নীল চিরকুট পর্ব ৫৭+৫৮

নীল চিরকুট পর্ব ৫৭+৫৮
নৌশিন আহমেদ রোদেলা

ঘড়িতে কয়টা বাজে জানা নেই নীরার। বারান্দায় আজ জ্যোৎস্নাদের মেলা। ঝিরঝিরে বাতাসে মৃদুমন্দ ঠান্ডাভাব। বারান্দার এক কোণায় টুলের উপর বসে আছে নীরা। উদাসী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তারা ভর্তি আকাশে। শাড়ির আঁচলটা গড়িয়ে আছে মেঝেতে। হাত খোপা করা চুলগুলো আজ উন্মুক্ত। গালের উপর শুষ্ক জলের ধারা। বেশ কিছুক্ষণ অনুভূতিশূন্যভাবে বসে থেকে দুই হাতে মুখ ঢাকল নীরা। বুক বেয়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। নিজের জীবনটাকে আরও একবার বোঝা বলে বোধ হলো তার। বেঁচে থাকাটা বড়ই নিষ্প্রয়োজন, অযথা বলে মনে হতে লাগল।

প্রিয়দের জীবনে নিজের জন্য বিন্দুমাত্র মিষ্টতা খুঁজতে খুঁজতে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ল ঠিক তখনই অন্যকারো উপস্থিতি টের পেল নীরা। মুখ থেকে দুহাত সরাতেই বারান্দার দরজায় অন্তুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে। নীরাকে অবাক করে দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো অন্তু৷ মেঝেতে হাঁটু গেড়ে নীরার মুখোমুখি বসল। নীরার হাতদুটো আলতো করে নিজের হাতে তুলে নিয়ে চোখে চোখ রাখল। নীরার বিস্মিত, স্তম্ভিত চোখদুটো থেকে গড়িয়ে পড়ল দু’ফোটা টসটসে জল। অন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নীরার ডানহাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু খেল তার হাতে। নরম কন্ঠে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ আম্মা এত রেগে আছেন কেন? কি হয়েছিল সন্ধ্যায়?’
স্তম্ভিত নীরা জবাব দিতে পারল না। স্থির চেয়ে রইল অন্তুর চোখে-মুখে। পুরো ব্যাপারটা নীরার কাছে অবিশ্বাস্য, স্বপ্ন বলে বোধ হচ্ছে। অন্তু একটা হাত নীরার গালের উপর রাখল।
‘ নিশ্চয় কিছু ঘটেছিল। না বললে জানব কি করে? ইরার সাথে কিছু হয়েছে?’
এবারও জবাব দিল না নীরা। তার শরীর কাঁপছে। এই স্বপ্নটা সত্যিই যদি স্বপ্ন হয় সেই ভয়ে শরীর কাঁপিয়ে কান্না পাচ্ছে। অন্তু আগের মতোই নরম স্বরে ডাকল,
‘ নীরু?’

অন্তুর এই ছোট্ট ডাকেই ডুকরে কেঁদে উঠল নীরা। চেয়ার ছেড়ে মেঝেতে বসে ভয়ে ভয়ে মাথা রাখল অন্তুর বুকে। অন্তু বাঁধা দিল না। মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করল। এই এতোবছর পর নিজের খোলস ভেঙে বেরিয়ে এলো নীরা। অন্তুর একটু আদর, একটু প্রশ্রয় পেয়ে বুকের সব কষ্টগুলো এই প্রথমবারের মতো প্রকাশ করল সে। রুদ্ধ কন্ঠে বলল,

‘ আমার আর সহ্য হচ্ছে না। এই সংসার, এই জীবন আর ভালো লাগছে না। যতই নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি ততই সমস্যায় জড়িয়ে পড়ছি। নিজেকে এতো উটকো কেন লাগছে আমার? কারো জীবনে বিন্দুমাত্র মিষ্টতা নেই আমার জন্য। সারাদিন চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করি, কখন অন্তু ফিরবে। কখন আমার সাথে একটু হেসে কথা বলবে। কিন্তু অন্তু তো কখনও আমার কাছে ফিরে না। আমি এই অন্তুকে প্রচন্ড ভয় পাই। তার দিকে তাকাতে ভয় পাই। তাকে ছুঁতে ভয় পাই।’
এটুকু বলে থামল নীরা। ক্লান্ত কন্ঠে বলল,

‘ আমি ক্লান্ত অন্তু। আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না। একটুও না।’
অন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নীরার চুলে আলতো হাত বুলিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ সরি। প্রেমিক হিসেবে সরি। হাজবেন্ড হিসেবে সরি। বন্ধু হিসেবে আই এম এক্সট্রিমলি সরি দোস্ত।’
নীরা মাথা তুলে তাকাল। চোখ ভর্তি বিস্ময় নিয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রইল। অন্তু নীরার আঁচলটা ঠিক করে দিতে দিতে বলল,

‘ কি হয়েছিল সন্ধ্যায়?’
নীরাকে স্থির তাকিয়ে থাকতে দেখে চোখের ইশারায় বলতে বলল অন্তু। বহুদিন বাদে অন্তুর চোখদুটো যেন চির পরিচিত হয়ে উঠল নীরার চোখে। ইরা আসার পর একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত করে বলে ফেলল নীরা৷ অন্তুর কপালে মৃদু কুঞ্চন দেখা দিল। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে কিছু একটা ভাবল। নীরাকে ভীত চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসার চেষ্টা করল অন্তু। মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়াল। নীরার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

‘ ইট’স ওকে। আমি আম্মাকে সামলে নিব। আম্মা উপরে শক্ত হলেও ভেতরে খুব নরম। ইরার ওভাবে কথাগুলো বলা উচিত হয়নি। আম্মা কষ্ট পেয়েছেন। আম্মাকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি নীরা। অতটা ভালো এখনও কাউকে বেসে উঠতে পারিনি।’
এটুকু বলে থামল অন্তু। মুখ কাঁচুমাচু করে অন্যদিকে তাকাল। তারপর ফট করেই বলে ফেলল,
‘ তাই বলে বউকে যে খুব কম ভালোবাসি তেমনটাও নয়।’
কথা শেষ করেই বারান্দা থেকে ভেতরের ঘরে গেল অন্তু। নীরা স্তব্ধ চোখে দেখল, নতুন অন্তুর নতুন সূর্যোদয়।

পার্পেল রঙের গাউন গায়ে স্থির বসে আছে ছোঁয়া। কাজের মেয়েটি চুল বাঁধছে। সিঁথি হক তীক্ষ্ণ চোখে লিপস্টিক পর্যবেক্ষণ করছেন। পার্পেল রঙের জামার সাথে লাল, খয়েরী নাকি পার্পেল রঙের লিপস্টিক লাগানো যেতে পারে তা নিয়ে মারাত্মক দু’টোনায় পড়েছেন। ছোঁয়া মনে মনে নিজেকে উত্তেজিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। উত্তেজিত হওয়ার বদলে ক্রমেই ঝিম ধরে আসছে মন। এক সপ্তাহ পরই বিয়ের তারিখ ঠিক করেছেন বাবা-মা। সাইম ব্যস্ত মানুষ অতো ছুটি সে পাবে না। তাছাড়া, বিয়ের পর হানিমুন বলেও একটা ব্যাপার আছে। সাইমের পছন্দ অনুযায়ী দূর্দান্ত কিছু হানিমুন সুইটসও ঠিক করে ফেলেছেন বড় খালামণি আর সিঁথি হক। ছোঁয়াকেও পছন্দের কথা জিগ্যেস করেছিল সাইম। কিন্তু সিদ্ধান্ত না নিতে নিতে অনভ্যস্ত ছোঁয়া তার পছন্দের কথা জানাতে পারেনি। কোনো পছন্দের জায়গা সে ভেবেই পায়নি। অবশেষে, সবটা মায়ের উপর ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে থেকেছে সে। আজ আবারও সাইমের সাথে দেখা হবে ছোঁয়ার। এর আগেও বার দুয়েক দেখা হয়েছিল তাদের। সাইম সুদর্শন, ওয়েল মেইনটেনেন্ট ছেলে। ভার্সিটি প্রফেসর হওয়ায় কথাবার্তায় সবসময়ই প্রফেসর প্রফেসর ভাব। তাদের যেদিন প্রথম দেখা হলো সেদিন সাইমের প্রথম প্রশ্ন ছিল,

‘ টাইম ট্রাভেল সম্পর্কে একজেক্ট ধারণা কী আপনার?’
ছোঁয়া কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল এমন প্রশ্নে। কেউ যে হবু বউয়ের সাথে দেখা করতে এসে এমন উদ্ভট প্রশ্ন করতে পারে তা যেন ধারণাতেই ছিল না ছোঁয়ার৷ ছোঁয়াকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে মৃদু হেসে কফি কাপে চুমুক দিয়েছিল সাইম। গম্ভীর কন্ঠে বলেছিল,
‘ আপনার বড় খালামণি বলেছিলেন, আপনি নাকি প্রচন্ড পড়াকু মেয়ে? বড় খালামণির কথাটা সম্পূর্ণ সত্য বলে মনে হচ্ছে না।’

তারপরের সময়টুকু দক্ষ শিক্ষকের মতো টাইম ট্রাভেল সম্পর্কে বুঝিয়েছে সাইম। ছোঁয়া বুঝেছে। রেস্টুরেন্ট থেকে বাড়ি ফিরে আপাদমস্তক ক্লাস শেষ করে ফিরে আসার মতো অনুভূতি হয়েছে ছোঁয়ার। অথচ সে ভেবেছিল, ডেইট নামক বিষয়টা ভীষণ উত্তেজনাপূর্ণ হয়!
সিঁথি হক রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই ফোন হাতে নিল ছোঁয়া। নম্রতা-নীরাকে ফোনে না পেয়ে নাদিমকে ফোন লাগাল। তিনবারের মাথায় ফোন উঠাল নাদিম। প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বিসমিল্লাহতেই দুই-তিনটা বিশ্রী গালি উপহার দিয়ে বসল সে। ছোঁয়া সেসব তোয়াক্কা না করে বলল,

‘ তুই কখনও ডেইটে গিয়েছিস?’
ছোঁয়ার প্রশ্নে যেন আকাশ থেকে পড়ল নাদিম। কয়েক সেকেন্ড চোখ বড় বড় করে চেয়ে থেকে ধমকে উঠে বলল,
‘ ক্যান? ডেইট ফেইটে গেলেও তোরে কইতে হইব ক্যান? বাই এনি চান্স, তুই কি ডেইটের ক্লাসিফিকেশন শোনার লাইগা ফোন দিছিস আমারে? শোন ছোঁয়াইয়া, তুই হইলি ইংরেজ বলদ। বলদদের ডেইটে কোনো ক্লাসিফিকেশন নাই। এদের একমাত্র ডেইট হলো গলা মিলিয়ে হাম্বা হাম্বা করা। তুই তোর অস্ট্রেলিয়ান গরুকে নিয়ে হাম্বা হাম্বা শুরু করে দে। হাম্বা হাম্বা করতে করতে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড ভেঙে ফেল। তোদের এই হাম্বা প্রতিযোগিতার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করব আমি। পুরস্কারের নাম হবে, ‘হাম্বা ডেটিং পুরস্কার’ নামটা সুন্দর না?’

বেলা নয়টা। রমনায় নিজস্ব অফিসে বসে আছেন নুরুল সাহেব। টেবিলের উপর ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ আর খুলে রাখা অমীমাংসিত ফাইল। নাকের ডগায় চশমা রেখে ফাইলের প্রতিটি লাইন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন তিনি। এমন সময় দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল বেয়ারা। ছড়ানো ছিটানো ফাইলগুলো গুছিয়ে নিতে নিতে বিনীত কন্ঠে বলল,
‘ আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে, স্যার।’
নুরুল সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন। চশমার উপর দিয়ে কুটিল চোখে তাকালেন। বিরক্ত কন্ঠে বললেন,
‘ এতো সকালে? এপয়েন্টমেন্ট ছিল নাকি? নাম কি?’
বেয়ারা পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘ এপয়েন্টমেন্ট বোধহয় ছিল না স্যার। এই কার্ডটা আপনাকে দিতে বলেছে। ভেতরে আসতে বলব স্যার?’
নুরুল সাহেব কার্ডটা নিলেন। গোয়েন্দাদের মতো খুব সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন। উল্টেপাল্টে দেখে নিয়ে মৃদু মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বেয়ারার দিকে তাকালেন। আঙ্গুলের ডগা দিয়ে চশমাটা ঠিক করে নিয়ে বললেন,
‘ আসতে বলো।’
বেয়ারা নির্দেশ পেয়ে মাথা হেলিয়ে বেরিয়ে গেল। কয়েক মিনিট পরই দরজায় মৃদু শব্দ হলো। কেউ একজন ভরাট অথচ বিনয়ী কন্ঠে অনুমতি চাইল,
‘ মে আই কাম ইন, স্যার?’
নুরুল সাহেব তাকালেন। কয়েক সেকেন্ড দরজার দিকে চেয়ে থেকে মাথা নাড়লেন। ঠোঁট নেড়ে বললেন,

‘ বসুন।’
আরফান ভেতরে এসে, সালাম দিয়ে, চেয়ার টেনে বসল। আরফানের কার্ডটা এখনও নুরুল সাহেবের হাতে। নুরুল সাহেব কার্ডটা উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে বললেন,
‘ ডক্টর আরফান আলম। লেকচারার অব ঢাকা মেডিকেল কলেজ, রাইট?’
‘ জি স্যার।’
‘ স্যার স্যার বলছেন কেন? আমি কি আপনার কলেজের প্রফেসর?’
নুরুল সাহেবের প্রশ্নে কিছুটা অপ্রস্তুত হলো আরফান। হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘ আপনি একজন সিনিয়র এডভোকেট। অভিজ্ঞ একজন মানুষ। স্যার ডাকাটাই বোধহয় যথাযথ।’
‘ আপনি কোনো কেইসের কাজে এসেছেন নাকি পার্সোনাল?’
আরফান জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল,

‘ পার্সোনাল।’
‘ তাহলে স্যার শব্দটা এবোয়েড করুন।’
আরফান কিছুটা বিপাকে পড়ল। আঙ্গুলের ডগা দিয়ে ডান চোখের ভ্রু চুলকিয়ে বলল,
‘ আসলে আঙ্কেল… ‘
আরফানকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েই চায়ের কাপে চুমুক দিলেন নুরুল সাহেব। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
‘ ইংরেজদের আংকেল ডাকটা আমার পছন্দ নয়।’
আরফান হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ তাহলে চাচা বলে সম্বোধন করতে পারি?’
নুরুল সাহেব বিরক্ত কন্ঠে আওড়ালেন,

‘ চাচা!’
আরফান এবার তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। নুরুল সাহেব ইচ্ছে করেই তাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে বুঝতে পেরে সুপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মুহূর্তেই মুখভঙ্গি পাল্টে স্পষ্ট কন্ঠে বলল,
‘ আমাকে মেয়ে জামাই বানালে আমি আপনাকে অনায়াসে বাবা ডাকতে পারি, স্যার। এটাই হয়তো পৃথিবীর শুদ্ধতম ডাক।’
নুরুল সাহেব ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। আরফানের এমন অপ্রত্যাশিত উত্তরে কিছুটা হোঁচট খেলেন। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললেন,

‘ আপনি… ‘
‘ আপনি আপনি বলছেন কেন? আমি তো আপনার মক্কেল নই।’
কথার মাঝে বাঁধা পাওয়ায় থমকালেন তিনি। কুঞ্চিত ভ্রু জোড়া আরও খানিকটা কুঁচকে আরফানের দিকে তাকালেন। পরমুহূর্তেই হেসে ফেলে বললেন,
‘ আমার কথায় আমায় ফিরিয়ে দিলে? গুড, ভেরি গুড। তবে, আমি তোমার উত্তরগুলো অন্যরকম আশা করেছিলাম।’
আরফান মৃদু হেসে বলল,
‘ বেয়াদবির জন্য সরি, স্যার।’
নুরুল সাহেব অমায়িক হাসলেন। বেয়ারাকে দু কাপ চা দিতে বলে কথা এগুলেন,

‘ তোমার মা আমাদের বাসায় সিভি পাঠিয়েছেন জানো?’
‘ জি জানি।’
‘ তাহলে হঠাৎ আমার সাথে দেখা করার কারণ? নম্রতার জেদ?’
আরফান হাসল। নুরুল সাহেব আরফানকে চা নিতে ইশারা করে বললেন,
‘ আমার স্ত্রী বলে, আমি আমার মেয়েদের বিগড়ে ফেলেছি। কথাটা পুরোপুরি মিথ্যে নয়। আমার মেয়েগুলো খুব স্বাধীনচেতা, একরোখা, জেদী। আমি কখনও তাদের ডানা কাটিনি বরং উড়তে দিয়েছি। উড়তে শিখিয়েছি। আমার এই বিগড়ে যাওয়া মেয়ের জন্য পাঞ্চুয়াল, ম্যাচিউর এবং রেসপন্সেবল একজন লাইফ পার্টনার প্রয়োজন। যে আমার মতো তাকে বুঝবে। ডানা কেটে ঘরে না বসিয়ে, উড়তে দিবে। কি মনে হয়? আমার বিগড়ানো মেয়েটাকে সামলাতে পারবে?’

আরফান ঠোঁটের কোণে হাসি ধরে রেখে বলল,
‘ নম্রতার সাথে আমার পরিচয়টাই হয়েছিল তার চূড়ান্ত অবাধ্যতার বয়সে। কলেজ পড়ুয়া জেদী, অগোছালো কিশোরী ছিল তখন। আমি তাকে ওভাবে ভেবেই অভ্যস্ত। তাকে কখনো শান্ত, চুপচাপ, মানিয়ে নেওয়া ধরনের মেয়ে হিসেবে কল্পনাই করিনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমি তাকে যতটা ভালো রাখতে পারব, অন্য কেউ পারবে না।’
নুরুল সাহেব জবাব না দিয়ে চুপ করে চেয়ে রইলেন। আরফানের আত্মবিশ্বাসী কথাবার্তা, ব্যক্তিত্ব তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে খেয়াল করলেন। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,
‘ ডাক্তার হিসেবে তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। গত মাস থেকে শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে৷ আজকাল চোখেও দেখছি ঠিকঠাক। বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কেউ হাই, হ্যালো করলে স্পষ্ট দেখতে খুব একটা সমস্যা হবে বলে মনে হয় না।’
আরফান হেসে ফেলল। প্রসঙ্গটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে বলল,

‘ মা এসেছেন আমার সাথে। বাইরে অপেক্ষা করছেন। তিনি আপনার সাথে কথা বলতে চান।’
নুরুল সাহেব অবাক হলেন। ব্যস্ত হয়ে বললেন,
‘ সে কি? কোথায়? বাইরে বসিয়ে রেখেছ কেন? ডাকো তাঁকে?’
এটুকু বলে নিজেই বেয়ারা ডেকে বাইরে থাকা ভদ্রমহিলাকে ভেতরে আসতে বললেন। কিছুক্ষণের মাঝেই কালো ডোরাকাটা সাদা শাড়ি পরিহিতা এক ভদ্রমহিলা দরজায় এসে দাঁড়ালেন। নুরুল সাহেব উঠে দাড়িয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতেই অমায়িক হাসলেন ভদ্রমহিলা। দরজা থেকে হেঁটে ভেতর পর্যন্ত আসতেই প্রকাশ পেলো তার তীক্ষ্ণ ব্যক্তিত্ববোধ। নুরুল সাহেবের দিকে চেয়ে অমায়িক হেসে বললেন,

‘ অসময়ে বিরক্ত করার জন্য মাফ করবেন ভাইসাহেব। কী করি বলুন তো? আপনাদের মেয়ে নিতে চাই। যাদের বুক থেকে জান্নাতের নূর নিতে চলেছি তাদের কী ঘটকের হাতে নিমন্ত্রণ পাঠালে চলে?’
ভদ্রমহিলার আন্তরিক, মিষ্টি কন্ঠে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন নুরুল সাহেব। মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন, নম্রতার বিয়েটা তিনি দিবেন। নম্রতা রাজি না থাকলেও দিবেন। এমন একটা ছায়া। এমন একটা মায়ের লোভ আদৌ হাতছাড়া করা যায়? না, কখনো না।

দুপুর গড়াতেই ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে এলো নম্রতার বন্ধুরা। অন্তু নীরাকে নিয়ে বাইকে উঠতেই টিএসসির দিকে হাঁটা দিল নাদিম, নম্রতা আর ছোঁয়া। অন্তু আর নীরা চোখের আড়াল হতেই দৌঁড়ে এসে নাদিমের পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল নম্রতা। নাদিমের বাহুতে জোরেসোরে একটা চড় বসিয়ে গদগদ কন্ঠে বলল,
‘ আমি তোকে বলেছিলাম না? একমাত্র রঞ্জনই পারবে অন্তুর মাথায় সুবুদ্ধি ঢুকাতে? দেখেছিস? মিলে গেল তো?’
নাদিমের অপর পাশে পাশাপাশি হাঁটছিল ছোঁয়া। নম্রতার কথা শুনে বেশ কৌতূহল নিয়েই পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল সে। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল,

‘ কেন? অন্তুর মাথায় কি হয়েছিল আবার? ওয়াজ হি সিক?’
নম্রতা বেশ উৎসাহ নিয়ে বিষয়টা বুঝাতে নিতেই সটান দাঁড়িয়ে পড়ল নাদিম। ভীষণ চোটপাট দেখিয়ে বলল,
‘ এই ইংরেজের বাচ্চা চুপ। শইল্যের উপরে পইড়া ভর্তা বানাইয়া জিগাইতাছিস, ওয়াজ হি সিক? এই তোরা দূরে যাইয়া খাড়া। দুইপাশ থাইকা চাইপা চুইপা স্যান্ডউইচ বানায় ফেলতাছিস আমারে। সর!’
ছোঁয়া চশমা ঠিক করে একটু সরে দাঁড়াল। কপাল কুঁচকে বলল,
‘ শইল? হোয়াট ইজ শইল নমু?’
নম্রতা কন্ঠে গাম্ভীর্য আনার চেষ্টা করে বলল,
‘ শইল অর্থ দেহ। যাহাকে অঙ্গ বলে তাহাই হইল শইল। বুঝেছ?’
ছোঁয়া কি বুঝল বুঝা গেল না। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
‘ পরশু আমার বিয়ে, তোরা আসবি না?’
নাদিম চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে পা ছড়িয়ে বসে বলল,

‘ তোগো ছাতার বিয়েত যাই না। দুই বলদে মিলে হাম্বা হাম্বা করবি ওইনে আমাগো মতো মানুষের কি কাম?’
ছোঁয়া চোখ রাঙিয়ে তাকাল। রাগ নিয়ে বলল,
‘ এসব থার্ডক্লাস ওয়ার্ড আমার সামনে বলবি না। তোর এই থার্ডক্লাস পার্সোনালিটির জন্যই মাম্মা তোকে একদম সহ্য করতে পারে না। ট্রাই টু গিভ আদার রেসপেক্ট।’
ছোঁয়ার কথায় তেড়ে আসতে নিতেই থামিয়ে দিল নম্রতা। মামাকে তিন কাপ চা দিতে বলে নাদিমের পাশে বেঞ্চে গিয়ে বসল। কপাল কুঁচকে বলল,

‘ দুই সপ্তাহ পর সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা। তাও আবার লাস্ট সেমিস্টার। বিয়েটা দুই তিন মাস পরে করলেও তো পারিস। তোর মা এতো তাড়াহুড়ো কেন করছে বুঝলাম না। বর তো আর ভেগে যাচ্ছে না।’
‘ আরে অস্ট্রেলিয়ান মাল তো। টোটাল হাইব্রিড গরু। কখন উষ্টা খাইয়া মইরা যায়, গেরেন্টি নাই। হের লাইগা এতো তাড়াহুড়া। ঠিক কইছি না ছোঁয়াইয়া?’
কথাটা বলেই ছোঁয়ার মাথায় চাটি মারল নাদিম। ছোঁয়া নাদিমের বাহুতে দুইটা থাপ্পড় দিয়ে সরে বসল। তারপর বাধ্য মেয়ের মতো বলল,

‘ পরীক্ষার জন্যই বিয়েতে এতো তাড়াহুড়ো। বিয়েটা হয়ে গেলে সাইম অস্ট্রেলিয়া ফিরে যাবে। আমার পরীক্ষা শেষ হতে হতে ওখানের বাদ বাকি ফর্মালিটিসগুলোও কমপ্লিট হয়ে যাবে। নয়তো ওখানের ভার্সিটিতে তো ঠিক টাইমে জয়েন হতে পারব না।’
নম্রতা জবাব না দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিল। যে মেয়ের কাছে বিয়ের আগের দিনও ভার্সিটি আর পড়াশোনার চিন্তায় বড়। সেই মেয়েকে কিছু বলে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।

টেবিলের উপর থাকা ফোনটা পঞ্চম বারের মতো বেজে উঠতেই বিরক্তি নিয়ে তাকাল আরফান। ফোনটা সাইলেন্ট করে রোগীর কথায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু ঘুরেফিরে ফোনের ব্যাপারটাই মস্তিষ্কে ছন্দপতন করতে লাগল বারবার। সকাল থেকে একই নাম্বার থেকে কমপক্ষে ছয়- সাতবার কল করেছে একটি মেয়ে। ফোন দিয়ে কথাবার্তা না বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কি আশ্চর্য! কে এই মেয়ে? আরফান আড়চোখে ফোনের দিকে তাকাল। এইতো, আবারও কল করেছে মেয়েটা। আরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তার থেকে কী চাই এই মেয়ে?

ঘড়ির কাটা দশটা পেরিয়েছে। রান্নাঘরের দরজায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে নীরা। আজ বিকেল থেকে মাথা ঘোরানোর ব্যামোটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে জাহানারার।কিছুক্ষণ পর পরই চোখের সামনে সব অন্ধকার দেখছেন তিনি। দুই তিনবার মুখ ভরে বমিও করেছেন। তবুও নিজের জেদ বজায় রেখে একা হাতে যাবতীয় কাজ সামলাচ্ছেন সেই সন্ধ্যে থেকে। নীরার পেছনে অসহায়মুখে দাঁড়িয়ে আছে অয়ন। কিছুক্ষণ পরই টেলিভিশনে দূর্দান্ত ক্রিয়েট ম্যাচ টেলিকাস্ট হবে। মাকে এই অবস্থায় রেখে টেলিভিশন অন করা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না অয়ন। নীরা মিনমিন করে বলল,

‘ আপনার শরীর খারাপ মা। আপনি ছাড়ুন, আমি করছি।’
জাহানারা জবাব দিল না। ফ্যাকাশে চোখমুখ নিয়েই পানির কল খুলে হাঁড়ি-পাতিল ধোঁয়ায় মনোযোগ দিল। জাহানারার গম্ভীর মুখভঙ্গি দেখে আরও একবার অনুরোধ করার সাহস পেল না নীরা। বেশ কিছুক্ষণ পর ধৈর্যহারা হয়ে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন আনিসুল সাহেব। তাঁকে রান্নাঘরের দরজার কাছে আসতে দেখেই নিজেকে আরও একটু গুটিয়ে নিল নীরা। শশব্যস্তভাবে মাথায় আঁচল টেনে নতমুখে দাঁড়িয়ে রইল এক কোণায়। আনিসুল সাহেব রাগত কন্ঠে ধমকে উঠে বললেন,

‘ রাখো তুমি এসব। ছেলেদের জন্য বহু খেটেছ আর দরকার নেই। কামাই করে, রেঁধে বেড়ে খেতে পারলে খাবে নয়তো খাবে না। তুমি কেন কাজ করবা সারাদিন? আমি রোজগার করি না? ছেলে ছেলে করে মরে যাও। কোথায় এখন তোমার ছেলে? মাঝরাতেও বাড়ি ফেরার নাম নেই। বিয়ে করে বহু সেয়ানা হয়ে গিয়েছে আজকাল।’
আনিসুল সাহেবের ধমকা-ধমকির মাঝেই বাড়ি ফিরল অন্তু। ক্লান্তিতে শরীরটা ভেঙে আসছে তার। রাত নয়টা পর্যন্ত ভার্সিটি লাইব্রেরিতে পড়াশোনা সেড়ে, নাদিমের সাথে দুই কাপ চা আর সিগারেট ধরিয়েছিল অন্তু। বন্ধুর সাথে পারিপার্শ্বিক আলাপচারিতায় চোখের পলকে কেটে গিয়েছে দীর্ঘ এক ঘন্টা।

দশটার দিকে রওনা হয়ে পৌঁছুতে পৌঁছুতে বাজল এগারোটা। সারাদিনের অভুক্ত শরীরে সিগারেট খাওয়ায় পাক দিয়ে ধরছে পাকস্থলীর নিম্ন ভাগ। মাথায় ঘুরছে পরীক্ষা, চাকরী, সংসার নিয়ে হাজারও চিন্তা। বাইকে তেল শেষ অথচ হাতে টাকা নেই। ছোঁয়ার বিয়ের জন্য উপহার আরও কত খরচা। অথচ আয়ের উৎসে পকেট খালি। এমন একটা মানসিক চাপের মাঝে বাড়ির এই হৈ-চৈ ভীষণ তিক্ত লাগল অন্তুর। ক্লান্ত শরীরে দাঁড়িয়ে থেকে আনিসুল সাহেবের তিক্ত খোঁটাগুলো হজম করল। কোনোরূপ প্রত্যুত্তর করার চেষ্টা না করে রান্নাঘরে ঢুকল সে। জাহানারার হাত থেকে হাঁড়ি পাতিল সরিয়ে নিয়ে আচমকাই মাকে পাঁজা কোলে করে বেরিয়ে এলো। জাহানারা চমকে উঠলেন। বিস্মিত হলেন। অন্তু মাকে বসার ঘরের সোফায় বসিয়ে দিয়ে ফ্লোরে বসল। জাহানারার একহাত ধরে ক্লান্ত কন্ঠে বলল,

‘ কি করতে হবে বলো, আমি করে দিচ্ছি। আমার বউ ছুঁলে সমস্যা। আমি ছুঁলে তো সমস্যা নাই আম্মা।’
জাহানারা জবাব না দিয়ে হাত টেনে নিলেন। অন্তু হাতটা আবারও নিজের হাতে নিয়ে বলল,
‘ সারাদিন খাই নাই আম্মা। তুমি তো জানোই তোমার ছেলে ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না। বাড়ি ফিরে যদি তোমাকে এই অবস্থায় দেখি তাহলে কী আর খেতে ইচ্ছে করে বলো? ইরার ওভাবে কথা বলা অন্যায় হয়েছে। কিন্তু ইরা অন্যের বাড়ির মেয়ে আম্মা। সে অন্যায় করলে তাকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার তো আমার নাই। কাজটা যদি ইরার জায়গায় নীরা করত তাহলে ভিন্ন কথা। আমার বউ আমার মাকে অপমান করলে আমি চুপ করে থাকব না। আমি বলছি না নীরা নির্দোষ। নীরার উচিত ছিল ইরার ভুল শুধরে দেওয়া। ও বুঝে উঠতে পারে নাই। এবারের মতো ওকে মাফ করে দাও।’

শেষ কথাটা বলে নীরার দিকে তাকাল অন্তু। অন্তুর চোখের ভাষা বুঝতে পেরে দুই কদম এগিয়ে এলো নীরা। মৃদু বিনয়ী কন্ঠে বলল,
‘ ইরার বেয়াদবির জন্য আমি সরি মা। আমি ইরাকে বকাবকি করেছি। ওকে এ বাড়িতে আসতেও নিষেধ করেছি। ও আর এখানে আসবে না। আপনি এবারের মতো মাফ করে দিন। আর কখনও এমনটা হবে না।’
জাহানারা উত্তর না দিয়ে গম্ভীর মুখে বসে রইলেন। অন্তু বায়না ধরা কন্ঠে বলল,

‘ আমি জানি তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছ। নীরার মাফ চাওয়াতে সেই কষ্ট কমে যাবে না। তবুও বলছি রাগ করে থেকো না আম্মা। আমি রাগের মাথায় কত কি করে বসি। তুমি কষ্ট পাও আবার মাফও করে দাও। নীরা তো আমারই বউ। তোমার ছেলের বউ তো তোমার মেয়েই হলো। এবারের মতো মাফ করে দাও। ও আর কখনও তোমায় অসম্মান করে কথা বলবে না। নীরা?খবরদার আম্মাকে অসম্মান করে কোনো কথা যেন না বলা হয়। আমার আম্মা কষ্ট পেলে কিন্তু আমি কাউকে ক্ষমা করব না। মনে থাকবে?’
নীরা মাথা হেলিয়ে সায় জানাল। জাহানারার চোখ টলমল করে উঠল। চোখের জল ঢাকতে ধমক দিয়ে বললেন,
‘ হয়েছে। এখন এতো ঢং না করে তোর বউকে বল খাবার দিতে। খেয়েদেয়ে ঘুমা। আম্মার জন্য এতো দরদ দেখাতে হবে না।’
অন্তু হেসে ফেলল। নীরাকে খাবার দিতে ইশারা করে জাহানারার হাত ধরে রেখেই বলল,
‘ তোমার সঙ্গে খাব। নীরা বলল তুমি নাকি ভাত, ঔষধ কিচ্ছু খাও নাই।’

টেবিলে খাবার দিতে দিতে মা-ছেলের দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল নীরা। জাহানারা যেমন শাশুড়ীই হোক, মা তো মা-ই হয়। মাঝেমাঝে এই মায়েরা বড় অভিমানী হয়। এক আকাশ অভিমান জমিয়ে রাখে সন্তানের একটু পরোয়া, একটু আদর পাওয়ার আশায়। সন্তানের একটু হাসিতেই ভেঙে টুকরো টুকরো হয় সেই অভিমানের পাহাড়। চোখ টলমল করে। টলমল করে মা সত্ত্বাও। ইরা এখানে উপস্থিত থাকলে আবারও অশান্তি করত। নীরাকে মাফ চাইতে দেখে রাগারাগি করত। কিন্তু নীরার আনন্দ হয়। ইরার মতো প্রতিবাদী চিন্তা তার আসে না। এতটুকু মাথা নোয়ানোর ফলে যদি সংসার শান্ত হয় তবে তাতেই তার আনন্দ। এতটুকু মাথা নোয়ানোর ফলে যদি কোনো মা একটু তৃপ্ত হয় তবে এই মাথা নোয়ানোই তার শ্রেয়। পৃথিবীর সবার কি ইরা, নম্রতার মতো প্রতিবাদী হওয়া সাজে?

খাওয়া-দাওয়া শেষে ঘরে যেতেই নীরার উপর চোখ পড়ল অন্তুর। নীরা শাড়ির আঁচল একপাশে তুলে দিয়ে বিছানা ঝাড়ছিল। অন্তুর অবাধ্য চোখ প্রথমেই গিয়ে থামল নিষিদ্ধ কোনো জায়গায়। অন্তু কেশে উঠল। তাড়াহুড়ো করে চোখ সরিয়ে নিতেই চোখ ফিরিয়ে তাকাল নীরা। অন্তু অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে ঘাড় চুলকাল। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বিছানায় গিয়ে বসল। কন্ঠে গাম্ভীর্যতা এনে বলল,
‘ শাড়ি পরার কি দরকার?’
নীরা বিছানা তৈরি করে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চুলগুলো হাত খোঁপা করতে হাত উঁচু করতেই ফিনফিনে শাড়ি সরে গিয়ে দৃশ্যমান হলো ফর্সা উদর। অন্তু কপাল কুঁচকে আয়নার দিকে চেয়ে রইল। আয়নার ভেতর দিয়েই চোখে চোখ পড়ল। নীরা অপ্রস্তুত কন্ঠে বলল,

‘ মা বলেছে।’
অন্তু চোখ সরিয়ে নিল। শার্ট পাল্টে বিছানায় আসতেই ডাকল নীরা। অন্তু চোখে-মুখে জিজ্ঞেসা নিয়ে বলল,
‘ হুম?’
নীরা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। বহু দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে অসহায় চোখে তাকাল। অন্তু টি-শার্টের উপরের বোতাম খুলে কলারটা একটু ঠেলে দিয়ে আনমনে বলল,
‘ কি হলো?’
নীরার চোখ আটকাল অন্তুর বুকে। পেটানো শরীরে লোমশ বুক আর শ্যামবর্ণ গলদেশের দিকে চেয়ে আচমকায় বলে উঠল,

‘ ভালোবাসি।’
জীবনে প্রথমবার, এতো কসরত, এত আকাঙ্খা, এত অপেক্ষার পর নীরার বলা কথাটা ঠিক বিশ্বাস হলো না অন্তুর। অমনোযোগী অন্তু চট করে মনোযোগী হয়ে উঠল। চোখ তুলে নীরার দিকে চেয়ে চোখ ছোট ছোট করে প্রশ্ন করল,
‘ কী?’
নীরার চোখ টলমল করছে। টলমলে চোখে তার আবেদনময়ী চাহনী। সেই সর্বনাশা চাহনির দিকে চেয়ে বুক শুকিয়ে এলো অন্তুর। অবাধ্য চোখদুটো জোরপূর্বক নেমে এলো অর্ধাঙ্গীর লতানো দেহে। পরমুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নিয়ে লম্বালম্বিভাবে শুয়ে পড়ল অন্তু। ধরফর করা বুক নিয়ে কপাল কুঁচকাল। কপালে ডানহাত রেখে চোখ বন্ধ করল। ক্লান্ত কন্ঠে বলল,
‘ কাল কথা বলি। প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে, ঘুমাব। আলোটা নিভিয়ে দিলে ভালো হয়।’

রাত প্রায় দুটো। রাতের নিজস্ব ঝিমঝিম শব্দে ভরে উঠেছে চারপাশ। খাবার ঘরে গ্লাসে পানি ঢালল কেউ। বাবার রুমের ক্যাটক্যাটে ফ্যানটা বিশ্রী শব্দ দিচ্ছে। এই সবটাই অন্ধকারে ডুবে থাকা ঘরটিতে বসে মনোযোগ দিয়ে শুনল নম্রতা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় কিছুক্ষণ ভূতগ্রস্তের মতো বসে রইল। তারপর ফোনটা নিয়ে এলার্ম বন্ধ করল। আরফানের ডিউটি শেষ হওয়ার কথা একটায়। সেই অনুযায়ীই দুটোই এলার্ম দিয়ে রেখেছিল নম্রতা। ঘুমটা খানিক কেটে যেতেই আরফানের নাম্বারে ডায়াল করল নম্রতা। প্রথম দফায় বিজি দেখিয়ে দ্বিতীয় দফায় ওয়েটিং দেখাল লাইন। নম্রতার কপাল কুঁচকে এলো। এতোরাতে কার এতো দরকার পড়ল আরফানকে? নম্রতা অপেক্ষা করল। দুই মিনিট পর ডায়াল করতেই আবারও ওয়েটিং দেখাল ফোন। নম্রতার মাথায় আসা খারাপ চিন্তাগুলো ঠেলে সরিয়ে দিয়ে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল নম্রতা। তৃতীয় বারে ফোন রিসিভ করল আরফান। নম্রতা মন খারাপ ভাবটা উড়িয়ে দিয়ে উচ্ছল কন্ঠে বলল,

‘ কি করছিলেন ডক্টর সাহেব?’
আরফান ছোট্ট করে উত্তর দিল,
‘ কিছু না। আপনি?’
নম্রতার মনটা একটু চুপসে গেল। হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘ আমি তো ঘুমোচ্ছিলাম। আপনার সাথে কথা বলব বলে দুটোয় এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম জানেন?’
আরফান হাসল।
‘ এত কষ্ট না করে সকালে কল দিলেই হতো।’
‘ সকালে কল দিলে হবে কেন? আমার কত কথা জমা আছে জানেন? এগুলো আজ না বললে পেটের ভাতই হজম হবে না আমার।’

‘ আচ্ছা, বলুন।’
আরফানের আগ্রহহীন কন্ঠে ভেতরটা মোচড়ে উঠল নম্রতার। সে এতো আগ্রহ নিয়ে বসে ছিল অথচ আরফানের কোনো আগ্রহ নেই? আরফান কি খুব বেশি ক্লান্ত? আরফান ক্লান্ত ভেবে নিজেকে সামলে নিল নম্রতা। মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ আপনি মাত্র ফিরলেন। খুব ক্লান্ত বোধহয়। আপনি এখন রেস্ট নিন। আমি কথাগুলো কালই বলব।’
আরফান সাথে সাথেই বলল,
‘ আচ্ছা।’

নম্রতার হঠাৎই দুনিয়া ভেঙে কান্না পেয়ে গেল। আরফান হাজার ক্লান্ত থাকলেও এভাবে কথা বলে না। এতো অবহেলা ভরে তো কখনও না। ভয়ানক রেগে থাকলেও না। তবে আজ কেন? নম্রতা মন খারাপ করে ফোন রেখে দিল। বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেও চোখে ঘুম ধরা না দেওয়ায় আবারও আরফানের নাম্বারে কল করল নম্রতা। কি আশ্চর্য! আবারও ওয়েটিং! নম্রতা শুয়া থেকে উঠে বসল। অনুভূতিশূন্য চোখে চেয়ে রইল তারাহীন অন্ধকার আকাশে। বেশকিছুক্ষণ পর আবারও কল করল নম্রতা। এবার সীম বন্ধ। নম্রতার মস্তিষ্কে হঠাৎই একটি অদ্ভূত প্রশ্ন জাগল, আরফান কী তার কলে বিরক্ত হয়েই ফোন বন্ধ করল?

নীল চিরকুট পর্ব ৫৫+৫৬

নম্রতা কী খুব বিরক্ত করে তাকে? কই! আরফান তো কখনও বলেনি। নম্রতা ফোনটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে বিছানায় গা এলাল। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তেই আবারও এক বিষাক্ত ভাবনা উঁকি দিয়ে গেল মাথায়, এতোরাতে কার সাথে কথা বলছিল আরফান? নম্রতা মনেপ্রাণে ভাবতে লাগল, নিশ্চয় কোনো ফ্রেন্ড অথবা হসপিটালের কোনো কলে ছিল আরফান। ফোনে ওয়েটিং থাকা কোনো বড় ব্যাপার না। প্রয়োজন তো থাকতেই পারে। পরমুহূর্তেই কুটিল মস্তিষ্ক প্রশ্ন ছুঁড়ল, এত রাতে আরফানের ফোনে ফ্রেন্ডের কি কাজ? কি এত কথা যে এতোবার কল দিতে হয়? নম্রতার মাথা ঘোরাতে লাগল। নিজের চিন্তাকে যথাসম্ভব ইতিবাচক করার চেষ্টা চালাল সে। ইশ! একটা ঘুমের ঔষধ হলে বেশ হতো!

নীল চিরকুট পর্ব ৫৯+৬০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here