নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ১৫
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা
“প্রথমত আমি কোনো বিয়ের পিঁড়িতে বসিনি আর দ্বিতীয়ত বেহায়া? বেহায়া কাকে বলছেন হ্যা? আমার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে এত্ত বড় ধা’ম’রা হয়েও বেহায়ার মতো আমার পিছু পরে ছিলেন আমাকে পটাতে। নেহাত আমি ভদ্র সভ্য মেয়েমানুষ বলে আপনি আমাকে পটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর এখন আপনি আমায় বেহায়া বলছেন।”(তেজমাখা স্বরে)
ইলার তেজমাখা স্বর শুনে আদিত ভ্রু কুঁচকে চেয়েই রইলো ইলার দিকে কিছুক্ষন। চেয়ে থাকার মাঝেই ইলা আবারো বলে উঠলো,,
“আমার থেকে আপনার পিছু ছাড়ানোর জন্য বাবা মিথ্যা বলেছিলো আপনাকে ভালোই বুঝতে পারছি। এর জন্য তো বাবাকে জবাবদিহি করতেই হবে, সে পরের হিসাব আগে আপনার সাথে আমি হিসেব মিলিয়ে নেই। এখনই যাচ্ছি শাশুড়ি মাকে বলতে যে এখানে আমাদের বিয়ে হবে সেই সাথে হানিমুনও।”(নাক ফুলিয়ে)
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ইলা নাক মুখ ফুলিয়ে আর কোনো কথা বললোনা, লাগেজ টানতে টানতে রিসোর্টের ভেতরে হনহন করতে করতে ছুটে গেলো। আদিত ইলার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। দীর্ঘশ্বাসের সাথে সাথে আদিতের মনে পরে গেলো পুরোনো দিনের তাদের প্রেমের শুরুটার কথা। আদিত ইলাকে প্রচন্ড ভালোবাসতো, এখনও বাসে তবে আগের মতো আর তা প্রকাশিত হয়না। আদিত ভাবনার মধ্যে পরে গেলো, ইলার বাবা তাকে আর ইলাকে আলাদা করতে এতো বড় একটা মিথ্যা বলেছে। ইলাকে তার সামনে স্বার্থপর প্রমাণ করেছে। এই ভাবনার মাঝে আদিতের রাগ হলো, সে এতটা বোকা কিভাবে হলো! একবার অন্তত সত্যটা যাচাই করতে পারতো, কিন্তু তা না করে সে তার বাবার সাথে কানাডা পাড়ি দিয়েছে। একাকিত্ব, বিষন্নতায় নিজেকে পাপের রাজ্যে প্রবেশ করিয়েছে। হিটম্যান, এক অর্থে খু’নি বানিয়েছে নিজেকে।
সবটা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আদিত। মুহূর্তের মাঝেই মনটা ভারী বিষণ্ণ হয়ে গেলো আদিতের, চারদিকে কত মানুষের কোলাহল, সমুদ্র ঢেউয়ের কোলাহলে খারাপ লাগার কথা নয় তবুও আদিতের মন বিষন্ন হয়ে উঠলো।
“হ্যালো, জামাইর মা স্যরি শাশুড়িমা। শাশুড়িমা আপনার ছেলেকে ঠিক কোন কবিরাজের তাবিজ দিয়ে বশ করতে পারবো একটু বলবেন আমাকে? একসময় আমাকে বশ করে মন মতো নাচিয়ে এখন আমাকে ভেগে যেতে বলছে! এসবের মানে হয় কোনো?”(কান্নারত স্বরে)
স্নিগ্ধা কিছুক্ষন আগে বাথরুম থেকে ভিজে চুপচুপে হয়ে বেরিয়েছিল। আজকে তাকে সম্পূর্ণ নির্বাক, নিশ্চুপ লাগছিলো। কল্যাণী স্নিগ্ধার এমন চেহারা দেখে অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন কি হয়েছে কিন্তু স্নিগ্ধাক নিরুত্তর ছিল। শেষে কল্যাণী মেয়েকে কাপড় পাল্টে আসতে বললেন, স্নিগ্ধা কাপড় পাল্টে আসলে কল্যাণী স্নিগ্ধাকে বিছানায় বসিয়ে চুলের জল তোয়ালে দিয়ে মুছে দিতে থাকেন, তখনই কারো কান্নারত কণ্ঠস্বরের বাণী শুনতে পান। নজর ঘুরিয়ে দরজার দিলে তাকালেন তিনি, দরজায় ইলাকে দেখে বেশ অবাক হলেন কল্যাণী। দু মাস পর ইলাকে পুনরায় স্বচক্ষে দেখেছেন তিনি, শেষবারের কথা মনে পড়তে কল্যাণীর মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। মেয়েটাকে সবার সামনে টানতে টানতে আদিত বাড়ির বাহিরে বের করে দিয়েছিলো। ইলাকে কল্যাণীর পছন্দ হয়েছে, পছন্দ না হয়েও উপায় নেই কথাবার্তা ও চেহারায় সবসময় মিষ্টি আভাস ছড়িয়ে থাকে। মেয়েটার সাথে এমন করায় আদিতকে অনেক বকাঝকা করেছিলেন তিনি। ঐদিন মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছিলো তাই আর ঐবাড়িতে আসেনি সে। এদিকে কল্যাণীর তাকানোতে ইলা কান্নার স্বর আরেকটু বাড়িয়ে বলে উঠলো,,
“দেখুন না শাশুড়ি মা আপনার ছেলে আমায় প্রতিশ্রুতি দিয়েও রাখছেনা। আমাকে আপনার ছেলে বলেছে তার বউ বানাবে, বেবির মাম্মি বানাবে। সেই আপনার ছেলে পল্টি খেয়ে যাচ্ছে, বলছে আমি নাকি বেহায়ার মতো তার পিছু পরে আছি! আপনিই বলুন আমি যদি আপনার ছেলেরে ভালো নাই বাসতাম তাহলে ওর জন্য কি ওর লেজ ধরে কক্সবাজার অব্দি এসে উঠতাম?”(কান্নারত স্বরে)
কল্যাণীর হুঁশ ফিরলো, ইলার কথা শুনে মৃদু হাসলেন। কল্যাণী ইলার মুখদর্শন করে যা বুঝেছেন মেয়েটা অতীব সরল মনের, নির্ভেজাল। ইলার চক্ষুতে কল্যাণীর দেখেছেন আদিতের প্রতি এক আকাশসম ভালোবাসা।
ছেলেটা জীবনে এতটা ভালোবাসার একটা মানুষ পেয়েও কেন যে মেয়েটাকে অবহেলা করছে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,,
“তুমি আদিতকে বিয়ে করতে চাও?”
“বিয়ে করতে চাই মানে, এখনই করতে চাই। বিয়েটা একবার করে নিই আপনার ছেলেকে বুঝাবো আমাকে ফেলে কানাডা চলে যাওয়ার মজা।”(মুখ ভেঙিয়ে)
স্নিগ্ধা নির্বাক চেয়ে আছে ইলার দিকে। মেয়েটা সোজা সাপ্টা কথা বলে, কথাও সোজা ভাবে বলে ফেলে প্যাঁচবিহীন। স্নিগ্ধাও তো ইলার মতোই চটপটে ছিল, কিন্তু ভাগ্যর পরিহাসে আজ স্নিগ্ধা একেবারে নির্বাক ও নিঃশেষের দ্বারপ্রান্তে।
ইলার নজর পরলো স্নিগ্ধার মলিন মুখশ্রী পানে। স্নিগ্ধার সাথে হওয়া অন্যায়ের কথা শুনে ইলাও বেশ কষ্ট পেয়েছে। স্নিগ্ধা মেয়েটা বয়সে এখনো অনেক ছোট, আর এই বয়সেই এমন একটা ইন্সিডেন্ট এর শিকার হয়েছে।
ইলা মলিন হাসলো, পরক্ষনেই মিষ্টি হেসে বলে উঠলো,,
“আরেহ স্নিগ্ধা, কেমন আছো? জানি নিশ্চয়ই বৌদিকে পেয়ে ভালো হয়ে গেছো। কি মলিন মুখে বসে আছো, হাসো একটু। আমি এই রিসোর্টেই উঠেছি, চল স্নিগ্ধা ঘুরে আসি বাহির থেকে, আমাদের সাথে সারু ও শেরহাম দাভাই ও যাবে। অনেক মজা করবো। শাশুড়িমা আমার লাগেজ আপাতত এখানেই রাখছি, ঘুরে আসলে আমার রুমে নিয়ে যাবো।”(উৎফুল্ল চিত্তে)
ইলা নিজ উদ্যোগে স্নিগ্ধার কাছে গিয়ে ভেজা চুল আঁচড়ে দিয়ে স্নিগ্ধার হাত ধরে বাহিরে যেতে উদ্যোত হলো।
“তখন তো ভাগিয়ে দিয়েছিলে, এখন আবার গলা জড়িয়ে চু’মু কেনো খাচ্ছ?”(গম্ভীর কণ্ঠস্বরে)
শেরহামের গম্ভীর কণ্ঠস্বরে কথাটা বলে উঠতেই সারু নাক ফুলিয়ে অভিমানী স্বরে বলে উঠলো,,
“বেলকনিতে যে প্রেম বিলাস করতে গিয়েছিলেন খেয়াল ছিল আপনার যে কেউ বেলকনিতে তাকালে আপনার প্রেম বিলাস দেখতে পেতো? এর উপর আপনি খালি গায়ে শুধু টাওয়াল পড়ে ছিলেন। তাই ভাগিয়ে দিয়েছিলাম। এখন রুমের মধ্যে আছি তাই চু’মু খেতে আসছি।”(অভিমানী স্বরে)
শেরহাম ভ্রু কুঁচকে সারুর দিকে চেয়ে রইলো। সারু কেনো জানি মুখ ফুলিয়ে রাখতে পারলোনা, ফিক করে হেসে দিলো। শেরহামের গালে চু’মু খেয়ে বলে উঠলো,,
“প্রেমবিলাস করতে এসেছি জনাব এখন কি মুখ ফুলিয়ে গম্ভীর হয়েই থাকবেন?”
শেরহাম ভরাট কণ্ঠে বলে উঠলো,,
“হ্যা গম্ভীর হয়েই থাকবো, যখন চু’মু খেতে আর প্রেমবিলাস করতে গিয়েছিলাম তখন আমায় প্রত্যাখান করেছিলে। এখন আমি তোমাকে প্রত্যাখান করলাম, সরো।” (ভরাট কণ্ঠে)
সারু সরলোনা, দু হাতে শেরহামের গলা জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। শেরহাম কিয়ক্ষন নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো তবু সারুকে জড়িয়ে ধরলোনা। সারু মুখ কালো করে বলে উঠলো,,
“এখন কি জড়িয়েও ধরবেন না? আজব, আমার কি লজ্জা শরম নেই নাকি যে বেলকনিতে সমুদ্র পাড়ের এতগুলো মানুষের সামনে আপনাকে জড়িয়ে ধরে প্রেমবিলাস করবো! আশ্চর্য! যান লাগবেনা আপনার জড়িয়ে ধরা।”(মুখ কালো করে)
সারু সরে যেতে উদ্যোত হলে শেরহাম সারুকে টান দিয়ে জড়িয়ে ধরলো বক্ষের সাথে। সারুর চুলে মুখ গুঁজে বলে উঠলো,,
“ভাবলাম কই রাগ ভাঙাবে শ’খানেক চু’মু দিয়ে। কই তা না, একটা চু’মু দিয়েই তুমিও ফুলে যাচ্ছ। আমার বিড়াল আমাকেই মেও করছো। এটা কিন্তু ঠিক নয়।”(ধীর কণ্ঠে)
“হইছে হইছে আর জড়িয়ে ধরে এসব বলা লাগবেনা, আসুন বাহিরে যাবো। আজকে তো প্ল্যান ছিল সবাই একসাথে ঘুরবো। সবাই হয়তো বেরিয়ে পরেছে আর আপনি এখনো আমাকে জড়িয়ে ধরে আছেন।”
শেরহাম সারুকে ছেড়ে দিলো। সারুর কপালে অধর ছুঁইয়ে বলে উঠলো,,
“আচ্ছা ছেড়ে দিলাম মহারানী, এবার আসুন আমরাও বের হই।”
আদিত, শেরহাম ও সারু, ইলা ও স্নিগ্ধা, কল্যাণী, মিতালি ও নেহাল রায় সবাই সমুদ্র পাড়ে এসেছে সমুদ্র ঢেউ ও চারদিকের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। সারু ও ইলা মিলে জল ছোড়াছুড়ি শুরু করলো এঁকে অপরকে। স্নিগ্ধা চুপচাপ আদিত ও শেরহামের সাথে দাঁড়িয়ে রইলো। কল্যাণী, মিতালি ও নেহাল রায় ইলা ও স্নিগ্ধার জল ছোড়াছুড়ি দেখে মৃদু হাসলেন। চারদিকে মানুষজনের ভিড়, প্রত্যেক মানুষই উৎফুল্ল ও উল্লাসিতমুখর হয়ে আছে।
নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ১৪
“উৎস চৌধুরী স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে পছন্দ করে। আপনার মেয়েকে আমি ভালোবাসি, আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করতে চাই। আই থিঙ্ক আপনার মেয়ের জন্য আমার চেয়ে বেটার হাসব্যান্ড আর পাবেন না।”