নীল চিরকুট পর্ব ১১+১২
নৌশিন আহমেদ রোদেলা
‘ তোর কি মনে হয়? এতোকিছুর পরও ওই ফাজিলটাকে রিকুয়েষ্ট করবো আমি? ইম্পসিবল!’
নীরা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বিরক্ততে চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
‘ দরকারটা আমাদের নমু। তাই রিকুয়েষ্টটা আমাদেরই করতে হবে। এতো ইগো দেখালে কি চলে বল?’
নীরার কথায় রাগে গা জ্বলে উঠল নম্রতা। চোখের আগুনে নীরাকে ঝলসে দেওয়ার চেষ্টা করে বলল,
‘ ইগো? আমি ইগো দেখাচ্ছি? এটাকে ইগো নয় সেল্ফরেসপেক্ট বলে। মানুষের মিনিমাম সেল্ফরেসপেক্ট থাকা উচিত। আর আমার তা আছে। সো,আমি যাচ্ছি না। ব্যস!’
নীরা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
‘ প্লিজ দোস্ত। দু’মিনিটের জন্য “সেল্ফরেসপেক্ট” ওয়ার্ডটা ভুলে যা। কাজটা হয়ে গেলে আবার মনে করে নিস। আপাতত এসাইনমেন্টটা কমপ্লিট করতে হবে। নয়তো… শেষ! এক্কেবারে ফেইল। প্লিজ দোস্ত!’
নম্রতা স্পষ্ট গলায় বলল,
‘ ফেইল হলে ফেইল তবুও ওই ব্যাটার কাছে যাবো না আমি। সামান্য একটা ডাক্তার হয়ে আকাশ ছোঁয়া ভাব। উনাকে দেখে কি মনে হয় জানিস? মনে হয়, এই দুনিয়ায় সেই একমাত্র ডাক্তার আর কোনো ডাক্তার এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে নি আর করবেও না। ব্যাটা, বেয়াদব!’
নীরা নম্রতা থেকে খানিকটা দূরে সরে দাঁড়াল। আড়চোখে নম্রতার দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ নতুন ডাক্তার তো তাই। মেডিক্যালের লেকচারারদের ভাব দেখানোটা স্বাভাবিক। তারওপর তুই যা করেছিস।’
নাক ফুলিয়ে নীরার দিকে তাকাল নম্রতা। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
‘ আমি করেছি? কি করেছি আমি? বল কি করেছি? এখন তো সব দোষ আমাকেই দিবি। তুই আমার ফ্রেন্ড নামে কলঙ্ক। এই মুহূর্তে ওই ব্যাটার চামচার খাতায় নাম লিখা গিয়ে যা।’
নীরা মুখ কালো করে বলল,
‘ ধুর! শুধু শুধু বাজে বকছিস নমু। চল না প্লিজ। পরশো এসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে। না দিলে এক ইয়ার লস। আশরাফুল স্যারকে তো চিনিস। ব্যাটা কেমন স্ট্রিক্ট! এসাইনমেন্ট জমা না দিলে শুধু এফ গ্রেড না এর থেকেও বেইজ্জতের কিছু থাকলে তাই দিয়ে দিবে। তারপর মিলাদের গা জ্বলানো কথা। আমাদের ইমেজের প্রশ্ন চলে আসছে দোস্ত। বাসায়ও বাঁশ খেতে হবে। প্লিজ নমু , রাজি হয়ে যা না। প্লিজ, প্লিজ। বিপদে পড়লে কি এতো ভাবলে চলে?’
নম্রতা জোরে একটা শ্বাস টেনে নিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। হসপিটালের দিকে চোখ রেখে খানিক ভেবে বলল,
‘ বেশ! চল। কিন্তু ওই ফাজিলটার সাথে একটা কথাও বলবো না আমি। যা বলার তুই বলবি। ওকে?’
নীরা খুশি হয়ে বলল,
‘ ওকে,ওকে।’
নিজের স্বার্থের কথা ভেবেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও হসপিটালের ভেতরের দিকে এগিয়ে গেল নম্রতা আর নীরা। ডক্টরের চেম্বারের সামনে এসে দাঁড়াতেই তার এসিস্ট্যান্টকে ডেকে জিগ্যেস করল নীরা,
‘ এক্সকিউজ মি? ডক্টর.আরফান চেম্বারে আছেন?’
এসিস্ট্যান্ট মাথা নাড়লো। অতিরিক্ত ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,
‘ জ্বি না। স্যার, ক্লাসে আছেন। দুটোয় ক্লাস শেষ হবে।’
এসিস্ট্যান্টের কথা শুনে চোখ কপালে উঠল নম্রতার। কী বলছে এসব? দুটোই ক্লাস শেষ হবে? অথচ, এখন বাজছে মাত্র সাড়ে বারো। নম্রতা কপাল কুঁচকে নীরার দিকে তাকাল। নীরাও অসহায় হরিণীর মতো মুখ করে চেয়ে রইল। আবারও এক দফা রাগ গিয়ে পড়ল ওই মানুষটির উপর। ব্যাটা সবসময় কোনো না কোনো ঝামেলা পাকায়। সৃষ্টিকর্তা হয়তো এই লোকটিকে ঝামেলার ফুল প্যাকেজ হিসেবেই এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। সাথে আস্ত বেয়াদবও বানিয়েছেন। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে করিডোরের চেয়ারে গিয়ে বসল নম্রতা। নীরা মুখ ফুলিয়ে নম্রতার দিকে তাকাল। নম্রতা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ এই ব্যাটা ইচ্ছে করে এমন করছে। কোনো ক্লাস ফাস নাই বুঝলি? আমাদের পেরেশানি বাড়ানোর সূক্ষ্ম চেষ্টা চালাচ্ছে খাটাসটা। দেড়টা থেকে যে আলামিন স্যারের ক্লাস, মনে আছে তোর? মাসে একটা মাত্র ক্লাস নেয় স্যার। ক্লাসটা টু মাচ ইম্পোর্টেন্ট।’
নম্রতার কথায় চাপা আর্তনাদ করে উঠল নীরা। পাশের চেয়ারটাতে ধপ করে বসে পড়ে বলল,
‘ মনে আছে কিন্তু এটাও তো ইম্পোর্টেন্ট দোস্ত। আজ ইনফরমেশন না পেলে একদিনের মাথায় তো এসাইনমেন্টটা শেষও করতে পারবো না। তারপর আবার ডক্টরের রিকমেন্ডেশন লাগবে। আজ কথা না বলে গেলে এরজন্যও ঘুরতে হবে আমাদের।’
রাগে চোখ-মুখ কুঁচকে খানিক শক্ত হয়ে বসে রইল নম্রতা। বিরবির করে বলল,
‘ আশরাফুল স্যার কেন যে এই ডাক্তারের কাছ থেকেই রিকমেন্ডেশন নিতে বললো আল্লাহ জানে। ঢাকায় কি আর কোনো ডাক্তার ছিলো না?’
নীরা দুঃখী দুঃখী কণ্ঠে বলল,
‘ স্টুডেন্টদেরকে স্যারের ইচ্ছেমতো ছয়জন ডক্টরের আন্ডারে ভাগ করে দিয়েছেন স্যার। এই টপিক সম্পর্কে হয়ত এই ছয়জন ডক্টরই ভালো ধারনা দিতে পারবে। আর আমাদের ভাগ্যের দোষে এখানে এসে পড়েছি আমরা। তবে,দোষটা কিন্তু ডাক্তারের নয় তোর। লোকটার কতো অমায়িক ব্যবহার দেখেছিস?তুই যদি উনার সাথে ঝামেলা না করতি তো এতোটা পেরেশানি হতো না আমাদের। ‘
নম্রতা রাগী চোখে তাকাল। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
‘ সেই! সব দোষ তো আমারই। আসলে, দোষ নয় ভুল। আমার প্রথম ভুলটা হলো, সাইকোলজির মতো ফাউল একটা সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশোনা করার ডিসিশন নেওয়া। আর দ্বিতীয় ভুল হলো, তোর মতো ডাফারকে বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে মেনে নেওয়ার ডিসিশন নেওয়া। ডাফার একটা! ‘
নীরা আর কথা বাড়ালো না। দীর্ঘ দেড় ঘন্টা পর ডক্টর.আরফান আলম কেবিনে এসে ঢুকলেন। তারা দু-দুটো প্রাণী যে কেবিনের সামনে বসে আছে সেদিকে ভুলেও তাকালেন না। এমন একটা ভাব নিলেন যেন এই দুনিয়ায় কেবিনের দরজা আর উনি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো বস্তু নেই। ব্যাপারটা নম্রতার আত্মসম্মানে লাগল। দরজার উপর লেখা,
“ডাঃ আরফান আলম
এমবিবিএস, এমসিপিএস(মেডিসিন)
প্রভাষক
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ”
দেখেই নেইম-প্লেটটা করাত দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে বুড়িগঙ্গার পানিতে ভাসিয়ে দেওয়ার ইচ্ছেটা প্রবল থেকে প্রবল হয়ে উঠল নম্রতার। নিজের রাগটা যথারীতি নিয়ন্ত্রণ করে নীরার দিকে তাকাল। নীরা ভাবাবেগ শূন্য গলায় আবারও এসিস্ট্যান্টকে ডাকল,
‘এক্সকিউজ মি? ডক্টর তো এসেছেন। উনাকে গিয়ে বলুন ভার্সিটি থেকে দু’জন স্টুডেন্ট এসেছে উনার সাথে দেখা করার জন্য।’
লোকটি চরম বিরক্তি নিয়ে ভেতরে গেলো। মুহূর্তেই ফিরে এসে বলল,
‘স্যার মাত্রই ক্লাস নিয়ে ফিরলেন। এখন লাঞ্চ করবেন। আগামী আধঘন্টা কারো সাথে দেখা করবেন না।’
নম্রতার রাগটা এবার আকাশ ছুঁলো। ক্ষেপে গিয়ে বলল,
‘ আশ্চর্য তো! দুটো মেয়ে সেই দুপুর থেকে ওয়েট করছে আর সে খাবার নিয়ে পড়ে আছে? পাঁচ মিনিট পর লাঞ্চ করলে কি মরে যাবে নাকি? লাঞ্চ তো আমরাও করি নি কই আমরা তো তার মতো খাওয়ার জন্য মরে যাচ্ছি না। আজাইরা!’
নীরা নম্রতার ডানহাতটা শক্ত করে চেপে ধরে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল। চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বলে জোরপূর্বক হেসে বলল,
‘ ইট’স ওকে। আমরা অপেক্ষা করছি।’
ডক্টর.আরফানের এসিস্ট্যান্টকেও তার মতোই বেয়াদব বলেই মনে হলো নম্রতার। নম্রতাদের থাকা না থাকা তার কাছে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব পেলো বলে মনে হলো না। নম্রতাদের দিকে বিরক্তিপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হেলতে দুলতে চলে গেলো। এসিস্ট্যান্টের এমন ব্যবহারে মেজাজটা আরো দু ডিগ্রি তেতে গেলো নম্রতার। নিজেদেরকে ফেলনা প্রাণীর মতো মনে হতে লাগলো। “ডক্টর” নামক শব্দটির উপরই একধরনের বিতৃষ্ণা জন্মাতে লাগলো। মনটা কালো রঙের পর্দায় ঢেকে যেতে লাগলো ধীরে ধীরে। সকাল সাতটাই ক্লাসের উদ্দেশ্যে হল থেকে বেরিয়েছিল দু’জনে। ক্লাস শেষ করে দু’ঘন্টা যাবৎ অপেক্ষা করে চলেছে শুধুমাত্র পাঁচ মিনিট সময় পাওয়ার অপেক্ষায়। অথচ সেই পাঁচ মিনিটের জন্যও দেখা দিতে পারছেন না ডক্টর.আরফান আলম। তার প্রতি বিদ্বেষটা নম্রতার নতুন নয় তবে আজ যেন তা প্রকাশ পাচ্ছে এক নতুন রূপে। ঘড়ি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে আরো আধাঘন্টা পাড় করল নম্রতারা। ক্ষুধা আর বিরক্তিতে শরীর মিইয়ে পড়ছে প্রায়। এমন সময় তার এসিস্ট্যান্ট এসে বলল,
‘ এখন রোগী দেখার সময়। আপাতত বাড়তি মানুষের সাথে দেখা করা সম্ভব নয়। বিকেল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত রোগী দেখেন না স্যার। হাসপাতালেই থাকে না। পাঁচটা বাজতে মাত্র আড়াই ঘন্টা বাকি। এর মধ্যে রোগী দেখা শেষ করতে হবে। রাউন্ডেও যেতে হবে। আপনারা সাড়ে সাতটার দিকে দেখা করতে পারবেন। আপনারা অপেক্ষা করতে পারেন। নয়তো চলে যেতে পারেন।’
এটুকু শোনার পর মেজাজটা ঠিক রাখা একবারেই দুষ্কর হয়ে উঠল। আরে বাবা, দেখা না করতে চাইলে আগে বললেই হতো এভাবে ভোগান্তিতে ফেলার মানেটা কি? কি মনে করে সে নিজেকে? প্রিন্স চার্মিং? নাকি মহাজান্তা? দেখতে তো আস্তা হনুমান আর গুণে আস্ত একটা বেয়াদব।
‘ দেখেছিস? লোকটা কেমন ঠান্ডা মাথায় বদলা নিচ্ছে। সেদিন এতোকিছুর পরও উচ্চবাচ্য করেননি। আজও না। চুপচাপ থেকে তার থেকেও বেশি নাচিয়ে ছেড়ে দিলেন।’
নম্রতা বিরক্ত কন্ঠে বলল,
‘ তুই কি এখানে ওই লোকের প্রসংশা করার জন্য বসে আছিস? ব্যাটা পাঁচটা থেকে সাতটা পার্সোনাল টাইম স্পেন্ড করে। ওই সময়টুকু থেকে পাঁচ মিনিটও আমাদের দেওয়া যেত না? সেই বারোটা থেকে বসে আছি। ন্যূনতম মানবিকতাটা থাকা উচিত।’
নীরা ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ তো? কী করবি এখন? সাড়ে সাতটা পর্যন্ত অপেক্ষা করবি?’
‘ সাড়ে সাতটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে হলে ফিরব কখন? আর সাড়ে সাতটায় যে এই ভদ্রলোক আমাদের সাথে দেখা করতে রাজি হবেন তারই বা কি নিশ্চয়তা আছে? মাঝে থেকে হলের ম্যামের কাছে পানিশমেন্ট খেয়ে বসে থাকব।’
দ্বিধাদ্বন্দ নিয়ে আরও আধ ঘন্টা মতো বসে রইল তারা। তারপর সাড়ে সাতটা পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল। আরফান নিয়মমাফিক রোগী দেখে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেল পাঁচটায়। সন্ধ্যা পেরিয়ে ঠিক সাতটায় আবারও হাসপাতালে ঢুকল সে। নীরা ঘড়ি দেখে বিরবির করে বলল,
‘ বেশ পানচুয়াল।’
নম্রতা রাগী চোখে তাকাতেই চুপ হয়ে গেল নীরা। ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে বিধ্বস্ত নীরা-নম্রতার ডাক পড়ল রাত আটটা কুড়ি মিনিটে। হিমশীতল কেবিনে বসে থাকা আরফান তার থেকেও হিমশীতল কন্ঠে বললেন,
‘ বসুন।’
নীরা, নম্রতা চেয়ার টেনে বসল। দুজনেই ক্লান্তিতে পর্যুদস্ত। চুল উসকো-খুসকো , এলোমেলো। আরফান সেসব কিছু পাত্তা না দিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
‘ আপনারা হয়ত সাইকোলজি ডিপার্টমেন্ট থেকে এসেছেন। স্যারের মেইল পেয়েছি আমি। অপেক্ষা করানোর জন্য দুঃখিত। বলুন, কিভাবে সাহায্য করতে পারি।’
নম্রতা অত্যন্ত ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে তাকাল। এই লোকটির সাথে সাক্ষাৎ-ই তার ঝামেলাপূর্ণ। শুধুমাত্র এই ব্যক্তির জন্য নতুন করে হারানোর কষ্টে কাঁদতে হয় তাকে। তার ওপর আজকের এই ভোগান্তি! নম্রতাকে চুপ থাকতে দেখে। নীরাই আলোচনা এগিয়ে নিল। সবরকম তথ্য নিয়ে আলোচনা শেষ করতে করতে ঘড়িতে সাড়ে নয়টার ঘন্টা বাজল। আরফানকে ধন্যবাদ দিয়ে অনেকটা দৌড়েই কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো তারা। আরফান তাদেরকে গাঢ় দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছিল। নম্রতার ঘৃণাভরা দৃষ্টিটা কি চোখে পড়েছিল তবে? নম্রতারা হলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দশটা বাজল। যথারীতি তাদের ঢুকতে দেওয়া হলো না। গেইটের দারোয়ানকে টাকা খাইয়েও ভেতরে ঢুকার সু্যোগ হলো না। শেষমেশ বাধ্য হয়েই সাড়ে দশটার দিকে ধানমন্ডিতে নিজের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হলো তাদের। সিএনজি খুঁজতে খুঁজতে ভারি রাগ নিয়ে বলল নম্রতা,
‘ এতো রাতে একা কোথায় গিয়েছি আমরা? বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সাড়ে এগারোটার বেশি বাজবে। রাস্তাঘাটে কোনো দূর্ঘটনা হলে? সব দোষ এই ডাক্তারের। এই লোকটাকে আমার সহ্যই হচ্ছে না। বেয়াদব!’
নীরা জবাব দিল না। নম্রতা তেজ নিয়ে বলল,
‘ কী হলো? বোবা বনে গেলি কেন হঠাৎ?’
নীরা শূন্য দৃষ্টিতে নম্রতার দিকে তাকাল। কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলল,
‘ আমরা তো একটা ভুল করে ফেললাম নমু।’
নম্রতা ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
‘ কী ভুল?’
‘ ওই লেকচারার, আই মিন নিষাদ নামক ছেলেটা তো ডক্টর আরফানের বন্ধু। আমরা উনার থেকে নিষাদের ঠিকানা নিতে পারতাম। ওই সময়ে মনেই ছিল না।’
নম্রতার মুখে কালো ছায়া দেখা গেল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
‘ চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী? পরশু তো আমরা আবারও আসছি। তখন টেকনিক্যালি জিগ্যেস করলেই হবে। ব্যাটাকে একবার পেয়ে গেলে বুঝাব মজা।’
নম্রতা ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। হঠাৎ করেই আবিষ্কার করল মনটা ভালো নেই তার। সব মিলিয়ে নিজের উপরই ভীষণ বিরক্ত সে। এই অসহ্যকর জীবনটা আর এক দন্ডও ভালো লাগছে না তার। সেই ‘সে’ কে খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত সে। ধৈর্য্যের বাঁধ এবার ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। আর কত সহ্য করে যায় এই বিষাদ?
কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি হয়েছে। সপ্তাহের তীব্র গরম ধুয়েমুছে স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে প্রকৃতি। ধুলোবালিতে ঢেকে থাকা শহরের গা জুড়ে স্নান শেষের স্নিগ্ধতা আর মায়া। গাছের পাতাগুলো হয়ে উঠেছে উচ্ছল সবুজ। লেকের টলটলে পানিতে প্রাণ এসেছে। পানির ওপর ভেসে আছে দু’একটা কৃষ্ণচূড়ার পাঁপড়ি। লেকের দক্ষিণ দিকের ব্রেঞ্চটাতে পায়ের জুতো জুড়া রেখে তারওপর বসে আছে নাদিম। মাথার উপর থাকা বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছের পাতা চুইয়ে পড়ছে জল। হেলে পড়া সূর্যের কিরণে সেই জলে মোহনীয় এক রং লেগেছে। স্নিগ্ধ কমলা রং।
অন্তু, রঞ্জু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সামিয়ানা দেওয়া দোকানগুলো থেকে পলিথিন জোগার করে এনেছে। ভেজা ব্রেঞ্চে পলিথিন রেখে তারওপর সংকুচিতভাবে বসে আছে। নীরা ব্রেঞ্চের গায়ে ঠেস দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে। কড়া সবুজ রঙের জামাতে গায়ের রং-টা ফুটে উঠেছে তার। সেই রঙের মাঝে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াচ্ছে অপর একজনের চোরা দৃষ্টি। ছোঁয়া কৃষ্ণচূড়া গাছের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে তার গাঢ় নীল ফতুয়া আর জিন্স। চশমাটা ফতুয়ার গলায় ঝুলছে। বিরক্ত দৃষ্টি লেকের পাশের কাঁদা আর জমে থাকা ঘোলাটে পানির ওপর ঘুরাফেরা করছে। বন্ধুদের এই উৎকট পছন্দে রীতিমতো বিরক্ত সে। নম্রতা ব্রেঞ্চের সামনে দ্রুতপায়ে পায়চারী করছে। সবার দৃষ্টি নম্রতার চলার সাথে সাথে এদিক থেকে ওদিকে ঘুরছে। এক মুঠো মাখা চানাচুর মুখে পুড়ে নিয়ে ধমকে উঠল নাদিম। চানাচুর চিবোতে চিবোতে বলল,
‘ ওই হারামি? এমনে লাগাইছত ক্যান? মাথা চক্কর মারতাছে। এক জায়গায় খাঁড়া বাল।’
ছোঁয়ার বিরক্তি আরও খানিকটা বাড়ল। নাক কুঁচকে বলল,
‘ খাবার মুখে দিয়ে কথা বলিস কেন? ছিঃ। আর কথাবার্তাগুলো একটু ভদ্রভাবে বলা যায় না? খ্যাত!’
নাদিম দাঁত কিরমির করে বলল,
‘ শালার… ‘
অন্তু গালে হাত দিয়ে বসেছিল। গাল থেকে হাত সরিয়ে আড়মোড়া ভাঙল। নিজস্ব ভঙ্গিতে হেসে বলল,
‘ দয়া করে আবার ঝগড়া টগড়া শুরু করিস না তোরা। সন্ধ্যা নেমে যাবে একটু পরেই। আগে ঝামেলাটা মিটিয়ে নিই তারপর যত ইচ্ছে ঝগড়া করিস। প্যারা নাই।’
নাদিম হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর মতো ভঙ্গিমা করে বলল,
‘ কাগজের লেখাটা ফ্লুইড দিয়ে মুছিয়ে ফেললেই হয়।’
নম্রতা জ্বলে উঠে বলল,
‘ তোর মাথা হয়। আশরাফ স্যারকে চিনোস না? ব্যাটা ঠিকই বুঝবে।’
নাদিম আবারও দূর্দান্ত এক বুদ্ধি দিল,
‘ উপরের পাতাটা খুইলা ফালাইয়া দিয়া নতুন পৃষ্ঠা লাগাইয়া দে। টাক্কু ব্যাটায় বুঝব না।’
অন্তু ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ তাতেই বা কি? সেখানে আরফান আলমের রেফারেন্স তো লাগবেই। ওটা আনার জন্য হলেও চেম্বারে আবার যেতেই হবে।’
নম্রতা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
‘ ওই অসভ্য লোকের কাছে আমি যাবোই না আর। ন্যূনতম মানবতা নেই লোকের। বেয়াদব একটা। অসহ্য! এই লোককে ডাক্তার কে বানাইছে? আল্লাহ যদি একটা খুন মাফ করত, কসম আমি এই লোকরে খুন করতাম। উফ! উফ!’
‘ অলওয়েজ চিরিং বিরিং করে লাফালে এমনই হয়। কি দরকার ছিল এতো চপর চপর করার? যার লাঠি তারই মাটি, বুঝছিস? একটু চুপচাপ থেকে সাইনটা নিয়ে এলেই পারতি। ওই দুই মিনিট তোর মুখ বন্ধ থাকল না?’
রঞ্জনের কথার পিঠে বেশ সাবধানী কন্ঠে বলল নীরা,
‘ ব্যাটা কিন্তু খুব খারাপ না। আমার এসাইনমেন্টে কিন্তু কোনো গন্ডগোল করেনি। চুপচাপ সাইন দিয়ে দিয়েছে।’
নীরার কথায় তেড়ে এলো নম্রতা। চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘ ওই হারামি! তুই আবার ওই ব্যাটার চামচাগিরি করতাছিস? দ্যাখ, তুই যদি ওই ব্যাটাকে পটাইয়া বিয়েশাদী করার চিন্তায় থাকিস তাহলে তোর বিয়েতে আমরা একটাও যাব না। এতো মাখন ভালো না।’
নম্রতার শেষ দুটো বাক্যে চোখ বড়বড় করে তাকাল অন্তু। বিদ্বেষ নিয়ে বলল,
‘ মানে? ওই ব্যাটার সাথে এই পাগলা ঘন্টীর কিছু চলে নাকি?’
‘ তা নয়তো কি? সেইদিন থেকে তো আর এমনি এমনি গুণ গেয়ে বেড়াচ্ছে না। অতকিছুর পরও কেউ গুণ গায়?’
অন্তুর শ্যামলা মুখটা কালো হয়ে গেল। গা জ্বলানো কন্ঠে বলল,
‘ ওহহো, পরিষ্কার গায়ের রং দেখেই পটে গিয়েছে। দোস্ত তুই তো ভালোই টুপ ফেলছিস। ডাক্তার ফাক্তারদের বহুত টাকা।’
নীরা আগুন দৃষ্টিতে তাকাল। তপ্ত কন্ঠে বলল,
‘ খবরদার উলটো পালটা কথা বলবি না অন্তু। তোর কথা শুনেই বুঝা যায় তোর মন কত কালো।’
‘ সেই! কালো হবে না কেন? আমিও কালো, আমার মনও কালো। তোদের মত ধলাদের সাথে আমার যায় নাকি?’
‘ কথাটাকে আমি ওভাবে বলিনি।’
‘ আমি বুঝে নিয়েছি। বুঝানোর জন্য ধন্যবাদ।’
ওদের কথাবার্তার ধরনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সবাই। ছোঁয়া দাঁতে নখ কাটতে কাটতে ভীত চোখে চেয়ে রইল। নাদিম মুখ পুড়ে চেনাচুর নিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকাল। নম্রতাকে কড়া চাহনি দিয়ে বলল,
‘ গ্যাঞ্জাম লাগাই দিছত হারামি।’
নম্রতা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে ছিল। নাদিমের কথায় ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। আবারও সব রাগ গিয়ে পড়ল আরফানের উপর। ওই বেয়াদব লোকটার জন্যই তো এমনটা হলো। এই একটা লোকেই নম্রতার জীবনটাকে ছারখার করে ছেড়ে দিল। সারারাত জেগে এসাইনমেন্ট করে ঘুমু ঘুমু চোখ নিয়ে ক্লাস করেছে নম্রতা, নীরা। টানা দুটো ক্লাস শেষ করে, খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে আরফানের চেম্বারে গিয়েছে একটা সাইনের প্রয়োজনে। আরফান আজ প্রথমেই কোনো গন্ডগোল করেনি। আধঘন্টা- একঘন্টা পরই চেম্বারে ডেকেছিল তাদের। সবই ঠিকঠাক ছিল কিন্তু বিপত্তি বাঁধল অন্য জায়গায়। মনে মনে নিরন্তর বলে চলা গালিগালাজের একটা দুটো হুট করেই স্পষ্টভাবে বেরিয়ে এলো নম্রতার মুখ থেকে। নীরা অবাক দৃষ্টিতে নম্রতার দিকে তাকাল। আরফানের সচেতন কানে তা বোধহয় হাতুড়ি পেটা করে গেল। কপাল কুঁচকে সামনে বসা তরুণী দু’জনের দিকে তাকাল। একদম ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল,
‘ আপনাদের এসাইনমেন্টগুলো দিন। কোথায় সাইন করতে হবে?’
নম্রতা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বসে ছিল। আরফানের স্বাভাবিক কন্ঠে খানিকটা স্বস্তিই পেল। তবে কি লোকটি গালিদুটো শুনেনি? ইয়া মাবুদ! তোমার হাজার হাজার শুকরিয়া। আরফান খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সাইন করে ফাইলদুটো ফিরিয়ে দিল। নীরা নিজের এসাইনমেন্টটা দেখে নিয়ে স্মিত হেসে ধন্যবাদ জানাল। অপরদিকে নম্রতার মাথায় হাত। তার এসাইনমেন্টে লাল কালিতে বড় বড় করে লেখা,
‘ Not as expected. There is some lack. Need to improve. ‘ তার নিচে ইংরেজিতে সাক্ষর। নম্রতা লেখাটা দেখে বিস্ফারিত চোখে আরফানের দিকে তাকাল। আরফান অত্যন্ত ভদ্র কন্ঠে বলল,
‘ আপনারা কিছু মনে না করলে, এবার আসতে পারেন। বাইরে বেশকিছু প্যাশেন্ট ওয়েট করছে। দুটোয় ক্লাস। তাদেরকে সময় দেওয়া জরুরী।’
নীরা আর নম্রতা বোবা চাহনী নিয়ে বেরিয়ে এলো। চেম্বার থেকে বেরিয়েই নম্রতা রণচণ্ডী রূপ ধারণ করল। তবে নীরা ভাবলেশহীন। তার মতে, আরফান ভুল কিছু করেনি। নিজের চেম্বারে বসে, মুখের ওপর কেউ গালি দিলে দুনিয়ার কেউই নেচে নেচে সাহায্য করতে আসবে না। আরফান যে তাদের চেম্বার থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়নি এটাই তো ভাগ্য। সেই থেকে এখন পর্যন্ত নম্রতার ক্যাচ ক্যাচ খ্যাচ খ্যাচ চলছে। শাহবাগ থেকে রমনা পার্ক পর্যন্ত সে নিরন্তর গালাগাল করে এসেছে। শাহাবাগ মোড় থেকে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নাদিম। কিছু না-জেনে, না-শুনেই ভয়ানক সব গালি দিয়ে বন্ধুদের কান ঝালাপালা করে ফেলেছে। নাদিমের গালির তোড়ে এক পর্যায়ে হার মানতে হয়েছে নম্রতাকে। বাকি বন্ধুদের মতো তাকেও অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইয়ারফোন কানে দিয়ে ফুল সাউন্ডে গান শুনতে হয়েছে। নাদিমের হৈচৈ- এ বর্তমানে ফিরল নম্রতা। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে নাদিমের দিকে তাকাতেই উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলে উঠল সে,
‘ ধুরু! এই মাইয়া গো কথা মাইন্ডে নিতে হয় নাকি দোস্ত? বাদ দে তো। চল, আইজ আবার বাজি লাগুক।’
অন্তু অন্যদিকে তাকিয়ে চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,
‘ আমি যার-তার কথা মনে রাখি না দোস্ত। চল। লেটস্ প্লে। যে হারবে আজকের রাতে খাওয়ার বিল হবে তার।’
অন্তুর প্রথম কথাটা তীরের মতো গিয়ে বিঁধল নীরার বুকে। মুহূর্তেই ভার হয়ে গেল মন। নাদিম ভাব নিয়ে বলল,
‘ ব্যাপারই না। আইজ আমি আর তুই। রঞ্জন বাদ।’
রঞ্জন বাঁকা হেসে বলল,
‘ তোরা কখনই আমার সাথে জিততে পারিস না।’
নাদিম রঞ্জনের কথায় পাত্তা না দিয়ে উঠে দাঁড়াল। জুতো জুড়া পরে নিয়ে টি-শার্ট আর চুল ঠিক করল। গিটারটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে অন্তুর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল। বলল,
‘ মাম্মা দুইটা। ‘
অন্তু চমৎকার হাসল। তার হাসি দেখে আফসোসের হাসি হাসল নাদিম। বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ তুমি মামা হাসি মাইরাই মেয়ে পটায় ফেলো। হাসবি না খবরদার।’
নাদিমের কথায় হুহা করে হেসে উঠল অন্তু। নাদিম হলুদ রঙের জামা গায়ে একটি মেয়েকে ইশারা করে বলল,
‘ দোস্ত, তুই আগে। ওই মাইয়াটা।’
অন্তু দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াল। হেসে একবার বন্ধুদের দিকে তাকাল। বুকে ফু দিয়ে নিয়ে বলল,
‘ জুতা পেটা না খাই। আল্লাহ বাঁচাইও।’
নাদিম এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজল। তারপর হাতের ইশারায় ডাক দিতেই দৌঁড়ে এলো দশ এগারো বছরের একটি বাচ্চা। গোলাপী, ময়লা একটি জামা গায়ে। খালি পা। ময়লা, পিংলে চুলগুলো ঝুঁটি বাঁধা। হাতের নীল মগে গোলাপ আর বিভিন্ন ফুল। নাদিম খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
‘ তোর কাছে আজ কয়টা ফুল আছে রে সুমাইয়া?’
সুমাইয়া উল্টাপাল্টা গুণে নিয়ে আন্দাজি বলল,
‘ পঞ্চাইশটা।’
‘ আচ্ছা। পঞ্চাশটা থেকে চারটা ফুল আমায় দে। ওই আপুগুলো যদি পটে যায় তাহলে তোকে প্রতি ফুলের জন্য ডাবল টাকা দেওয়া হবে। আর যদি না পটে জুতো দিয়ে দৌঁড়ানি দেয় তাহলে টাকা পয়সা পাবি না। ওই টাকা দিয়ে ঔষধ কেনা লাগব। জুতোর বাড়ি খেলে ঔষধ লাগাতে হবে। বুঝছিস?’
সুমাইয়া খুশিতে ঝুমঝুম করে উঠল। এই ভাইয়া-আপুর দলটাকে ভীষণ ভালো লাগে তার। এরা কখনোই তাকে বকে না, ধমকায় না। ঘেন্নাও করে না। পাশে বসতে দেয়। যাওয়ার সময় প্রতিবারই এতোগুলো ঝালমুড়ি আর টাকা দেয়। সুমাইয়ার থেকে একটা গোলাপ নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল অন্তু। বন্ধুরা চাপা উত্তেজনা নিয়ে অন্তুর দিকে তাকিয়ে রইল। সুমাইয়ারও উৎসাহের শেষ নেই। এই ভাইয়ারা প্রায় প্রায়ই এমন খেলা খেলে। খেলা শেষে সবাই যখন দৌঁড়ে পালায় তখন সুমাইয়াকেও দৌঁড়াতে হয়। সুমাইয়ার ভালোই লাগে। ওই সুন্দর দেখতে আপুগুলো যখন খিলখিল হাসে কি সুন্দর দেখায় তাদের মুখ! এদের গা থেকে ভুরভুর করে সুন্দর গন্ধ বেরোয়। ফুলের থেকেও সুন্দর গন্ধ। কি ভালোই না লাগে সেই গন্ধ!
ঘড়ির কাটা বারো বাজতে চলল। টেবিলে বসে ফোনের উপর ঝুঁকে আছে নম্রতা। অলস ভঙ্গিতে ফেসবুক স্ক্রল করছে। একটু আগেই এসাইনমেন্ট শেষ করেছে সে। সেইসাথে এক ঝাঁক চিন্তা এসে বাসা বেঁধেছে মাথায়। কাল বারোটায় এসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে। ওই বেয়াদব লোকটা যদি এগারোটার আগে সাইন না দেয় তবে কি করে চলবে? চিন্তায় মাথা ভনভন করছে নম্রতার। নম্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। হঠাৎ করেই উপলব্ধি করল, তার কান্না পাচ্ছে। তার ডায়েরি, তার ভালোবাসার মানুষটির স্মৃতিগুলো বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রণা তৈরি করছে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, ডায়েরি হারানোর পেছনে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী লোকটির কাছেই হার মানতে হচ্ছে নম্রতাকে। আচ্ছা? সত্যিই কি ওই বেয়াদব লোকটার বন্ধুই তার ‘সে’? তাই যদি হয় তাহলে নম্রতার কোনো খোঁজ-খবর নেয় না কেন সে? সে কি নম্রতাকে মিস করে না? নম্রতার যেমন হঠাৎ করেই নিজেকে পাগল পাগল লাগে।
চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। তার হয় না? আচ্ছা? মানুষটার কি বিয়ে হয়ে গিয়েছে? সিনেমা, নাটকের মতো ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে পরিবার? এটাই কি তার এই নিরুদ্দেশ যাত্রার প্রধান কারণ? নাকি সবকিছুই ছিল সাজানো, সুন্দর কোনো নাটক? নম্রতা আর ভাবতে পারে না। অবচেতন মন ফেসবুকে ‘আরফান আলম’ নাম সার্চ দিয়ে বেড়ায়। বাংলা ফন্টে না পেয়ে ইংরেজিতে খুঁজে। আবার বাংলায় খুঁজে। অবশেষে পেয়ে যায় সেই প্রত্যাশিত আইডি। আইডি পেয়েই চট করে প্রোফাইলে ঢুকে গেল নম্রতা।
পুরো প্রোফাইল ঘেঁটেও আহামরি কিছু পাওয়া গেল না। খুবই সাধারণ একটি প্রোফাইল। বছর আগের পাঁচ-দশটা পোস্ট আর তাতে শ’খানেক রিয়েক্ট। প্রোফাইল পিকচারে নান্দনিক পার্কে সাদা শার্ট গায়ে বসে থাকা রুচিসম্মত একটি ছবি। ছবির পেছনের দৃশ্য দেখে বোঝা যাচ্ছে ছবিটি বাংলাদেশে তোলা নয়। ব্যাটা কি বিদেশী নাকি? নম্রতা আরও কিছু ছবি দেখল। এর আগের প্রোফাইল পিকচারগুলোও বিদেশেই তোলা। নম্রতা ঠোঁট উল্টাল। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে প্রোফাইল থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর আবারও ঢুকল প্রোফাইলে। প্রচন্ড সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সে। নীরার সাথে আলোচনা করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু আপাতত তা সম্ভব নয়। নীরার মনটা আজ ভীষণ খারাপ। তাকে এসব নিয়ে ঘাটানো চলবে না। নম্রতা বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে ম্যাসেজ রিকুয়েষ্ট পাঠাবে বলে ঠিক করল। অসহ্য লোকটি এখন অনলাইনে আছে। ম্যাসেজের রিপ্লাই দিলেও দিতে পারে। অনেক ভেবে-চিন্তে। নিজের আত্মসম্মানকে বস্তাবন্দি করে ম্যাসেজ পাঠাল নম্রতা,
‘ আসসালামু আলাইকুম ডক্টর আরফান আলম স্যার। আপনার সাথে একটু জরুরি কথা ছিল।’
ম্যাসেজটা দিয়ে উশখুশ করতে লাগল নম্রতা। দশ মিনিটের মাথাতেও যখন ম্যাসেজ সীন হলো না তখন তার উশখুশ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেল। রাগে নিজের চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার। কি দরকার ছিল নক করার? যেচে পড়ে ফাউ এটিটিউট দেখার কোনো মানে হয়? পরক্ষণেই ভাবল, এছাড়া তো উপায়ও নেই। ব্যাটাকে না মানালে দেখা যাবে বারোটার আগে ব্যাটার দেখায় পাওয়া যাবে না। আর নগদে এত বড় একটা শূন্য ঝুলে যাবে নম্রতার খাতায়। উত্তেজনা ধরে রাখতে না পেরে ফোন রেখে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল নম্রতা। নীরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে ব্যস্ত। নম্রতা বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ দোস্ত?’
নীরা না তাকিয়েই উত্তর দিল,
‘ হু।’
‘ অনেক বেশি মন খারাপ? ‘
নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ মন খারাপ কেন থাকবে? মন খারাপ না। ভাল্লাগছে না কিছু। সবকিছু অসহ্য লাগছে। গোটা জীবনটাকেই কেমন অসহ্য লাগছে।’
নম্রতা বেশ রয়ে সয়ে বলল,
‘ তুই অন্তুকে পছন্দ করা সত্ত্বেও কেন মেনে নিচ্ছিস না, বল তো?’
নীরাকে বেশ অপ্রস্তুত দেখাল। থতমত খেয়ে বলল,
‘ আমি অন্তুকে পছন্দ করি? কে বলল তোকে? আন্দাজি।’
‘ তুই কাকে, কতোটুকু পছন্দ করিস সেটা আমার অন্যকারো থেকে জানতে হবে? আমি বুঝি না?’
নীরা দৃঢ় কন্ঠে বলল,
‘ আমি অন্তুকে পছন্দ করি না।’
নম্রতা হেসে বলল,
‘ আমি নিজেও প্রেমে পড়েছি বইন। প্রেমে পড়ে প্রেমের স্বাদ একদম গুচিয়ে ফেলেছি। এমন জ্বলেপুড়ে যাওয়া প্রেমিকাকে তুই প্রেমের দৃষ্টি শেখাচ্ছিস? তোর চাহনী দেখেই বোঝা যায় তুই অন্তুর প্রতি দুর্বল। অন্তু বলদটাই শুধু বুঝে না।’
নীরা জবাব দিল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
‘ তুই ভুল বুঝছিস।’
‘ ঢং না করে কারণটা বল। রাজি কেন হচ্ছিস না? অন্তু আমাদের নিজের বন্ধু। প্রথম থেকে চিনি ওকে। অসাধারণ একটি ছেলে। পড়াশোনাতেও ভালো। কর্মঠ ছেলে। গায়ের রং-টা একটু কালো হলেও দেখতে খারাপ না। তুই নিশ্চয় ওর গায়ের রং নিয়ে নেগেটিভ জার্জ করছিস না?’
‘ কি সব বলছিস নমু? গায়ের রং আমার কাছে ম্যাটার করে না।’
‘ তাহলে?’
‘ বাসায় মানবে না। বাসায় তো এখনই ছেলে দেখা হচ্ছে। বাসায় এখন জুটে গেলেই মিটে গেল টাইপ অবস্থা। তারওপর অন্তু আমার সেইম ব্যাচ। ওর স্যাটেল হতে আরও চার-পাঁচ বছর চায়। আমার বা আমার পরিবারের অত সময় কোথায়? তাছাড়া, অন্তু আমার থেকে তিন-চারমাসের ছোট। বউয়ের থেকে বর ছোট? কথা উঠবেই।’
নম্রতা অবাক হয়ে বলল,
‘ এটা কোনো ডিফারেন্স হলো? আর মাসের হিসাব কে করছে শুনি? স্যাটেল হওয়ার ব্যাপারটা একটু চিন্তার হলেও আন্টিকে বললে নিশ্চয় সময় দেবে।’
নীরা হেসে ফেলল। ঠোঁটের কোণে বেদনাপূর্ণ হাসি ঝুলিয়ে বলল,
‘ আমাদের সমাজের মানুষগুলো এইসব ছোটখাটো বিষয়গুলোকেও হিসাবের খাতা থেকে ঝেড়ে ফেলে না নমু। সমাজটা হিসেব-নিকেশে পাক্কা। কাউকে অপদস্ত করার হিসেব-পত্রে তাদের জুড়ি মেলা ভার। আর মাও সময় দেবে না। ইরাও তো বড় হচ্ছে। ওকেও বিয়ে দিতে হবে। বাবাহীন গোটা পরিবারটা এখন ভাইয়ার ঘাড়ের ওপর পা রেখেই দাঁড়িয়ে আছে কোনোরকম। আর কত সহ্য করবে তারা? বড় মেয়ে হিসেবে বুঝে নেওয়ার দায়িত্বটা তো আমার। চাকরী-বাকরি কিছু করলে হয়ত বলতে পারতাম চাকরী করছি। কিন্তু তাও তো নেই। অনার্সই শেষ হলো না এখনও।’
নম্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মানুষের জীবন যে এতটা ক্রিটিক্যাল হতে পারে ভেবেই দেখেনি নম্রতা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল নম্রতা। খানিকবাদে ধীর কন্ঠে বলল,
‘ তাই বলে নিজের ভালোবাসাটা চেপে যাবি?’
‘ ধুর! ভালোবাসা কই? এটা শুধুই ভালোলাগা। এই ভালোলাগাটাকে সামলে উঠতে খুব বেশি কষ্ট হবে না। কিন্তু একবার যদি এগিয়ে যাই তাহলে দেখবি চারপাশের দুঃখগুলো চম্বুকের মতো আকঁড়ে ধরছে আমাদের। কি দরকার এত দুঃখের? তার থেকে এই ভালোলাগাটুকু আর সুপ্ত ভালোবাসাটুকু নিয়ে দূরে থাকাটাই ভালো। যে সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যতই নেই তাকে কেন্দ্র করে স্বপ্ন বুনে, কষ্ট বাড়িয়ে কি লাভ?’
নম্রতা কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। নিরুত্তর আকাশের দিকে চেয়ে রইল। পাশ থেকে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল নীরা। কত কত অসহায়ত্ব সেই এক টুকরো দীর্ঘশ্বাসে! আচ্ছা? অন্তুও কি এভাবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে? নীরা তাকে ভালোবাসে না ভেবে কষ্ট পায়? ইশ! ছেলেটা যদি জানত ‘নীরা’ নামের মেয়েটা তাকে কতই না ভালোবাসে। কিন্তু অন্তু বড় দূর্ভাগা। ভালোবাসার মানুষটির ভালোবাসার কথা জানার অধিকারও তার নেই। সব ভালোবাসা প্রকাশ করতেও নেই। কিছু কিছু ভালোবাসাকে বিশ্ববিদ্যালয় চত্তরে, বইয়ের ভাঁজে, মনের খাঁজেই লুকিয়ে থাকতে হয়। তাদের যে বড্ড ভয়। দুঃখ পাবার ভয়! হারিয়ে গিয়ে, ভেঙে গুড়িয়ে যাবার ভয়!
নীরার সাথে কথা বলে রাত একটার দিকে রুমে এলো নম্রতা। রুমে ফিরেই গায়ে চাদর দিয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নিল নীরা। নম্রতা ঘুমুবে ঘুমুবে করেও ফোনটা হাতে নিল। নোটিফিকেশনে আরফানের রিপ্লাই দেখা যাচ্ছে। পাঁচ মিনিট আগে রিপ্লাই করেছে সে। নম্রতা এতোক্ষণ নীরা-অন্তুর চিন্তায় আরফানের কথাটা ভুলে গেলেও এবার তাড়াহুড়ো করে ম্যাসেঞ্জারে উঁকি দিল। আরফান বাংলা ফন্টে খুব সুন্দরভাবে সালামের জবাব দিয়েছে। আর কিছু লিখেনি। নম্রতা বাধ্য হয়েই উত্তর দিল,
‘ কেমন আছেন?’
মিনিটখানেক পর উত্তর এলো,
‘ আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আপনি কে?’
প্রশ্নটা শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল নম্রতার। আইডিতে এতো বড় বড় করে লেখা, ‘নম্রতা মাহমুদ’ তবুও চিনতে পারছে না? আজব! নম্রতা নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করে লিখল,
‘ আমি নম্রতা মাহমুদ।’
‘ তা জানি। কিন্তু নম্রতা মাহমুদ নামে কাউকে মনে পড়ছে না, দুঃখিত।’
অপমানে সারা শরীর রি-রি করে উঠল নম্রতার। কিন্তু কি আর করার? ইটটি মারলে পাটকেলটি তো খেতেই হবে। নম্রতা এসাইনমেন্টে থাকা আরফানের সাইনসহ পেইজটির ছবি তুলে সেন্ট করল। নিচে লিখল,
‘ এই এসাইনমেন্টটি যার আমি সেই।’
‘ ওহ্। তো, কী চাই?’
নম্রতার শরীরে যেন আগুন লেগে গেল। কি চাই, মানে? এটা কেমন ভদ্র ব্যবহার? ব্যাটা ফাজিল। আমি তোর মাথা চাই, দিবি মাথা? রাগে টগবগ করতে থাকা নম্রতা এবার আর রিপ্লাই দিল না। ব্লক অপশনে গিয়েও ফিরে এলো। মনে পড়ে গেল সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘ বিপদের সময় অপমান গায়ে মাখতে নেই।’ নম্রতারও এখন ভয়ানক বিপদ। কাল এগারোটার মধ্যে সাইন না পেলে সর্বনাশ। অতএব, এই রাগ, ক্ষোভকে পাত্তা দিলে চলবে না। আপাতত নেতিবাচক অনুভূতিগুলোকে বস্তাবন্দি রাখতে হবে। সাইনটা নেওয়ার পর নাহয় একে আচ্ছা এক শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে। নম্রতা জোরে জোরে শ্বাস নিল। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করার চেষ্টা করল। তারপর লিখল,
নীল চিরকুট পর্ব ৯+১০
‘ আসলে, আপনাকে সরি বলার ছিল। সকালের ব্যাপারটার জন্য আই এক্সট্রিমলি সরি স্যার।’
‘ স্যার? শালা থেকে ডিরেক্ট স্যার? গুড ইম্প্রুভ। তো, সরি কেন? কি হয়েছিল সকালে?’
নম্রতার রাগ এবার আকাশ ছুঁলো। ফোনটা টেবিলের উপর ফেলে রেখে সারা ঘরময় পায়চারী করতে লাগল। এতো ভাব! কিসের এতো ঢং এই লোকের? নিজেকে ভাবেটা কি এই লোক? রাজা-মহারাজা? কথা বলার কি বাঁজ! উফ, অসহ্য!
