নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ১৬
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা
উৎসের মুখনিঃসৃত বাক্যবচন শুনে হতভম্ব হলেন কল্যাণী সেই সাথে বাকি সবাই। শেরহাম আর আদিত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে উৎসর দিকে। স্নিগ্ধা নির্বাক হয়ে উৎসের দিকে চেয়ে আছে। সকালে উৎসর ওইরকম স্পর্শ মনে পড়তেই চিত্তে শূন্য অনুভব হলো স্নিগ্ধার। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠলো স্নিগ্ধার।
“আপনার যদি অনুমতি থাকে তাহলে আমি এখনই আপনার মেয়েকে বিয়ে করবো, আর জীবনে যদি বিয়ে করি তাহলে আপনার মেয়েকেই করবো। কারণ আমি ‘ও’কে ভালোবাসি। সবার আশীর্বাদ নিয়ে বিয়ে করতে চাইছি দেখে আপনাদের মতামত জিজ্ঞাসা করছি নয়তো জিজ্ঞাসা করতাম না। তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করতাম।”(ভাবলেশহীন ভাবে)
কল্যাণী রায় অবাকের শেষ চূড়ায় পৌঁছালেন। চেনা নেই জানা নেই হুট করে একজন এসে স্নিগ্ধাকে ভালোবাসে বলছে আবার বিয়ে করতে চাইছে। ভাবতেই অবাক লাগছে অনেক সবার কাছে।
আদিত চুপ করে থাকলোনা, তেজমাখা কণ্ঠে বলে উঠলো,,
“আপনার সাহস দেখে অবাকের শেষ চূড়ায় পদার্পন করছি। আমার বোনকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করার কথা বলছেন? আপনার সাহস হয় কি করে আমার বোনের দিকে তাকানোর? লিমিটে থাকুন নয়তো চোখ তুলে হাতে ধরিয়ে দিবো।”(রাগান্নিত স্বরে)
উৎস ভ্রু কুঁচকালো, বজ্রকণ্ঠ স্বরে বলে উঠলো,,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আমি ওর উডবি হাসব্যান্ড হই, নজর দিতেই পারি আমার উডবি শা’লাবেবি। এতে আমার চোখ তুলে হাতে দেওয়ার কি আছে? বোনকে কি বিয়ের আগেই বিধবা বানাতে চাও নাকি?”(বজ্রকণ্ঠ স্বরে)
আদিত রেগে কিছু বলতে যাবে তখনই ইলার উৎফুল্ল কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো,,
“ডাক্তার উৎস চৌধুরী, আপনি!”(উৎফুল্ল কণ্ঠস্বরে)
উৎস ইলার দিকে তাকালো, ইলা যে এখানে উৎস জানতোনা। জানবেও বা কি করে, ইলায় তো এখানে আসার কথা ছিলোনা তবুও এসেছে একমাত্র আদিতকে ভালোবাসে বলে। অনেকদিন পর উৎস ইলাকে স্বচক্ষে দেখছে। মেয়েটা তার বাবার মতোই হয়েছে, রঙে, মুখশ্রীর গড়নেও।
মেয়েটা তার মায়ের পেটের না হলেও বাবার রক্ত মেয়েটার শরীরে আছে যা উৎসর শরীরেও আছে। না চাইতেও উৎসর এই মেয়েটাকে নিজের মায়ের পেটের বোনের মতো মনে হয়। পঁচিশ বছর আগে যদি তার বাবা ওইরকম একটা ঘৃণ্য কাজ না করতো তাহলে আজকে হয়তো ইলা বা ইলার মতোই তার একটা মায়ের পেটের বোন থাকতো। সে যা হোক, ভাই বোন হতে মায়ের পেটের হওয়া লাগেনা, মন থেকে চাইলে মায়ের পেটের না হয়েও কাউকে নিজের আপন ভাই বোন অনুভব করা যায়।
সব ভেবে উৎস মৃদু হাসলো। ঠোঁটের কোণে হাসি বিদ্যমান রেখে বলে উঠলো,,
“হ্যা আমি, তা কেমন আছো ইলা? আঙ্কেল কেমন আছেন এখন?”(মৃদু হেসে)
ইলা মৃদু হাসলো, বললো,,
“বাবা ভালো আছেন। আর আমিও। কিন্তু আপনি এখানে? আর স্নিগ্ধাকে ভালোবাসেন, বিয়ে করতে চাইছেন এসবের মানে কি?”
“আমি স্নিগ্ধাকে ভালোবাসি, সহজে আমি কোনো কিছুকে ভালোবাসিনা এবার হোক সেটা কোনো জিনিস বা কোনো মানুষ। একবার যেটাকে ভালোবাসি ঐটা আমার চাই মানে চাই, আমি স্নিগ্ধাকে ভালোবাসি তাই ওকে আমার চাই। বিয়ে তো আমি স্নিগ্ধাকেই করবো এবার যেভাবেই হোক, সবার সম্মতিতে বা তুলে নিয়ে গিয়ে।”(ভাবলেশহীন ভাবে)
আদিত ভীষণ রেগে গেল, রেগে উৎসর দিকে এগিয়ে যেতে নিলে স্নিগ্ধা আদিতের হাত খাম’চে ধরলো।
কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে উঠলো,,
“আ.. আমার ভালো লাগছেনা দ.. দাভাই। রিসোর্টে ফ.. ফিরে চল।”(কাঁপা কাঁপা স্বরে)
আদিত স্নিগ্ধার হাত ধরলো। চোখ দিয়ে আশ্বাস দিলো দাভাইয়ের সাথে আছে মানে সব বিপদ থেকে সুরক্ষিত আছে। কল্যাণী গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,,
“মশকরা করছো? ইলার কথায় যা বুঝলাম ভদ্র পরিবারের ছেলে ও ডাক্তার তুমি। ইলা তোমার পূর্ব পরিচিত হলেও আমরা নই, তাহলে অচেনা মানুষের সাথে কেনো এমন ব্যবহার করছো?”(গম্ভীর কণ্ঠে)
উৎস হাসলো, দারুন একটা হাসি উপহার দিলো। বললো,,
“আপনাদের কাছে উৎস চৌধুরী অচেনা হলেও উৎস চৌধুরীর কাছে আপনারা সম্পূর্ণ চেনা। আমি স্নিগ্ধাকে ভালোবাসি, বিয়ে করতে চাই তাই আপনাদের থেকে সম্মতি নিচ্ছি, ধরতে গেলে প্রস্তাব দিচ্ছি। বয়স বিবেচনা করলে আমি স্নিগ্ধার জন্য পারফেক্ট। স্নিগ্ধার জন্য আমার কাছে সবকিছুই আছে। সবচে বেশি যেটা আছে সেটা হচ্ছে ভালোবাসা। ভালো যখন ওকে বেসেছি বিয়েটাও ওকেই করবো।”
কল্যাণী রায়ের মুখো ভঙ্গি পরিবর্তন হলোনা। গম্ভীর হয়েই পর্যবেক্ষণ করলেন উৎসকে। শেরহাম এতক্ষন চুপচাপ থাকলেও এখন খানিকটা রাগী স্বরে বলে উঠল,,
“লিমিট ক্রস করে ফেলছেন বলে মনে হচ্ছেনা আপনার?”(রাগী স্বরে)
“উহু, একদমই না। ভালোবাসা অতঃপর বউ বানাতে চাওয়া অপরাধ নাকি? তাহলে তো ইলা আর আদিত এঁকে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখাটাও তো অপরাধ।”
আদিত ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলো উৎসর দিকে, ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলো,,
“আমি ইলাকে ভালোবাসি বা ইলা যে আমাকে ভালোবাসে এটা কিভাবে জানলেন আপনি? এতো কিছু জানার অধিকার আপনার নেই আপনি হয়তো ভুলে গেছেন।”(ঝাঁঝালো কণ্ঠে)
উৎস মুখ বাকিয়ে আওড়ালো “এতো কিছু জানার অধিকার আপনার নেই হয়তো ভুলে গেছেন”। অতঃপর কনফিডেন্স মিশ্রিত স্বরে বলে উঠলো,,
“অধিকার আছে কি নেই তা না হয় পরেই জানতে পারবে। আপাতত তোমার বোনের সাথে আমার বিয়ে দাও। আর কতকাল বউবিহীন থাকবো? আর ভালো লাগেনা বউ ছাড়া।”
আদিত রেগে দাঁতে দাঁতে চেপে কিছু বলে উঠবে এর আগেই স্নিগ্ধা হুট্ করে কান্না করে উঠলো। স্নিগ্ধায় কান্নায় চারদিকের প্রায় মানুষ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে হুট্ করে কান্না করায় সবাই বিচলিত, হতভম্ব হলো।
কল্যাণী রায় মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। স্নিগ্ধা এতদিনের নীরব কান্নাটা আজকে স্বশব্দেই কাঁদলো। চারদিকে ভিড় জমে গিয়েছে। রায় পরিবারের সবাই উদ্বিগ্ন হলো। স্নিগ্ধা কিছুতেই কান্না থামাচ্ছেনা। উৎসর অস্বস্তি সেই সাথে বুকে চিনচিনে ব্যথা করছে স্নিগ্ধার এই অসহায় কান্নায়। কল্যাণীর থেকে স্নিগ্ধাকে এক টানে ছাড়িয়ে উৎস দু হাতে আগলে নিলো স্নিগ্ধাকে নিজের বক্ষে।
আদিত, শেরহাম রাগান্নিত হয়ে এগিয়ে আসতে নিলে উৎস হাত দিয়ে ইশারা করে তাদেরকে থামতে ইশারা দিলো।
এই ঘটনায় স্নিগ্ধার কান্না থামলোনা বরংচ আরও বৃদ্ধি পেলো। মনে পরলো সেদিন, সেই ভয়ানক রাতের কথা। কি বিচ্ছিরি ভাবে ছুঁয়েছিল ওই পুষণ ভৌমিক। ভাবতেই স্নিগ্ধার বুক ফে’টে আরও জোরে কান্না বের হয়ে আসছে।
উৎস হাতের বন্ধন আরেকটু শক্ত করে, স্নিগ্ধার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে উঠলো,,
“কাঁদছো কেনো? অতীত মনে পরছে আমার ছোঁয়ায়? হয়তো হ্যা, তবে সব ছোঁয়ায় খারাপ উদ্দেশ্য বা দৈহিক চাহিদা থাকেনা। মার্জিত ছোঁয়া ও উদ্দেশ্যও রয়েছে। আমি তোমায় ভালোবাসি, তোমার কান্না আমার সহ্য হচ্ছেনা। আমি তোমায় তোমার ইচ্ছেমত ভালোবাসব যেভাবে তুমি চাও তবুও কান্না বন্ধ করো। তোমার অতীত জেনেই আমি তোমায় ভালোবেসেছি বাসছি বাসবো, অতঃপর নিজের অর্ধাঙ্গিনী করতে চাচ্ছি। আমাকে তোমার বিশ্বাস করা লাগবেনা, আমি নিজেই বিশ্বাস তোমার মনে জন্মাব। শুধু এই কান্না বন্ধ করো, এরপর থেকে আজীবনের জন্য কান্না কাকে বলে ভুলে যাবো। প্লিজ, কেঁদো না।”(মৃদু স্বরে)
উৎসের আদরমাখা কণ্ঠে না চাইতেও অনেকটা শান্ত হলো স্নিগ্ধা তবুও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে নীরবে কেঁদে যাচ্ছে সে। কল্যাণী উৎসের মুখোভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করলেন। স্নিগ্ধার কান্নায় স্পষ্ট ছেলেটার মুখ মলিন ও ফ্যাকাসে হয়ে পরেছে মুহূর্তর মাঝেই। কল্যাণী মন দিয়ে উৎসের বলা প্রতিটা কথা শুনলেন, উৎস প্রতিটা কথা চিত্ত থেকে বলেছে তা স্পষ্ট কল্যাণীর কাছে।
পিঠে কারো শার্ট খামচে ধরার অনুভূতি অনুভব হতেই শেরহাম পিছু তাকালো দ্রুত, দেখলো সারু পরে যাচ্ছে মাথা ঘুরিয়ে। দ্রুত শেরহাম সারুর বাহু ধরে বুকের সাথে মেশালো। এদিকে সারুর হুট্ করে এভাবে অজ্ঞান হয়ে পড়ায় আরেকদফা চমকালো সবাই।
চারদিকে মানুষের ভিড় দেখার মতো, সবাই উৎসুক হয়ে চেয়ে আছে রায় পরিবার ও উৎসের দিকে।
শেরহাম সারুকে ধরে আলতো করে গাল স্পর্শ করে অনবরত ডেকে যাচ্ছে, তবে সারু নিঃশব্দ, নিস্তেজ হয়ে শেরহামের বুকের সাথে মিশে আছে।
হসপিটালে ডাক্তারের কেবিনে বসে আছে শেরহাম। ডাক্তার অভীক মজুমদার গম্ভীর মুখশ্রী করে মৃদু হেসে বললেন,,
“অভিনন্দন আপনাকে, আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন। তবে প্রেগন্যান্সি সময়ে আপনার ওয়াইফের ঠিকমতো যত্ন ও চেকাপ করাতে হবে। ওনার শারীরিক কন্ডিশন তেমন ভালো নয়। বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে ওনার প্রতি।”(মৃদু হেসে)
শেরহাম যেন এক মুহূর্তের জন্য থমকালো। ডাক্তার অভীক মজুমদার কি বললেন বোধগম্য হয়েও বোধগম্য হলোনা শেরহামের। শেরহাম বাবা হতে যাচ্ছে এরচেয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পরেছে সারুর শারীরিক কন্ডিশন ভালো নয় শুনে। শেরহাম একরাশ টেনশন নিয়ে ডাক্তার অভীক মজুমদারকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওনার কক্ষ থেকে বের হলো। এদিকে শেরহামকে শুকনো মুখে বেরিয়ে আসতে দেখে সবার চোখে মুখেই টেনশনের ছোঁয়া দেখা গেলো। মিতালি এগিয়ে এসে শেরহামের বাহুতে হাত রেখে বলে উঠলেন,,
“তোর মুখ এমন শুকনো লাগছে কেন শেরহাম? সারু ঠিক আছে তো? ডাক্তার কি বললেন?”(চিন্তিত স্বরে)
শেরহাম কিছুক্ষন চুপ থাকলো অতঃপর হালকা হেসে বলে উঠলো,,
“সারু প্রেগন্যান্ট, আমি বাবা হতে যাচ্ছি।”(হালকা হেসে)
মিতালি চোখ বড় বড় করে তাকালেন। যেন ওনার বিশ্বাস হলোনা কথাটা, পরক্ষনেই খুশিতে গদ গদ হয়ে উঠলেন। হসপিটালে শেরহাম, আদিত, নেহাল রায়, মিতালি ও উৎস এসেছিলো। স্নিগ্ধার অবস্থা বেগতিক ছিল বলে স্নিগ্ধাকে হসপিটালে আনা হয়নি, কল্যাণী সেখানে থেকে গিয়েছেন মেয়ের সাথে।
সারু প্রেগন্যান্ট, মা হতে যাচ্ছে এটা শুনে উপস্থিত সবাই খুশি হলো। শেরহাম ধীর পায়ে সারুর কেবিনের দিকে রওনা হলো। তার মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে, সারুর শারীরিক কন্ডিশন ভালোনা তেমন একটা, প্রেগন্যান্সির সময়ে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। শেরহাম শুনে খুব খুশি হয়েছে যে সারু প্রেগন্যান্ট। কিন্তু শেরহাম ভাবছে এটা কি সঠিক সময় সারুর প্রেগন্যান্সির। মেয়েটা এখনো ওই ক্ষেত্রে নিজেকে সামলে উঠতে পারেনি, প্রেগন্যান্সির ব্যথা সহ্য কিভাবে করবে। ভাবতেই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে শেরহামের।
কেবিনে ঢুকে শেরহাম ধীর পায়ে হেঁটে গেলো সারুর কাছে। সারুর পাশে টুলের উপর বসে সারুর শান্ত মলিন মুখটার দিকে কিয়ক্ষন চেয়ে রইলো। শেরহাম সারুর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অধর ছোঁয়ালো সারুর হাতে।
এদিকে হাতে কারো স্পর্শ পেতেই সারু চোখ জোড়া মেলে তাকালো। দেখলো শেরহাম তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অধর ছুঁইয়ে বসে আছে। সারু ইশারায় জিজ্ঞাসা করলো “কি হয়েছে?”
শেরহাম বদৌলতে মুচকি হাসলো, বলল,,
নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ১৫
“খুব দ্রুতই আমাদের মাঝে লিটেল স্টার আসতে চলেছে। যে তার ছোট্ট ছোট্ট হাত আমাদের গালে ছুঁইয়ে আমাদের মাম্মা পাপা ডাকবে।”(মুচকি হেসে)
সারু হতভম্ব হলো, কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে পেটে হাত স্পর্শ করে ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠলো সারু। শেরহাম সারুর ঢুকে ঝুঁকে সারুর কপালে গভীর ভাবে ঠোঁট ছোঁয়ালো।