চলে যাওয়া। তাইতো?”
কানন দেবীর মুখ ছোট হয়ে এলো। পুরোনো কিছু স্মৃতি মুহূর্তের মাঝে অবলোকন করলেন আঁখি বন্ধ করে। মিনিট কয়েক অতিবাহিত হতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলেন,,
“বিয়ে বিশাল পবিত্র অর্থ বহন করে। কিন্তু কিছু কালো রঙা মনের কলুষিত মানুষ বিয়ে অর্থটাকে এমন ভাবে উপস্থাপিত করে যে এর পবিত্রটা ঢাকা পরে যায় অদৃশ্য এক পর্দা দিয়ে। বিয়ে হচ্ছে একটা পবিত্র বন্ধন, এই বন্ধন পালন করা স্বামী স্ত্রী উভয়ের কর্তব্য। এই কর্তব্য পালনের জন্য স্বামীর স্ত্রী উভয়ের মধ্যে সম্মান থাকাটা জরুরি। সম্মান না থাকলে সম্পর্কটা টেকানো যায়না, বিয়ের পবিত্রতা বিনষ্ট হয়। মানুষ তো আজকাল বিয়েটাকে ছেলেখেলা পেয়েছে, কিছু হলেই বিয়ে ভেঙে দিচ্ছে। পবিত্রতা ন’ষ্ট করছে। তবে তাদের জন্য তো আর বিয়েটাকে ফিকে ভাবতে পারিনা। এটা অনুচিত। তুমি বিয়েটাকে যেমন ভাবছো, তেমন কিছুই নয়। সম্পর্কে সম্মান থাকলে ভালোবাসা জন্মাবে। ভালোবাসা জন্মালে আজন্ম থেকে যাওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা জন্ম নেবে। অতঃপর যতই বাঁধা আসুক কেউ কাউকে ছেড়ে যাবেনা।”
উৎস নিশ্চুপ হয়ে পুরোটা শুনলো, কিয়ক্ষন নীরবতা পালন করলো। শক্ত কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো,,
“তোমার আর বাবার তো ভালোবেসে বিয়ে হয়েছিল, ভালোবাসা থাকলে আজন্ম থেকে যাওয়ার প্রতিজ্ঞার জন্ম হয়। তাহলে বাবা তোমাকে ছেড়ে কেনো চলে গেলো আরেক মহিলাকে বিয়ে করে?”(শক্ত কণ্ঠে)
কানন দেবী নিরুত্তর ও নির্বাক হলেন। ছেলের এমন প্রশ্ন অবশ্য ছেলের প্রশ্ন করার সময়ই বুঝেছিলেন।
“সম্পর্কের ভার স্বামী স্ত্রী উভয়ের উপরে থাকে, সেখানে উভয়কেই এঁকে অপরকে সম্মান করতে হবে। যদি একজন একটুও খামতি রাখে সম্মান করাতে তাহলে সেই সম্পর্কে ফাটল ধরা শুরু করে যার ফলাফল দু খন্ড হয়ে যাওয়া।”
কানন দেবীর এমন মন্তব্যয় উত্তর করলোনা উৎস। চারদিকে মানুষের কোলাহল, আনন্দ উল্লাস করছে মানুষজন। কিছুক্ষন যেতে কানন দেবী পুনরায় বললেন,,
“তোমার জন্য বেস্ট লাইফ পার্টনার চুজ করবো। বিয়েটা করে ফেলো, আর কত একা থাকবে? আমার তো বয়স হয়ে যাচ্ছে, আর কবে নাতি নাতনির মুখ দেখবো, তাদের সাথে খেলবো?”
কানন দেবী কি বললেন কিছুই শুনলোনা উৎস। খুব মনোযোগ সহকারে কিছু পর্যবেক্ষণ করছে উৎস। উৎসর মুখোভঙ্গি দেখে ভ্রু কুচকালেন কানন দেবী।
“মা, একটু অপেক্ষা করো এখানে আমি বউ নিয়ে আসছি।”(মৃদু কণ্ঠে)
উৎস আর অপেক্ষা করলোনা কানন দেবীর কথা শুনার জন্য। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সমুদ্র ধারে। উৎসর নজর স্থির এক রমণীর বাচ্চামোর দিকে। দুহাত ভরে জল তুলছে আর উপরের দিকে ছুঁ’ড়ছে। মাঝে মধ্যে স্নিগ্ধ এক হাসি দিচ্ছে। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণা রমণীকে বেশ লাগলো উৎসর কাছে।
লজ্জা, শরম সব জলাঞ্জলি দিয়ে উৎস এক কান্ড বাধিয়ে ফেললো। এগিয়ে গিয়ে রমণীটিকে কোলে তুলে নিলো।
দূর থেকে কানন দেবী ছেলের এহেন কাণ্ডে চোখ বড়োবড়ো করে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। ছেলে যে এমন কান্ড বাধিয়ে ফেলবে কস্মিনকালেও কল্পনা করেননি। এই ছেলে একটা অজানা অচেনা মেয়েকে কোলে তুলে নিয়েছে এতো লোকজনের মাঝে!
উৎস রমণীটিকে কোলে তুলে নিতেই চারদিকের কিছু মানুষ হৈহৈ করে উঠলো এই ভেবে তারা নতুন কাপল।
উৎস মেয়েটিকে কোলে তুলে এনে কানন দেবীর সামনে দাঁড় করালো।
“তোমার বউমাকে নিয়ে আসলাম। এখনই বিয়ে করিয়ে দাও। হানিমুনও কক্সবাজার হয়ে যাবে।”(মৃদু হেসে)
কানন দেবী মেয়েটিকে লক্ষ্য করলেন। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের, কোমর অব্দি কেশ বেণী করা। চেহারায় আলাদা একটা মায়াবি ভাব রয়েছে, যদিও বর্তমানে মেয়েটি কাঁদো কাঁদো মুখ করে রয়েছে। মেয়েটির মনের অবস্থা টের পেটে কানন দেবী উৎসকে ধমকে উঠলেন,,
“উৎস! এটা কোন ধরণের অসভ্যতামি? এতো গুলো লোকের মাঝে তুমি অচেনা অজানা একটা মেয়েকে কোলে তুলে নিলে! মেয়েটার মনের কি অবস্থা হচ্ছে বুঝতে পারছো?”(ধমকে)
উৎস ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিলো,,
“বিয়ে করতে বললে, ওকে আমার ভালো লেগেছে তাই কোলে করে নিয়ে আসলাম বিয়ে করবো বলে। আমি থাকতে আমার বউ কষ্ট করে হেঁটে তোমার কাছে আসবে তা কি করে হয়, তাই কোলে করে নিয়ে আসলাম। বউ আবার অচেনা হয় নাকি? আর লোকজন উল্টাপাল্টা কিছুই ভাবেনি। ভেবেছে আমারা নিউ কাপল, তাই হৈচৈ করে হাত তালি দিয়েছে।”
কানন দেবী পুনরায় ছেলের কথা শুনে ছেলেকে ধমকে উঠলেন। এদিকে স্নিগ্ধার মনের মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অচেনা একটা লোক সবার সামনে এভাবে তাকে ছুঁয়েছে, কোলে তুলেছে। লোকজন আবার হাততালিও দিচ্ছে, সবটা দেখে স্নিগ্ধা বেশ ভয় ও উত্তেজিত হয়ে উঠলো। অচেনা মানুষের এমন স্পর্শে স্নিগ্ধায় শরীরে কাঁ’টা দিয়ে উঠেছে। সেই হিংস্র মুহূর্তের কথা মনে পরে গেলো স্নিগ্ধার, আশেপাশে পরিবারের কেউ নেই। স্নিগ্ধার নিজেকে অনেক অসহায় মনে হলো, ভয়ে বুক ফে’টে কান্না আসতে লাগলো স্নিগ্ধার। উৎস হুট করেই স্নিগ্ধার হাত আলতো করে ধরে বলে উঠলো,,
“কাঁদলে এখনি কেঁদে নাও, এরপর আর কখনো কাঁদার সুযোগ পাবেনা। শুনো পারলে এখনই তোমার হৃদয়ে আমার নাম গেঁথে নাও “উৎস চৌধুরী”। যদি গাঁথতে না পারো তাহলেও সমস্যা নেই। কার্ডিওলজিস্ট হই, হার্ট সার্জারি করে ওখানে আমার নাম গাঁথবো।”(মৃদু হেসে)
নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ১২
স্নিগ্ধা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলো। কিয়ক্ষন পর অনুভব করলো কার্নিশ বেয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পরছে। স্নিগ্ধা উৎসের হাত ঝা’ড়া দিয়ে সরিয়ে ফেললো। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, উৎসের স্পর্শ করা স্থান ঘষতে ঘষতে উল্টো হয়ে ছুটতে লাগলো। পুনরায় কোনো পুরুষ মানুষের ছোঁয়া স্নিগ্ধাকে অস্বাভাবিক করে তুলেছে।