নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২৪

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২৪
সিনথিয়া

মুখের হাসিটা দপ করে নিভে গেলো আরশির। চোখজোড়া ফুটবল। আঁতকে উঠলো যেনো এমিলিয়াকে শেহজাদের বুকে হামলে পড়তে দেখে। ভাগ্যিস মানুষটার দু’হাতেই লাগেজ। নয়তো বোন বলে মাথায় হাত রাখলেও ওখানেই আরশির সহ্যের বাঁধ ভাঙতো।
তাই বলে ঝুঁকি নিলো না মেয়েটা।
ত্রস্ত তেড়ে এলো ওদের দিকে। হাত থেকে বাস্কেটটা নিচে রেখে টেনে তুললো এমিলিয়াকে। কত্তো বড় সাহস এই চম্পা- চামেলির! ওর জাম্বুবানকে সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরে?
ভেতর ভেতর ফুঁসছে আরশি। এলোমেলো চুলগুলো চোখের সামনে থেকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে এমিলিয়ার দু’কাঁধে হাত রাখলো সজোরে!
চোখের পলকে রাগ টুকু গিলে মুখে মেকি হাসি মেখে বললো,

“শুধু ভাইয়াকে মিস করলেই হবে? ভাবিকেও তো মিস করতে হবে!”
পরপর শেহজাদের দিকে তাকিয়ে আওড়ালো,
“বেবি! আমাকে বলবে না আপুও আছে এই বাসায়? যতই হোক; প্রথমবার যেহেতু দেখা! একটা গিফট তো পাওনা রয়ে গেলো ওনার!”
কে বেবি? কার বেবি? সবটা মাথার উপর দিয়ে গেলো প্রফেসরের। হতভম্ব হয়ে চাইলো মেয়েটার দিকে! তখনই বুঝলো আসল রহস্য। পুড়ছে কেউ একজন। শেহজাদের পাতলা অধর সরে গেলো এক পাশে। বাঁকা হেসে দেখতে রইলো কি করে ওর মিস চার্লি।
“এমি– ইউ ক্যান কল মি এমি! ওসব আপু-টাপু আমার পোষায় না! বাই দ্য ওয়ে তোমার নাম–”
আরশির আঙুল গুলো নিজের কাঁধ থেকে সরাতে সরাতে কথাগুলো বলতে নিচ্ছিলো এমিলিয়া! কিন্তু শেষটা করলো শেহজাদ!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বউয়ের কোমরের ফাঁকে হাত গলিয়ে বুকের পাশে মেশালো মেয়েটাকে। শানের মতো গলায় বললো,
“আরশি! আমার ওয়াইফ আর সম্পর্কে তোর ভাবী! বিয়ের সময় তো ছিলি না; এখন ভাইয়ের বউয়ের নামটাও ভুলে গেলি?”
এমিলিয়া প্রতিত্তোরে কিছু বলার মতো শব্দ খুঁজে পেলো না! বিয়েতে আসবে কার? যাকে একতরফা ভালোবাসতো তার? এতোটা হিম্মত জোগাতে পারেনি তখন! কিন্তু এখন কেনো যেনো সামলাতে পারলো না নিজেকে। শেহজাদকে দেখেই পুরোনো এমিলিয়া হামাগুড়ি দিলো তার কিশোরী বয়সের ভালো লাগার দিকে!
মরিয়ম বেগম পরিস্থিতি সামাল দিলেন কথার মোড় অন্য দিকে ঘুরিয়ে। কিচেনের দিকে যেতে যেতে বলে উঠলেন,
“আরে! তোরা কি সব কথা এখানে দাঁড়িয়েই শেষ করবি ? আরশিকে রুমে নিয়ে যা! একটু ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্টটা সেড়ে আরামসে গল্প কর!”
আরশি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে প্রফেসরের পাশে।হাতের উষ্ণতা যেনো উলের কোট ভেদ করে গিয়ে কোমরে লাগছে। নড়েচড়ে উঠলো ও।মরিয়মের কথায় দাঁত বের করে হাসলো ঠিকই কিন্তু তার ভিতরেই চিবিয়ে চিবিয়ে শেহজাদকে বললো,

“আমার কোমরটা ছাড়ুন বলছি!”
প্রফেসর মাথা নোয়াল মেয়েটার কথার পিঠে। কানের সামনে মুখ নিয়ে আওড়ালো,
“কোমরটা একেবারে রুমে গিয়েই ছাড়বো–বেবি! সবাইকে দেখাতে হবে না হাউ ডিপলি উই আর ইন–লাভ?”
শেহজাদের ফিসফিসে শব্দ বৃষ্টির মতো শিহরণ তুললো ঐ ছোট্ট গতরে। লোম দাঁড়িয়ে গেলো শরীরের। অবাক নয়ন তুলে মানুষটার দিকে তাকতেই রাঙা গালে টপ করে চুমু খেয়ে বসলো প্রফেসর।
ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেলো সবাই। মেহমেদ হাসান তো চোখের উপর হাত দিয়ে পিছু নিলেন স্ত্রীর।
মরিয়ম বেগমের ওড়না চেপে থামালেন ওনাকে! আমুদে স্বরে বললেন,

“ দেখলে মারিয়ম? বলেছিলাম না? আমাদের শায়ান ঠিক একদিন আরশিকে বউ হিসেবে মেনে নেবে! তুমি নাতি-নাতনির মুখ দেখার প্রিপারাশেন নিয়ে রাখো ডার্লিং! তখন কিন্তু আর কোমর ব্যাথার অজুহাতে কাজ হবে না!”
হাসলেন প্রৌঢ়া। বুক ভরে শ্বাস নিলেন। পরোটার হটপট টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন,
“যা হওয়ার সব উপরওয়ালার পক্ষ থেকেই হয়েছে! এমনিতেও আরশিকে ওর মা-বাবা
এখানে পাঠিয়েছে আমাদের ভরসা। মেয়েটার একটা সুন্দর সংসার হোক; হাসিখুশি থাকুক! এর চাইতে বেশি কিছু চাই না!”
এমিলিয়া তড়পালো ভেতর ভেতর। আরশির দিকে আড়চোখে একপল তাকিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেলো নিচ তলায় নিজের রুমে।
মনে মনে ভাবলো,
“এমি এতো সহজে হাল ছাড়ার মেয়েই না! তুমি কি করে এ বাড়িতে টিকতে পারো; আমি দেখবো!”

জারার পার্ট টাইম জবটা চলে গেছে। তবে আয়ান আসায় ঘুষিটা একেবারে বরাবর দিতে পেরেছে ম্যানেজারের গালে। একেবারে মুখ থুবড়ে লোকটা মাটিতে পড়ার পর লাইব্রেরী ছেড়েছে ছেলে-মেয়ে দুটো।
জারা মুখ গোজ করে হাঁটছে অফিসারের পিছু পিছু। কোনো খেয়াল নেই আশেপাশের। শুধু অনুসরণ করছে লম্বা ছায়াটা। তখনই হুট করে থেমে যায় আয়ান। বেখেয়ালে প্রসস্থ পিঠে এসে নাকটা লাগতেই ছিটকে দুকদম পেছায় মেয়েটা৷ ব্যাথা জায়গায় হাত দিয়ে ডলতে ডলতে চোখ তুলে চাইলো অফিসারের দিকে। ধীর কন্ঠে শুধোলো,
“এভাবে থামলেন কেনো?”
আয়ান হাত রাখলো ওর মাথায়। মুখে চিন্তা মিশিয়ে বললো,

“ঠান্ডা কিছু খাবে? ইশশ! রোদের তাপে তালুটা গরম হয়ে গেছে মনে হয়!”
জারা হাসলো না। নীল চোখে রোজের সেই স্ফূর্তিটুকু বিলীন হয়ে গেছে যেনো। ছোট ছোট চুলগুলো হাত দিয়ে কানের পেছনে নেয়নি একবারও। তারমানে কি সত্যিই মন খারাপ করে ফেললো বাটারফ্লাই?
এবারটায় অশান্ত হলো অফিসার। বেখেয়ালে আজলে তুলে নিলো বিষন্ন মুখটা।
“আমি বলেছিলাম আরো কয়েকটা ঘুষি দিয়ে আসতে ঐ বেটাকে। তখন তো দিলে না! এখন চলো তাহলে! বেশি দূর চলে আসেনি আমরা!”
“জুস খাবো!”
“এ্যাঁ?”

কিশোরীর অবাক করা আবদারে মুক বোনে দাঁড়িয়ে আয়ান। ভেবেছিল কি আর জারা বললো কি!
“এ্যাঁ নয়! জুস খাবো! ঐ তো সামনেই একটা সুপারশপ আছে। ওখানে যাই চলুন!”
হুট করেই জারার পিচ্চি পিচ্চি আঙুলের মুঠোয় আসলো আয়ানের তর্জনী।
ম্লান মুখ মেয়েটার। নিচের দিকে তাকিয়েই আওড়ালো,
“আজকে পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ!”
“ শুকনো ধন্যবাদ দিয়ে আমি কি করবো? যদি তোমার বয়—”
প্রশ্নবিদ্ধ চোখজোড়া তুলে চাইলো জারা। ঘাঁবড়ালো মানুষটা। তোতলানোর স্বরে বললো,
“বন্ধুই না হতে পারলাম?”

মেয়েটা কিছু বলার আগেই ওর মুখের সামনে ঝুঁকে আসলো অফিসার। অন্য হাত দিয়ে নাক ছুঁয়ে বললো,
“ভয় নেই বাটারফ্লাই! বেশি কিছু চাইবো না! শুধু একটু ভরসা করো! তাহলেই হবে!”
থামলো আয়ান। ঐ থমকে যাওয়া নীল চোখে নিজের উত্তর খুঁজতে গিয়ে হাসলো নিম্নোষ্ঠ কামড়ে। শুধোলো পরপর,
“চলো! জুস নিয়ে আসি?”
কিশোরী ত্রস্ত ওপর-নিচ মাথা নাড়তেই মানুষটা ছুটলো জুস আনতে। জারাও পেছন পেছন হাঁটলো ওর। মাথায় হাজারটা চিন্তা! পার্ট টাইম একটা জব না পেলে হাত খরচটা চালাতে জমানো টাকা ভাঙতে হবে। অফিসারকে ভরসা করে ঠিকই, কিন্তু ধার চাওয়ার মতো মেয়ে ও নয়!
শপের সামনেই চেয়ার টেবিল রাখা। মানুষজন বসছে সেখানে। কথা বলছে, আড্ডা দিচ্ছে।
একটা ফাঁকা চেয়ার টেনে বসলো মেয়েটাও। টেবিলের উপর আরো কিছু কাঁচের বোতল রাখা। সাথে আয়ানও একটা জুসের বোতল এনে জারার সামনে রেখে বললো,

“তুমি বোসো! আমি এক-সেকেন্ড আসছি!”
মানুষটার কথা খেয়াল করলো না বোধ হয় ও। বেখেয়ালে টেবিলের উপর থেকে অন্য একটা বোতল হাতে নিয়ে ছিপি খুলে এক ঢোক খেয়েই নাক-মুখ কুঁচকে এলো ওর।
নিজে নিজেই বিড়বিড় করে বললো,
“এতো তিতকুটে কেনো লাগলো? কি এটা?”

ধূসর মেঘ জমতে শুরু করেছে সফেদ আকাশে। একটু বাদেই হয়তো তুষারপাতও শুরু হবে অম্বরের বুক ভেঙে।
শেহজাদের রুম দোতলায়। সিড়ি ভেঙে উঠে রুমে ঢুকতেই পাশ থেকে সরে পড়লো আরশি। সামনে দাঁড়িয়ে আঙুল তুলে বললো,
“আপনি আঙ্কেল আন্টির সামনে আমার গালে ইয়ে খেলেন কেনো?”
শেহজাদ ভাবভঙ্গি নিরেট। হাতের কব্জিতে ঘড়ির টাইম দেখে আফসোস করে বললো,
“ তাহলে ঠোঁটে খেলে ভালো হয় বলছো? কিন্তু এখন যে সময় নেই হাতে মিসেস চার্লি! ভার্সিটি থেকে এসে খাই? ”
ত্রস্ত আঙুল নামিয়ে ফেললো মেয়েটা। ইতিউতি দৃষ্টি ফেললো কুন্ঠা এড়াতে। হাল ছেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাবে, তখনই বাহু চেপে ধরলো প্রফেসর। এক টানে বুকের সাথে মেশালো আরশিকে। মাথার সাথে মাথা ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,

“তখনের ‘বেবি’ ডাকটা জেলাসিতে ডেকে ছিলে তাই না?”
ছাড়া পেতে নিতান্তই ব্যর্থ চেষ্টা চালালো আরশি। নিজেও স্বর নামিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে আওড়ালো,
“আমি কেনো জেলাস হবো! আপনি যান আপনার এমির কাছে!”
ওর চোখ জোড়া আঁটকে ফ্লোরে। মানুষ হিংসে তো তার জন্যই করে যার জন্য ভালোবাসা অনুভব করতে পারে। কিন্তু শেহজাদের প্রতি আরশির অনুভূতির নাম নেই। বা হয়তো চেষ্টাই করেনি কোনো নাম দেয়ার।
প্রফেসরের হাতের বাঁধন দৃঢ় হলো। নীল চোখের গন্তব্য সবকিছু ছাপিয়ে গিয়ে আঁটকালো মেয়েটার অধরজোড়ায়। শুকনো ঢোক গিললো শেহজাদ। গলার এডাম এ্যাপলটার ওঠানামা দেখেই চোখ-মুখ ফ্যাকাসে হলো আরশির। ছটফটিয়ে বললো,

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২৩

“কি করছেন? দরজা খোলা কিন্তু!”
ভ্রু নাচালো প্রফেসর। একপল পেছনে তাকিয়ে খোলা দরজায় চোখ বোলালো। পরপর ঠোঁটযুগল ওর কানে ঘেঁষে আওড়ালো,
“মম-ড্যাড দেখে ফেললেও মাইন্ড করবে না। রিল্যাক্স বেবি। জাস্ট এক মিনিট– ”
হাঁসফাঁস বাড়লো কিশোরীর। উপায় না পেয়ে শেহজাদের পিছনে তাকিয়ে হড়বড়ালো,
“আরে এমি? তুমি এখানে?”

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২৫