নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ২৬

নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ২৬
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

ভোরের মৃদু আলো ফুটেছে। হসপিটালের বাহিরে মেইনরোডের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে শেরহাম। মেইনরোডে আপাতত ভারী কোনো গাড়ির অস্তিত্ব নেই। পেট চালানোর তাগিদে রিকশাওয়ালারা ধীরে ধীরে চলাচল শুরু করেছে মেইনরোডে। শেরহাম একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে, দেখছে মানুষগুলোর আজকের দিনের পরিকল্পনা। আর ভাবছে, হুট্ করে কি থেকে কি হয়ে গেলো।
একরাশ দুঃখ নিয়ে আদিত কানাডা পাড়ি দিলো অপরদিকে ইলা, কৌশিক রায়ের এই ভয়াবহ পরিস্থিতি। শেরহামের গলায় যেন পাথর বিঁধে আছে। হাঁসফাঁস লাগা শুরু হয়েছে, সারারাত সে, কল্যাণী আর নেহাল রায় হাসপাতালেই ছিল।

দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছেন তারা, সারু রাত প্রায় তিনটা অব্দি তাকে ফোন দিয়েছে তবে একরাশ বিতৃষ্ণায় শেরহাম ফোন রিসিভ করেনি। কথা বলতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করছিলো না, তখন যেমন মুখ তেঁতো হয়ে ছিল এখনও তাই হয়ে আছে।
জীবন ভারী অদ্ভুত! এই জীবনে মুহূর্তেই এই পৃথিবী সুখ পাওয়া যায় আর মুহূর্তেই এক পৃথিবী শোক পাওয়া যায়।
এটা সৃষ্টির নিয়ম, এটাকে অগ্রাহ্য করার কারো সাধ্য নেই। এটা মেনে নিয়েই মানবজীবন অতিবাহিত হয়েছিল, হচ্ছে এবং হবেও।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শেরহাম দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আদিত যদি জানে সুস্থ সবল যে ইলাকে সে এয়ারপোর্ট দেখে পাড়ি জমিয়েছে কানাডায় সে ইলা এখন অচল প্রায়। তাহলে আদিতের রিএকশন কি হবে? পাগল প্রেমিকের মতো হাঁসফাঁস করবে? উড়াল দিয়ে কানাডা থেকে বাংলাদেশ আসতে চাইবে? শেরহাম জানে আদিত ভালোবাসে ইলাকে, ভীষণ ভালোবাসে। শেরহাম লক্ষ্য করেছিল আদিতের চক্ষুতে ইলার জন্য এক সমুদ্র প্রেম আছে, যার কোনোদিন অন্ত হবেনা। এখন যদি ভগবান কৃপা করেন তাহলে ইলা ও কৌশিক চৌধুরীর জ্ঞান ফিরবে। অন্যথায় কোমায় যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
কাঁধে কারো হাত রাখায় শেরহাম পাশ ফিরে চাইলো। নেহাল রায় দাঁড়িয়েছেন তার পাশে। শেরহাম মৃদু হাসার চেষ্টা করলো তবে হাসি আসলোনা। নেহাল রায় ভারী কণ্ঠে বলে উঠলো,,

“একা দাঁড়িয়ে কি ভাবছো? সারুকে ফোন করেছো? এই সময়ে মেয়েটাকে টেনশনে ফেলা উচিৎ নয়।” (ভারী কণ্ঠে)
“টেনশনে কেউ কাউকে ইচ্ছে করে ফেলেনা বাবা, ভাগ্য নিজ থেকেই মানুষকে বাধ্য করে তাকে দিয়ে অপর একটা মানুষকে টেনশনে ফেলতে। আমিও ভাগ্যর এই খেলার শিকার। ভাবছি কি এখন জানো? পরবর্তীতে এসবের পরিণতি কি হবে!”(রাশভারী স্বরে)
নেহাল রায় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কথার পিঠে কথা বললেন না। নিঃশব্দে শেরহামের পাশাপাশি চেয়ে রইলেন মেইনরোডের দিকে। সময় যতই অতিবাহিত হচ্ছে হসপিটালে মানুষজনের আনাগোনা বাড়ছে, মেইনরোডে বাড়ছে যানবাহন সেই সাথে যানবাহনের শব্দ।
“আপাতত বাড়ি চল, ফ্রেশ হয়ে আসবো। সারাটা রাত চিন্তায় বিভোর ছিলাম। ভোরের দিকে চোখ লেগে আসলেও আর ঘুমাইনি। মাথা ব্যথা করছে।” (মৃদু স্বরে)

নেহাল রায়ের উক্তিতে ফোঁস করে একটা ছোট শ্বাস ছাড়লো শেরহাম। নেহাল রায়কে সাথে আসতে বলে সে হসপিটালের ভেতরে ঢুকলো।
ইলা, কৌশিক চৌধুরী ও প্রমীলা চৌধুরীর কেবিনের সামনের চেয়ারে নির্লিপ্ত ভাবে দেয়ালের দিকে চেয়ে থম মেরে বসে আছেন কল্যাণী।
শেরহামের খারাপ লাগলো জেঠিমণির এই করুন চেহারাটা। ভালোবেসে আগলে রাখা মেয়েটা সাথে নেই, ছেলে বাবাকে বাঁচানোর তাড়নায় ভিনদেশে পাড়ি জমিয়েছে শেষে যাকে নিজের আরেক মেয়ে মনে করে ভালোবাসলেন সেও আজ প্রায় অচল। জ্ঞান আসলে তো আসলোই আর না আসলে জীবন্ত লাশ হয়ে থাকবে ইলা আর কৌশিক চৌধুরী।

“জেঠিমণি, বাড়িতে যাওয়া উচিৎ আমাদের। বাড়ি ফিরিনি বলে মা আর সারু হয়তো টেনশন করছে। ফোন দিয়েছিলো রিসিভ করতে পারিনি, সেই মন মানসিকতা ছিলোনা তখন।”(থমথমে স্বরে)
কল্যাণী সময় নিয়ে শেরহামের দিকে চাইলেন। শেরহামের বুক ধ্বক করে উঠলো জেঠিমণির এই বিবর্ণ মুখশ্রী দেখে। শেরহাম অনুভব করলো তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসলো।
কল্যাণী উঠে দাঁড়ালেন তবে দাঁড়ানো আয়ত্ব করতে পারলেন না, পড়ে যেতে নিলেন। শেরহাম আঁকড়ে নিলো জেঠিমণিকে। শেরহামের আঁকড়ে ধরাতে কল্যাণী যেন ভরসায় কাঁদার স্থান পেলেন। মৃদু আওয়াজে ফুঁপিয়ে উঠলেন। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলেন,,

“সুখ! কখনো কি পরিপূর্ণ হয়ে দেখা দিবেনা শেরহাম? সবটা থেকেও কেনো অদৃশ্য! এই অদৃশ্যর খেলা শেষে কবে, কখন দৃশ্যমান হবে সবটা?” (অস্পষ্ট স্বরে)
“জেঠিমণি! তুমি আমাদের সবার চেয়ে বেশি জ্ঞানী। সবটা বুঝো তুমি, এটাও বুঝো আকাশ মেঘলা হয়ে বর্ষণের পরে সবটা মিষ্টি মধুর হয়। এমনি এক প্রহর আমাদের অপেক্ষায়, আমরা এখন আকাশের মেঘলা পরিবেশে আছি। শীঘ্রই সেই মিষ্টি প্রহর আমাদের হবে। কষ্টের পরেই সুখ, মিষ্টির দেখা মিলে। সুখ, দুঃখ মিলিয়েই তো মানবজীবন। ধরতে গেলে এক অর্থে #নীরদ_ক্লেশের_অন্ত বলাই যায় পুরো মানবজীবনকে। ধৈর্য ধরো, সবটা ঠিক হয়ে যাবে।”
“দুঃখের পরেই আমরা সুখের আভাস পাই,
সে আভাসে নিজেদের রাঙাই”
▫️নামীরা অন্তিকা

স্নিগ্ধার ঘুম ভেঙেছে অনেক সকালেই। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে বাঁ পাশে উৎসের কক্ষের দিকে তাকাতেই স্নিগ্ধার গতকাল রাতের কথা মনে পড়লো। অজান্তেই অস্থিরতা জেঁকে বসলো চিত্তে। উৎসের কক্ষের দরজা খোলা, সেদিকে পা বাড়াতে নিয়েও স্নিগ্ধা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বাগানের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। বাড়িটার চারদিকে অনেক উঁচু প্রাচীর দেওয়া। বাড়ির মূল দরজা বাহির থেকে আটকানো। বাহিরে দারোয়ান পাহারা দেন, উৎসের আদেশে গেইট খুলেন আবার আটকে দেন। উৎসের মামা মামি এখনো ফিরেনি, ফিরতে তাদের আরও তিন চারদিন দেরী আছে।
স্নিগ্ধার পালানোর কোনো পথ নেই দেখেই উৎস বাড়ির দরজা খোলা রাখে, খোলা রাখে বলতে ভেতর থেকে আটকানো থাকে। স্নিগ্ধার যখন ইচ্ছে তখন বাগান পরিদর্শনে বেরোয়।

ঠিক তেমনি ভোরেও স্নিগ্ধা বাগানের ফুলেদের সাথে ভাব বিনিময় করে নিজের অস্থিরতায় পরিপূর্ণ চিত্ত শান্তিপূর্ণ করতে বাগান পরিদর্শনে এসেছিলো।
ফুলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এতটাই মুগ্ধকর স্নিগ্ধা ফুলের সৌন্দর্যে হারিয়ে গিয়েছিলো। ঘন্টা দুয়েকের মতো এই বাগানেই এই ফুল তো ওই ফুলের কাছে ঘুরে বেড়ালো। তাদের সৌন্দর্য কাছ থেকে দেখলো, মন চাইলো তো ডান হাতের দু আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দিলো। গোলাপ ফুলের ঘ্রাণ শুকলো প্রাণ ভরে। এতকিছুর মাঝেও স্নিগ্ধার চিত্তে ওই কান্নারত, অসহায়ত্ব ফুটে উঠা মুখশ্রীর কথাই ভেসে বেড়াতে লাগলো।

উৎস মন্দ নয়, ভাবলো খানিকটা স্নিগ্ধা। পরক্ষণেই ভাবলো এসব ভাবনা ভিত্তিহীন। বয়সের ক্ষেত্রে আকাশ পাতাল পার্থক্য তাদের। তেরো বছরের! স্নিগ্ধা মুখে কয়েকবার আওড়ালো “তেরো বছর”। কোনোভাবেই এই লোককে ভালোবাসা সম্ভব নয়। তুলে এনেছে তাকে, পরিবার থেকে আলাদা করে এনেছে এই এতদূর।
এরজন্য হলেও এই লোককে ভালোবাসা উচিৎ নয়।
এমনিতে উৎসকে যে কোনো নারীই ভালোবাসবে, তবে স্নিগ্ধা পারবেনা। এটা স্নিগ্ধার মস্তিষ্কের কথা হলেও স্নিগ্ধা উপলব্ধি করছে মন ভিন্ন কথা বলছে।

এসব ভাবা বাদ দিলো স্নিগ্ধা। আশেপাশে পাখিরা কিচিরমিচির করছে। পরিবেশটা ভালোই উপভোগ করছে স্নিগ্ধা। কিন্তু না চাইতেও চিত্ত উৎসের কথা তুলছে বারবার। স্নিগ্ধা ফোঁস করে একটা শ্বাস ছাড়লো। অপবিত্র হয়ে এসব ভাবাও তো হাস্যকর দেখায়। ভেবেই তাচ্ছিল্যর হাসলো স্নিগ্ধা। সামনে সদ্য ফোঁটা গোলাপ ফুলটাকে যেই ছুঁয়ে দিতে যাবে অমনি পেছন থেকে উৎসের গম্ভীর কণ্ঠস্বরের বাক্য বচন শুনতে পেলো স্নিগ্ধা।
“তৈরী হও, তোমাকে তোমার আপন নীড়ে দিয়ে আসবো।”(গম্ভীর কণ্ঠস্বরে)
স্নিগ্ধার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো, চমকানো দৃষ্টিতে উৎসের দিকে ফিরে চাইলো। নির্বোধ হয়ে বলে উঠলো,,

“হঠাৎ বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলছেন? সুস্থ আপনি?”(নির্বোধ কণ্ঠে)
উৎস প্রতিক্রিয়া দেখালোনা। রাশভারি কণ্ঠে বলে উঠলো,,
“ভালোবাসা আমার প্রাপ্য নয় স্নিগ্ধা। আমার বোঝা হয়ে গেছে দারুন ভাবে। পাখিকে উড়তে দেওয়া উচিৎ, তারা স্বাধীন। তাদের স্বাধীনতায় ব্যাঘাত করা উচিৎ নয়। তাদের জোর করে খাঁচায় ভরে রাখলে তারা একটু একটু করে বিলীন হয়ে যায়। তুমি আমার না হও তবুও বিলীন হয়ো না। মুক্তি চেয়েছিলে না? আজ তোমার মুক্তি। গত দুইদিনের জন্য ক্ষমা করো আমায়।” (রাশভারি স্বরে)

স্নিগ্ধা থমকালো, একধাপ অবাক হলো। রাতারাতি কি এমন হলো আগের উৎস আর আজকের উৎসের মাঝে এতো বিস্তর ফারাক! উৎস তাকে মুক্তি দিবে, খুশি হলো স্নিগ্ধা। তবে হলোনা এটা ভেবে শুধু খুশি? তার তো ভীষণ খুশি হওয়া উচিৎ সেখানে শুধু খুশি কেনো যেন মানতে পারছেনা স্নিগ্ধা। সে এতো অল্প খুশি চায়না, সে ভীষণ খুশি চায়। তবে কি কিছু অনুভব করছে স্নিগ্ধা।

দীর্ঘ একটা জার্নির পর অবশেষে কানাডার মাটিতে পা রাখলো আদিত। এয়ারপোর্ট এসে দাঁড়িয়েছে কাঙ্খিত ব্যাক্তির আশায়। ফোন অন করতেই তব্দা খেলো আদিত। অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে মেসেজ ও একটা ভিডিও এসেছে। ইংরেজিতে মেসেজ দেওয়া, মেসেজটা ঠিক এমন,,
“ওয়েলকাম ব্যাক। দুই তীরেই সব হারানোর জন্য তৈরী থেকো আদিত রায় উড়ফে হিটম্যান। একুলে বাবাকে হারানোর বেদনা ঐকূলে গোটা পরিবার। অভিনন্দন ধ্বংসকে আপন করে নেওয়ার জন্য।”

নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ২৫

আদিত থ হয়ে ভিডিওটা অন করলো। প্রায় সবকিছুই আঁধার, হুট্ করে নজরে আসলো ইলা, কৌশিক চৌধুরী ও প্রমীলা চৌধুরীর র’ক্তা’ক্ত দেহ। হৃদমাঝারে ধ্বক করে উঠলো আদিতের। নিজের বিনাশ চাইলেও প্রেয়সীর এমন রক্তিভ অবস্থা তো কখনোই দেখতে চায়নি আদিত। হৃদয়ে ঝড় উঠেছে আদিতের। চারদিকে অন্ধকার দেখতে শুরু করেছে সে, বুক ফেটে কান্নারা বেরিয়ে আসতে চাইছে।

নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ২৭