নীল চিরকুট পর্ব ৪৭+৪৮

নীল চিরকুট পর্ব ৪৭+৪৮
নৌশিন আহমেদ রোদেলা

বিছানার এক কোণায় পাশ ফিরে শুয়ে আছে নীরা। সময়টা প্রায় মধ্যরাত। থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। জানালার পর্দা উড়িয়ে ঠান্ডা বাতাস আসছে স্তব্ধ, নিশ্চুপ ঘরে। ঘরের ভেতর উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। নীরার পাশেই লম্বালম্বিভাবে শুয়ে আছে অন্তু। কপালের উপর ডানহাতটা তুলে দিয়ে মাঝে মাঝেই ভীষণ উশখুশ করছে সে। নীরা জানে অন্তু ঘুমোয়নি। আলোতে তার ঘুম হয় না, সে-ও নীরার জানা। তবুও আগের মতোই শক্ত হয়ে শুয়ে রইল নীরা। নিজ মুখে না বললে কিছুতেই আলো নেভাবে না সে। মুখে কুলুপ এঁটে পত্নী সেবা পাওয়ার ইচ্ছে থাকলে, আজ সেই আশার গুড়ে বালি দেবে নীরা। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকার পর হঠাৎই ঘাড়ের উপর গরম নিঃশ্বাস টের পেল নীরা।

নিঃশ্বাসের স্পর্শ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতেই চমকে উঠল নীরা। দমবন্ধ হয়ে এলো। উত্তেজনায় হাত-পায়ে কাঁপন ধরল। অন্তু তার এতো কাছে? নীরা কম্পিত বুক নিয়ে সোজা হয়ে শুল। সাথে সাথেই নিজের মুখের ঠিক উপরেই আবিষ্কার করল প্রিয় একটি মুখ। ঝলমলে আলোয় কাঙ্ক্ষিত মানুষটির শক্ত চোয়াল, প্রশস্ত কাঁধে নজর আটকে গেল নীরার। একদৃষ্টে চেয়ে রইল অন্তুর মুখে। অন্তু নীরার দিকে এক পলক চেয়েই দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ডানহাতটা বাড়িয়ে দিয়ে নীরার পাশে থাকা সুইচবোর্ড হাতড়ে আলো নেভাল। সবুজ রঙা ঢিম লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে সরে আসতে নিতেই চট করে টি-শার্টের কলার খামচে ধরল নীরা। নীরার আচমকা আক্রমণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল অন্তু। নীরার উপর পড়ে যেতে নিয়েও কোনোরকমে সামলে নিল সে। নীরার মাথার পাশে বামহাতের ঠেস দিয়ে বিস্ময় নিয়ে তাকাল। নীরার বামহাতের মুঠোতে থাকা কলারের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকাল। নীরার মুখের দিকে চেয়ে হতভম্ব কন্ঠে প্রশ্ন করল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ কী?’
নীরার হাতের মুঠো আরও খানিকটা শক্ত হল। অন্তু বাধ্য হয়েই আরও একটু ঝুঁকে এলো কাছে।
‘ রাতে বাড়ি না ফেরার কারণ কী?’
অন্তু উত্তর না দিয়ে কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করল। নীরা হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে রেখে অন্তুর মুখের দিকে চেয়ে রইল। অন্তু কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতেই দু-একবার নীরার দিকে তাকাল৷ নীরার মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার কোনো লক্ষ্মণ না দেখে মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ফেলল। নিজের পরাজয় মেনে নিয়ে হতাশ কন্ঠে বলল,
‘ কী চাই?’
নীরা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,

‘ আইডিয়া চাই।’
অন্তুর কপাল কুঁচকে গেল। ভ্রু বাঁকিয়ে নীরার দিকে চেয়ে থেকে আবারও কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করল। নীরা মুঠো শক্ত রেখেই বলল,
‘ আইডিয়া না দিলে ছাড়ব না।’
অন্তু বিরক্ত কন্ঠে বলল,
‘ কিসের আইডিয়া?’
‘ শাশুড়ী মা বলেছে, নিজের বরকে ঘরে আটকে রাখার দায়িত্ব আমার। সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করানোর পরও যদি ছেলে রাত-বিরেতে বন্ধুর বাসায় পড়ে থাকে তাহলে চলবে কেন? শাশুড়ী মায়ের কথায় পয়েন্ট আছে। কিন্তু বরকে কিভাবে আটকাব বুঝে উঠতে পারছি না৷ ছেলেদের সম্পর্কে ছেলেদের ধারণা থাকে সবচেয়ে বেশি। তাই আইডিয়া চাচ্ছি, কিভাবে আটকাব আমার বরকে?’

কথাটা বলে সরল চোখে চাইল নীরা। অন্তুর হতভম্ব দৃষ্টি লক্ষ্য করে কৈফিয়ত দেওয়ার মত করে বলল,
‘ বেস্টফ্রেন্ড হিসেবে আইডিয়া চাইছি। বাকিরা তো নেই কাছে। থাকলে নিশ্চয় চুপ করে থাকত না।’
অন্তু বিস্মিত চোখে চেয়ে রইল। নীরা যে এমন কিছু বলতে পারে ধারণায় ছিল না তার। নীরার কথার পিঠে কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে চুপ করে রইল অন্তু। ভ্রু,কপাল কুঁচকে কিছু একটা ভাবতে লাগল। অন্তুর নিশ্চলতার সুযোগে আরও একটা অদ্ভুত কাজ করে বসল নীরা। আচমকায় কাছে টেনে চুমু খেল অন্তুর গলায়। অন্তুর সারা শরীর ক্ষণিকের জন্য কেঁপে কেঁপে উঠল। চকিতে নীরার দিকে তাকাল। মেয়েটা কী পাগল হয়ে গিয়েছে আজ? নীরা আবারও একই কাজ করল। তৃতীয়বারের পাগলামো যেন অসহনীয় ঠেকল অন্তুর। গলার এক পাশে গাঢ় দাগ বসিয়েই সম্বিৎ ফিরে পেল নীরা। চমকে উঠে অন্তুকে ছেড়ে দিয়ে পাশ ফিরে শুল। কাঁথায় চোখ-মুখ ঢেকে নিজের লজ্জা আর অস্বস্তি ঢাকার বৃথা চেষ্টা করল। এতোক্ষণ পর ছাড়া পেয়ে নীরার পাশেই চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল অন্তু। গলার জ্বালা ধরা জায়গাটুকু হাত দিয়ে আলতো স্পর্শ করে আড়চোখে নীরার দিকে তাকাল। আশ্চর্য! কি চায় এই মেয়ে?

পার্কের বেঞ্চিতে চুপচাপ বসে আছে নাদিম। দুই আঙ্গুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট। মাথায় এক দঙ্গল চুল। চোখে-মুখে নিষ্পৃহ ভাব। কোলের উপর রাখা গিটারটায় সুর তোলার প্রচেষ্টা নেই। নাদিম সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে মুখ কুঁচকাল। বিস্বাদ। সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে পকেট থেকে ফোন বের করে ভ্রু বাঁকাল। নিচের ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবল। তারপর ধীর হাতে ডায়াল করল পরিচিত এক নাম্বারে। কল ঢোকার সাথে সাথেই ঝট করে রিসিভ করে ফেলল অপর পাশের ব্যক্তি। নাদিম গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ হ্যালো?’
ওপাশ থেকে জবাব পেল না নাদিম। কারো ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ এসে ধাক্কা খেতে লাগল ফোনের স্পিকারে। সেই সাথে অল্প একটু নাক টানার শব্দ। নাদিম বিরক্ত হল। বন্ধুর খাতিরে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে বিরক্তি দমন করল সে। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ হ্যালো, মৌশি? ক্যান ইউ হেয়ার মি?’
ওপাশ থেকে মৃদু জবাব,
‘ হ্যালো স্যার।’
‘ কেমন আছ মৌশি?’
মৌশি কান্না আটকে রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
‘ আপনি কেমন আছেন স্যার?’
নাদিম হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। এই বয়সের মেয়েদের অল্পতে কেঁদে কেটে পৃথিবী ভাসিয়ে ফেলার স্বভাবটা বড় বিরক্তিকর।

‘ আমি ভালো আছি।’
কথাটুকু বলে থামল নাদিম। ছোট্ট একটা শ্বাস টেনে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ তোমার কী এখন কোনো টিউটর প্রয়োজন মৌশি? প্রয়োজন হলে আমায় জানিও। আমি একটা ভালো টিউশনি খুঁজছি।’
নাদিমের কথায় অবাক হল মৌশি। নাদিম তার কাছে হেল্প চাইছে? সত্যিই চাইছে? কথাটা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না মৌশির। মৌশি অবাক হয়ে বলল,
‘ আপনার প্রয়োজন স্যার?’
নাদিম উত্তর দিল না। মৌশি খুশি হয়ে বলল,

‘ আপনি আমাকে যেকোনো সাবজেক্ট পড়াতে পারেন স্যার। কখন আসবেন বলুন। সকাল, দুপুর, রাত এনিটাইম।’
‘ টিউশনিটা আমার জন্য নয় মৌশি, আমার বন্ধুর জন্য। দারুণ ট্যালেন্টেড একটা ছেলে। অসাধারণ পড়ায়। যদি তোমার টিচারের প্রয়োজন থাকে তবেই হ্যাঁ বলো। অন্যথায় নয়।’
মৌশির মন খারাপ হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
‘ আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড?’
নাদিম ভ্রু কুঁচকাল,
‘ হ্যাঁ। কেন?’
মৌশি উত্তর না দিয়ে বলল,
‘ আমি উনার কাছে পড়ব।’
নাদিম মৃদু হাসল। মৌশি যে চট করেই রাজি হয়ে যাবে এমনটাই ধারণা করেছিল নাদিম। অন্তুর মাধ্যমে নাদিমের সাথে কানেক্টেড থাকার শেষ চেষ্টাটা যে মৌশি কিছুতেই হাতছাড়া করবে না তা-ও নাদিমের জানা। নাদিম ফোন কেটে গিটারে সুর তুলল। চেহারায় বাবার তেমন ছাপ না থাকলেও নাদিমের ব্যক্তিত্ব আর চাল-চলনে বাবার প্রকাশ স্পষ্ট। বাবার মতোই ছন্নছাড়া জীবনবোধ। নারীমহলে দীর্ঘশ্বাসের কারণ। কথাবার্তায় স্পষ্ট, ভয়হীন তেজ। নাদিমের মনে হঠাৎই প্রশ্ন জাগে, আচ্ছা? চরিত্রের দিক দিয়েও কি তারা একই? একই কি তাদের পরিণতিও?

সুন্দর, ঝকঝকে সকাল। রাতে বৃষ্টি হওয়ায় বাতাসে মৃদু ঠান্ডা আমেজ। এখানে সেখানে জমে আছে কর্দমাক্ত পানি। আরফান দ্রুত পায়ে হাসপাতালের ফটকে এসে দাঁড়াল। গেইট থেকে কিছুটা দূরে, ফোন কানে দাঁড়িয়ে আছে নম্রতা। এক হাতে ছোট্ট একটি হ্যালমেট। গায়ে সাদা-কালো শাড়ি। আরফান কিছুটা এগিয়ে এসে নম্রতার মুখোমুখি দাঁড়াল। ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বলল,
‘ বাহ! নিউ লুক।’
নম্রতা শিশুসুলভ হেসে বলল,
‘ আপনি ফ্রী?’
নম্রতার ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমির আভাস পেয়ে ভ্রু বাঁকাল আরফান। সন্দিহান কন্ঠে বলল,
‘ আপনার মাথায় একজেক্টলি কি চলছে নম্রমিতা?’
‘ ফুসকা ঘুরছে। আপনি ফ্রী থাকলে দু’জন মিলে রবীন্দ্র সরোবরে যাব। আপনি বেলীফুলের মালা কিনে দিবেন। সেই মালা হাতে ফুসকা হাউজ যাব। পেট পুরে ফুসকা খাব। আপনি চাইলে আইসক্রিমও খাওয়াতে পারেন। আই ওন্ট মাইন্ড।’

নম্রতার হাসি হাসি মুখের দিকে চেয়ে হাসল আরফান। ডানহাতের কব্জিতে থাকা ঘড়িটা একবার দেখে নিয়ে বলল,
‘ মাত্রই ক্লাস শেষ করে বেরুলাম। আগামী দুই ঘন্টা ফ্রী। আমার ডিউটি দুই ঘন্টা পর থেকে। এই দুই ঘন্টায় যতটুকু সম্ভব ঘুরে বেড়ানো যায়।’
আরফানের কথায় খুশি হয়ে গেল নম্রতা। গোলাপী রঙের হ্যালমেটটা খুব দ্রুত মাথায় চাপিয়ে বলল,
‘ গ্রেট। তাহলে চলুন!’
নম্রতাকে স্কুটিতে উঠতে দেখে ভ্রু কুঁচকাল আরফান,

‘ চলুন মানে? আপনি কী স্কুটিতে যাবেন নাকি?’
নম্রতা অমায়িক হাসি দিয়ে বলল,
‘ শুধু আমি নই। আপনিও যাচ্ছেন।’
আরফান আঁতকে উঠে বলল,
‘ আমি আর স্কুটিতে? ইম্পসিবল!’
নম্রতা মুখ ফুলিয়ে বলল,
‘ কেন! আপনার ধারণা আমি স্কুটি চালাতে পারি না?’
‘ তা নয়। আমার রিকশায় যেতে ভালো লাগে। আমরা বরং রিকশায় যাই?’
নম্রতা শক্ত কন্ঠে বলল,
‘ না। আমরা স্কুটিতেই যাব। জলদি উঠুন।’
আরফান হতাশ কন্ঠে বলল,
‘ মেয়েদের স্কুটিতে উঠে রবীন্দ্র সরোবর যাব? ব্যাপারটা ভীষণ উইয়ার্ড লাগছে নম্রতা।’
‘ লাগলে লাগুক।’
‘ আপনি আমার ন্যাচার জানেন নম্রমিতা। এসব স্কুটি ফুটিতে উঠা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। প্লিজ রিকশায় চলুন।’
নম্রতা সামনের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট উত্তর দিল,

‘ না।’
‘ আপনি বাচ্চাদের মত জেদ করছেন।’
নম্রতা ফিরে তাকাল। ঝট করে স্কুটি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে ঝাঁঝাল কন্ঠে বলল,
‘ করলে করছি। আপনিও তো বাচ্চাদের মতোই ভয় পাচ্ছেন। আর ভয় পাচ্ছেন বলেই বাবার সাথে দেখা করতে চাইছেন না। এটা আপনার পানিশমেন্ট।’
আরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হতাশ কন্ঠে বলল,
‘ এখানেও বাবা?’
নম্রতা তেড়ে এসে বলল,
‘ তো?’
‘ আপনি এখনও সেই আগের মতোই আছেন। সব কিছুতেই আগের মতোই ভয়ানক জেদ।’
নম্রতা হ্যালমেটটা খুলতে খুলতে বলল,
‘ তো? আপনি কি আমার পরিবর্তন চাইছিলেন? আপনি চান আমি পাল্টে যাই?’
আরফান হেসে বলল,

‘ একদমই না। আমিতো আরও এই ভেবে খুশি হচ্ছি যে, এতোদিন পরই হোক আর যায়হোক শেষমেষ পুরাতন শ্যামলতার সাথে দেখা তো মিলছে।’
নম্রতা সন্তুষ্টির হাসি হাসল। পরমুহূর্তেই চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,
‘ একদম গলানোর চেষ্টা করবেন না। স্কুটিতে উঠার প্ল্যান আমি ক্যান্সেল করব না। কিছুতেই না।’
‘ যদি আপনার বাবার সাথে দেখা করতে রাজি হই তবে?’
নম্রতা চকিতে তাকাল। সন্দিহান কন্ঠে বলল,
‘ সত্যি?’
‘একদম।’
‘ চুক্তিপত্র জমা দিন। আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।’

আরফান হেসে একটা রিকশা ডাকল। নম্রতাকে রিকশায় উঠতে ইশারা দিয়ে একটা ফোন এটেন্ড করল। ফোন কিছুক্ষণ কথা বলার পর মুখটা কালো হয়ে গেল আরফানের। নম্রতার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে কিছু একটা বলবে তার আগেই হাসল নম্রতা। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ হঠাৎ কাজ পড়ে গিয়েছে? আচ্ছা, মন খারাপ করবেন না। আজ নাহয় আমি একাই ফুসকা খাই। এরপরের বার আপনি খাওয়াবেন। সাথে আইসক্রিম ফ্রী। মনে থাকবে?’
কথাটা বলে মিষ্টি হাসল নম্রতা। আরফান হাসল না। নম্রতার স্নিগ্ধ মুখের দিকে চেয়ে মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল সে। চাপা মন খারাপ নিয়ে বলল,
‘ মনে থাকবে।’
নম্রতা আবারও হাসল। আরফানের মুখে হাসি নেই। অতি সন্তপর্ণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ চেয়ে রইল প্রিয়তমার প্রিয় দুটো চোখে।

নাদিমের যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘড়িতে বারোটা কি একটা বাজে। হলের চেরচানা ঘরটাতে আলো-আঁধারির খেলা। বেশ কিছুক্ষণ চোখ বোজে পড়ে থাকার পর বিছানা হাতড়ে মুঠো ফোনটা উদ্ধার করল নাদিম। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে থাকা তারিখটা দেখেই ফট করে মনে পড়ে গেল, আজ তার মায়ের মৃত্যু দিন। ঠিক এই দিনটাতেই চোখের সামনে পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিলেন মা। স্বেচ্ছা মৃত্যু অর্থাৎ আত্মহত্যা। গত নয় বছর ধরে ব্যাপারটা নিছক আত্মহত্যা মনে হলেও আজ এই স্নিগ্ধ দুপুরে ব্যাপারটাকে নিছক আত্মহত্যা বলে ভাবতে ইচ্ছে করছে না।

প্রত্যক্ষ না হোক পরোক্ষভাবে হলেও বাবাকে এই মৃত্যুর পেছনে দায়ী করে মনটাকে বিষিয়ে দিতে ভালো লাগছে। নাদিমের বাবা আদিব ছিলেন ছন্নছাড়া ধাঁচের মানুষ। জীবনের ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে বেঁচে থাকার স্বাদ আচ্ছাদনই ছিল তার মূলমন্ত্র। নাদিম ভেবে পায় না, এমন একটা মানুষকে কি করে ভালোবাসার জালে আটকে ফেলল মা? সংসার নামক ভয়ানক জালে আটকে ফেলে, কিভাবে সেই মুক্ত ডানা কাটল? নাদিম উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়াল। জানালার পাল্লাটা খুলে দিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিল। গাঢ় নীল আকাশের দিকে চেয়ে হুট করেই তার মনে হল, মা আসলে পাখা কাটতে পারেনি। বাবার মুক্ত পাখা কেটে ফেলার ক্ষমতা হয়ত মায়ের ছিল না। আর ছিল না বলেই এমন ভয়াবহ পরিণতি হলো তাদের ভালোবাসার। নাদিমের মস্তিষ্কে ‘ভালোবাসা’ নামক শব্দটা বলের মত ঢপ খেতে লাগল। ঢিপ ঢিপ শব্দ তুলে আওড়াতে লাগল, ‘ ভালোবাসা’, ‘ভালোবাসা’। সত্যিই কী ছিল ভালোবাসা?

ঘরের ছোট্ট ড্রেসিং টেবিলটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে অন্তু। শার্টের কলারটা বিভিন্নভাবে টেনেও গলার দাগ ঢাকা যাচ্ছে না। শ্যামলা গায়ে গোল হয়ে ফুলে আছে টকটকে লাল দাগ। অন্তু বিরক্ত চোখে চেয়ে রইল। দাগ ঢাকার মতো কোনো সরঞ্জাম খুঁজে না পেয়ে নিজের উপরই চটে যাচ্ছে সে। সকাল সকাল এমন অপ্রত্যাশিত ফ্যাসাদ একদমই ভালো লাগছে না। আয়নায় নিজের গলাটা খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে কিছু একটা ভাবল অন্তু। আলমারি থেকে শীতের চাদর বের করে গলায় পেঁচাল।

অসন্তুষ্ট চোখে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিয়েই ঘরের বাইরে পা রাখল। খাওয়ার টেবিলে বসেই নীরার উপস্থিতি টের পেল অন্তু। খাওয়ার সময় অসচেতনভাবে দুই-একবার চোখাচোখিও হল তাদের। প্রতিবারই অপরাধীর মতো চোখ আড়াল করল নীরা। খাবার সার্ভ করতে করতেই গালদুটো লজ্জায় লাল হয়ে উঠল তার। ভীষণ অস্বস্তিতে হাসফাস করে উঠল মন। ইশ! কি দরকার ছিল রাতে ওমন একটা কান্ড করার? অন্তু কি ভাবছে? অন্তুর শীতল চাহনি দেখে গলা শুকিয়ে আসে নীরার। নিজের গালে ডজন খানিক চড় বসানোর অদম্য ইচ্ছে দমন করে নিজের কাজে মন দেয়। শঙ্কিত মনের অশনি সতর্কবার্তায় বারবারই আঁতকে উঠে বলে, অন্তু যদি রেগে গিয়ে বাড়িতে আসা একেবারেই বন্ধ করে দেয়?

গোধূলীর শেষ সময়টায় বারান্দায় বসে বই পড়ছিল নম্রতা। পাশের টেবিলে ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ। নম্রতার একনিষ্ঠ মনোযোগের মাঝেই পাশে এসে বসলেন নুরুল সাহেব। নম্রতা বই থেকে চোখ না তুলেই মৃদু আসল। মোলায়েম কন্ঠে বলল,
‘ গুড আফটারনুন বাবা।’
‘ আফটারনুন মা। কি পড়ছিস?’
নম্রতা এবার চোখ তুলে তাকাল। বইটা বন্ধ করে সোজা হয়ে বসল। মৃদু হেসে বলল,
‘ তেমন কিছু নয় বাবা।’
‘ মন খারাপ?’

নম্রতা হেসে মাথা নাড়ল। জবাবে মিষ্টি হাসি উপহার দিলেন নুরুল সাহেব। পকেট থেকে নীল রঙা খাম বের করে চায়ের কাপের পাশে রাখতে রাখতে বললেন,
‘ মন খারাপ না থাকাটা সুসংবাদ। মন খারাপ থাকাটা অতিশয় সুসংবাদ। একটু পর যে মন খারাপ থাকবে না তা হবে অত্যধিক সুসংবাদ।’
নম্রতা বুঝতে না পেরে কপাল কুঁচকে তাকাল। টেবিলের উপর থাকা খামটির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ মানে? এটা কি বাবা?’

নুরুল সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। চশমাটা খুলে গ্লাস মুছতে মুছতে রহস্য করে বললেন,
‘ ডাক্তারকে বলে দিস সব বাসায় আমার মতো বাবা থাকে না। কিছু কিছু বাসায় তোর মার মতো অত্যাচারী মহিলাও থাকেন। কবুতরটা আদৌ মালিকের কাছে পড়বে নাকি শিকারীর, কে জানে?’

নীল চিরকুট পর্ব ৪৫+৪৬

কথাটা বলে সকালের পত্রিকাটা হাতে তুলে নিয়ে বারান্দা ছাড়লেন নুরুল সাহেব। নম্রতা বাবার যাওয়ার পথে বোকার মতো চেয়ে থেকে খামটা তুলে নিল হাতে। খামটা উল্টেপাল্টে দেখতেই খামের অপর পৃষ্ঠায় গুটি গুটি অক্ষরে ‘আরফান আলম নিষ্প্রভ’ নামটা দেখেই চমকে উঠল সে। কিছুক্ষণ হতভম্ব চোখে চেয়ে থাকার পর নিজের হাতেই চিমটি দিল নম্রতা। ‘ আরফান চিঠি পাঠিয়েছে’ —- এই ছোট্ট বাক্যটা মস্তিষ্কে পৌঁছাতেই সারা গায়ে আনন্দের ঝড় উঠে গেল। প্রচন্ড উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে লাগল শরীর। বুকে ভর করল প্রথমবার চিঠি পাওয়ার অনুভূতি। আহ্ কি সুখ!

নীল চিরকুট পর্ব ৪৯+৫০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here