নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ২৯

নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ২৯
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

“তোমার এই হ’টনেস দেখেই তো তোমায় সুদূর বাংলাদেশ থেকে পুনরায় কানাডায় টেনে আনলাম। আই ওয়ান্না স্পেন্ড ওয়ান নাইট উইথ ইউ ব্যব।”(ধীরে ধীরে)
পায়ের উপর পা তুলে সোফায় অভীক মাহমুদের মুখোমুখি বসে ছিল আদিত। অভীক ঈগলের দৃষ্টিতে আদিতের দিকে চেয়ে অ্যালকোহল পান করছিল অভীক। বহুদিন পর আদিতের নাগাল পেয়েছে অভীক। আদিত কঠোর দৃষ্টিতে শক্ত হয়ে বসে ছিল এর মাঝেই পেছন থেকে কে আদিতের কাঁধে হাত রেখে উক্ত কথা বলে উঠলো। আদিত প্রতিক্রিয়া দেখালোনা। মুহূর্তেই কর্ণপাত হলো কোনো তীক্ষ্ণ নজরবিশিষ্ট নারীর ধারালো মুখশ্রীর হাসি।
বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে নারীটি অভীকের পাশে সোফায় ধপ করে বসে পড়লো। নিজে উদ্যোগে টি টেবিলে থাকা একটা গ্লাস তুলে নিয়ে অ্যালকোহল ঢাললো। আদিতের দিকে ইশারা করে বললো,,

“খাবে ব্যব? দারুন এনার্জি পাবে।”
আদিত বিরক্ত হলো, দৃষ্টি অভীকেই নিবদ্ধ রাখলো। কীয়ৎক্ষন সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আদিত ধারালো স্বরে বলে উঠলো,,
“তোমাদেরও ড্রামা শেষ হলে মেইন পয়েন্টে কথা বলি। বাবা কোথায়?”
অভীক ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,,
“বাবা কোথায় মানে? তুই নিজে হাতেই তো আমার বাবাকে খু’ন করলি।”(ভ্রু কুঁচকে)
আদিত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নিশ্চুপ থাকলো। মিনিট দুয়েকের মতো অতিবাহিত হতে অ্যালকোহল পান করতে করতে নারীটি বলে উঠলো,,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ব্যব এতো হাইপার কেন হচ্ছ? আমার প্রস্তাব ভালো লাগেনি বুঝি? উত্তর না দিয়েই দেখি বাবার কথা বলছো। বাবার পায়ের নিচে থাকতে বুঝি বেশ লাগে?”(মুখ বাকিয়ে)
অভীক পাশে বসে থাকা নারীটির দিকে চেয়ে বলে উঠলো,,
“অ্যালকোহল তোর জন্য আনিনি রেবা। এতো পান করছিস কেন?”
রেবা স্মিত হেসে আদিতের দিকে চেয়ে বলে উঠলো,,
“এমন চুম্বককে দেখে দেখে অ্যালকোহল পান করার মজা লুফছি। এতো কথা কেন বলছো? বহুদিন পর হট একটা আইটেম দেখতে পারছি।”(স্মিত হেসে)
অভীক ভ্রু কুচকালো। একপ্রকার ধমক দিয়ে বলে উঠলো,,
“হট আইটেমের মজা পরেও নিতে পারবি, আপাতত ডিল করে নি-ই। ততক্ষন চুপ থাক।(আদিতের দিকে চেয়ে) এ হচ্ছে আমার স্টেপ সিস্টার রেবা মাহমুদ।”

“নাটক শেষ হলে বাবাকে এখানে আনো। তোমাদেরও নাটক পরেও করতে পারবে।”(গম্ভীর কণ্ঠে)
আদিতের ভরাট কণ্ঠস্বর শুনে রেবা, অভীক দুজনেই থামলো। অভীক বাঁকা হেসে বললো,,
“এতো তাড়া কিসের? ধীরে ধীরে কার্যক্রম পূর্ণ করি। প্রথমেই বলি তোর উপর আমার কোনো রাগ আমার বাবাকে খু’ন করেছিস বলে। আমার ওনার সাথে কোনো লেনদেন ছিলোনা, ছিল ওনার টাকার উপর এবং এখনো আছে। গত দুই বছর ধরে ওনাকে খু’ন করে সব সম্পত্তি আমি আর রেবা নিতে চাইছিলাম সেই সাথে এসজে গ্রুপের লিডার হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কোনোভাবেই সফল হইনি, যা তোর জন্য হয়েছি।

শালা খু’ন করলিটা কিভাবে? এতো সিকিউরিটি থাকার পরেও! তোর উপর আমার একটাই রাগ আমার বাবাকে খু’ন করলি ভালো কথা এতো টাকা লোকশান কেন করলি? ড্রাগস্ স্মাগলীন, নারী পাচার এছাড়াও আরো অনেক অন্যায় উপায়ে অর্জিত টাকার প্রায় অর্ধেক টাকা তুই অনাথ আশ্রম, হাসপাতাল, স্কুলের পেছনে খরচ করে ফেললি। কেন রে তুই কি সরকার যে ফ্রি তে সমাজসেবা করে বেরিয়েছিলি? কতগুলো টাকা তুই শেষ করে ফেলেছিস ফালতু কাজে! মেজাজটা যা গরম হয়েছিল, তোর বাপকে উঠিয়ে একধাপ থেরাপি দিয়েছিলাম।

রাগের বহিঃপ্রকাশ করলাম আরকি, এটা দেখিয়েই তোকে বাংলাদেশ থেকে কানাডা নিয়ে এসেছি। মূলত তোকে মা’রার আমার ইচ্ছে নেই। আমার বাপের এতো সিকুউরিটি থাকার পরেও খু’ন করে ফেললি এটি দক্ষ ভাবে। ভাবলাম তোর মতো একজন হিটম্যান পার্টনার এসজে গ্রুপের দরকার। তাই আরকি তোর সাথে এই বৈঠক। আমাদের পার্টনার হলে এখান থেকে বাপ নিয়ে জানে বেঁচে যেতে পারবি আর না হলে তোর উপরের টিকেট আমি কাটবো। আমি যে কি এর নমুনা তো পেয়েছিসই, তোর পাখির এমন অবস্থা করেছি বেচারী জীবন্ত লা’শ হয়ে আছে।(বাঁকা হেসে)

আদিত ভেতরে ভেতরে হতভম্ব হলেও বাহিরে নিজেকে কঠিন দেখালো। ইলার কথা ভাবতেই আদিতের ভীষণ রাগ উঠলো। মন চাইলো এখনই অভীককে খু’ন করে ফেলতে। তবুও নিজেকে শান্ত রাখলো আদিত, পুরো একমাস হয়েছেন কানাডা আসার। এতদিন পর নিজ ইচ্ছাতেই আজকে সে ধরা দিয়েছে অভীকের কাছে। অভীকের ধ্বংসের ব্যবস্থা করেই এখানে এসেছে সে। এদিকে আদিতকে একই ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে অভীক ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলে উঠলো,,
“পাপের রাজ্যে পাপেরই আগমন ঘটে। আমার বাপ পাপের রাজ্য গড়েছিল আমিও পাপের রাজ্যে পাপ হয়েই এসেছি। সেখানে টাকা, পাওয়ারের লোভে বাবাকে খু’ন করার পরিকল্পনা করা অস্বাভাবিক কিছুই না।”(ভাবলেশহীন কণ্ঠে)

অভীকের কথা বলার পর পরই রেবা বেসামাল অবস্থায় মাতাল কণ্ঠে বলে উঠলো,,
“বুঝলে ব্যব, তোমার প্রেয়সীর কথা জেনে ভীষণ রাগ উঠেছিল। তোমার মতো হ্যান্ডসাম আমার পাখি না হয়ে আরেকজনের পাখি হবে, বিষয়টা আমার হজম হতোনা। তাই প্রি-প্ল্যান করে তোমার প্রেয়সীকে ফুস করে দিলাম। বেচারি বোধহয় বাঁচবেও না।”(মাতাল কণ্ঠে)
আদিতের রাগ আকাশ ছোয়া হলো। কানে এয়ারপড ব্লুটুথের সাথে কানেক্ট ছিল আর এতক্ষন ধরে আদিত ও ইনতেহার কলে ছিল। আদিত শুনতে পেলো, “আদিত, আঙ্কেলকে নিয়ে সেফ জোনে আছি আপাতত। ওদের পার্ট চুকিয়ে দ্রুত বাহিরে আসো। ফ্লাইটের টাইমও হয়ে যাচ্ছে।”

ইনতেহারের বলা কথায় আদিতের মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো। এতক্ষন ধরে এদের ফালতু বকবক সহ্য করার মূল উদ্দেশ্যে ছিল বিপুল রায়কে সেফ জোনে নিয়ে যাওয়া অভীককে কথায় ব্যস্ত রেখে। যেটায় সফল হয়েছে আদিত। আদিত এখন আরেকটু আরাম করে বসলো। বাঁকা হেসে বললো,,
“তোর ভাগ্য কত সুন্দর, তোর বাবাও আমার হাতে মা’রা গিয়েছিলো। এখন তুই আর তোর স্টেপ সিস্টারও মা’রা যাবি।”

অভীক আর রেবা দুজনেই নেতিয়ে পড়েছে সোফায়। তাঁদের বিন্দুমাত্র শক্তি হচ্ছেনা মাথা বা শরীর তুলে দাঁড়ানোর।
“নাটক করে অ্যালকোহল খাচ্ছিলি তাইনা? তোকে যে এই অ্যালকোহল দিয়ে গেছে সে মাত্র অল্প কিছু টাকায় বিক্রি হয়ে গিয়েছিলো আমার কাছে। তোর অ্যালকোহলে ডায়াজিপাম ড্রাগস মিশিয়ে দিয়েছিলো সে। এতে করে ধীরে ধীরে নেশায় আবদ্ধ হয়ে স্থির হয়ে যায় মানুষ। তোর আর এই মেয়ের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তোদের করা লোভ, পাপের ফল আগুনে জ্ব’লসে মৃ’ত্যু। নেহাত ভালো হয়ে গিয়েছি, নয়তো আরো কঠিন যন্ত্রনাদায়ক মৃ’ত্যু দিতাম।”(রাগান্নিত স্বরে)

আদিত যে কক্ষে রয়েছে সেখানে অ্যালকোহলের অনেক বোতল রাখা ছিল ও বিভিন্ন ড্রাগস এর প্যাকেটও ছিল। মূলত এই কক্ষে অভীক, রেবা আর এসজে গ্রুপের অনেকে নেশা করতো। আদিত সেখান থেকে অ্যালকোহলের পাঁচ ছয়টা বোতল নিয়ে রেবা আর অভীকের শরীরে ঢেলে দিলো। পকেট থেকে লাইটার বের করে আগুন জ্বালিয়ে দিলো। অভিক আর রেবা নেশাক্ত ও নেতিয়ে পড়েছে যার ফলে চেঁচাতেও পারছেনা। আদিত বাঁকা হেসে প্রস্থান নিলো কক্ষ থেকে।

“এই অবস্থায় এডমিশনের প্রিপারেশন কেন নিচ্ছ তুমি? রাত জেগে জেগে যে পড়ছো প্রেগন্যান্সিতে যদি সমস্যা হয়? তোমাকে আমি না করেছিলাম এডমিশনের জন্য প্রিপারেশন নিতে না, একবছর গ্যাপ দিলে কিছু হবেনা। তুমি এখন অসুস্থ, এই অবস্থায় কেন চাপ নিচ্ছ?”(কড়া কণ্ঠে)

মিতালির এহেন কণ্ঠে বলা বাক্য বচন শুনে মুখ থমথমে করে ফেললো সারু। প্রেগন্যান্সির তিনমাস প্রায় শেষের দিকের সময়। সারুর এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট প্রায় একমাসের কাছাকাছি হচ্ছে দিয়েছে। জিপিএ ফাইভ না আসলেও ফোর পয়েন্ট আট সাত পেয়েছে সে। সাইন্সের স্টুডেন্ট হিসেবে আর প্রিপারেশন অনুযায়ী সারু ভেবেছিলো এ প্লাস পাবে। তবে আশানুরূপ রেজাল্ট পেলোনা সে, তবে যা পেয়েছে তাতেই সে খুশি আছে। সারু ভাবে প্রেগন্যান্ট হলে কি হয়েছে এডমিশনের জন্য প্রিপারেশন নিবে। কিন্তু এতে ঘোর বিপত্তি জানিয়েছেন মিতালি। শেরহাম নিজেও বারণ করেছে সারুকে এই বছর এডমিশন দিতে না কিন্তু সারু পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দিয়েছে যত যাই হোক সে এডমিশন প্রিপারেশন নেবে আর এডমিশনও দিবে। রাত প্রায় আটটার কাছাকাছি, সারু নিজের কক্ষে বসে পড়ছিলো। শেরহাম অফিস থেকে দ্রুত ফিরেছে আজকে, ফ্রেশ হওয়ার জন্য সে বাথরুমে গিয়েছে। মিতালি সারুর জন্য খাবার নিয়ে আসতেই সারুকে পড়তে দেখেই রাগান্নিত স্বরে কথাটা বলে উঠেন।

সারু মিতালির কথা শুনে বইয়ে পৃষ্ঠা ভাজ করে রেখে মিতালির দিকে তাকিয়ে বলে উঠেলো,,
“এক বছর গ্যাপ দেওয়া মানে অনেকটা সময় হারিয়ে ফেলা। আমি সময় হারাতে চাইনা, আমি একদম সুস্থ আছি। যা হবে সবটাই ভালো হবে, থিঙ্ক পজিটিভ মা।”(নরম স্বরে)
মিতালি খাবারের প্লেট নিয়ে এগিয়ে আসলেন সারুর দিকে। সারু পড়ার টেবিলে বসে ছিল। মিতালি পাশে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। ভাত মাখিয়ে সারুর মুখের সামনে তুলে ধরে বললেন,,
“সবটা ভালো হবে জানি, তবে তোমার এই অসুস্থ শরীর নিয়ে এতটা চাপ নেওয়া উচিত নয়। এতে তোমার আর বাচ্চার দুজনের সমস্যা হতে পারে।”(মৃদু স্বরে)

সারু আলতো হাসলো, খাবারটা মুখে নিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল,,
“এতটুকু কিছুই না, এটা কোনো চাপই না। আমাদের সমস্যা হবেনা।”
“হয়েছে, খাবার মুখে নিয়ে কথা বলতে নেই।”(গম্ভীর স্বরে)
সারু টেডি স্মাইল দিয়ে মিতালির হাতে খেতে লাগলো। সারুর অদ্ভুত লাগে এই মহিলা আজ থেকে তিনমাস আগেও কেমন ছিল আর এখন কেমন! সারুর নিজের মায়ের মতো খেয়াল রাখে! এইতো সপ্তাহখানেক আগের কথা, রান্না ঘরে মিতালিকে সাহায্য করতে গিয়েছিলো সারু। মিতালি সাহায্য করতে বারণ করেছিল কিন্তু সারু অবাদ্ধ হয়ে হাতে হাতে এটা ওটা করে দিচ্ছিলো। এরই মাঝে হুট্ করে তিনি সারুর হাত ধরে কান্না করে বলে উঠেছিলেয়েন, “আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও সারু। তোমাকে নিজের মেয়ের মতো করে রাখবো বলেও নিজের মেয়ের মতো রাখতে পারিনি। সর্বদা খারাপ আচরণ করেছিলাম এরজন্য আমি খুবই দুঃখিত ও লজ্জিত। আমায় ক্ষমা করো।”

সারু ভীষণ অবাক হয়েছিল, মায়ের পরে ঠিক সেদিন পুনরায় আবারো আরেক মাকে পেয়েছিলো। শুরুতে যেভাবে মিতালি তাকে আদর যত্ন ভালোবেসেছিলেন তেমনটাই বাসতে শুরু করেছেন। সারু রেগে নেই মিতালির আচরণে। সবশেষে মানুষটা ক্ষমা চেয়েছে বয়সে অনেক বড় হয়েও। এরপরেও সারু রাগ করে থাকার কারণ পায়নি। খেতে খেতে এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সারু।
“সব ভালোবাসা বউমায়ের নামে রেজিস্ট্রেশন করলে ছেলে তো ভালোবাসার অভাবে দেউলিয়ে হয়ে যাবে। কিছু শেরহাম রায়ের নামেও রেজিস্ট্রেশন করো।”(অসহায় কণ্ঠে)
শেরহামের কথায় ফিক করে হেসে দিলো সারু। মিতালি শেরহামের দিকে একনজর তাকিয়ে সারুকে খাইয়ে দিতে দিতে বললেন,,

নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ২৮

“আমার ভালোবাসা এখনো তোমার একাউন্টে অনেক জমা রয়েছে, ওগুলো নিয়ে খুশি থাক। আপাতত ভালোবাসা সব সারু পাবে। তোমার জমাকৃত ভালোবাসা নিয়ে তুমি খুশি থাকো।”(মৃদু স্বরে)
শেরহাম দুঃখী দুঃখী ভাব করে বলে উঠলো,,
“নাতি নাতনি আসলে এভাবেই বাড়ির ছেলেকে সবাই ভুলে যায়। তখন নাতি নাতনি আর বউমাই সব, হুহ।”(দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে)

নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব ৩০