নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ১১
সিনথিয়া
শেহজাদের প্রশ্নের পিঠে উত্তর দেয়ার মতো অবস্থায় নেই রেজা। শ্যামলা বর্ণের মানুষটা আক্রোশে লাল হয়ে গেছে কেমন।
ফুঁসছে মুষ্টিবদ্ধ হাতে। চোখের সামনে পছন্দের মানুষকে অন্য কারোর বাহুডোরে দেখে ঠিক-বেঠিকের হিসেব ভুলে বসেছে যেনো ও।
অমনি লম্বা পা ফেলে ছেলেটা এগিয়ে আসলো ওদের কাছে।
ততক্ষণে টেবিলের উপর থেকে কোনোমতে নেমে পড়েছে আরশি। কি হবে বা কি হতে চলেছে ভেবেই বুকটা কাঁপছে ওর। হাত-পা জমে হিম হয়েছে এইটুকু সময়ের মধ্যে।
উপয়ান্তর না পেয়ে দুইটা মইয়ের মতো ছেলের মাঝে দাঁড়িয়েই উপরওয়ালাকে ডাকলো ও,
“এরা মারামারি করে করুক! আমাকে শুধু সহিসালামতে ক্লাস অবধি পৌঁছে দিও।”
কারন শেহজাদের যে মেজাজ। আর রেজাও তো জানে না যে ওরা হাজবেন্ড-ওয়াইফ! ছেলেটা উল্টোপাল্টা কিছু বললে যে মানুষটাও নির্ঘাত মেজাজ হারিয়ে মারপিট শুরু করে দেবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই আরশির!
অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় ঘামলো মেয়েটা। তক্ষুনি রেজা ওর শক্তপোক্ত হাতটা দিয়ে আরশির কনুই চেপে ধরলো। শেহজাদের হিমশীতল চোখে তাকিয়ে পশ্চিমা ভাষায় বলল,
“ক্লাসে চলো আরশি!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শেহজাদের ঠোঁটে প্রহসনের ফাঁদ। দু’হাত বুকে গুঁজলো। এক চোখের ভ্রু উঁচিয়ে আরশিকে বলল,
“নেভারমাইন্ড বেইবি! যেটা শুরু করেছিলাম, সেটা নাহয় বাসায় গিয়েই শেষ করবো? ওকেই? ”
লোকটার মুখে বেইবি ডাকটা ঠিক হজম হলো না আরশির। কেশে উঠলো অমনি। নিজেকে ধাতস্থ করে তাকালো মানুষটার বরফ শীতল চোখে।
মেয়েটার হতভম্ব মুখ দেখে বাঁকা হাসলো শেহজাদ। এগিয়ে এসে উষ্ণ হাতটা ছোঁয়ালো ওর গালে। পরপর শাণের মতো চোখজোড়া দিয়ে রেজার দিকে চেয়ে বলল,
“এন্ড ডোন্ট ওয়ারি ফর মি! আ’উইল কাম টু দ্য ক্লাস আফটার আই সল্ভ দিস ম্যাটার উইথ মিস্টার রেজা! হুমম?”
রেজার চোয়াল শক্ত। কিন্তু শেহজাদের কথার ইঙ্গিত বুঝে মুঠো আলগা করতেই আরশির পেলব বাহুটা খসে পড়লো ওর হাতের কবল হতে।
মেয়েটা আতঙ্ক চোখে একে একে তাকালো মানুষ দুটোর দিকে। খড়খড়ে গলাটা ঢোক গিলে ভিজিয়ে টলতে থাকা পা’দুটো নিয়ে রুম ছাড়লো শঙ্কায়।
এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও আরশি বের হতেই মুখ খুললো রেজা। কন্ঠে শেহজাদের উপর রাগের চিহ্ন স্পষ্ট। হিসহিসিয়ে বলল বিদেশি ভাষায়,
“তা ঠিক কোন ম্যাটারটা সল্ভ করবেন প্রফেসর? আমার ফ্রেন্ডকে অফিস-রুমে এনে হেনস্তা করার? নাকি আপনার এই পলিশড্ জেন্টেলম্যানের মুখোশটা যে আজকে আমার সামনে ছিঁড়ে গেলো সেটার?”
শেহজাদের ঠোঁটের কোনার বাঁকা হাসিটাও লোপ পেলো মূহুর্তেই। শান্ত মুখাবয়ব বদলে গেলো রোষানলে।
এগিয়ে এসে দুম করে থাবা বসালো রেজার কলারে। কানের কাছে মুখ নিয়ে দাঁতে দাঁত পিষলো। পশ্চিমা ভাষায় থেমে থেমে আওড়ালো,
“আরশি আমার ওয়াইফ! আমার ওয়াইফকে আমি হেনস্তা করবো না ভালোবাসবো সেটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত বিষয়।
ডু নট ইন্টারফেয়ার ইন মাই পার্সোনাল লাইফ মিস্টার রেজা! না হলে যে হাত দিয়ে তুমি আমার ওয়াইফকে টাচ করেছো সেই হাত ভেঙে গুড়িয়ে দিতে আমার সেকেন্ডও লাগবে না!”
শেহজাদের বলা কথাগুলো অবাক করলো না রেজাকে। উল্টে কুটিল হাসলো ছেলেটা। শেহজাদের থাবা থেকে জামার কলারটা ছাড়াতে গিয়ে দু’কদম সরে গেলো পেছনে।
পরপর বিদেশি স্বরে বলল,
“দ্যান আ’উইল টেইক দিজ এজ এ্যা চ্যালেঞ্জ প্রফেসর! লেটস্ সি হু শি উইল চুজ! ইউ অর মি! কারন আমি এটা হলফ করে বলতে আরশি আপনাকে এক ফোঁটাও পছন্দ করে না। সো, হোয়েদার ইউ আর হার হাজবেন্ড ওর নট, সি ইজ ডেস্টিনেটেড টু বি মাইন!”
কথাগুলো বলে পেছালো রেজা। যেতে যেতে পরনের শার্টের কলারটা ঠিক করলো। কান পর্যন্ত চওড়া হেসে আবারও বলল,
“ট্রাই হার্ডার প্রফেসর! লেট দ্য গেইম… বিগিন!”
ফার্স্ট সেমিস্টারের মাইক্রোইকোনেমিক্স ক্লাস নিচ্ছেন মিসেস বেলা আর্চার। প্রচুর স্বাস্থ্যবান হওয়ায় দেখতে ছোটখাটো ফুটবলের মতোন।
অথচ গোলগাল মহিলা শ্বাস ছাড়লেও যেখানে শ’খানেক স্টুডেন্টের ভয়ে টথস্থ থাকার কথা, সেখানে ক্লাসে কারোর কোনো মনোযোগ নেই?
যে যার মতো ব্যস্ত মোবাইল নিয়ে!
মিসেস বেলার মেজাজ খারাপ হলো। ভারি হাতটা পোডিয়ামে ফেলতেই লাফিয়ে উঠলো আরশি, জারা দুজনেই।
ঝিমোচ্ছিলো ওরা। বাজ পড়ার মতো শব্দে ধরফরিয়ে উঠে বসে মেয়ে দুটো। আরশি আশেপাশে তাকায়। রেজাকে না দেখে শঙ্কায় দুরুদুরু কাঁপে ওর বুকের ভিতর।
ছেলেটা এতোক্ষণে প্রিন্সিপালের কাছে চলে যায়নি তো? আরশি আর শেহজাদ যে হাজবেন্ড-ওয়াইফ সেটা জানিয়ে দেয়নি তো এরমধ্যে? জানলে টেঁকো প্রিন্সিপালটা ওকে কি করবে? পাঠিয়ে দেবে অন্য সেকশনে?
আরশির ভাবনার মধ্যেই ধুপধাপ পা ফেলে ক্লাসে ঢোকে শেহজাদ। সাথে রেজা আর ভার্সিটির প্রিন্সিপালও রয়েছেন।
প্রিন্সিপালকে দেখেই আরশির আত্মা খাঁচা ছাড়া। অদূরভবিষ্যতের ভাবনায় কুলকুল ঘামলো মেয়েটা।
তারমধ্যেই রেজা এসে কখন যে ওর পাশে বসেছে, খেয়ালই করলো না ও।
রেজা বসেই আড়চোখে একবার তাকালো শেহজাদের দিকে। পরপর মানুষটার শিকারি দৃষ্টি উপেক্ষা করে ঝুঁকে আসলো আরশির কানের কাছে।
ফিসফিস করে বিদেশি ভাষায় বললো,
“ভয় নেই ম্যাডাম! আমি প্রিন্সিপালকে এখনো কিছু বলিনি আর বলবোও না। তবে একটা শর্তে! ”
হতচকিত মেয়েটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় রেজার দিকে। ঢোক গিলে নিজেও শুধোয় পশ্চিমা ভাষায়,
“কি শর্ত?”
এই যেনো সুযোগ রেজার। আর সেটা লুফে নিতেও এক পা-য়ে খাঁড়া সে। ত্রস্ত বলে উঠলো ইংরেজিতে,
“দ্য কন্ডিশন ইজ, ইউ হ্যাভ টু বি মাই ফ্রেন্ড। বলো রাজি আছো?”
এতক্ষণে আঁটকে রাখা শ্বাসটা যেনো অবশেষে ছাড়তে পারলো আরশি।
বিবর্ণ মুখটায় হাসি ফুটিয়ে পশ্চিমা ভাষায় বললো,
“কেনো রাজি থাকবো না! আর এটা কোনো শর্ত হলো। আমি আরো ভাবলাম কি না কি চাইবেন আপনি?”
জারাও উৎসুক দৃষ্টি ফেরালো ওদের দিকে। ইংরেজিতেই বলল,
“কিসের এতো হাসাহাসি হচ্ছে আমাকে রেখে?”
আরশি তাকালো জারার দিকে। ওদের দুজনের ফ্রেন্ড সার্কেলটাতে আজ আরো একজন সদস্যের আগমন। এই কথাটা বলতে বলতেই মেয়েটা ভাবলো,
এই সু্যোগে জারা আর রেজারও একটা হিল্লে করে দেয়া যাবে। ম্যাচমেকার ট্যাগটা গায়ে লাগলো বলে ওর।
রেজা যে কি বলেছে আরশিকে, সেটা দূর থেকেই আন্দাজ করতে পারলো শেহজাদ।
ঐ নীল চোখজোড়া যে এক মূহুর্তের জন্যও সড়েনি আরশির উপর থেকে।
প্রিন্সিপাল লোকটা গলা পরিষ্কার করে দাঁড়ালো পোডিয়ামের সামনে। মিসেস বেলার থেকে পারমিশন চাইলো কিছু বলার জন্য। মহিলা এমনিতেই শেহজাদ বলতে অজ্ঞান।
তার দিকে তাকিয়েই ঘাড় কাত করলেন উনি।
হতাশ শ্বাস ফেললেন প্রিন্সিপাল। পরপর বললেন গম্ভীর কন্ঠে,
“এ্যাটেনশন ক্লাস! আই হেভ এ্যান এ্যানাউন্সমেন্ট ফর ইউ!”
পুরুষালী ধীর কন্ঠে পিনপতন নীরবতা নামলো ক্লাসে। সবার কৌতূহলী দৃষ্টি তখন প্রিন্সিপালের দিকে। মানুষটা থামলো একটু।
পরপর স্বভাবসুলভ পশ্চিমা ভাষায় বলল,
“ভার্সিটি তোমাদের জন্য আগামীকাল একদিনের একটা ক্যাম্পিং এর আয়োজন করেছে। ইকোনোমিক্স ডিপার্টমেন্টের সব স্টুডেন্ট এবং প্রফেসররা এই ক্যাম্পিং পার্টিসিপ্যাট করবে।”
মূহুর্তেই করতালিতে ফেঁটে পড়লো পুরো ক্লাস। ক্যাম্পিং এর নাম শুনেই ম্যারম্যারে ক্লাসটা যেনো প্রাণ ফিরে পেলো।
উল্লোসিত একেকজন ক্যাম্পিং নিয়ে একেক রকম প্রশ্ন করলো প্রিন্সিপালকে।
মানুষটাও ধৈর্য্য ধরে শুনলেন সেসব। পরপর উত্তরে আবারও বিদেশি ভাষায় বললেন,
“ক্যাম্পিং টা হবে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্কে। আমরা প্রথমে নিউইয়র্ক সিটি থেকে ট্রেনে যাবো শিকাগো পর্যন্ত। সেখান থেকে বাসে করে ফিনিক্স এবং ফিনিক্স পৌঁছে লোকাল বাসে করে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্কে।”
আবারও করতালিতে সবার কানের পর্দা ফাঁটলো। ক্যাম্পিং এ এ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেয়েই যেনো সকলের উৎসাহ বেড়ে দ্বিগুণ হলো মুহূর্তেই।
এনাউন্সমেন্ট শেষে রুম ছাড়লেন প্রিন্সিপাল। শেহজাদ চোড়াচোখে একবার আরশিকে দেখলো। মেয়েটা জারার সাথে ক্যাম্পিং এর গল্পে মশগুল।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো মানুষটা। পরপর লম্বা পা ফেলে মিসেস বেলার সাথে বেড়িয়ে গেলো নিজেও।
অমনি আবার শুরু হলো রুমজুড়ে কথার গিজগিজ শব্দ। তারমধ্যেই জারাকে খপ করে ধরলো আরশি। মুখে একরাশ আবদার জুড়ে বলল,
“জারা তুমি যাবে তো ক্যাম্পিং এ? প্লিজ প্লিজ চলো। তুমি না গেলে একটুও ভালো লাগবে না।”
জারা কিছু একটা ভাবলো। উত্তর দিলো বেশ অনেকক্ষণ পর।
“যেতে পারি, কিন্তু একটা শর্তে!”
আরশির ফর্সা মুখে চিন্তার ছাঁপ বসলো আবারও। তারপরও জিজ্ঞেস করলো রয়েসয়ে,
“কী শর্ত?”
জারা পুরোপুরি এবার ঘুরে বসলো আরশির দিকে। ভাবটা এমন যেনো খুব সিরিয়াস কিছু।
“আজ থেকে তুমি-টুমি বাদ। যদি তুই করে ডাকতে পারিস তাহলেই ক্যাম্পিং এ যাবো!
নাহলে যাবো না!”
মেয়েটা প্রথমে ভড়কে গেলেও জারার কথা শুনে পরপর জোরে হেসে ফেললো।
দুই কিশোরীর খিলখিল শব্দে মুখরিত হলো গ্যালারির মতো সুবিশাল ক্লাসরুমটা।
আর সেই হাসির দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো রেজা। মনে মনে ভাবলো,
“আরশি আমার হবে! তাতে যা করতে হয় আমি করবো!”
তুষারের চাদর পেচিয়ে সন্ধ্যে নামলো লাল-নীল বাতির শহরটায়। কর্মব্যস্ত ম্যানহাটন সিটি প্রস্তুতি নিলো একটা দীর্ঘ রাতের।
আরশিরও ক্যাম্পিং যাওয়ার প্রস্তুতি প্রায় শেষের দিকে। দুটো ট্রলি হয়েছে। দুটোই ওর জিনিসপত্রে ঠাসা।
মেয়েটা ট্রলি দুটোর দিকে তাকিয়ে গর্বের শ্বাস ফেললো। পরপর এদিক-ওদিক চাইলো আরো কিছু নেয়া বাকি আছে নাকি দেখতে।
তখনই ওর রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো শেহজাদ। দরজার ফ্রেমে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুঁজলো মানুষটা। কপালে ভাজ ফেলে জিজ্ঞেস করলো,
“এতো গুলো ট্রলি কিসের জন্য? ”
আরশির নড়েচড়ে উঠলো শেহজাদের কথায়। চোড়াচোখে একপল গ্রে ট্রাউজার আর টাইট টি-শার্ট পড়া লোকটাকে দেখেই উঠে দাঁড়ালো বিছানা ছেড়ে। মিনমিন করে বলল,
“ কালকের ক্যাম্পিং এর জন্য!”
আরশির কথার মধ্যেই মানুষটা এগিয়ে এসে বসলো ওর বিছানায়। বালিশ দুটো পাশাপাশি রেখে সেখানে সোজা হয়ে শুয়ে পড়তেই চোখ কপালে উঠলো আরশির।
মেয়েটা হড়বড়ালো বিভ্রমে,
“আরে! আ-আপনি এখানে কেনো শুচ্ছেন। আর আপনি শুলে আমি কোথায় ঘুমোবো?”
শেহজাদ এক হাত ভেঙে চোখের উপর রেখেছে কেবল।
“কেনো ফ্লোরে?”
“এই ঠান্ডায় আমি ফ্লোরে ঘুমোবো?”
মানুষটার ঘুম জড়ানো কন্ঠ। সেভাবেই বলল,
নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ১০
“বুঝতেই যখন পারছো তাহলে দাঁড়িয়ে না থেকে লাইট অফ করে চুপচাপ পাশে এসে শুয়ে পড়ো! কাল সকাল সকাল উঠতে হবে আমাদের!”
তবুও বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে রইলো আরশি।
এই জাম্বুবানের তো ভরসা নেই। কি মতলবে হঠাৎ করে পাশে শুতে বলছে কে জানে?