নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ২৮

নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ২৮
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

বাংলাদেশ থেকে কানাডার সময়ের পার্থক্য তেরো ঘন্টা। বাংলাদেশ সময় বর্তমানে বারো টা বেজে ত্রিশ মিনিট আর কানাডায় এখন রাত একটা বেজে ত্রিশ মিনিট। সাধারণত আদিত অ্যালকোহল পান করেনা, যেদিন কারো মা’র্ডার করে সেদিনই একটু আকটু খায়। শেষবার পুষণ ভৌমিককে মার্ডার করেছিল, যদিও তখন আদিত ভীষণ ক্ষোভে ছিল। অ্যালকোহল পান করার মতো নেশাটা তীব্র ছিলোনা, ছিল শুধু খু’ন করার তীব্র নেশা।

তবে আজ, আজ আদিতের ফ্রেশ মাইন্ড। কোনো ক্ষোভ নেই। হতে পারে আছে তবুও প্রকাশ পাচ্ছেনা ক্ষোভটা। সোফায় আয়েশী ভঙ্গিতে বসে নিশ্চিন্ত মনে অ্যালকোহল পান করছে সে। এই মুহূর্তে যেন এটাই একমাত্র ধর্ম তার। ইনতেহার পাশে বসে চেয়ে আছে তার দিকে। আদিত না তাকিয়েই জিজ্ঞাসা করলো,,
“খাবি?”
“উহু!” (নিচু স্বরে)

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তাহলে এভাবে তাকিয়ে কি দেখছিস? নজর টজর দিস না। আমার পেট খারাপ হলে সাপ, ব্যাঙ এগুলোকে শিকার করে কে’টে টুকরো টুকরো করবো কিভাবে?”(আড়চোখে তাকিয়ে)
ইনতেহার ভরকানো দৃষ্টিতে তাকালো আদিতের দিকে। ভ্রু কুঁচকে আদিতের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে বেশ বড়সড় টেবিলের উপর বেঁধে রাখা এডউইন জেমসের দিকে তাকালো। এডউইন জেমসের চক্ষুতে এখন মৃ’ত্যু ভয়েরা উপস্থিত হচ্ছে।
“শিকার করার আগে বাঘ হিংস্র থাকে। তুমি সবসময় তেমনই থাকতে, আজকে এমন হাস্যকর মশকরা কেনো করছো?”(নিচু স্বরে)

“বাঘ বলে কি অনুভূতি নেই নাকি? সবসময় হিংস্র থাকতে হবে এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম আছে নাকি ইনতেহার? কিছু কিছু বাঘ দেখবে, নিশ্চুপে শিকারকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকবে ঝোপঝাঁড়ের আড়ালে। অতঃপর দেখবে হুট্ করে এক লাফ দিয়ে শিকারীকে আবদ্ধ করে ছিঁ’ড়ে ফেলবে অনেক হিংস্র ক্ষো’ভ নিয়ে। আমার অনুভূতিটাও বর্তমানে এমন। শান্ত ভাবে থাকবো তবে এমন হিংস্র মৃত্যু দেবো, রূহ কেঁপে উঠবে।”(শান্ত স্বরে)

ইনতেহার আড়চোখে তাকালো আদিতের দিকে। আদিত তার দেহের সম্পূর্ণ ভার সোফার উপর ছেড়ে দিয়েছে। ইনতেহার ভেবেই চলেছে এই বুঝি লাফ দিয়ে উঠেই এডউইন জেমসকে টর্চার শুরু করবে। হেল হাউজের নির্মমতা কতটা ভয়ঙ্কর, তা বুঝিয়ে পৃথিবী থেকে চিরমুক্তি দিবে এডউইনকে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ইনতেহার। বাবার নিষ্প্রভ মুখশ্রীটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। ছোটবেলায় তাকে জন্ম দিতে গিয়ে তার মা মারা গেলো। জীবনের এতগুলো বসন্ত বাবার ছায়াতলেই কাটিয়েছে বাবাকে ভালোবেসে, সেই বাবার আজকে কি করুন পরিস্থিতি! ইনতেহারের রাগ হয়, মন চায় বাবার এই করুন পরিস্থিতি যারা করেছে তাদের হাত কে’টে ফেলতে। তবে ইনতেহার এমন কিছুই করবেনা। আদিত থাকতে ইনতেহারকে কিছুই করা লাগবেনা শুধু মাত্র তাদের অবস্থানটাই আদিতকে জানানো ছাড়া।

এই যেমন সকালে এডউইনের অবস্থান বের করে তাকে কিডন্যাপ করে এনেছে। ঠিক এমনই। ফোঁস করে একটা শ্বাস ছাড়লো ইনতেহার।
আদিত উঠে দাঁড়িয়েছে। এডউইনকে যে টেবিলে শুইয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে সেই টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। টেবিলে এডউইনের পাশে ছুরি, লবন, গুঁড়া মরিচের কৌটা রাখা আছে।
এডউইনের মুখ স্কচটেপ দিয়ে আটকানো ছিল যার দরুন সে শুধু গোঙাতেই পারছিলো, কিছু বলতে পারছিলোনা।

“তোর খুব শখ তাইনা নিজ চোখে জাহান্নামের নির্মমতা দেখা? আজ এমন জাহান্নাম দেখাবো তুই মরার পর তোর রূহ তোর দেহের পরিনাম দেখে আবারও মৃত্যু বরণ করতে চাইবে। আমার উচিৎ ছিল তোর মতো জঞ্জালকে সেদিনই মে’রে ফেলা, তবে মারিনি। যে ডোজ দিয়েছিলাম ভেবেছিলাম নিজ থেকেই ম’রে যাবি। কিন্তু না তোর তো কৈ মাছের জান। এতো সহজে বিলীন কিভাবে হবি, সেই বেঁচে থেকে চামচামি করলি। তোর এক্স বস যে তোর নতুন বসের বাপকে খু’ন করিয়েছে তা তো বললিনা, বললি শুধু আমার কথা। ফাঁসিয়ে দিলি শুধু শুধুই।”(অত্যান্ত রাগান্নিত স্বরে)

এডউইন শুধু গোঙাচ্ছেই, আদিতের ভয় তার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পরেছে। পূর্বে একবার আদিতের হিংস্রতার শিকার হয়েছিল সেই শোধ তুলতেই তো অভীককে আদিতের কথা বলেছিলো, কিন্তু হলোটা কি! আদিত আরও হিংস্র হয়ে উঠলো। আগের বার রেহাই দিলেও এবার তো নিশ্চিত মৃ’ত্যু।
আদিত এডউইনের মুখের স্কচটেপ খুলে দিলো। সঙ্গে সঙ্গেই এডউইন অস্থির স্বরে ইংরেজিতে বলে উঠলো,,

“আদিত! আদিত প্লিজ আমায় মেরোনা। আমি ভুল করেছি, আমায় মাফ করে দাও।”
আদিত শুনলোনা। নিজের নির্মমতা পুনরায়ের চেয়েও ভয়ঙ্করভাবে প্রকাশ করতে লাগলো। ছু’রি দিয়ে এক ইঞ্চি করে গভীর ভাবে ক্ষ’ত করছে এডউইনের শরীরে। ব্যথায় এডউইন গগন কাঁপা চিৎকার করছে। আদিতের যেন হৃদয়ে প্রশান্তির ঢেউ উঠছে। সেই ক্ষ’ত স্থানে সে চিমটি করে লবন ছিটিয়ে দিচ্ছে। এডউইন কাঁ টা মুরগির মতো ছটফট করছে। এদিকে ইনতেহার নিশ্চুপে আদিতের কান্ড দেখে যাচ্ছে।
আদিত এবার এডউইনের হৃদপিন্ড বরাবর ছু’রি দিয়ে কা’টলো, অতঃপর গুঁড়া মরিচ ছিটিয়ে দিলো সেখানে। এডউইনকে পায় কে, তার চিৎকারে মনে হলো হেল হাউজ কেঁপে উঠছে। ভীষণ ভয়ানক লাগছে পরিবেশটা। তবে আদিত, ইনতেহার বেশ উপভোগ করছে পরিবেশটা।
“হেল হাউজের অতিথি হেল হাউজের মর্মার্থ বুঝবেনা এমনটা হয় এডউইন জেমস? মর্মার্থ অনেক আনন্দদায়ক তাইনা?”(প্রশস্ত হেসে)

আদিতের কথায় কিছুই বলতে পারলোনা এডউইন। শুধু গোঙাতে লাগলো। ব্যথাতুর আওয়াজ। ভীষণ করুন শোনালো আওয়াজটা। আদিতের মায়া দয়া কিছুই অনুভব হলোনা, তার হাত এডউইনের র’ক্তে লা’ল হয়ে গেছে। সর্বশেষ আদিত উন্মাদের মতো হেসে উঠলো। হাতে থাকা র’ক্তে রঞ্জিত ছু’রিটা এডউইনের হৃদপিন্ডে গেঁথে দিয়ে একদলা থুথু ছুঁড়ে মা’রলো এডউইনের শরীরে। একরাশ ক্ষোভ নিয়ে হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,,

“তোদের মতো ঘৃণ্য জানোয়ারদের কঙ্কাল সংগ্রহ করতে বেশ আনন্দ পাই। তোর কঙ্কাল হেল হাউজের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখবো, তোর কঙ্কাল যখন দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখবো দেখিস তোর কাছে তখন তোকে খুব নাইস এন্ড এট্রাক্টিভ দেখাবে।”(হিসহিসিয়ে)
এডউইনের গোঙানি কমে এলো। আসলেই কৈ মাছের প্রাণ। এখনো ম”রার নাম গন্ধ নেই।
“এঁকে এসিডে চুবিয়ে কঙ্কাল বানিয়ে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখিস। আজকে বাড়িতে যাবোনা, পাশের ঘরেই থাকবো। শুন, আগামী দুদিনের মধ্যেই এসজে গ্রুপের সকল সদস্যের ইনফরমেশন আমাকে দিবি। রাত অনেক হয়েছে, তুইও এখানেই থেকে যা।”

শরীর ঝেড়ে আদিত হামি দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ইনতেহার নির্বিকার ভাবে এডউইনের মুখশ্রীপানে চেয়ে আছে। মৃদু হাসলো ইনতেহার। অন্যরুমে গেলোনা, রুমের সোফাতেই লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো। আপাতত তার ঘুমের দরকার, সকালে উঠে এই নমুনাকে আবার এসিডে চুবিয়ে কঙ্কাল বানিয়ে টাঙিয়ে রাখতে হবে। পাপিষ্ঠ মানুষের কঙ্কাল দেখতে বেশ ভালো লাগে, মনে শান্তি শান্তি অনুভব হয়।

ইলাদের কেবিনের দরজা খুলে উৎস এক পলক স্নিগ্ধার দিকে তাকালো। ভেজা নেত্রপল্লব, মায়ের বুকে লেপ্টে ফোঁপাচ্ছে। শেরহাম নির্বাক চোখে চেয়ে আছে স্নিগ্ধার দিকে। স্নিগ্ধার পাশেই সারু, মিতালি দাঁড়িয়ে। আর শেরহামের পাশে নেহাল রায়। উৎস স্নিগ্ধার কান্না দেখে মনে মনে ভেঙালো,,
“এহহ পাপা কি পারী, এমন ভাবে কাঁদছে যেন তিনদিন আটকে রেখে খেতে দেইনি, আনলিমিটেড বেল্ট দিয়ে মে’রেছি।
মনে মনে এসব বললেও উপর দিয়ে নিজেকে বেশ গম্ভীর করে কেবিন থেকে বের হলো সম্পূর্ণ। উৎস বের হতেই সবাই উৎসের দিকে তাকালো। শেরহাম যেন উৎসকে দেখতেই চটে গেলো। তবে উৎস সবাইকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে হসপিটাল থেকে বেরোনোর জন্য উদ্যোত হলো। ভাবখানা এমন দেখালো যেন সে চেনেই না এদের কাউকে। কল্যাণী উৎসের এমন কাণ্ডে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলেন উৎসের যাওয়ার দিকে।

দুদিন পর বিকেলে,
পরপর দুদিন অতিবাহিত হওয়ার পরেও ইলার জ্ঞান ফিরলোনা। ডাক্তার শাফান কনফার্ম করলেন ইলা কোমায় চলে গিয়েছে। কবে এই অবস্থা থেকে বের হবে এটা বলা যাচ্ছেনা। এদিকে প্রমীলা চৌধুরী নিজে অসুস্থ হলেও মেয়ের এহেন অবস্থায় কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন। কৌশিক চৌধুরী উত্তেজিত হয়ে পড়ায় ওনার অবস্থা প্রায় শোচনীয় হয়ে পরেছে।

শেরহাম কি করবে বুঝে উঠতে পারলোনা। আদিত যাওয়ার তিনদিন হওয়ার গেলো। তবুও আদিত ফোন করেনি তাদের। ওখানে কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই জানতে পারছেনা শেরহাম। আদিত ঠিক আছে কিনা নেই! একদিকে আদিতের টেনশন অন্যদিকে ইলার কোমায় চলে যাওয়া। পরিবারে যেন একটা অসহায়ত্ব নেমে এসেছে। চারদিকে দুঃখদের আনাগোনা। সুখ শব্দটা কতদিন হলো তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে! না জানি আবার কবে সুখ শব্দটা তাদের দ্বারে আসবে!
হসপিটালে নেহাল রায় আর কল্যাণী রয়েছেন। শেরহামও যাবে। তবে সেখান থেকে তাকে অফিস যেতে হবে। কতগুলো দিন হলো অফিসে ঠিকমতো উপস্থিত থাকতে পারছেনা সে বা নেহাল রায় কেউই। আজকে যাবে।

“সারু, আমি একেবারে রাতে ফিরবো। অফিসে যাবো আজকে। ঠিকমতো খেয়ে নিবে কিন্তু, মা থাকবে বাড়িতে। ভালো খারাপ সবটা মাকে বলবে।”(মৃদু কণ্ঠে)
সারু জবাব দিলোনা। নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো শেরহামের দিকে।
“ইলাদির কি আর জ্ঞান ফিরবেনা?”(স্থির কণ্ঠে)
শেরহাম নির্লিপ্ত ভাবে চাইলো সারুর দিকে। এই প্রশ্নের জবাব অনেকটা কঠিন মনে হলো তার কাছে। কঠিন লাগবেই তো, যে প্রশ্নের জবাব জানেনা শেরহাম সে প্রশ্ন তার কাছে কঠিনই লাগার কথা। তবুও সারুকে আশ্বাস দেওয়ার স্বরে বলে উঠলো,,
“দ্রুতই ফিরতে পারে অথবা অনেক দেরীও হতে পারে। আমরা পজিটিভ ভাবি, তাহলে সবটা পজিটিভই হবে।”

“আদিত দাভাইয়েরও তো কোনো খোঁজ নেই। কানাডা যাওয়ার পর ওনার তরফ থেকেও কোনো ফোনকল আসেনি। উনি তো জানেনও না ইলাদির এক্সিডেন্ট হয়েছে আর উনি কোমায় চলে গেছেন!”(নিষ্প্রভ স্বরে)
শেরহাম বলার মতো কিছু খুঁজে পেলোনা। সত্যিই তো কি বলার আছে। আদিত কানাডা যাওয়ার আজ তিন দিন হয়ে যাওয়ার পরেও একবারের জন্যেও কল করেনি যে ঠিক মতো পৌছিয়েছে নাকি অন্যকিছু। শেরহাম সারুর দিকে এগিয়ে আসলো।

নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ২৭

“সবটা ঠিক হয়ে যাবে সারু, এতো ভেবোনা। আমাদের উচিৎ এসময়ে সবটা পজিটিভ ভাবা। সবটা ঠিক হবে, ধৈর্য হারিয়ে ফেলনা। সৃষ্টিকর্তা আমাদের ধৈর্যর পরীক্ষা নিচ্ছেন, আমাদের ধৈর্যহারা হলে চলবেনা।”(থেমে থেমে)
সারু শুনলো মনোযোগ দিয়ে। শেরহাম এগিয়ে এসে দুহাত দিয়ে সারুকে বুঁকের সাথে মিশিয়ে নিলো। সারুর কপালে আলতো ঠোঁট ছুঁইয়ে কিছুক্ষন নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।

নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ২৯