নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ২৩

নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ২৩
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

অনিচ্ছাকৃত ভাবে ইচ্ছাকৃত হয়ে চোখে কাজল পড়লো স্নিগ্ধা। উৎসের কিনে দেওয়া সেই আয়নায় নিজের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে।
খারাপ দেখাচ্ছে, উহু, একটুও খারাপ দেখাচ্ছেনা। মাঝে মধ্যে কদাচিৎ স্নিগ্ধা চোখে কাজল দিয়েছে, টিপ তো কোনোদিনই পড়েনি। এই প্রথম, খারাপ লাগছেনা দেখতে। ভাবুক হলো স্নিগ্ধা, আজকের পুরো দিনটা একবার স্মরণ করলো। নাহ, খারাপ কাটেনি। ভালোই, সুন্দর অনুভূতির সাথে কেটেছে। তবে প্রকাশ করেনি, প্রকাশ করতেও চায়নি। কেনো করবে? উৎস চৌধুরীকে সে চেনেনা। চেনে শুধু একজন অসভ্য, বেয়াদব হিসেবে যে কিনা একটা মেয়েকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে পরিবার থেকে আলাদা করে সুদূর চট্টগ্রাম নিয়ে এসেছে কেবল জোর করে তাকে ভালোবাসাতে। এমনটা হয় নাকি? স্নিগ্ধার একটুও ভালো লাগছেনা, উল্টো অসহ্য লাগছে।

দুটোদিন হয়ে গেলো মায়ের সাথে কথা হয়নি, মাকে দেখেনি চোখের সামনে। ভাই, বৌদি পরিবারের কাউকেই দেখেনি। কিভাবে সময় যাচ্ছে তার? বাড়িতে থাকলে নিশ্চয়ই প্রতিদিনের মতো কল্যাণী স্নিগ্ধাকে খাইয়ে দিতো। উৎসও তো নিজ হাতে স্নিগ্ধাকে খাইয়ে দেয়। যদিও বিষয়টা স্নিগ্ধার পছন্দ হয়না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মায়ের কথা, পরিবারের কথা ভেবে স্নিগ্ধার কান্না এলো। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বেশ দূরে। স্নিগ্ধা যদি পালিয়েও যায় কিভাবে ঢাকা ফিরবে? না আছে তার কাছে টাকা, আর না আছে বাড়িতে যোগাযোগ করার জন্য ফোন। অন্যথায় এই লোকটার কাছেই বন্দিনী হয়ে থাকতে হবে এখানে।
যা স্নিগ্ধা মানতে চায়না, ইচ্ছে হয়না বিন্দুমাত্র।

কল্যাণী কৌশিক চৌধুরীকে ডিনারে দেখছেন স্বপরিবারে। পরিবার বলতে কৌশিক চৌধুরী, ইলা আর প্রমীলা চৌধুরী। কৌশিক চৌধুরী কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছেন যে কল্যাণী কেনো তাদের ডিনারে ইনভাইট করেছেন। তবুও ইলার জোরাজুরি ও সম্মান রক্ষার্থে ওনারা রায় বাড়িতে আসলেন।
কল্যাণী সহ বাকিদের খাবার দাবারের ভারী তোড়জোড়। সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে ওনাদের নিয়ে। ইলা চারদিকে নজর বুলালো, আদিতকে কোথাও দেখলোনা। সুযোগ বুঝে মায়ের কাছ থেকে উঠে গিয়ে পা বাড়ালো আদিতের কক্ষের দিকে।

আদিতের কক্ষে গিয়ে দেখলো আদিত কক্ষে নেই, ইলা বাছ বিচার না করে বেলকনিতে গেলো। আদিত রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ মেঘলা হয়ে আছে, মাঝে মাঝে চমকাচ্ছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও পরছে, বাতাসের সাথে সাথে সেগুলো আদিতের শরীরে পরছে। এতো অশান্তির মাঝেও আদিত শান্তি পেলো যেন।
ইলা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিঃশব্দে হাসলো, পা টিপে টিপে আদিতের পিছু গিয়ে পেছন থেকে জরিয়ে ধরলো। মৃদু স্বরে বললো,,

“বিপরীত ধর্মের চার্জ পরস্পরকে আকর্ষণ করে, আপনি আমি হচ্ছি বিপরীত ধর্মের চার্জ। আপনাকে আমি আকর্ষণ করলেও আপনি বিকর্ষণ করে এখানে একা দাঁড়িয়ে আছেন। এটা কি ঠিক নয়, ভালোবাসি বলেই এতো আকর্ষণ আকর্ষণ খেলছি, নয়তো কবেই আপনাকে বিকর্ষণ করতাম, হুহ!”(মৃদু স্বরে)
ইলার মৃদু স্বরে বলা কথার মাঝে আদিত অভিমান খুঁজে পেলো। তবে মুখে কিছু বললোনা, আর না ইলাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে ওর মুখশ্রী পানে তাকালো।
আদিত নীরবে আঁধার অম্বরের দিকে চেয়ে আছে। আদিতের সাড়া শব্দ না পেয়ে ইলা পুনরায় সুধালো,,
“আজকে আপনার আমার বিয়ের কথা ফাইনাল করেই বারি যাবো, মাইন্ড ইট। আর কোনো বাহানা শুনবোনা আপনার, বুঝলেন আদু।”

আদিত এতক্ষন না ফিরলেও, এখন ফিরলো। ইলার মুখশ্রী পানে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষন, আদিতের এহেন চাহনি দেখে ভ্রু কুঁচকে গেলো ইলার। সন্দিহান স্বরে বলে উঠলো,,
“আপনার মুখশ্রী এমন কেনো দেখাচ্ছে? এমন শুকনো ভাবে নির্লিপ্ত হয়ে আছেন কেনো? আমার উপস্থিতি আপনার ভালো লাগছেনা? সত্যিই সত্যিই আমায় আর ভালোবাসেন না?”(সন্দিহান স্বরে)
আদিত কিয়ৎক্ষণ সময় নিলো, ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,,
“আর দু ঘন্টা পর বারো টায় আমার ফ্লাইট, ইমার্জেন্সি কানাডা ব্যাক করছি।”(ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে)

ইলা চোখ বড় বড় করে অবিশ্বাসের নজরে তাকালো আদিতের দিকে। এক কদম পিছিয়ে গিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,,
“মিথ্যে কথা কেনো বলছেন? মশকরা করছেন? দেখুন, আজকে আমাদের বিয়ের কথাবার্তা বলা হবে। আপনি, আপনি এমন মশকরা করে আমার মন খারাপ করাতে পারেন না।”(অস্পষ্ট স্বরে)
আদিত দীর্ঘশ্বাস ফেললো। শান্ত নজরে ইলার চোখের দিকে তাকালো, এগিয়ে গিয়ে দুহাত দিয়ে ইলার গাল স্পর্শ করলো। ধীর কণ্ঠে বলল,,
“তোমায় ভালোবাসি, তবে আমার এখন কিছু করার নেই ইমার্জেন্সি কানাডা যেতে হবে।”(ধীর কণ্ঠে)
ইলার যেন শ্বাস রুদ্ধ হয়ে এলো। আদিত কানাডা চলে যাচ্ছে, ভাবতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো ইলার। ইলা আদিতের দুহাত গাল থেকে সরিয়ে আদিতের শার্টের কলার চেপে এক ঝাকুনি দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,,

“আবার আমায় একা রেখে কানাডা চলে যাচ্ছেন? চার বছর! চার, চারটা বছর আপনার জন্য অপেক্ষা করেছি। আপনাকে ভীষণ ভালোবেসেও চোখের সামনে একটা বারের জন্য দেখতে পাইনি। ভীষণ করে চাইলেও আপনার কণ্ঠস্বর শুনতে পাইনি। কেবল সবটা কল্পনা করে গিয়েছি আপনাকে ভালোবেসে। সেই আপনি, আবার আসলেন। আপনাকে পেতে না পেতেই আপনি আবার আমায় ফেলে, একা করে কানাডা যাওয়ার কথা বলছেন! কিভাবে বলছেন এটা? ভালো না বাসলে বলে দিন, কক্ষনো আপনার দু চোখের সামনে আসবোনা। আই প্রমিস।”(দাঁতে দাঁত চেপে)
“ভালোবাসি, তবে বুঝার চেষ্টা করো। তখনো আমি পরিস্থিতির শিকার আর এখনো। যদি আমি কানাডা না যাই তাহলে বাবাকে হারিয়ে ফেলবো চিরদিনের জন্য। কখনো বাবা বলে ডাকতে পারবোনা বাবাকে। তাই সবকিছুর উর্ধে গিয়ে আমাকে কানাডা যেতে হচ্ছে।”(থেমে থেমে)
ইলা থমকালো, অবাক স্বরে বললো,,

“আঙ্কেল! আঙ্কেলের কি হয়েছে? বাঁচাতে পারবেনা মানে?”(অবাক স্বরে)
“আপাতত তোমায় বুঝিয়ে বলতে পারবোনা, তবে এতটুকু বুঝো আমাকে ইমার্জেন্সি কানাডা ব্যাক করতে হবে। কথা দিচ্ছি, এবার আসলে আর কখনো তোমায় একা করে ছেড়ে যাবোনা। আসার সময় বাবাকে নিয়েই আসবো, আমাদের হ্যাপি ফ্যামিলি হবে। শুধু এইবারই!”(করুন স্বরে)
ইলা ছেড়ে দিলো আদিতের শার্ট। ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠলো, আদিত দু হাতে আগলে নিলো ইলাকে। ইলার মাথায় চু’মু খেয়ে শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো ইলাকে।
“চোখ মুছো, নিচে চল।”

ইলা চোখ মুছে নাক টানলো, ইলার নাক টানা দেখে আদিত ফিক করে হেসে উঠলো। ইলার কপালে এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা চুলের গুচ্ছ সরিয়ে কানে গুঁজে দিলো। ইলা ঢোক গিললো, আদিত ইলার হাত ধরে নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
সবেমাত্র সবাই ডাইনিংয়ে বসেছে। তন্মদ্ধে ইলার বাবা কৌশিক চৌধুরী “ইলা কোথায়?” বলে উঠলেন। প্রমীলা তাকিয়ে দেখলেন ইলা কোথাও নেই। তবে চোখ দিয়ে বুঝালেন আছে হয়তো আদিতের পাশে।
চোখের ইশারা শেষ হতে না হতেই আদিত ইলাকে নিয়ে সেখানে হাজির হলো।
“আমি সোজা ভাবে বলতে ভালোবাসি। তোমাদের সামনে রেখেই যা বলার বলতে চাই ও করতে চাই।”
বলেই আদিত নিজের পকেট থেকে একটা রিংয়ের বাক্স বের করলো। রিংটা হাটু গেড়ে ইলার সামনে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,,

“আই লাভ ইউ ইলা, উইল ইউ ম্যারি মি?”
ইলা কিছুক্ষন আগের যাতনা ভুলে গেলো কিয়ৎক্ষণের জন্য। খুশ মেজাজে মুখ হাত দিয়ে তাকালো আদিতের দিকে। খুশিতে ইলার চোখে পুনরায় অশ্রু জমে গিয়েছে। নজর সরিয়ে বাবা, মায়ের দিকে তাকালো সে। ইলা লক্ষ্য করলো মায়ের মুখে প্রশান্তির হাসি। বাবা মুখ গম্ভীর করে রেখেছে, বিষয়টা ভাবাচ্ছে ইলাকে। মুহূর্তেই উজ্জ্বল হয়ে উঠা মুখশ্রী দপ করে নিভে গেলো।
ইলা কৌশিক চৌধুরীর দিকে চেয়ে আছে। কৌশিক চৌধুরী ইলার দিক থেকে নজর সরিয়ে প্রমীলার দিকে তাকালেন। দেখলেন প্রমীলা হাস্যউজ্জল মুখে তাকিয়ে আছে ইলার দিকে। অর্থাৎ তিনি খুশি, কৌশিক চৌধুরী মৃদু হেসে তাকালেন ইলার দিকে। ইলার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

ইলা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বুঝালো, হাত বাড়িয়ে দিলো আদিতের দিকে। আদিত রিংটা ইলার হাতে পরিয়ে দিলো, ইলা লাজ লজ্জা ভুলে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো আদিতকে। মুহূর্তেই ডাইনিং টেবিলে বসা সকলের হাসির আওয়াজ শুনতে পেলো ইলা। পরক্ষণেই ছেড়ে দিলো আদিতকে। ইলা খুশি মনে প্রমীলা চৌধুরীর কাছে গেলেন, তিনি মেয়ের গাল স্পর্শ করে চুমু খেলেন আলতো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
ডাইনিং টেবিলে সবার মধ্যে উচ্ছ্বাস। অবশেষে একটা সম্পর্ক জোড়া লাগলো। তবে কৌশিক চৌধুরী আদিতের সাথে দৃষ্টি মেলাতে পারছেন না। আদিতকে ইলার থেকে দূরে সরে যাওয়ার জন্য ইলার মিথ্যে কথা ও অনেক অপমান করেছেন তিনি আদিতকে।
“স্নিগ্ধা কোথায় শাশুড়িমা?”

ইলার হঠাৎ প্রশ্নে রায় বাড়ির লোকজন ইতস্তত বোধ করলেন। পরক্ষণেই কল্যাণী বলে উঠলেন,,
“স্নিগ্ধা দুদিন হলো ওর মামার বাড়ি গিয়েছে, এখানে ভালো লাগছেনা তাই ভাবলো ঘুরে আসবে।”(মৃদু স্বরে)
ইলা কিছু বললোনা, প্রায় অনেকক্ষন ধরে গল্প গুজব হলো। আদিত কৌশিক চৌধুরীর সাথে সেধে কথা বললো। যার অর্থ সে কৌশিক চৌধুরীর করা মিথ্যে ওই কান্ড ভুলে গিয়েছে। পরিবারের খুশির সময়ে আদিত দেয়াল ঘড়ির সময় দেখলো, প্রায় এগারোটার কাছাকাছি। বেরোতে হবে তাকে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। না চাইতেও মৃদু স্বরে বলে উঠলো,,

নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ২২

“এখন তোমাদের সবাইকে একটা কথা বলতে চাই, আর এক ঘন্টা পর আমার ফ্লাইট। ইমার্জেন্সি কানাডা ব্যাক করতে হচ্ছে, তাই ইলার সাথে বিয়ে ফাইনাল করলাম। বাকিটা তোমরা দেখে নিও, আমার অনেক দরকারি কাজ পড়ে গেছে। কানাডা যেতেই হবে।”(মৃদু স্বরে)

নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ২৪