নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪৮ (২)
সিনথিয়া
‘ মানলাম তিন দিন আগে আমার আরশির মায়ের জন্মদিন ছিল! তাই বলে তোমার ছেলে এই তিনদিন নিজেও ঘরের বাইরে বের হবে না? আর আরশি মাকেও বের হতে দেবে না? আশ্চর্য! বউয়ের জন্মদিন কেউ তিনদিন ধরে পালন করে?’
মেহমেদ হাসান প্রচন্ড রেগে আছেন। তিনি রেগে গেলে খুব শব্দ করে খবরের কাগজ ওল্টান। এবারও তাই করলেন। স্নোবলও মায়ের উপর মারাত্মক রেগে আছে । একাত্মতা পোষন করতে মেহমেদের কথা শেষ হতেই সে পিছনের পা জোড়া দিয়ে থপ করে বারি মারলো ফ্লোরে। বোঝালো এ বাড়ির ছেলের এহেন বিবেকবর্জিত কাজে সে-ও সমান লজ্জিত, রাগান্বিত। সে তার মা কে কিছুতেই ঐ লোকের সাথে একা এক ঘরে থাকতে দিতে রাজি নয়। বাঙালি ছেলেপেলের উপর তার একদম ভরসা নেই। কখন কী করে ফেলে! নিউইয়র্কের হলেও তা-ও একটা কথা ছিল!
তবে হাসান ভিলার কর্তাদের যতটা মেজাজ খারাপ ততটাই নিরুদ্বিগ্ন ভিলার কর্ত্রী। ব্রেড-এ বাটার লাগাতে লাগাতে স্বামীকে একপ্রকার উপেক্ষা করেই হাঁক ছুঁড়লেন গৃহসহায়িকার উদ্দেশ্যে। সে এলে ব্রেড-বাটার দেয়া খাবারের ট্রেটা তুলে দিলেন তার হতে। চোখের ইশারায় দোতলার ঘরে দেখিয়ে দিতেই মরিয়ম বেগমের আদেশ বুঝে ফেললো মেয়েটা। তারপর চপল পায়ে ট্রে হাতে উঠে গেলো দোতলায়। শেহজাদের দরজায় নক করে খাবারের ট্রেটা মেঝেতে রেখেই ফের নিচে নেমে এলো ততক্ষণাৎ। বলাবাহুল্য প্রতিবেলায় খাবার নিয়ে এমন উপর-নিচ সে করে চলেছে বিগত তিন দিন ধরে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তবে পাত্তা না পেয়ে মুখ গোঁজ করলেন মেহমেদ এবং স্নোবল দু’জনেই। দু’জনেই যে আরশি অন্ত প্রাণ। সেখানে ঐ ছ’ ফুট জাম্বুবান এভাবে তাদের দলের লোককে হাইজ্যাক করে ফেললো? নাহ! আর চুপ করে থাকা যায় না! আওয়াজ তুলতে হবে। মেহমেদ হাসানও আওয়াজ তুললেন। মরিয়ম বেগমকে তাগাদা দিয়ে শুধালেন,
‘ আমি তোমাকে যা জিজ্ঞেস করেছি, তুমি কি শুনতে পেয়েছো?’
আবারও একাত্মতা ঘোষণা করলো স্নোবল। গলা দিয়ে ঘরঘর শব্দ করে বোঝালো,
‘ শুনতে পেয়েছো?’
মরিয়ম বেগম বিতৃষ্ণ মুখে ফিরলেন তাদের দিকে। উত্তরের বদলে পাল্টা প্রশ্ন করে শুধালেন,
‘ তোমাদের সমস্যা কী?’
মেহমেদ হাসান অবাক স্বরে বলে উঠলেন,
‘ তোমাদের বলতে?’
মরিয়ম বেগম তার পায়ের দিকে ইশারা করে আওড়ালেন,
‘ তুমি আর স্নোবল! তোমাদের সমস্যা টা কী? তখন থেকে আমার কানের মাথাটা খেয়ে ফেলছো!’
স্ত্রীর ঝাঁঝাল স্বরে থতমত খেলো মেহমেদ। গলা পরিষ্কার করে চোখের চশমাটা এক হাতে ঠিক করতে করতে শুধালেন,
‘ হ্যাঁ! হ্যাঁ! এখন তো কানের মাথা খেয়ে ফেলি বলবেই! আর যখন আমি তোমার ছেলের বয়সী ছিলাম, তখন কেমন আমার পিছে পিছে ঘুরতে মনে আছে?’
মরিয়ম বেগম পুরোনো কথা মনে করে ঠোঁট টিপে হাসলেও সেটা প্রকাশ করলেন না স্বামীর সামনে। মেকি গাম্ভীর্যের সাথে আওড়ালেন,
‘ আমি যে প্রথম প্রথম তোমাকে পছন্দ করতাম না সেটাও বলো! থাকতে তো ছেলের মতোই মুখটা সবসময় বাংলার পাঁচ করে রেখে!’
‘ তারপর সেই আমাকে হাসানোর দায়িত্বটাও তো তুমিই নিলে বেগমজান!’
মেহমেদের কথায় মরিয়ম বেগমের ছদ্ম গম্ভীরতার ছন্দপতন ঘটলো। লনের ফুলগুলোর মতোই খিলখিলিয়ে উঠলো তার প্রবীণ মুখ। হাসিমুখে স্বামীর দিকে খাবারের প্লেটটা এগিয়ে দিতে দিতে বললেন,
‘ থাক! এখন আর অতো পটাতে হবে না আমাকে! সে বয়স যে পেরিয়ে গিয়েছে আপনার! মনে আছে?’
‘ মোটেই না! আমি এখনো এভারগ্রিন! তোমার ছেলে তো কোনো কম্মের না! আমার এখনো মনে যা জোর আছে না? তাতে এতোদিনে ওর আরেকটা ভাইবোন চলে আসতো! আর এই ব্যাটা এখনো আমাকে একটা সুখবর দিতে পারলো না?’
মেহমেদ হাসান খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথাগুলো বললেও এবারে শব্দ করে হেসে উঠলেন মরিয়ম। ঝুঁকে এসে তার হাত থেকে খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে শুধালেন,
‘ তুমি যেভাবে ওদের ডাকাডাকি করছো, তাতে সুখবরটা পাবে কী করে শুনি?’
এতক্ষণে স্মিত হাসলেন প্রৌঢ়। পরোটা তুলে স্ত্রীর মুখের সামনে ধরে বললেন,
‘ আমার অমন গোমড়ামুখো ছেলেটার জন্য আরশি মাকেই দরকার ছিল। তুমি যদি সেদিন ইবরাহিমের কাছ থেকে ওর মেয়েটাকে চেয়ে না আনতে, তাহলে বোধহয় আমাদের এই অপূর্ণ সংসারটা আর পূর্ণ হতো না মরিয়ম! এখন শুধু একটা আদুরে গলায় দাদা ডাক শোনার অপেক্ষা! তাহলেই আমার শান্তি!’
মরিয়ম খাবারের গ্রাস টুকু লুফে নিলেন স্বামীর হাত থেকে।
তারপর আড়চোখে চেয়ে শুধালেন,
‘ তাহলে বলো? বেস্ট ওয়াইফের এওয়ার্ডটা আমি পাচ্ছি!’
‘ সে তো কবেই পেয়ে গেছো!’
‘ কোথায়?’
‘ কেনো? এই জলজ্যান্ত আমিটা কী তোমার প্রাইজ নই? কত ভালোবাসি তোমায় বলো! তারপরও তোমার অন্য প্রাইজ লাগবে? এ তো ভারী অন্যায় বেগমজান! এমন অন্যায়ের শাস্তি হিসেবে তোমাকে আজ আমার সাথে দাবা খেলতে হবে! সবসময় তো আরশি মা-ই খেলে! তবে আজ তুমি খেলবে! বলো রাজি?’
স্বামীর শাস্তির এমন বহর শুনে ফের একবার হেসে উঠলেন মরিয়ম। মাথা দুলিয়ে বললেন,
‘ এমন কথার পিঠে তো আর কিছু বলা যায় না! বেশ! আজ না হয় আরশির বদলে আমিই তোমার সাথে চেজ খেললাম। তবুও দয়া করে মেয়েটাকে আর ডেকো না! ওরা একটু একসাথে সময় কাটাচ্ছে কাটাক!’
মেহমেদ প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে আওড়ালেন,
‘ তোমার কী মনে হয় বেগমজান? আমি ডাকলেই তোমার ছেলে তাকে আসতে দেবে? বাবাকে বন্ধু মনে করেছে কি না? নইলে সেদিন কীভাবে বলে চলে গেলো, বউকে কোলে নিলে হার্টরেট ভালো থাকে, চাইলে তুমিও ট্রাই করে দেখতে পারো? তুমি ভাবতে পারছো? আ’ম আই হিজ ফ্রেন্ড অর হোয়াট?’
স্বামীর কন্ঠের উষ্মা আন্দাজ করতে পেরেই মরিয়ম বেগম ঠোঁট টিপলেন। তারপর দুষ্টুমি করে বলে উঠলেন,
‘ আসলেই ভালো থাকে বুঝি? তাহলে তো শুধু শুধু ঐ ট্রেডমিলটার আর দরকারই নেই। তুমি নাহয় রোজ আমাকে কোলেই চড়িও। তাতে তোমার হার্টরেটও ভালো থাকবে আর আমার মনও?’
মরিয়ম বেগমের দুষ্টুমি ধরতে পেরে আর রাগ করে থাকতে পারলেন না মেহমেদ। নিঃশব্দে, অপলক চেয়ে রইলেন স্ত্রীর দিকে। তারপর স্নোবলের সামনে হুট করেই চুমু খেয়ে বসলেন মরিয়মের গালে। সহসা পিছনের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো স্নোবল। কি মুশকিল! যাদের কাছে মাম্মার আর পাপার নামে বিচার দিতে এসেছিল তারাই যদি ওর সামনে চুমু খাওয়া করা শুরু করে দেয় তাহলে ও যাবে টা কার কাছে? হায়রে মনুষ্যজাত! হায়রে ন্যায়বিচার!
শেহজাদ ধীরপায়ে দরজার ওপাশ থেকে খাবারের ট্রে টা এনে বেডসাইড টেবিলে রাখলো। তারপর বিছানায় বসে সমস্ত নিবেশন ঢাললো পাশেই ঘুমোনো নিখুঁত ঐ চেহারায়।
ভোরে ফোঁটা স্নিগ্ধ দোলনচাঁপার মতো মিষ্টি মুখটার দিকে তাকিয়ে বড্ড মোলায়েম স্বরে শুধালো,
‘ আজকেও যাবে না নিচে?’
আরশি ঘুমের মধ্যেই দু’দিকে মাথা নাড়লো। শীতের শেষ আর বসন্ত শুরু হওয়ার মাঝামাঝি সময়টায়ও শীত শীত বাতাস ঢুকছে জানালার পর্দা ভেদ করে। তাতেই বিড়ালছানার ন্যায় কম্ফোর্টারের তলায় নাক পর্যন্ত ঢেকে ফেললো রমনী। বিড়ালের মতোই আদুরে গলায় বলে উঠলো,
‘ আর আপনিও এখন নিচে যাবেন না!’
এমন আবদার শুনে দাঁতে নিম্নাষ্ঠ পিষে ধরলো শেহজাদ। নীলাভ চোখে দুষ্টুমির ঢেউ খেলে উঠলো সহসা। চিবুকের ভাঁজে বয়ে বেরানো স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যকে ছুটি দিতেই চঞ্চল কিশোরের মতো প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো তার প্রশ্রয়। আরশির ছদ্ম ঘুমের বারোটা বাজিয়ে শুধালো,
‘ আচ্ছা? তা..আমি কেনো যাবো না?
সটান চোখ মেলে চাইলো তার প্রিয়তমা। ঘুমিয়ে থাকার যে অভিনয়টা করবে ভেবেছিল তাতে সাময়িক ইস্তফা জানিয়ে উঠে বসলো সে। মাথার এলোমেলো চুল আর ভবঘুরের মতো চেহারায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে বিছানা থেকে নিচ নামলো পরপর। নিজের হাতের থেকে দ্বিগুন বড় হাতটা ধরে শেহজাদকে টেনে নিয়ে এলো আয়নার সামনে। আয়নায় চোখ রেখে কুন্ঠিত স্বরে শুধালো,
‘ কেনো যাবেন না এবার বুঝতে পেরেছেন? দেখতে পাচ্ছেন কিছু?’
শেহজাদ দেখলো। তবে আরশি যা দেখাতে চাইলো তা নয়! দেখলো দর্পনের কাঁচে ঘাসফুলের গায়ে একফোঁটা শিশিরবিন্দুর মতোই একটা স্নিগ্ধ, আদুরে মুখখানা। ভোরের আকাশে খসে পড়া তারার ন্যায় সে তার ধ্যান জ্ঞান হারালো সেই মুখের দিকে তাকিয়ে। ভুলে বসলো নিজের উত্তর জানাতে। অমনি তাগাদা দিয়ে উঠলো আরশি। সিনচেন নাইটসুট পরনের মেয়েটা কন্ঠে জোর দিয়ে শুধালো,
‘ কী হলো? দেখত পাচ্ছেন না? এই যে আপনার ঘাড়ে, গালে এতোগুলা দাগ! সবাই যদি জিজ্ঞেস করে কীসের দাগ এগুলো? তখন কী বলবেন আপনি? মশার?’
এবার হুঁশ ফিরলো শেহজাদের। বুঝলো আরশি চিন্তা নিরর্থক নয়। বুকের দাগগুলো ঢাকা গেলেও গাল এবং গলার দাগ ঢাকতে আসলেই হিমশিম খেতে হতো তাকে!
তবুও হাসি চাপাতে পারলো না প্রফেসর। উল্টে ঠোঁট টিপে বেশ গর্ব ভরেই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো দাগগুলো। তারপর ছদ্ম বিচলিত স্বরে আওড়ালো,
‘ মশার দাগ এমন হয় না স্নোফ্ল্যাক! সবাই বুঝে ফেলতো এই কারুকার্যের আর্টিস্ট অন্য কেউ! যার জন্য আমি গত তিনদিন ঘরের বাইরে বের হতে পারলাম না, ভার্সিটি পর্যন্ত যেতে পারলাম না! বলছি ম্যাডাম? এভাবে ছুটি কাটালে আপনার বরের চাকরি থাকবে?
অনুতাপে গৌরবর্ণা থেকে নীল হয়ে গেলো আরশি। অপরাধী মুখ করে অন্য দিকে ফিরে আওড়ালো,
‘ আপনি এভাবে বলছেন কেনো? শুধু কি আমি আপনাকে কামড়েছি নাকি? আপনিও তো সেইম কাজ করেছেন। আপনার জন্য আমিও তো নিচে যেতে পারছি না! কই? তাতে আমি তো একবারও বলিনি যে আমার জরিমানা হয়ে যাবে? ক্লাস না করলে ইকোনোমিক্সের প্রফেসর এবারের সেমিস্টার ফাইনালে ফেইলও করিয়ে দিতে পারে।’
আরশি থামতেই পিছনে দাঁড়ানো গ্রে ট্রাউজার পরা আবরণহীন সুঠাম দেহখানা ঝুঁকে এলো অল্প। আগাম সতর্কতা জারি না করেই আরশির দেহ কাঁপিয়ে মুখ গুঁজলো তার রমণীর গলায়। চাপা স্বরে বললো,
‘ কারণ তোমার ইকোনমিক্সের ক্লাসগুলো আমি নিই, ফাইনালে তোমাকে ফেইল করাবো না বলেই এখন থেকে তুমি আমার কাছে টিউশন নেবে। বাসায়ও তুমি আমার কাছে পড়াবে! মনে থাকে যেনো!’
আচমকা এমন বরসুলভ হামলায় আরশি পুরোপুরি কাবু। সমস্ত শরীরজুড়ে ঝমঝমিয়ে নামলো অনুভূতির বৃষ্টি। শিহরণে ভিজলো মন। গলার খাঁজে পুরুষালী উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শে পায়ের আঙুল খামচে ধরলো মেঝে। আবেশে বুঁজে এলো চোখের পাতা। পিছন থেকে কোমর পেঁচিয়ে ধরা হাতখানায় সরাতে কসরতও করলো খুব নিজের হাত দিয়ে। কিন্তু লাভ হলো না। অগত্যা অসার হওয়া গলায় কোনোমতে বলে উঠলো,
‘ বললেই হলো? আ…আমি কোনো টিউশন নেবো না আপনার থেকে!’
‘ কেনো? আমি খারাপ পড়াই?’
আরশির ততক্ষণে হাঁসফাঁস শুরু হয়েছে শেহজাদের বাহুডোরে দাঁড়িয়ে। গলায় যে আদরের ঝড় তুলেছে শেহজাদ তা উপেক্ষা করতে না পেরে বড্ড অসহায় বোধ করলো সে ভিতর ভিতর। সর্বদা বইয়ে মুখ গুঁজে থাকা ভদ্রশিষ্ট মানুষটাও এমনধারা অশিষ্ট কাজ করে ফেলতে পারে, ঘুনাক্ষরেও কী কোনোদিন টের পেয়েছিল আরশি?
ভাবনা থেকে বেরিয়ে চোখ মেলে সোজাসুজি আয়নার দিকে চাইলো আরশি। শেহজাদের পানে তাকিয়ে পরাস্ত স্বরে বলে উঠলো,
‘ আপনি ভীষন ভালো পড়ান! আপনার ক্লাস করার জন্য কত দূর থেকেও স্টুডেন্টরা চলে আসে আপনি জানেন? অথচ আমি? ক্লাসে বসে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকবো না আপনার পড়া বুঝবো সেটাই ডিসাইড করে উঠতে পারি না! এতো কেনো সুন্দর হতে হবে আপনাকে? নাকটা এতো কেনো খাঁড়া খাঁড়া হতে হবে আপনার? গাল, চিবুক, কপাল, সব কিছু এতো কেনো নিখুঁত হবে? চোখগুলো এতো কেনো সুন্দর হবে? এরকম গ্রীক গডদের মতো শরীর নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন বলেই তো আমি ডিসট্রাক্টেড হই বেশি, পড়া বুঝি কম!’
এতটুকু বলেই থামলো মেয়েটা। তারপর ছদ্ম প্রবোধ মিশিয়ে জানালো,
‘ এতোগুলো কারণের জন্যই আপনার এই অফার আমি রিজেক্ট করলাম! আ’ম সরি প্রফেসর! আমি দুঃখীত! আপনি ভালো পড়ান, কিন্তু আপনি একটু বেশিই সুন্দর! আর যেখানে আপনাকে দেখলে বরাবরই আমি ফোকাস হারিয়ে ফেলি! সেখানে পড়া বোঝা তো দুঃস্বপ্ন!’
শেহজাদ আরশি গলাতে মুখ গুঁজেই লাজুক হাসলো। প্রিয়দর্শিনীর মুখে নিজের এমন ভূয়সী প্রশংসায় রক্তিম হলো তার কান, গাল। আদরে আবেশিত গলায় বললো,
‘ তুমি এতো বেশি কথা কেনো বলো স্নোফ্ল্যাক? আমি বলেছি এতো বেশি কথা বলতে? আমি পড়াবো মানে পড়াবো! ব্যাস!’
শেহজাদ লজ্জা পাচ্ছে বুঝতে পেরে আরশিও একই ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
‘ আপনি এতো আদর কেনো করছেন আমাকে? আমি কি বলেছি এতো আদর করতে? আর আমাকে পড়াতে চাইলে পড়ান! কিন্তু আমিও তাহলে না পড়ে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকবো মানে তাকিয়ে থাকবো! ব্যাস!’
অমনি আরশিকে ঘুরিয়ে নিজের মুখোমুখি করলো শেহজাদ। ব্যগ্র দৃষ্টিতে মেয়েটার আগাগোড়া দেখতেই শুকনো ঢোক গিললো আরশি। উৎকন্ঠা নিয়ে শুধালো,
‘ ওভাবে কেনো দেখছেন আমাকে?’
আরশির সন্ত্রস্ত প্রশ্নে অধর কোণা চূড়ায় উঠলো শেহজাদের। বাঁকা হেসে রমনীর কপালের কেশকুন্তল কানের পাশে গুঁজে দিতে দিতে বললো,
‘ কেনো? তুমি আমাকে যেভাবে দেখো, আমিও তো সেভাবেই তোমাকে দেখছি!’
আরশির বিশ্বাস হলো না। ভয়ার্ত মুখ আর সরুচোখে চেয়ে সে বললো,
‘ না! আপনি সেভাবে দেখছেন না!’
‘ তাহলে তুমিই বলো! কীভাবে দেখছি তোমাকে?’
প্রশ্রয় পেয়ে লাগামহীন ছুটলো আরশির বেলেহাজ একেকটি স্তবক। বলে বসলো,
‘ আমার মনে হচ্ছে, আপনি এখনই আমায় চুমু খাবেন! ভীষণ কড়া একটা চুমু! আর তারপর আবারও তিনদিন আমরা ঘর থেকে বের হতে পারবো না! ঠিক বলছি না?’
আরশি কথা শেষ করতেই শেহজাদ ঝুঁকে এলো ওর মুখের সামনে। রমনীর ওষ্ঠপুট লুফে নিতে নিতে চওড়া হাসলো সে পুরুষ। বন্ধ চোখে হতবিহ্বলতার চূড়ান্তে পৌঁছে মেয়েটা শুনলো এক পুরুষালী ভরাট কন্ঠ,
‘ ইউ আর ড্যাম রাইট স্নোফ্ল্যাক!’
❝প্রাণ চায় চক্ষু না চায়
বলি একি তোর দুস্তরলজ্জা
প্রাণ চায় চক্ষু না চায়…!
সুন্দরও এসে ফিরে যায়
তবে কার লাগি মিথ্যা এ সজ্জা..!❞
গুনগুনিয়ে রবি ঠাকুরের গান গাইছে জারা। কয়েকদিন যাবত বৃষ্টি থামেনি অত্যাধুনিক এই শহরের অলিতে-গলিতে। কমেনি আকাশের অভিমানী রূপ। ফিকে হয়নি মন খারাপের সুর। উদাস প্রকৃতির সাথে তার একমাত্র বান্ধবীটিও সমান উদাস মুখে বসে আছে ক্যান্টিনের চেয়ারে। টেবিলের উপর রেখেছে তার ক্লান্ত বিষন্ন মুখখানা। কফির কাপ ধোঁয়ার কুন্ডলী উড়িয়ে ঠান্ডা হয়ে গেছে বহুক্ষণ। আরশির খেয়াল নেই সেদিকে। তার নিস্প্রভ চাওনিতে শুধু ভেসে বেড়াচ্ছে সেদিন সকালের শেহজাদের আরশিকে টিউশন পড়ানোর কথাগুলো। ঐ ঘটনার পর মাঝে কেঁটেছে একসপ্তাহ। তবুও কেনো যেনো আরশিকে পড়ানোর ভূতটা শেহজাদের মাথা থেকে নামেনি।
সবটা শুনে জারার মনে হলো এই পরিস্থিতিট সাথে এই গানটাই চমৎকার মানাবে। সে তার উদাস বন্ধুর ব্যথায় সমান উদাস হয়ে আবার গুনগুনিয়ে উঠলো। গাইতে লাগলো,
‘ প্রাণ চায় চক্ষু না চায়..’
‘ আচ্ছা তোর কি সত্যি মনে হয় না? জাম্বুবান আমাকে পড়ালে এবারের সেমিস্টারে পাস করার বদলে আমি ফেইল করবো! আমি ওনাকে এতোবার করে বোঝালাম, যে বাসায় তার কাছে আমি পড়বো না! কে শোনে কার কথা?’
গানের মাঝে বিঘ্ন ঘটায় জারা থামলো। এই একই কথা কম করে হলেও কয়েকশো বার বলেছে আরশি। তবুও কিছুক্ষণ পরপর তোতাপাখির মতো একই বুলি আওড়াচ্ছে। শেষমেশ জারা দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ আমার মনে হয়, তুই অন্য কোনো কারণে প্রফেসরের কাছে টিউশন পড়তে চাইছিস না! নে! এবার কারণটা ফটাফট বলে ফেল! কী কারণে তুই তোর অমন হ্যান্ডসাম প্রফেসর বরকে রিজেক্ট করে দিতে চাইছিস?’
আরশি এবার ঋজু হয়ে উঠে বসলো। দু’হাতে টেবিলে রেখে দৃষ্টি ফেললো কোলের ওপর। তারপর আফসোস আর অনুতাপ মেশানো বিমর্ষ স্বরে বলে উঠলো,
‘ এমনিতেই ক্লাসে সবাই ওনার বউ বলে বাঁকা চোখে আমাকে দেখে! ভাবে আমি ওনার থেকে এক্সট্রা হেল্প নেই! কিন্তু সত্যি কথা বলতে আমি তো পড়তেই বসি না বাসায়! হেল্প কখন নেবো? এবার যদি বাসায়ও ওনার কাছে আমি পড়া শুরু করি, তাহলে…
‘ তাহলে তোরা পড়া বাদ রোমান্স করা শুরু করে দিবি! তাই তো? বুঝি বুঝি! এই বিবাহিতদের এই একটাই সমস্যা! এরা রোমান্স ছাড়া আর কিছু বোঝেনা! আরশি জান! আমি তোর সাথে একমত! তোর প্রফেসরের কাছে পড়তে না চাওয়ার কথায় অবশ্যই যুক্তি আছে! আই এগরি উইদ ইউ!’
‘ আজ্ঞে না! উনি পড়াতে বসলেই আমি হেসে ফেলবো! আর নয়তো তাকিয়ে থাকবো ওনার দিকে! কি বিচ্ছিরি একটা ব্যাপার হবে ভাবতে পারছিস?’
জারা ঠোঁট টিপে হেসে ফেললো আরশির কথায়। মেয়ে যে তাকে নিয়ে ঠাট্টা করছে সেটা বুঝতে পেরেই আরশি ফের একবার প্রলম্বিত শ্বাস ফেললো। তারপর জারার দিকে ক্লান্ত চোখে সোজাসুজি তাকিয়ে ভণিতাহীন ভাবে শুধালো,
‘ আচ্ছা ধর! আয়ান ভাই তোকে পড়াতে চাইলো! তাহলে তুই কীভাবে রিয়েক্ট করতি? এই যে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছিস! তুই পারবি? না হেসে আয়ান ভাইয়ের সামনে বসে চুপচাপ পড়া বুঝতে?’
জারা মিনিটখানেক চুপ থেকে আকাশ-পাতাল এক করে কিছু একটা ভাবলো। তারপর আরশিকে একটুখানি হাসানোর অভিপ্রায়ে গলা পরিষ্কার করে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
‘ শোন! বরের কাছে টিউশন নেয়ার মতো থ্রিলিং ব্যাপার আর একটাও নেই। ওখানে পড়া হয় কম, আর প্রেম হয় বেশি। আর যেখানে প্রেম বেশি সেখানে হাসার প্রশ্নই আসে না! তুইও হাসবি না। শোন তোকে আইডিয়া দেই, প্রফেসর পড়াতে বসলেই তুই নাকের পানি চোখের পানি এক করে বলবি, উফ! এতো কেউ পড়ে? তার চেয়ে চলুন আমরা পড়া বাদ দিয়ে কাজের কাজ করি! জারার না অনেকদিন ধরে খালামনি হওয়ার প্রচন্ড শখ। চলুন! ওর খালামনি হওয়ার শখটা পূরণ করে দেই?’
আরশি ঠান্ডা হওয়া কফির কাপে চুমুক বসিয়েছিল মাত্র। কিন্তু জারার কথাবার্তা শুনে সেই কফি গলা অবধি না গিয়ে সোজা উঠে গেলো মস্তকে। প্রচন্ড এক বিষম খেয়ে কাশতে কাশতে সত্যি সত্যি চোখে নাকের পানি চোখের পানি এক হলো আরশির। জারা তড়িঘড়ি তার মাথায় চাপড় দিতে দিতে বললো,
‘ দেখেছিস! আমি মিথ্যে বলিনি। এইজন্যই তো প্রফেসরের নাম নিতে না নিতেই একেবারে বিষম খেয়ে বসলি! তোদের দেখলে না আমার খালি শাহরুখ খান আর কাজলের কথা মনে হয়! মানে দু’জনই দু’জনকে মনে মনে চাইছিস অথচ তোদের কাছাকাছি আসার একটা আইডিয়া দিতেই তুই বিষম খাচ্ছিস। এভাবে চললে আমি খালামনি হতে পারবো? তোদের উচিত আমার আর বানর মশাইয়ের কাছ থেকে কিছু টিপস নেয়া। তাহলে তোদের লাভ লাইফটা যদি একটু হাঁটু তুলে দাঁড়ায়!’
আরশি কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বিড়বিড় করে বললো,
‘ আমরা কাজল আর শাহরুখ হলে তোরা কী? সাইফ আলী আর প্রিতি জিন্তা?’
জারা ঘাড়ের পিছনের চুলগুলো হাত দিয়ে হাওয়ায় উড়ালো। আননে ছদ্ম অহং মেখে আওড়ালো,
‘ হতেও পারে। আমি প্রিতি জিন্তার চাইতে কম সুন্দর নাকি? টিচার না হয়ে নায়িকা হলে খুব একটা খারাপ হতো না বল! আফসোস! ’
জারার এমন অভিনয়ে হেসে ফেললো আরশি। ম্লান মুখখানা মুক্তোর দানার মতো ঝলমলিয়ে উঠলো সেই হাসিতে। ঠান্ডা কফির কাপদুটো খালি হলো! দুই বান্ধবী গল্পের ঝুলি খুলে বসতেই সেমিস্টার ফাইনালের পড়া, জারার চাকরি, স্মোবলের বিয়ে দেয়া সহ আরো কত কী উঠে এলো তাদের আলাপে। তক্ষুনি আরশির মন পড়লো অন্য একটা কথা! সব আলাপ বাদ দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ তুই আর আয়ানভাই বিয়ে করছিস কবে? আমরা এ বছর কোনো দাওয়াত পাচ্ছি কি পাচ্ছি না? আমার ভাইটাকে আর কত অপেক্ষা করাবি শুনি?’
ক্লাসি ববকাট চুলের আড়ালে বিষন্ন হয়ে যাওয়া মুখটা চোখে পড়লো না আরশির। সে শুধু দেখলো বিয়ের কথা শোনা মাত্রই ছদ্ম লাজুক হাসতে থাকা রমনীকে। যার দুঃখগুলো বোধহয় একান্তই তার নিজের। জারা নিজের সেই দুঃখটুকু গিলে বলে উঠলো,
‘ এই তো, এই মাসেই। দিদুমণিকেও এখানে চলে আসতে বলেছি। বাবা-মা তো নেই! উনি চলে আসলেই আঙ্কেল আন্টিকে জানিয়ে আসবো বিয়ের ডেট টা৷’
আরশি দুষ্টুমি করে বললো,
‘এই যে, ম্যাডাম! ব্রাইডমেইড হিসেবে কিন্তু আমি সবার আগে দাওয়াত টা পাই ঠিকাছে?’
একটা মা-বাবা হারা মেয়ে সেই বিষন্নতা ভুলে ক্ষণিকের জন্য হাসলো। কিন্তু সময় গড়াতে না গড়াতেই ওদের এই আলাপের ছন্দপাত ঘটলো জারার ফোন বেজে ওঠায়। স্কুল থেকে কল করেছে জারারই এক কলিগ টিচার৷ হয়তো তার বদলে ক্লাস নিতে বলবেন! জারা প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে ফোন তুললো। মিনিটখানেকের ফোনালাপ সেরে যন্ত্রখানা টেবিলের উপর রাখতেই দেখলো আরশি খুব গভীর মনোযোগ সহকারে তার ফোনের ওয়ালপেপারের উপর ঝুঁকে আছে! তাকিয়ে দেখছে কিছু একটা! তারপরই সন্দিগ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
‘ ওয়ালপেপারে এই বাচ্চার ছবিটা…’
আরশি পুরো কথা শেষ করার আগেই জারা স্মিত হেসে জানালো,
‘ আমার ছোটবেলার ছবি। হারিয়ে যাওয়ার পর যখন দিদুমণি আমাকে খুঁজে পেলো, তার পরের ছবি এটা। উনি আমাকে কোলে নিয়ে তুলেছিলেন। আর পিছনে যারা দাঁড়িয়ে আছে তারা আশ্রমের অন্যসব দাদা-দাদী। গাজীপুর বৃদ্ধাশ্রম! আমার ছেলেবেলার এক টুকরো স্মৃতি এটা!’
জারা কথাগুলো শুনে কপালে ভাঁজ পড়লো আরশির। কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করলো সে! ছবির এই বাচ্চাটাকে আগেও কোথাও একটা নিশ্চয়ই দেখেছে, কিন্তু কোথায়? মনে পড়ছে না কেনো? আদৌ দেখেছে, নাকি সবটাই মনের ভুল? জারার ছোটবেলার ছবি সে কী করে দেখবে?
আর ঠিক সেই সময় ওদের টেবিলের সামনে সিন্দাবাদের ভূতের মতো এসে হাজির হলো এক শ্যাম পুরুষ। কোঁকড়ানো চুল আর স্বল্প বিস্তর হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে আরশির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো মানুষটা। উচ্ছ্বসিত স্বরে অনেকদিনের পরিচিত বন্ধুর মতো বলে উঠলো,
‘ আরশি! ভালো আছো? তোমাকে মিস করছিলাম খুব!’
আরশির বিস্তর ভাবনার সুতো ছিঁড়তেই যেনো হুট করে আবির্ভাব এই বান্দার! তাকে দেখে উল্টে মেজাজ খারাপ হলো আরশির। তবুও সৌজন্যতার ছদ্ম হাসি মুখে ঝুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। চিনতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কিন্তু আপনাকে তো ঠিক…?’
আগন্তুক স্বল্প বিস্তর হেসে আরশিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘ আমি রেজা! তোমাকে নোটস দিয়েছিলাম! মনে আছে? তারপর হয়তো খুব কমই দেখা হয়েছে আমাদের! তবুও আমি তোমাকে ভুলিনি। অথচ আফসোস! তুমি কিন্তু আমাকে সেই ভুলেই গেলে!
‘নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৪৮
এবার আর খোঁজ খবর নেয়ার বিষয়টুকু নিঃসঙ্কোচে এড়িয়ে যেতে পারলো না আরশি। অপ্রস্তুত হেসে ক্লাসমেট হিসেবে যতটুকু খোঁজ খবর নেয়া দরকার ততটুকুই নিলো। তবে সেখানেও বাঁধল আরেক বিপত্তি। কথার মাঝখানেই রেজার পিছনে এসে মূর্তমান হয়ে দাঁড়ালো একখানা থমথমে মুখ। নীল গহ্বররে বিশদ অন্ধকার নামিয়ে পিছন থেকেই রেজাকে জিজ্ঞেস করে বসলো,
‘ ইজ ইট ফান টকিং টু মাই ওয়াইফ, মিস্টার?’