নীল চিরকুট পর্ব ২৭+২৮
নৌশিন আহমেদ রোদেলা
প্রকৃতিতে শরৎের ছোঁয়া লেগেছে মাত্র। নিকষকালো আকাশে এখন শুভ্র মেঘের খেলা। চারপাশে ফুরফুরে বাতাস থাকলেও ভ্যাপসা গরম অস্থির করে তুলছে জীবন। আরফান বারান্দায় রাখা বেতের সোফায় বসে আছে। গায়ে পাতলা টি-শার্ট আর টাউজার। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। পা-দুটো টি-টেবিলে রেখে কোলের উপর ল্যাপটপ। কপালে হালকা ভাজ। হাতের দশ আঙ্গুল কী-বোর্ডে নিরন্তর ছুটে চললেও মস্তিষ্কে ঘুরে বেড়াচ্ছে জটিল এক প্রশ্ন। মেয়েটি কি সত্যিই শ্যামলতা? এক ঝলক দেখেই এমন কিছু ভেবে নেওয়া কি ঠিক হচ্ছে আরফানের? শ্যামলতার পা দুটো যে আরফানের ভীষণ পরিচিত তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এতোগুলো বছরে পায়ের আঙ্গুলগুলোর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ পর্যন্ত মুখস্থ করে ফেলেছে আরফান। তবুও কোথাও যেন একটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। এক পলকের দৃষ্টিকে ততটা বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। মেয়েটাও তো স্পষ্ট কিছু বলছে না। বারবার ফোন বা ম্যাসেজ দেওয়াটাও অস্বস্তির। সেদিন যদিও নিজের অস্বস্তি, আত্মসম্মান পাশে রেখে রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসেছিল দু’জন কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। গোটা দুই ঘন্টা বসে থেকে দুই থেকে তিনটি কথা বলতে পেরেছিল আরফান। তারওপর মেয়েটি কেমন উদ্ভট কাজ করে বসল। হুট করেই উঠে চলে গেল। কি আশ্চর্য! মেয়েটাকে মাঝে মাঝে পাগল মনে হয় আরফানের।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কিন্তু পরমুহূর্তেই তার নিবিড় চোখদুটোর কথা মনে পড়ে। মেয়েটির চোখে কি সত্যিই অন্যরকম কিছু ছিল না? একদম অন্যরকম কিছু অনুভূতি? দরজা খোলার শব্দে বারান্দা থেকে রুমের ভেতর উঁকি দিল আরফান। আগুন্তককে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ল্যাপটপের স্যাটার নামিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। প্রায় সাথে সাথেই ছোটখাটো, সুন্দরী এক তরুণী এসে বসল সোফায়। সারা শরীরে তার শিশুসুলভ চঞ্চলতা। চোখে-মুখে স্বভাবসুলভ হাসি। হাতে দুই কাপ কফি। আরফান চশমাটা খুলে মনোযোগী চোখে তাকাল। মেয়েটি একটা কাপ এগিয়ে দিতেই মৃদু হাসল আরফান। কফি কাপ হাতে নিতে নিতে বলল,
‘ তোমার কফির হাত আগের থেকে ভালো হয়েছে। গুড। আই এম ইম্প্রেস।’
মেয়েটি হাসল না। চোখদুটোতে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘ তুমি বিয়ে কবে করছ? তুমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছ। সাথে আমিও বুড়ি হয়ে যাচ্ছি।’
আরফান হেসে বলল,
‘ তোমার বয়স কত? তেইশ অথবা চব্বিশ? তেইশ-চব্বিশ বছরে কেউ বুড়ি হয় না।’
‘ মেয়েরা পঁচিশ বছরেই বুড়ি হয়ে যায়। তুমি বুঝবে না। যারা সারাদিন পড়াশোনা করে তাদের এসব বুঝার কথা নয়। এখন বলো বিয়ে কবে করছ?’
আরফান হাসল তবে প্রত্যুত্তর করার চেষ্টা করল না। ল্যাপটপটা টি-টেবিলের উপর রেখে পা নামিয়ে বসল। মেয়েটি কৌতূহলী কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘ কাজ করছিলে? সারাদিন এতো কী কাজ করো? খুব ইম্পোর্টেন্ট নাকি অল্প ইম্পোর্টেন্ট?’
‘ খুব ইম্পোর্টেন্ট। রিসার্চের রিপোর্ট লিখছিলাম। আগেরবার ল্যাপটপটাই তো গেল।’
‘ গেল! কই গেল?’
আরফানের সাবলীল জবাব,
‘ একজন নদীতে ছুঁড়ে ফেলেছে। এখন নদীর তলদেশে থাকলে থাকতে পারে। একজেক্ট বলতে পারছি না।’
মেয়েটি আঁতকে উঠে বলল,
‘ কি সাংঘাতিক! তোমার রাগ হচ্ছে না? আমি হলে ল্যাপটপের সাথে সাথে তাকেও ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দিতাম।’
আরফান শব্দ করে হাসল। কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
‘ তখন রাগ হয়েছিল।’
‘ মারাত্মক রাগ হয়েছিল?’
‘ হ্যাঁ। মারাত্মক রাগ হয়েছিল কিন্তু এখন সেই রাগ মোটামুটিতে নেমে এসেছে। কিছুদিন পর মোটামুটি থেকে শূন্যতে নেমে আসতে পারে। এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।’
মেয়েটি সোফায় আয়েশ করে বসল। চোখ ছোট ছোট করে কৌতূহল নিয়ে বলল,
‘ কিন্তু সব রেখে ল্যাপটপটাই নদীতে ফেলল কেন? আর ঢাকা শহরে নদী কোথায়?’
‘ কক্সবাজারে গেলাম যখন, তখন ফেলেছে। কেন ফেলেছে, জানি না। ল্যাপটপ ফেলে দেওয়ার মতো আহামরি কোনো কারণ আমি খুঁজে পাইনি। আমার তখন মনে হয়েছিল মেয়েটি বদ্ধ পাগল। এখনও অবশ্য তাই মনে হয়। তবে সেই ভাবনাটা পরিবর্তন হলেও হতে পারে। হুট করেই মনে হচ্ছে, মেয়েটা আসলে বদ্ধ পাগল নয়। মাথায় একটু সমস্যা আছে মাত্র।’
কথাটা বলে হেসে ফেলল আরফান। মেয়েটি চোখ বড় বড় করে বলল,
‘ কি বলছ! ওটা একটা মেয়ে ছিল?’
আরফান মাথা নাড়ল। মেয়েটি চোখ দুটো ছোট ছোট করে সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘ সুন্দরী ছিল?’
আরফান কফি কাপটা টেবিলের উপর রেখে হাসল। মেয়েটির দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
‘ সুন্দরীই বলা যায় বোধহয়। তেমন খেয়াল করে দেখিনি কখনও। পরের বার দেখা হলে খেয়াল করে দেখব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পুরো এক ঘন্টা মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বুঝার চেষ্টা করব মেয়েটি আসলেই সুন্দরী কি-না। তারপর তোমায় এসে অপিনিয়ন জানাব। আপাতত আমার শার্টটা চট করে ইস্ত্রি করে দাও তো নিদু। ফ্যাস্ট, আমি বেরুব।’
রুমের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ক্রমাগত পায়চারী করছে নম্রতা। হাতে বই। পড়ায় মনোযোগ আসছে না। বিছানায় বেশ আয়েশ করে বসে আছে নীরা। সেকেন্ডর জন্য বিরতি না নিয়ে নিরন্তর পড়া মুখস্থ করছে সে। নম্রতা পায়চারী থামিয়ে বিরক্ত চোখে তাকাল। প্রচন্ড অভিমান নিয়ে নীরার পাশে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল। পুরো বিছানা হঠাৎ কেঁপে উঠাই চমকে উঠল নীরা। অবাক চোখে নম্রতার দিকে তাকিয়ে থেকে বুকে ফু দিল। বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করল,
‘ কি হলো? এমন ডাইনোসরের মতো লাফাচ্ছিস কেন?’
‘ ডাইনোসর? আমাকে তোর ডাইনোসর মনে হচ্ছে? আমি যে টেনশনে টেনশনে মরে যাচ্ছি সেদিকে তোর কোনো দৃষ্টি নেই? তুই আমার এমন বান্ধবী?’
‘ পরীক্ষার সময় টেনশনে থাকবি এটাই স্বাভাবিক। টেনশনে না থাকলে না-হয় ভিন্ন কিছু হতো।’
নম্রতা বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ আরে বাপ! এই টেনশন সেই টেনশন নয়। এটা হলো হৃদয় ঘটিত টেনশন।’
নীরা সরু চোখে তাকাল। সন্দিহান কন্ঠে বলল,
‘ কেন? হৃদয়ে আবার কি হলো? প্রেমিক পুরুষ তো পেয়েই গেলি। এখন তো তোর খুশিতে মরে যাওয়া উচিত। খুশি না হয়ে এতো টেনশন কেন?’
নম্রতা বিছানায় এক পা তুলে নীরার দিকে ঘুরে বসল। ঠোঁট উল্টে বলল,
‘ এখানেই আসল সমস্যা। ওই প্রেমিক পুরুষই সব সমস্যা। ওই ডক্টর আসলেই ‘সে’ কি-না সেই কনফিউশানটা নাহয় আমার পায়ের ছবিতে অনেকাংশ ক্লিয়ার হয়েছে। কিন্তু ডক্টর আর ‘সে’ কে মেলাতে গেলেই কেমন হেঁচকি উঠে যাচ্ছে আমার। দ্বিতীয়ত, লাস্ট উইকে পরীক্ষার জন্য ফোন ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিল। ডক্টর অসংখ্যবার ফোন দিয়েছে, আমি ধরিনি। এখন এক সপ্তাহ হয়ে গেল সে ফোন টোন কিছু দিচ্ছে না। আমি নিজে থেকে ফোন দিব কি-না সেটাও বুঝতে পারছি না। প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে।’
এটুকু বলে থামল নম্রতা। তারপর প্রচন্ড অভিমান নিয়ে বলল,
‘ আমি নিজে থেকে কখনই যোগাযোগ করব না। এতোদিন আমি চেষ্টা করেছি, কষ্ট করেছি, বেহায়া হয়েছি। এবার কি ওর চেষ্টা করা উচিত নয়? এবার সে যোগাযোগ না করলে আমি সত্যি সত্যিই বিয়ে করে ফেলব নীরু। আমার আর ভালো লাগছে না।’
নীরা হেসে ফেলল। বইটা উল্টে রেখে বলল,
‘ বিয়ে করলে সাফার সবচেয়ে বেশি তুই-ই করবি। পত্রপ্রেমিক নিয়ে তুই যে পরিমাণ পসিসিভ। তাতে দেখা গেল, বিয়ে করলি ঠিক আছে কিন্তু বাসর ঘরে বসে ফোন দিয়ে ন্যাকামো শুরু করে দিবি। “দোস্ত! আমি এই ব্যাটার সাথে বাসর টাসর কিছু করব না। আমার দমবন্ধ লাগছে। আমি এই ব্যাটাকে স্বামী হিসেবে মানি না, মানব না। আমার ডাক্তার আমাকে এনে দে ব্যস!” তখন যত প্যারা আমাদের। তোর কান্নাকাটি দেখে নাদিম, অন্তুরা সত্যি সত্যিই তোকে বাসর ঘর থেকে ভাগিয়ে আনতে পারে। এদেরও বিশ্বাস নেই। পরের দিন খবরের কাগজে আমাদের ছবি। আহ! হিট! হিট।’
নীরার বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল নম্রতা। নীরা হেসে বলল,
‘ হাসিস না। সিরিয়াসলি বলছি। তুই যদি অতো কান্ড করিস তাহলে নাদিম নির্ঘাত মধ্যরাতে তোর জামাইকে গিয়ে বলবে, আরে! এতো চাপ নিতাছ কেন মাইরি? বাংলাদেশে কি বউয়ের অভাব পড়ছে নাকি? এক বউ গেলে আরেকটা আসবে। আরেকটা গেলে আরোও একটা আসবে। আসতেই থাকবে।টেনশন করে চান্দি গরম কইরো না। তোমাকে আমরা আরেকটা বউ এনে দেব। দরকার পড়লে বউয়ের বাজার বানাই দেব। কিন্তু আমার বন্ধবীরে দেব না মামা। বান্ধবীর জামাই পছন্দ হয় নাই। সো, জামাই চেঞ্জ।’
নীরা এটুকু বলতেই হুহা করে হেসে উঠল নম্রতা। নীরাও খুব হাসল। নম্রতা হাসতে হাসতে বলল,
‘ হতেই পারে। নাদিমের পক্ষে সব সম্ভব।’
তারপর হঠাৎ-ই গম্ভীর হয়ে বলল,
‘ তাহলে তুই কিভাবে পারবি? তোর দমবন্ধ লাগবে না নীরু?’
নীরার মুখের ভাব পরিবর্তন হলো না,
‘ আমার কেন দমবন্ধ লাগবে?’
‘ তুই অন্তুকে ভালোবাসিস। অন্তুকে ভালোবেসে অন্যজনকে বিয়ে করতে যাচ্ছিস। তবু বলছিস দমবন্ধ কেন লাগবে?’
নীরা হেসে বলল,
‘ ছোটবেলা এঞ্জেল হওয়ার স্বপ্ন দেখতি না নমু? সুন্দর দুটো ডানা মেলে পরীদের মতো উড়ে বেড়ানোর স্বপ্নটা কোন মেয়ের ছিল না বলত? অথবা বিশাল রাজ্যের রাজকুমারী হয়ে যাওয়া। গা ভর্তি গহনা। ঘোড়ায় চড়া রাজপুত্র। এতো এতো দাসীর স্বপ্ন তো সবাই দেখতো। সেই স্বপ্ন পূরণ না-হওয়াতে কি দমবন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছিস? ভালো আছিস। নতুন নতুন স্বপ্ন দেখছিস। চোখে অসংখ্য স্বপ্ন থাকলে দু-একটা অসম্ভব স্বপ্ন ভুলে থাকা যায় নমু। অসম্ভব স্বপ্নগুলো অবসরে অনুভব করে আনন্দ পাওয়ার জন্যই হয়। বাস্তবে পাওয়ার জন্য নয়।’
নম্রতা হঠাৎ কোনো কথা খুঁজে পেল না। কয়েক সেকেন্ড অপলক চেয়ে থেকে বলল,
‘ অন্তুকে এটলিস্ট জানাতে তো পারিস। অথবা নাদিম বা রঞ্জন?’
‘ অন্তুকে বলার প্রশ্নই আসে না। আর নাদিম – রঞ্জনকেই বা কি বলব? এটা কি বলার মতো কিছু হলো? আমার আবেগ, আমার অনুভূতি আমার মধ্যে আবদ্ধ থাকাটাই কি ভালো নয়? তুই শুধু শুধু এতো ভাবছিস। বাদ দে তো।’
নম্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই মেয়েটাকে সে বুঝে না। কিচ্ছু বুঝে না।
নাদিম ভ্রু কুঁচকে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। ঘড়িতে তিনটা বাজতে আর তিন মিনিট বাকি। মৌশিকে পড়ানোর কথা দুইটা ত্রিশে। অথচ তার খবর নেই। মৌশির সময় জ্ঞানহীনতাই নাদিম বিরক্ত। চরম বিরক্ত। ঘড়ির কাঁটা যখন তিনটা দুইয়ের ঘরে গেল ঠিক তখনই মৌশির আগমন ঘটলো। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বই-খাতা বের করতে করতে বলল,
‘ সরি, স্যার।’
নাদিম জবাব দিল না। মৌশিকে আজ স্বাভাবিক লাগছে। মুখে বা শরীরে আলাদা কোনো সাজগোজ নেই। সাদা রঙের একটা টপের ওপর লাল রঙের স্কার্ফ ঝুলছে। চোখদুটো লাল হয়ে ফুলে আছে। মৌশি কাঁদছিল? কাঁদলে কাঁদতে পারে। এই বয়সী মেয়েদের কান্নাকাটি করা আহামরি বড় কোনো বিষয় নয়। এরা কথায় কথায় ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কেঁদে ফেলবে, এটাই স্বাভাবিক। নাদিম গম্ভীর মুখে পড়ানো শুরু করল। মৌশি হঠাৎ-ই প্রশ্ন করল,
‘ আপনার বন্ধু এখন কেমন আছে, স্যার?’
নাদিম জানাল, ‘ ভালো আছে।’
‘ উনি কি শেষমেশ পরীক্ষাগুলো দিচ্ছেন?’
নাদিম ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল। কপাল কুঁচকে বলল,
‘ আমার বন্ধুর যে পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল না সেটা তুমি কি করে জানলে?’
মৌশি হেসে বলল,
‘ আমি জানি। আমি অনেক কিছুই বুঝে ফেলতে পারি।’
নাদিম বিরস কন্ঠে বলল,
‘ ও আচ্ছা।’
মৌশি বোধহয় খানিক হতাশ হলো। নাদিম প্রত্যুত্তরে কিছু জিগ্যেস করবে, সামান্য কৌতূহল দেখাবে এমনটাই হয়ত আশা করেছিল মৌশি। মৌশি মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ আমি আরেকটা বিষয় বুঝে ফেলেছি।’
‘ কি বিষয় বুঝে ফেললে?’
‘ আপনি অতিশীঘ্রই আমাদের বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিবেন। মৌশি নামের একটা মেয়েকে যে পড়াতেন সেটাও ভুলে যাবেন। আমি ঠিক বলছি না স্যার?’
নাদিম হাসল, ‘ আমি তোমার মতো আগাম বুঝে ফেলতে পারি না মৌশি। আমার মনের কোনো ঠিক-ঠাকানা নেই। সকালে নেওয়া সিদ্ধান্ত বিকেলে এসেই বদলে যেতে পারে। তুমি তোমার পড়ায় মনোযোগ দাও। আমার তোমার বাড়ি আসা বন্ধ করে দেওয়াটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়।’
মৌশি কৌতুহল নিয়ে বলল,
‘ আগে আপনি মাঝে মাঝেই অন্যরকম করে কথা বলতেন। এখন কেন বলেন না?’
‘ ইচ্ছে করে না তাই।’
‘ এখন আমাকে পড়াতেও ইচ্ছে করে না, তাই না?’
নাদিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৌশির দিকে তাকাল। মেয়েটির বুকে কান্না। কন্ঠটা কি একটু কাঁপল? কিন্তু সেই কাঁপা কন্ঠটা অগোছালো নাদিমকে ছুঁয়ে দিতে পারল না। সে শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ হুম, ইচ্ছে করে না।’
মৌশি কিছু বলল না। মাথা নিচু করে গ্রামারটিক্যাল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নাদিম আগের মতোই নিরুদ্বেগ বসে রইল। মৌশির খাতা চেইক করতে করতে হঠাৎ মনে পড়ল, অন্তুর আজ ড্রেসিং করার ডেইট। ঠিক পাঁচটায় হাসপাতালে যেতে হবে। নাদিম তাড়াহুড়ো করে ঘড়ির দিকে তাকাল। ব্যস্ত ঘড়ির কাটা এখন চারটার গড়দোড়ায়।
বিকেল পাঁচটা। চেম্বার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় করছে আরফান। কালো চামড়ার ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে চেম্বার থেকে বেরুতেই নম্রতাকে চোখে পড়ল তার। নম্রতা নাদিম আর অন্তুর সাথে ড্রেসিংরুমের দিকে যাচ্ছে। নম্রতাকে দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল আরফান। গরমে ত্যক্ত-বিরক্ত নাদিমের চোখ এড়াল না আরফান। আরফানকে এদিকে আসতে দেখেই নম্রতার মাথায় চাটি মারল সে। ফিসফিস করে বলল,
‘ তোমার পিরিতি থুক্কু পত্রপ্রেমিক চইলা আসছে, মামা। ডাক্তাররে ফান্দে যেহেতু ফালাইছস কড়ায় গন্ডায় শোধ করুন লাগব। ডাক্তার প্রেমিক হওয়া সত্ত্বেও যদি হাসপাতালের ঔষধপত্র কিনে খাওয়া লাগে তাইলে তো যন্ত্রণা। ব্যাটাকে বল, আমাগো ঔষধের টাকা ফিরাই দিতে। নয়তো হাত, পা কিচ্ছু ধরতে দিবি না। তোরে আমরা ক্যাশ অন ডেলিভারি দিমু। ক্যাশ বন্ধ তো ডেলিভারিও বন্ধ।’
নাদিমের কথায় হেসে ফেলল অন্তু। নম্রতা গরম চোখে তাকাল। ততক্ষণে বেশ খানিকটা কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে আরফান। আরফানকে কাছাকাছি এসে দাঁড়াতে দেখেই হেসে হাত বাড়াল নাদিম,
‘ আসসালামু আলাইকুম, আরফান ভাই। কেমন আছেন?’
নম্রতা অবাক হলো। এই অল্পদিনে নাদিম আরফানের সাথেও বন্ধুত্ব করে নিয়েছে নাকি? আশ্চর্য! কিন্তু কিভাবে? আরফান হাত মিলিয়ে হাতটা বুকে ছুঁইয়ে হাসল। মোলায়েম কন্ঠে বলল,
‘ আলহামদুলিল্লাহ। তোমরা?’
‘ ভালোই আছি। একটা মাথা পাগল আরেকটা হাত ভাঙা নিয়ে ঘুরলে যতটা ভালো থাকা যায় ঠিক ততটা। আপনি একটু মাথা পাগলটাকে পাহাড়া দেন ভাই। আমি আর অন্তু পাঁচ মিনিটে আসছি।’
আরফান যেন সুযোগটা লুফে নিল। হাস্যোজ্জল কন্ঠে বলল,
‘ শিওর।’
নম্রতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই জায়গাটা থেকে সরে পড়ল অন্তু-নাদিম। আরফান এদিক-ওদিক তাকিয়ে এক হাতে পকেটে ঢুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। নম্রতার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
‘ কেমন আছেন?’
নম্রতা আরফানের দিকে তাকাল। আরফানের ঠোঁটের কোণে হাসি। নম্রতা নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল,
‘ ভালো। আপনি?’
‘ আমিও আলহামদুলিল্লাহ।’
কথাটা বলে নম্রতার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল আরফান। আরফানের কথার প্রেক্ষিতে আর কোনো কথা খুঁজে পেল না নম্রতা। আরফানকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বার কয়েক এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করল। কিন্তু লাভ বিশেষ হলো না। সময়ের সাথে সাথে অস্বস্তিটা আরও বেড়ে যাচ্ছে। নম্রতা অতিষ্ঠ হয়ে আরফানের দিকে তাকাল। আরফান মাথাটা একটু উঁচু করে অনেকটা ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি ফেরাচ্ছে না। পলক পড়ছে না। গম্ভীর, বিষণ্ন চোখজোড়ার উপর পুরু ভ্রু’জোড়া হালকা কুঁচকে আছে। নম্রতা বিরক্ত কন্ঠে বলল,
‘ সব ঠিকঠাক? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? কি দেখছেন?’
আরফান হাসল। সরল কন্ঠে বলল,
‘ আপনাকে দেখছিলাম। আপনি বোধহয় একটু বেশিই সুন্দর, তাই না?’
আরফানের স্পষ্ট, সাবলীল কথাটা কানে যেতেই বিস্ফারিত চোখে তাকাল নম্রতা। চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে কিছু কড়া কথা বলার প্রস্তুতিও নিয়ে ফেলল। কিন্তু হায়! ওই বিষণ্ন, শিশুসুলভ চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে পৃথিবীটাই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল নম্রতার। তার বিষণ্ন চোখ আর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসি দেখতে দেখতে নম্রতা হঠাৎ-ই উপলব্ধি করল, তার লজ্জা লাগছে। ভীষণ লজ্জা লাগছে। নম্রতা মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। সাথে সাথেই ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল অপ্রতিরোধ্য লাজুক হাসি।
ঘড়িতে কয়টা বাজে সেদিকে খেয়াল নেই নম্রতার। কফি হাতে,ঘরময় পায়চারী করে আবোল তাবোল কথার ঝুড়ি খুলেছে সে। নীরা বিছানায় বসে ঘুমে ঢুলছে। নম্রতা উত্তেজনা নিয়ে বলল,
‘ও যে হঠাৎ এমন কিছু বলবে বা বলতে পারে তা আমি কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি। হুট করেই বলে ফেলল, আপনি হয়ত একটু বেশিই সুন্দর,তাই না ? আমি জাস্ট বোকার মতো তাকিয়ে ছিলাম। ওই সময় নাদিম আর অন্তু না ফিরলে আমার যে কি হতো! ভাবতে পারছিস ?’
নীরা হাসল। মাথা দুলিয়ে বলল,
‘ভাবতে পারছি কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছি না।’
নম্রতা বিছানায় এসে বসল। অস্থির হয়ে বলল,
‘তাহলে আমার কি অবস্থা হয়েছিল একবার ভাব ? একদম আনএক্সপেক্টেট কিছু!’
নীরা হাসছে। আরফান নামক ব্যক্তিটাকে তার বেশ লাগছে। নীরা বালিশে ঠেস দিয়ে আয়েশ করে বসল। ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে বলল,
‘আগে আগে দেখো হতা হ্যা কিয়া!’
কথাটা বলে চোখ টিপল নীরা। নম্রতা হাসতেই আবারও বলল,
‘আমরা হয়ত লোকটিকে ঠিক চিনতে পারিনি নমু। লোকটা সবার সামনে যেমনটা শো করে আসলে তেমনটা নয়। ভিন্ন রকম।’
নম্রতা উত্তর দিল না। সুপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। গালে হাত দিয়ে আরফানকে ভাবতে লাগল। ভিন্ন রকম? সত্যিই লোকটি একটু অন্যরকম।মাঝে মাঝে গম্ভীর তো মাঝে মাঝে ভীষণ চঞ্চল।চোখ ভর্তি ছেলেমানুষি আর কৌতূহল।
বর্ষার শেষ আর শরৎের শুরু। কাল রাতে এক পশলা বৃষ্টি হওয়ায় সকালটা ঝকঝকে, পরিষ্কার। গাছের পাতায় ল্যাপ্টে থাকা জল আর মিষ্টি সোনালী রোদে ভরা চারপাশ। নিশ্চুপ সকালে অচেনা পাখির কিচিরমিচির শব্দ। দক্ষিণের জানালাটা খোলা। বৃষ্টির জলে ভিজে গিয়েছে ধবধবে সাদা পর্দা। বিশাল আম গাছের পাতার ফাঁক গেলে এক মুঠো রোদ এসে দুষ্টুমি জুড়েছে আরফানের বোজে রাখা চোখে আর গলায়। সকালের নরম আলোয় ভেসে যাচ্ছে নির্জন ঘর, বিছানায় শুয়ে থাকা ঘুমন্ত যুবক। হঠাৎ চুড়ির টুনটান আর বেলীফুলের তীব্র সুগন্ধে জেগে উঠল আরফানের মস্তিষ্ক। ঘুমটা ছুটে গিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকাল। মনের অজান্তেই বিড়বিড় করে ডাকল,
‘ শ্যামলতা?’
প্রায় সাথে সাথেই মুখের ওপর এসে পড়ল এক মুঠো ভেজা বেলীফুলের পাঁপড়ি। আরফান তৎক্ষনাৎ চোখ বোজল। পুরু ভ্রু জোড়া খানিক কুঁচকাল। এতোক্ষণ উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা আরফান এবার ঘাড় উঁচিয়ে তাকাল। বিছানার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ভয়ঙ্কর সুন্দর এক রমনী। পরনে তার সাদা ধবধবে শাড়ি। হাত ভর্তি শুভ্র কাঁচের চুড়ি। চঞ্চল চোখদুটোতে মায়া মেশানো কাজল। সারা শরীরে তাজা বেলীফুলের অলংকার। স্নিগ্ধ মুখটি সকালের নরম আলোয় ভেজা বেলী ফুলের মতোই কোমল, সুন্দর। আরফান ঘুমু ঘুমু চোখ নিয়েই উঠে বসল। সামনে দাঁড়ানো যুবতী আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল,
‘ কেমন দেখাচ্ছে আমায়?’
আরফান হেসে বলল,
‘ বেলীফুলের থেকেও সুন্দর। কিন্তু হঠাৎ এতো সাজগোজ?’
মেয়েটি হাসল। তার হাসিতে প্রগাঢ় চঞ্চলতার ছাপ।
‘ শরৎে আকাশ ভর্তি সাদা মেঘের পদচারণ। তুমি কি জানো? শরৎের প্রেমিকা হলো মেঘ। তাই আমি মেঘ সেজে শরৎকে প্রেম নিবেদন করছি। শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আমাকে মেঘের মতো লাগছে না?’
কথাটা বলে চরকির মতো ঘুরে নিজেকে প্রদশর্ন করার সুযোগ করে দিল সে। আরফান হেসে ফেলল। বিছানা ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। চার-পাঁচ মাস যাবৎ ছাঁদের ঘরটিকেই আপন করে নিয়েছে আরফান। বিশাল ছাঁদের এক কোণায় ছোট্ট তার ঘর। সামনে এক টুকরো ছিমছাম, সুন্দর বারান্দা। বারান্দার দরজায় দাঁড়ালেই চোখে পড়ে সারিবদ্ধ বেলীফুলের গাছ। আগে একটি ছিল। এখন অসংখ্য। সবই আরফানের লাগানো। আরফান বুক ভরে শ্বাস নিল। বেলীফুলের সুগন্ধটা নাকে যেতেই চোখে-মুখে খেলে গেল নিদারুণ চঞ্চলতা। আজ অনেকদিন পর বেলীফুলের সুবাস পাচ্ছে সে। তার চারপাশটা সুবাসে সুবাসে ভরে যাচ্ছে। আরফান চোখ ফিরিয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল। মেয়েটি প্রসন্ন হাসি নিয়ে দোলনায় দোল খাচ্ছে। শাড়ির আঁচল ল্যাপ্টে আছে মাটিতে। তাকে দেখে সত্যিই মেঘের মতো লাগছে। আকাশ থেকে নেমে আসা এক টুকরো শুভ্র, সুন্দর মেঘ। আরফান বেতের সোফায় বসতে বসতে বলল,
‘ বর্ষার ফুল দিয়ে শরৎের মেঘ সাজাটা কি ঠিক হলো? এটা অন্যায় হয়ে গেল না? তোমার উচিত ছিল শরৎের কোনো ফুল দিয়ে মেঘ সাজা। বর্ষার ফুল দিয়ে মেঘ সাজাটা উচিত কাজ হয়নি। শরৎ রাগ করতে পারে।’
মেয়েটি সরু চোখে তাকাল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ বর্ষার ফুল শরৎ কালে ফুটলে আমার কী দোষ? বর্ষার ফুলেরা যদি আমায় রাণী হিসেবে ঘোষণা করে তাতেই বা আমার কী দোষ?’
আরফান হাসল। বেলীফুলের গাছগুলোতে থোকা থোকা ফুলের বাহার। আরফানের বুকের গহীনে বিনা অনুমতিতেই বেজে উঠল একটা নাম, ‘শ্যামলতা।’
‘ তুমি কি বিয়ে করবে না?’
‘ তুমি সবসময়ই একই প্রশ্ন কেন করো?’
হাসিমুখে প্রশ্ন করল আরফান। এই মেয়েটিকে সে পৃথিবী সমান ভালোবাসে। কিছুতেই রাগ করতে পারে না। মেয়েটি কৃত্রিম মন খারাপ নিয়ে বলল,
‘ তোমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমিও যে বিয়ে করতে পারছি না। বুড়ি বয়সে বিয়ে করলে বুড়ো বুড়ো বর জুটবে। আমি বুড়ো বর বিয়ে করতে রাজি নই।’
‘ তাহলে তোমাকে বিয়ে দিয়ে দিলেই হয়ে যাচ্ছে। আমার বিয়ে নিয়ে কেন পড়েছ?’
মেয়েটি সীমাহীন বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ কি বলছ? তুমি জানো না? মা আর আমি কঠিন একটা প্রতিজ্ঞা করেছি। তুমি আগে বিয়ে না করলে মা আমায় বিয়ে দিবে না আর আমিও বিয়ে করব না। দেখলে না? বড় ভাইয়ার সাথে কেমন ইন্সিডেন্ট ঘটে গেল। সব কি আমার দোষ ছিল ভাইয়া?’
নিদ্রার শেষ বাক্যটা বড্ড বিষণ্ন শোনাল আরফানের কানে। নিদ্রার সাথে কখনোই অতটা সখ্যতা ছিল না আরফানের। ছোট থেকেই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত আরফান বোনের সাথে খুব একটা সহজ হয়ে উঠতে পারেনি। নিদ্রাও ধারে কাছে আসত না। নিদ্রার সকল বায়না, দুষ্টুমি, পাগলামো ছিল আরফানের বড় ভাই নেহলকে কেন্দ্র করে। নেহালও ছিল আমোদপ্রিয়, চঞ্চল। ছোট বোনটাকে পাগলের মতো ভালোবাসত। কিন্তু হঠাৎ-ই সব পাল্টে গেল। ভাইয়ার আকস্মিক মৃত্যু। তার এক বছর পর বাবার অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুতে কিভাবে যেন নিদ্রার সাথে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হলো আরফানের। তবুও কোথাও একটা বিস্তর ফারাক। আরফান চেষ্টা করেও নেহালের মতো অতোটা ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারে না। বোনটা যে তার বড্ড ভালোবাসার কাঙাল। আরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ তুলে তাকাল। চোখের কোণে জল জমেছে তার। সকালের রোদে চিকচিক করছে সেই অশ্রু। নিদ্রা নিস্তব্ধ। আরফান ধীর পায়ে নিদ্রার পাশে দোলনায় বসল। ডানহাতটা কোলে নিয়ে আদুরে কন্ঠে বলল,
‘ তোমার কোনো দোষ ছিল না, নিদু। ইট’স অল আবাউট ডিস্টেনি।’
নিদ্রা অসহায় চোখে তাকাল। আরফানের বুকে আলতো মাথা রেখে বলল,
‘ ইট’স আ ডিস্টেনি?’
আরফান হালকা হাতে বোনকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘ ইয়াপ। ইট’স আ ডিস্টেনি।’
কয়েক সেকেন্ড নিস্তব্ধ কাটার পর হঠাৎই কথা বলল আরফান,
‘ তোমাকে আমার অপিনিয়নটা জানানো হয়নি নিদু।’
নিদ্রা কপাল কুঁচকে বলল,
‘ অপিনিয়ন? অপিনিয়ন অফ হোয়াট?’
আরফান ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলল,
‘ এবাউট দেট গার্ল!’
নিদ্রা চোখ বড় বড় করে তাকাল। আরফান রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,
‘ মেয়েটি আসলেই মারাত্মক সুন্দরী।’
নিদ্রা এবার মাত্রাতিরিক্ত বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ মেয়েটার সাথে দেখা হয়েছিল তোমার?’
‘ হ্যাঁ। হয়েছিল।’
‘ কিভাবে?’
‘ হসপিটালে। তার বন্ধু আমার পেশেন্ট ছিল।’
‘ তুমি তাকে বকোনি?’
আরফান হেসে মাথা নাড়ল। নিদ্রা কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করল,
‘ তোমার রাগটা কি মোটামুটি থেকে শূন্যে নেমে গিয়েছে?’
আরফান হেসে বলল,
‘ মনে হচ্ছে।’
‘ তুমি কি তাকে বিয়ে করছ?’
মেয়েটির চোখে বিস্ময়। আরফান কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
‘ বিয়ে করছি কি-না জানি না। তবে সম্ভবনা আছে। আমি তার একটা সিক্রেট জেনে গিয়েছি। সেই সিক্রেটটা পুরোপুরি এক্সপোজ করার আপেক্ষায় আছি। আমার ধারণা সে আমার সাথে গেইম খেলার চেষ্টা করছে।’
নিদ্রা লাফিয়ে উঠে বলল,
‘ তারমানে তুমি বিয়ে করছ! আমি এক্ষুনি মাকে জানাচ্ছি যে নিষ্প্রভ ভাইয়া বিয়ে করছে। মেয়ে টেয়ে ঠিকঠাক। এখন শুধু বাসর সাজানো বাকি।’
আরফান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,
‘ বিয়ে করছি কখন বললাম?’
‘ এইমাত্রই বললে। আচ্ছা মেয়েটির নাম কি? মাকে তো ডিটেইলস জানাতে হবে, তাই না? আচ্ছা? সে-কি সবসময়ই জিনিসপত্র ফেলাফেলি করে? নাকি দেখে দেখে ল্যাপটপ জাতীয় জিনিসগুলোই ফেলে? টাইম মেইন্টেইন করে ফেলে? নাকি যখন তখন ফেলে? আচ্ছা! তুমি উত্তরগুলোর লিস্ট বানাতে থাকো। আমি আগে মাকে ইনফর্ম করে আসি। শী শুড নো দ্যা গ্রেট নিউজ।’
কথাটা বলেই চঞ্চল পায়ে বেরিয়ে গেল নিদ্রা। ঘটনার আকস্মিকতায় আরফান হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎই ডেকে উঠে বলল,
‘ বাট আই ডোন্ট ইভেন নো শী ইজ এনগেজড অর নট! নিদু? নিদু? দাঁড়াও।’
নিদ্রার দেখা পাওয়া গেল না। সিঁড়িতে বেজে উঠা পায়ের শব্দগুলো মিলিয়ে গেল দূরে। আরফান ছোট্ট শ্বাস টেনে দোলনায় গা এলাল। ঠোঁটের কোণে অযথায় ফুটে উঠল হাসি। চোখদুটো বোজার সাথে সাথেই ভেসে উঠল আকর্ষণীয় সেই পা। নেশা ধরানো সেই তিল। সেইসাথে নম্রতার বিস্মিত, আশ্চর্য দুটো চোখ।
দুই দিন হলো ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। গঁদ বাধা পড়াশোনা থেকে খনিকের মুক্তি। ঘাসের উপর হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে বন্ধুরা। অন্তুর ভাঙা হাতও এখন ঠিকঠাক। সেইসাথে ঠিকঠাক তার মাথাও। গত একমাস যাবৎ নীরার সাথে কোনোরূপ ঝামেলা সে করেনি। একদম স্বাভাবিক থেকেছে। শান্তভাবে পরীক্ষাগুলোও দিয়েছে। কয়েক মাস আগে এডমিশন হওয়ায় নতুন নতুন ছাত্রছাত্রীতে ভরে গিয়েছে ক্যাম্পাস। সব ফ্রেশারস্। প্রতিবারের মতোই মেয়েগুলো মাত্রাতিরিক্ত সুন্দরী। নাদিম, অন্তু, রঞ্জন নতুন মেয়েদের নিয়ে আলোচনা করছে। ছোঁয়া গভীর মনোযোগে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে। নম্রতার মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। গোটা এক মাসে আরফান একবারের জন্যও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। একবারের জন্যও না। মানুষটা সত্যি সত্যিই বিয়ে করে সংসারী হয়ে গেল না তো আবার? নম্রতার রাগ লাগছে। আরফান যদি সত্যিই বিয়ে করে থাকে তাহলে তাকে একদম দেখে নিবে নম্রতা।পত্র দিবে তাকে আর বিয়ে অন্য কাউকে? এত সোজা? এমন হলে গলায় ছুঁড়ি ঝুলিয়ে বিয়ে করতে বাধ্য করবে। দরকার হলে সতীন নিয়ে সংসার করবে। নয়তো আরফানকে খুন করে জেলে গিয়ে বসে থাকবে। শান্তি ! নাদিম গিটার কোলে নিয়ে বসে ছিল। পাশ দিয়ে দুটো মেয়েকে যেতে দেখতেই ভদ্র ছেলের মতো কাছে আসতে বলল। মেয়েগুলো প্রত্যুত্তর না করে সামনে এসে দাঁড়াল। দুই জনের চোখ-মুখই রক্তশূন্য, ফ্যাকাশে। ভাবভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছে, ভয়ে এখনই জ্ঞান হারাবে। নাদিম বিরস কন্ঠে বলল,
‘ নাম কি? কোন ডিপার্টমেন্ট?’
মেয়েদুটো ভয়ে ভয়ে নাম বলল। তাদের গলা কাঁপছে। চোখদুটো কাঁদো কাঁদো। আজকালকার ফ্রেশারদের এমন ন্যাকা ন্যাকা ভাব দেখলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় নাদিমের। নাদিম গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ পানি আছে? ঠান্ডা পানি খাওয়াও তো।’
দুই জনের মাঝে লম্বা মেয়েটি যন্ত্রের মতো করে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করল। বোতলটা নিতে গিয়ে নাদিম খেয়াল করল, মেয়েটা ঠকঠক করে কাঁপছে। এক ঢোক পানি গিলে গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে ছোঁয়ার হাতে দিল সে। ছোঁয়া বোতলটা নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ করল। চশমাটা ঠিকঠাক করে নিয়ে গন্ধ শুকল। সন্দিহান কন্ঠে বলল,
‘ এটা কি মিনারেল ওয়াটার? অথবা ফোটানো।’
‘ জি না আপু্। ভার্সিটি থেকেই নিয়েছিলাম।’
ছোঁয়ার মুখভঙ্গি দেখার মতো হলো। চোখ-মুখ কুঁচকে বোতলটা নাদিমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ সরি! আমি মিনারেল ওয়াটার ছাড়া খাই না। কতশত ব্যাকটেরিয়া আছে। ছিঃ।’
নাদিম বোতল দিয়েই ছোঁয়ার মাথায় থাপ্পড় লাগাল। চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘ বালের মিনারেল ওয়াটার মারাইতে আসছিস। আমি এইডা বুঝি না তোর মতোন গবেট ইংরেজরে এখনও এই দেশে রাখছেটা ক্যান? আই ওয়ান্ট টু গিভ ইউ আ লাত্থি। বিশ্বাস কর দোস্ত, তোর মতো গবেটরে বেশি হইলে ড্রেনের পানি খাওয়ানো যায়। এর থেকে শুদ্ধতম কিছু তোর লাইগা বাংলাদেশে নাই।’
ছোঁয়া চোখ রাঙিয়ে তাকাল। নাদিম ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে বাকি পানিটুকু শেষ করে বোতলটা ফিরিয়ে দিল। বেশ আয়েশ করে বসে বলল,
‘ আমাগো ডিপার্টমেন্টেই তো ভর্তি হইছ। চিনে আমাগো?’
মেয়েদুটো অসহায় মুখে মাথা নাড়ল। যার অর্থ চিনে না। নাদিম আগলা কন্ঠে বলল,
‘ মামা! চিনে না তো। এই দুঃখে ছাঁদ থাইকা লাফ দিয়া মইরা যাইতে মন চাচ্ছে।’
আতঙ্কে মেয়েদুটোর গলা শুকিয়ে এসেছে। তাদের সচেতন মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছে র্যাগিং-এর মতো বিশ্রী প্রথাটার মধ্যে তারা ফেঁসে গিয়েছে। নম্রতা রয়ে সয়ে বলল,
‘ কষ্ট পাইস না দোস্ত। না চিনলে এখন চিনবে। সমস্যা কই? কি, সমস্যা আছে?’
মেয়েদুটো দ্রুত মাথা নাড়ে, সমস্যা নেই। নম্রতা ঠেস দেওয়া কন্ঠে বলল,
‘ এই তিনটা ভাইয়ের মধ্যে কার উপর ক্রাশ খাইছ? নাকি ক্রাশ খাও নাই?’
মেয়েদুটো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। নম্রতা আবারও ধমকে উঠতেই একজন রঞ্জনকে ইশারা করে বলল,
‘ এই ভাইয়াটাকে ভালো লাগে।’
নীরা চোখ ছোট ছোট করে বলল,
‘ এই মেয়ে? এতো সাহস কোথায় পাও? সিনিয়রদের আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছ। যাওয়ার সময় সালামও দাওনি। কাহিনী কি? সিনিয়র মনে হয় না?’
‘ সরি আপু।’
নম্রতা বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ রঞ্জনকে ভালো লাগছে! মাই গড। তুমি আমার বরের ওপর কিভাবে ক্রাশ খেতে পারো? তোমার এতো সাহস কোথাকে?’
রঞ্জন হেসে ফেলল। নাদিম হাই তুলতে তুলতে বলল,
‘ বহুত বড় অন্যায় করে ফেলছ। আমার বান্ধবী বিশাল কষ্ট পাইছে। জ্বলেপুড়ে মরে যাচ্ছে। এই জ্বালাপোড়া কমাতে পানি লাগবে। তোমার কাজ হলো, ভার্সিটির শেষ মাথায় যে চাপকল আছে ওখান থেকে বোতল ভরে পানি আনা। সময় মাত্র পনেরো মিনিট। এক মিনিট এপাশ-ওপাশ হলে খবর আছে। আর হ্যাঁ… চোরের ওপর বাটপারি করার চেষ্টা করবে না। বাটপারিতে আমরা হেডমাস্টারি করে এসেছি। টাইম স্টার্টস নাও…’
মেয়েটা কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে হন্তদন্ত পায়ে ছুঁটে গেল। এতো বড় ভার্সিটি এড়িয়ায় কোথায় খুঁজবে সেই চাপকল? প্রথমত কিছু চিনে না তারওপর মাত্র পনেরো মিনিট! ছোঁয়া চশমা ঠিক করতে করতে দ্বিতীয় মেয়েটিকে বলল,
‘ তুমিও রঞ্জনের ওপর ক্রাশড? কেন? অন্তুকে দেখে ক্রাশ খেলে না কেন? অন্তু দেখতে বিশ্রী? তুমি ওকে অপমান করার চেষ্টা করছ?’
মেয়েটি ব্যস্ত হয়ে বলল,
‘ না আপু। অন্তু ভাইয়াও খুব কিউট।’
‘ এই! তুমি সিনিয়র ভাইকে কিউট বললা? এতো সাহস কই পাও?’
মেয়েটি যেন অকূল পাথারে পড়ল। দিশেহারা হয়ে চুপ করে রইল। নম্রতাদের কঠিন কথার ঘোরপ্যাঁচে ঠোঁট চেপে কান্না আটকাল । দশ মিনিটের মাথায় মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে নিজেদের ডিপার্টমেন্টের দিকে হাঁটা দিল। নীরা বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল,
নীল চিরকুট পর্ব ২৫+২৬
‘ এবারের ফার্স্ট ইয়ারগুলো ভয়ানক বিচ্ছু। সামনে দিয়ে চলে যায় তবু সালাম দেয় না। আর কিছু বললেই ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে লেগে যায়। আমরা যে পরিমাণ র্যাগ খেয়েছি তার টোয়েন্টি ফাইভ পার্সেন্টও ওদের দেওয়া হয় না। ন্যাকাবাজ একেকটা।’
বন্ধুদের মধ্যে এই নিয়ে চলতে লাগল আলোচনা। নম্রতার হুট করেই মন খারাপ হয়ে গেল। উফ! আরফান তার খোঁজ কেন নিচ্ছে না? নম্রতার কি উচিত তার খোঁজ নেওয়া?
