নূরজাহানের সংসার পর্ব ২

নূরজাহানের সংসার পর্ব ২
শ্রীমতি প্রজ্ঞা মঞ্জরী

সকাল ৭টা বেজে ২০ মিনিট। অর্ণব সবেমাত্র বাড়ি ফিরেছে। গত রাতে সেই যে বের হয়েছিলো আর এখন ফিরলো। সদরদরজা দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতেই মুমতাহিনা চৌধুরীকে ড্রয়িংরুমে বসা দেখলো অর্ণব। একপ্রকার মুখ-লুকিয়েই ঘরে দিকে হাঁটা ধরলো সে;
ছেলে সারা রাত বাড়িতে ফেরেনি জানলে নির্ঘাত ঘরে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে ছাড়বেন মুমতাহিনা চৌধুরী।
“দাঁড়াও অর্ণব।”

মায়ের শীতল সম্বোধনে পা-জোড়া থেমে গেলো অর্ণবের।পিছন দিকে ঘুরে একই স্থানে দাঁড়িয়ে রইলো সে।
“তুমি যদি ভেবে থাকো বড় হয়েছো, বিয়ে করেছো,এক সন্তানের বাবা হয়েছো বলে তোমার মা তোমার কাছে কোনোরূপ প্রশ্ন করতে পারবে না বা কৈফিয়ত চাইতে পারবে না;তাহলে তুমি ভ্রমে আছো।সারারাত কোথায় ছিলে তুমি?”
অর্ণব এবার চুপসে গেলো। মুমতাহিনা চৌধুরী অত্যন্ত দায়িত্ববান, সময়নিষ্ঠ, ন্যায়নীতিতে কঠোর একজন মানুষ। অর্ণবের যখন ১৬ বছর বয়স তখন তার বাবা মারা যায়। সেই থেকে অর্ণবকে অত্যন্ত কঠোর শাসনের মধ্যে বড় করেছেন তিনি। একা হাতে সন্তানকে বড় করেছেন।স্বামীর প্রয়াণের পর একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন পঁচিশ বছর ধরে। অত:পর নিজের কর্মজীবনের ইতি টেনেছেন অর্ণব নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পরে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আসলে আম্মা,আমি একটু কাজে বাইরে ছিলাম।” কিছুটা তুতলিয়ে জবাব দিলো অর্ণব।
“কি এমন কাজ পড়লো তোমার?যে সারা রাত বাড়ির বাইরে কাটলে? গতকাল তোমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে অবধি গেলো আর তুমি তার পাশে না থেকে রাতকে ভোর করে বাড়ি ফিরলে?”
মায়ের কথার পিঠে কোনো কথা খুঁজে পায়না অর্ণব।তাই চুপ করে মাথাটা নিচু করে নেয়।
“তোমায় আজই প্রথম ও শেষবারের মতো বলছি অর্ণব; এমন কোনো কাজ করো না যেন এই বয়সে এসে আমায় তোমাকে আবার ম্যানার্স শেখাতে হয়। এখন ঘরে যাও।বউমা এখনো নিচে নামে নি,তাকে নিয়ে এসো।”
অর্ণব মাথা নাড়িয়ে দ্রুত পায়ে রুমের দিকে যায়। রুমের দরজা খোলাই ছিলো,ফলে অর্ণব নক করতে গেলেই দরজা খুলে যায়।

“নূরজাহান?” নূরের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢোকে অর্ণব। কিন্তু বিছানা ফাঁকা।বাথরুম,বেলকনি সবস্থানে চেক করে অর্ণব;নূর কোথাও নেই। এক মূহুর্তের জন্য মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ কিরে দেয় অর্ণবের।
“নূরজাহান? নূরজাহান কোথায় তুমি? নূর? এই নূর?” অনবরত নূরের নাম ধরে ডাকতে থাকে অর্ণব। নিজের ফোনটা বের করে নূরের নাম্বার ডায়েল করে। ওপাশ থেকে জানান দেয় নূরের নাম্বার বন্ধ।আবার কল করে অর্ণব।একবার,দু’বার অরে প্রায় সাতাশটা কল দেয়। কিন্তু একইভাবে প্রত্যেকবার ফোন বন্ধ বলে।
অর্ণবের এবার নিজেকে অসহায় মনে হয়।কাল রাতে হুশে ছিলো না অর্ণব।নূরের প্রেগন্যান্সির খবরে দিক-বেদিক শূণ্য লাগছিলো তার।রাগের মাথায় অনেকগুলো কড়া কথা শুনিয়েছে সে নূরকে
মাঝরাত অবধি হাতির ঝিলের ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে ছিলো অর্ণব।এরপর গাড়ি নিয়ে হাইওয়েতে ড্রাইভ করেছে।ভোরের আলো ফোটা শুরু করলেই বাড়ির দিকে অগ্রসর হয়েছিল অর্ণব।
ক্লান্ত শরীর,ঘুম না হওয়ার কারণে লাল হওয়া চোখ নিয়ে এলোমেলো ভঙ্গিয়ে স্টাডি টেবিলের চেয়ারটা টেনে বসে অর্ণব।দু’হাতে নিজের চুলগুলো টেনে ধরে টেবিলে দিকে তাকিয়ে দেখে পেপারওয়েট দিয়ে ভারা দেওয়া একটা কাগজ। অর্ণবের নাম লেখা তাতে।

চট করে চিঠিটা হাতে তুলে নেয় সে।চিঠিটা পড়ে বাকরুদ্ধ হয়ে রয় অর্ণব,নূরজাহান সত্যিই তাকে ছেড়ে চলে গেছে। পেটে অর্ণবের বাচ্চাদের নিয়ে চলে গেছে নূরজাহান? অর্ণব না হয় রাগের মাথায় বাজে বকেছিলো কিন্তু নূর নিজেকে একবার ক্ল্যারিফাই করার চেষ্টাও করলো না?
চোয়াল শক্ত করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় অর্ণব, নূরের লেখা চিঠিটা ভাজ করে শার্টের বুকপকেট পুরে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

ঢাকা টু ফরিদপুরগামী বাসে বসে আছে নূর। অর্ণব প্রতিমাসে তাকে কিছু টাকা দিতো হাত-খরচা হিসেবে। নূর সেখান থেকেই কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিলো। সেখান থেকেই পাঁচশত টাকা দিয়ে ফরিদপুর যাওয়ার টিকিট কেটেছে সে।
উইন্ডো সিটে বসে গা-এলিয়ে দেয় নূর। মনের মধ্যে অন্তহীন জ্বালাপোড়া শুরু হয়েছে তার। বুঝতে শেখার আগেই বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়েছিলো;ব্রোকেন ফ্যামলিতে বড় হয়েছে সে।আর এখন তার সন্তানের ভবিতব্য ও একই হতে চলেছে? একা বাচ্চাটাকে কি করে মানুষ করবে নূর? একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ কি দিতে পারবে সে? এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মাথায় চক্কর দিয়ে ওঠে নূরের। প্রেগন্যান্সির প্রথম দিকে এমন সিকনেস খুবই কমন, কিন্তু নূরের এখন যা মানসিক অবস্থা তাতে কোনো ধরনের শারীরিক জটিলতাই মারাত্মক রূপ নিতে পারে।
বাসে ওঠার আগে নিজের সিমটা ফোন থেকে খুলে রেখেছে নূর। এরপর দুই লিটারের একটা পানির বোতল,ব্রেড আর কলা কিনেছে।

ব্যাগের সাইড পকেট থেকে পানি বোতলটা বের করে কিছুটা পানি পান করে নূর। এরপর চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে বাসের সিটে। একটু পরেই বাস চলতে শুরু করলেই স্বস্তির নিঃস্বাস ছাড়ে নূর।
“আপনি,আপনার বাড়ি,সংসার,শহর সব ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমি। আমি আমার সন্তানকেই বেছে নিলাম। এই ছোট্ট প্রাণটাকে নষ্ট করতে পারলাম না আমি।আমায় আপনি ভুলে যাবেন অর্ণব?ভুলের যাবেন আমাদের সংসারে কথা? #নূরজাহানের_সংসার এ কি নতুন কারো আগমন ঘটবে?” চোখ বন্ধ করে মনে মনে আওড়ায় নূর।
ড্রাইভিং সিটে বসে দারুণ স্পিডে গাড়ি চালিয়ে নূরদের বাড়িতে পৌঁছায় অর্ণব। একতলা একটা বাড়ি নূরদের। নূরের বাবা বেঁচে থাকতেই বাড়িটা তৈরি করেছিলেন।মেয়ের নামের সাথে মিল রেখে বাড়ির নাম “নূরমহল” রাখেন ভদ্রলোক।

কলিংবেল বাজানোর কয়েক মুহুর্তের মাঝেই দরজা খুলে যায়। এক অপরিচত রমণীর অবয়ব আসে সামনে। অর্ণব তাকে পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকে। রাহেলা তখন রান্নাঘরে সকালের নাস্তার আয়োজন করছিলেন। চুলায় তরকারি ঢেকে রেখে রুটি বেলছিলেন তিনি। অর্ণবকে দেখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন রাহেলা। কোনো এক অজানা কারণে তার চোখে-মুখে আতংক।অর্ণব কোনো রকমের ভনিতা না করে সোজা বলে উঠলো,
“আপনার মেয়ে কোথায় মা? সে কোন সাহসে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে? আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সে বাড়ি ছাড়লো কিভাবে?”

রাহেলার আতংকিত মুখে এখন বিস্ময়ের ছোঁয়া। “নূর? নূর তো এখানে আসেনি।”
রাহেলার কথায় অর্ণব স্তম্ভিত হলো। সে বিশ্বাস করতে পারলো না যেন! নিশ্চিত হতে নূরের কক্ষে গেলো অর্ণব। নূরের কক্ষ ফাঁকা পেয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে এলো। রাহেলা অর্ণবকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“কি হয়েছে অর্ণব?নূরের সাথে ঝগড়া হয়েছে?”
“আপনি কি নূরের আপন মা?” রাহেলার প্রশ্নের পিঠে পাল্টা প্রশ্ন করলো অর্ণব।
অন্যদিকে,
গত এক ঘন্টা ধরে বাস চলছে আপন গতিতে। নূরের বাস এখন পদ্মাসেতুর উপর। চোখ খুলে কীর্তিনাশার ঢেউগুলো দেখছিলো নূর।
” আমার জীবনটা এই পদ্মার মতোই।এককূল গড়ে তুলতে না তুলতেই ভাঙ্গনের শিকার হই। সময়ের নির্মম স্রোত আমার সাজানো নীড়ে আঘাত করে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়।” মনে মনে ভেবেই তাচ্ছিল্য ভরা হাসি ফুটে ওঠে নূরের ঠোঁটের কোণে।

“তুমি কোথায় যাবে?” পাশের সিটে বসে থাকা তরুণী প্রশ্ন করে নূরকে।
“ফরিদপুর যাবো।” নিরেট জবাব নূরের।
“আমিও তো ফরিদপুর যাবো। ফরিদপুর কোথায় যাবে?”
“জানিনা।”
নুরের এমন জবাবে অবাক হয় পাশে বসে থাকা মেয়েটি।
অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “সে-কি? তুমি জানো না কোথায় যাবে?”
“উঁহু, সত্যি-ই জানিনা কোথায় যাব।”
“ঠিকানা না জানলে তো বিপদে পড়বে। ফরিদপুর বিশাল বড় জেলা। হারিয়ে যাবে তুমি।”
চিন্তিত কণ্ঠে বলে ওঠে মেয়েটা।
“আমি যার কাছে যাবো তার বাড়ি ফরিদপুর সদরেই।তবে ঠিকানা জানিনা। পরে শুনে নিবো।” মেয়েটির দিকে তাকিয়ে জবাব দেয় নূর।
“আচ্ছা, তা-ই করো। আমার নাম স্নেহা,তোমার নাম?”
“নূরজাহান।”

“নুরজাহান? নূর মানে তো আলো, আর জাহান মানে পৃথিবী। মানে তোমায় এক হিসেবে পৃথিবীর আলো ও বলা যায় নূরজাহান।”
মেয়েটির কথায় একটু হাসলো নূর। তবে সেই হাসিতে উচ্ছলতা ছিলো না। ছিলো একরাশ না পাওয়া আর পেয়েও হারানোর হাহাকার।

নূরজাহানের সংসার পর্ব ১

“কিন্তু আমার যে গোটা দুনিয়াময় অন্ধকার।তমিস্রার ভয়াল অন্ধকার যেমন দিনের আলোকে গ্রাস করে, আমার জীবনের সব আলো তেমন গ্রাস করে নিয়েছে এক গ্রহণ। রাতের আঁধার তো তবুও চাঁদের আলোয় কিঞ্চিৎ পরিমাণ হলেও দূর হয়।কিন্তু আমার জীবনে?” আনমনে কথাগুলো ভাবতেই চোখ থেকে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে নূরের।
অনিমেষনেত্রে দূরের আকাশ দেখতে থাকে মেয়েটা।

নূরজাহানের সংসার পর্ব ৩