নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪৮
সিনথিয়া
মধ্যবেলার মিঠেরোদ মাথায় নিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে জারা। বরফভেজা রাস্তায় তার অল্পখানেক ব্যবধানে পা মিলিয়েছে আয়ান। ইজেল ক্যানভাসের ছবির মতো মুখটা তার দুশ্চিন্তায় ম্লান। বেশ কিছুক্ষণ এই মৌন সহাবস্থানের পাট চুকিয়ে ব্যস্ত কদমে সে পাশাপাশি হলো জারার। আগে-পিছের এই দূরত্বটুকু মিটতেই উদগ্রীব স্বরে শুধালো,
‘ আমি কি কিছু করেছি বাটারফ্লাই? হ্যাভ আই ডান সামথিং রং এগ্যাইন?’
জারা থমথমে মুখেই হাঁটা থামালো। তার ছিপছিপে গড়নের আজ ভারী রাশভারী ভাব। আয়ান বেশ বুঝতে পারলো অঘটন কিছু একটা ঘটেছে। কিন্তু কার তরফ থেকে এবং কীভাবে সেটাই বোঝাই যেনো দায় হলো তার। জারা যতটা শীতল চোখে চাইলো আয়ানের উৎকন্ঠিত মুখপানে? তার থেকেও শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
‘ আপনার হঠাৎ এমন কেনো হলো অফিসার?’
হুট করে অফিসার সম্বোধনে আহত হলো আয়ানের প্রেমিক সত্তা৷ একরাশ অভিমানে ভিজে গেলো তার পৌরুষ স্বর। অসহায় চোখমুখে বালকসুলভ অনুযোগ জুড়ে আওড়ালো,
‘ সেই বেরিয়ে থেকে একবারও কথা বলোনি আমার সাথে! বাইকেও উঠলেনা। বুঝতে পারছি তুমি রেগে আছো আমার উপর! কিন্তু বিশ্বাস করো বাটারফ্লাই! গতকাল রাতে…’
‘ গতকাল রাতে ভাগ্যিস আপনার ঘরে গিয়েছিলাম আমি! নয়তো জানতেই পারতাম না আপনি এতোগুলো দিন এতো বড় সত্যিটা লুকিয়ে রেখেছিলেন আমার থেকে!’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কথার মাঝে কথা টেনে নেওয়ায় থেমে গেলো আয়ান। বিস্ময়াভিভূতের ন্যায় কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো জারার তপ্ত চোখের দিকে। অবিশ্বাস আর বিদ্রুপ মিলেমিশে একাকার হলো তার কন্ঠস্বর। তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলে উঠলো,
‘ তুমি কি আমার..! জারা! প্লিজ বলো না! তুমি আমার পার্সোনাল ফাইলগুলো ঘেঁটেছো?’
আয়ানের প্রশ্নে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো নীলাম্বরীর। ক্ষুব্ধ চোখজোড়ায় খেলে গেলো বিমূঢ়তার ঢেউ। এক কদম দুকদম করে আয়ানের একেবারে কাছাকাছি এগিয়ে এলো সে। প্রশস্ত বুকে তর্জনী ঠেকিয়ে বড় অবিশ্বাসের সাথে বলে গেলো,
‘ আপনার সাথে আমার পুরো লাইফ জড়িয়ে আছে আয়ান। আমরা বিয়ে করবো, সংসার করবো! সেখানে আপনার পার্সোনাল ফাইল ঘেঁটেছি বলে আপনি রেগে যাচ্ছেন? আপনার পার্সোনাল ব্যাপারে জানার কোনো অধিকার নেই আমার?’
‘ না নেই!’
আয়ানের কাঠখোট্টা জবাবে নিজের অজান্তেই চোখজোড়া ছলছল করে উঠলো জারার৷ বলতে গিয়ে জড়িয়ে এলো ভিতরের কথা গুলো। তারপরও রুদ্ধ স্বরে আওড়ালো,
‘ আপনার মেডিকেল রিপোর্টগুলো কেনো দেখাননি আমাকে? কেনো বলেননি আপনি…’
আয়ান তখনও শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে। যেনো অন্ধকার নেমেছে তার সৌম্যসুন্দর মুখশ্রীতে। জারাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই মেঘমন্দ্র স্বরে বলে উঠলো,
‘ যে আমি অসুস্থ? এটা বলতাম তোমাকে? যে আমার হাতে তোমার সাথে সংসার করার মতো যথেষ্ট সময় নেই? উপরওয়ালা হাতে গোনা আর কয়েকটা, মাত্র কয়েকটা বছর রেখেছেন আমার জন্য এই পৃথিবীতে? যে আমি আর কয়েকবছর বাদে আর কাউকে চিনতে পারবো না? আঙ্কেলকে চিনতে পারবো না, আন্টিকে চিনতে পারবো না, শায়ানকে চিনতে পারবো না, তোমাকে…! এসব বলতাম আমি তোমাকে? কেনো? কে হও তুমি আমার? কীসের এতো অধিকার তোমার আমার লাইফে?’
দীঘির মতো টলমলে জলের ধারা কার্ণিশ পেরোলো চোখের। আয়ানের রুঢ় ব্যবহার কপোল গড়িয়ে চিবুক ভেজালো জারার। এতক্ষণ কপোট রাগ দেখানো মেয়েটা এবার যেনো একেবারে স্থবির বোনে গেলো। কিছুক্ষণ কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইলো এক ধ্যানে। কানে বোলতার মতো শব্দ সমেত কেউ একজন বলে চললো, ‘কে হও তুমি আমার?’
নিমেষেই ভেঙে পড়লো জারার স্বপ্নে সাজানো অলীক সংসার। স্থান-কাল-পাত্র ভুলে আয়ানের সামনে দাঁড়িয়েই ডুকরে উঠলো মেয়েটা। অথচ যে মানুষ জারার হাজার মন খারাপ ভালো করে দিতেও মরিয়া থাকতো সবসময়, সে যেনো আজ বরফখন্ডের চাইতেও নিরুত্তাপ।
জারার শব্দ করে কান্নার আওয়াজে আজ আর তার পৃথিবী থমকালো না। অস্থির পায়ে সে ছুটে এলো না জারার কাছে। মুছে দিলো না চোখের পানি।
জারা নিজে থেকেই কান্না থামিয়ে অবাক কন্ঠে শুধালো,
‘ কেউ হইনা আমি আপনার? কোনো অধিকার নেই আমার আপনার জীবনে? কেনো? ভা-ভালোবাসেননি আমায় কখনো?’
শুষ্ক ঢোক গিললো অফিসার। যেনো সত্যিটা গিলে মিথ্যেটা উগরে দিতে কঠিন গলায় বলে উঠলো,
‘ না!’
আরেকটা হোঁচট! জারা শূন্য দৃষ্টিতে কেবল তাকিয়ে রইলো আয়ানের আনত মুখের দিকে। যে দু’কদম এগিয়েছিল? একে একে বিদ্যুতস্পৃষ্টের মতো সেই দু’কদম পিছিয়ে গেলো মেয়েটা। কান্না নেই, পাল্টা প্রশ্ন, উত্তর কিচ্ছু নেই! যেনো সমস্ত অভিযোগের থলি শূন্য আজ ওর। দ্বিপ্রহরের একটুকরো মেঘের মতো বিষন্নতা নামলো ভেজা আননজুড়ে। জগতের সমস্ত মায়া ত্যাগ করলো মন। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী মেয়েটার বিশ্বাস উঠে গেলো নিজের উপর থেকে।
ভবঘুরে হয়ে কোন পথ ধরলো তা-কি সে নিজেও জানে? জানে না হয়তো! তবুও সে দাঁড়িয়ে রইলো না একদন্ডও। দুজনের মান-অভিমানের ভারী পাল্লা একা বয়ে বেরানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে পা বাড়ালো ম্যাপল পাতা ঝরা পথে। বসন্ত শুরু হওয়ার আগেই কি তার জীবনের রঙিন অধ্যায় আজ এই মধ্যাহ্নে এসে ফুরিয়ে গেলো তবে?
জারা চলে গেছে মিনিটখানেক হলো। অথচ আয়ান একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। মাথা নিচু৷ দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ দু’পাশে! ছেলেমানুষ সহজে কাঁদে না। তবুও আয়ানের চোখের দুকূল ছাপিয়ে পড়তে চাইলো অথৈজল। থরথর করে কাঁপলো তার পুরো শরীর। এটা কী করে ফেললো সে?
এভাবে শেষ করে দিলো সবটা? নিজেকেই নিজে ধিক্কার জানালো শেষমেশ। যে কথাগুলো জারা সামনে থাকতে বলতে পারেনি? সেই কথাগুলোই বলে চললো একে একে,
‘ আমি বড্ড লোভী জারা! আমি অসুস্থ জেনেও নিজেকে পারিনি তোমার জীবন থেকে সরিয়ে ফেলতে৷ বেঁচে থাকতে পারবো না জেনেও পারিনি তোমায় না ভালোবেসে থাকতে। চেয়েছিলাম কোনোদিন তোমাকে জানতেই দেবো না যে আমার এই অসুখের কথা! কারণ হয়তো আমি তোমার চোখে কখনও দূর্বল হতে চাইনি জারা। জানো? ভেবেছিলাম যতদিন বেঁচে থাকবো, ততদিনে অনেকগুলো ভালো স্মৃতি বানাবো তোমার সাথে! যেন মস্তিষ্ক তোমাকে ভুলে যেতে চাইলেও মন তোমাকে না ভুলতে দেয়! কিন্তু দেখো! ভালো মেমোরিজ বানাতে গিয়ে কতো বিচ্ছিরি একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেললাম! তোমাকে বকলাম, কষ্ট দিলাম! আ’ম সরি বাটারফ্লাই! এই ভীষণ স্বার্থপর আমি টাকে পারলে ক্ষমা করে দিও তুমি!’
‘ পারবো না ক্ষমা করতে আপনাকে!’
রিনরিনে ভাঙা স্বরে বলা কথাটুকু শুনতেই মাথা তুললো আয়ান। জারা ক্লান্ত বিষাদ মুখখানা নিয়ে সম্মুখে দাঁড়িয়ে তার। হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে ফের বললো,
‘ আপনার মতো বুদ্ধু লোককে ক্ষমা করতে আমার বয়েই গেছে!’
আয়ান তখনও ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে। জারা তার মানে চলে যায়নি তাকে ছেড়ে? পৃথিবী সমান বিস্ময়ে কন্ঠনালী চিড়ে কথা বেরুলো না আর কোনো। শুধু অভিমানী ফুলে-ফেঁপে ওঠা ঐ নরম গালগুলোতে আদর করে দিতে ইচ্ছে হলো ভীষন৷ ইশ! না জানি কতটা কেঁদেছে মেয়েটা ওর জন্য?
‘ এই আপনার ভালোবাসার নমুনা? ভালোবাসার মানুষকে নিজের ভালো মন্দ সবটা জানাতে হয়! হতেও তো পারে আমরা দু’জনে মিলে কোনো একটা সমাধান বের করে ফেললাম এই পরিস্থিতির। আপনার ভয় আমাকে ভুলে যাওয়া নিয়ে তো? বেশ! আপনি যতবার আমাকে ভুলে যাবেন ততবার আমি আপনাকে নতুন করে মনে করিয়ে দেবো যে…’
এটুকু বলে কিঞ্চিত সময় থেমে রইলো জারা। পরপর টিকালো লালচে নাক টেনে টেনে আওড়ালো,
‘ যে আপনি শুধু আমার বানরমশাই! তাও আবার যে সে বানর নয়! একেবারে এই শহরের সবচেয়ে বুদ্ধু বানর আপনি!’
এতোশত বিস্ময় বিমূঢ়তার মাঝেও মাথা নুইয়ে ফিক করে হেসে ফেললো আয়ান। জারার কাছে বড় নিষ্পাপ নিষ্কলুষ লাগলো সেই হাসিটুকু। তনুমনে বয়ে গেলো ঝড় শেষ হওয়ার পরের মূহুর্তের মতো ঠান্ডা ঠান্ডা পরশ। কেনো সে তখন একটু বুঝলো না মানুষটাকে? কেনো সে ওভাবে ফেলে চলে যেতে চাইছিল তাকে? জারার নিজের ওপরই রাগ হলো এবার। সেই রাগটুকু নিয়েই আয়ানকে থমথমে মুখে শুধালো,
‘ এখন আবার দাঁত বের করে হাসছেন কেনো? আপনার প্রশংসা করিনি! বানর বলেছি আপনাকে!’
আয়ান চমকালো। থমকে তাকালো সামনে। হাসিটুকু গায়েব হয়ে গেলো জারার রাগত মুখখানা দেখতেই। বড় বড় হতবিহ্বল চোখ দুটো ফের সন্ত্রস্ত হলো জীবনের এই বিশেষ মানুষটাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে। গমগমে পৌরুষ স্বরখানা নরম করে শুধালো,
‘ তাহলে কী করবো?’
জারা তখনও মুখ গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে। তার থেকেও গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে দাঁড়ান!’
অফিসার বাধ্য ছেলের মতো দু’হাত দু’দিকে ছড়ালো। ধীরে ধীরে তাকে আরেকদফা বিস্ময়ের চূড়ায় নিয়ে ফেলতেই যেনো জারা এগিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার বুকে। চওড়া সিনায় মুখ লুকিয়ে কেঁদে ভাসালো। প্রেয়সীর চোখের পানিতে সিক্ত হলো আয়ানের হৃদয়। জারাকে বুকের ভিতর নিয়েই তাবত দুনিয়ার সমস্ত দুঃখের ভাগ থেকে তাকে মুক্তি দিতে চাইলো একান্তে। চুলে মুখ গুঁজে পিঠে হাত রাখলো মেয়েটার। কষ্টগুলো যদি একটু আদর পেয়ে মুছে যায় তাতে ক্ষতি কী?
জারা কত সময় ওভাবে আয়ানের বুকে পড়েছিল তা সে জানে না। তবে হুঁশ ফিরতেই ধরা গলায় আবদার ছুড়ে বললো,
‘ আমি ডিসিশন চেঞ্জ করে ফেলেছি! বাংলাদেশে গিয়ে বিয়ে করছি না আমরা। এখানেই বিয়ে হবে আমাদের। এই নিউইয়র্কে! আঙ্কেল আন্টি, প্রফেসর, আরশি, স্নোবল সবাইকে সাথে নিয়েই হবে বানরমশাই আর তার বাটারফ্লাই এর বিয়ে! তারপর বাংলাদেশে ফিরলে ওখানকার আশ্রমের সবাইকে নিয়ে বড় করে আরো একবার অনুষ্ঠান করবো আমরা!’
আয়ান দুষ্টুমি করে বললো,
‘ অলিভিয়া বড় হয়ে আমাকে বিয়ে করে ফেলবে, এই ভয়ে তুমি এমন কথা বলছো না তো? তুমি তো ভারী হিংসুটে বাটারফ্লাই!’
আয়ানের বোকা বোকা প্রশ্নে আরো একবার শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরলো জারা। আরো গভীরভাবে তার বুকে মাথা রেখে চাপা স্বরে আওড়ালো,
‘ বুদ্ধু!’
‘ তবুও তো ভালোবাসো!’
‘ আপনার মতো বুদ্ধুকে আমি ভালো না বাসলে আর কে বাসতো শুনি?’
স্বর্ণালি সন্ধ্যার মতো চোখজোড়াও অশ্রুসিক্ত হলো আয়ানের। সেই পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই সে আকাশের দিকে মুখ তুললো। এতোটা সুখের ভিড়েও ভাগ্যবিধাতার সহস্র প্রশংসায় নুয়ে এলো তার মন। অস্পষ্টে আওড়ালো,
‘ কেউ বাসতো না! কেউ না!’
নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪৭
ভাগ্যবিধাতাও বোধহয় ওপর থেকে মুচকি হাসলেন এই জোড়া শালিককে দেখে। কে জানে? হয়তো কোনো মিরাকল ঘটিয়ে আরো কিছুটা সময় দেবেন ওদের। আশাতীত ভাবেই পৃথিবীর বুকে বেঁচে যাবে ওদের এই ভালোবাসা।